পানিহাটি শ্রীনিত্যানন্দ প্রভাবে আনন্দময়। গৃহে-গৃহে শ্রীহরি সংকীর্ত্তন মহোৎসব। শ্রীরঘুনাথ দাস পানিহাটিতে এসে পরম সুখী হলেন। ক্রমে তিনি গঙ্গাতটে যেখানে ভক্ত সঙ্গে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসে আছেন সে স্থানে উপস্থিত হলেন। দূর থেকে শ্রীরঘুনাথ দেখলেন, গঙ্গাতট আলোকিত করে একটা বৃক্ষমূলে ভক্তগণ সঙ্গে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসে আছেন। শ্রীরঘুনাথ দেখেই দূর থেকে সাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন।
শ্রীহিরণ্য-গোবর্দ্ধন প্রসিদ্ধ জমিদার। সর্ব্বত্র তাঁদের খ্যাতি। তাঁরা ব্রাহ্মণ- বৈষ্ণবের সেবা-পরায়ণ। শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য ও শ্রীজগন্নাথ মিশ্র প্রভৃতি নবদ্বীপ শান্তিপুরাদি নিবাসী পণ্ডিতগণেকে বহু অর্থ-কড়ি দানাদি করে সাহায্য করেন। তাঁদের পুত্র শ্রীরঘুনাথ দাস এসেছেন সর্ব্বত্র সাড়া পড়ে গেল। শ্রীরঘুনাথ দাসের কথা ভক্তগণ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীচরণে নিবেদন করলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু রঘুনাথ দাসের নাম শুনেই বললেন – রে রে চোরা ! আয়, তোকে আজ দণ্ড দিব। ভক্তগণ শ্রীরঘুনাথ দাসকে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীচরণে নিয়ে এলেন। শ্রীচরণ মূলে রঘুনাথ দাস লুটিয়ে পড়লেন। করুণাময় নিত্যানন্দ অভয় চরণ তাঁর শিরে ধারণ করলেন, শ্রীরঘুনাথের সেই শ্রীচরণ-স্পর্শ মাত্র যেন সব বন্ধন কেটে গেল। সহাস্য বদনে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বলতে লাগলেন তুমি আমার ভক্তগণকে চিড়া-দধি ভোজন করাও। এ তোমার দণ্ড। এ কথা শুনে শ্রীরঘুনাথের আনন্দের সীমা রইল না। তখনই দই-চিড়া মহোৎসবের আয়োজন আরম্ভ হল। চারিদিকে লোক প্রেরণ করে দই-চিড়া আনতে লাগলেন। উৎসবের নাম শুনে পসারিগণ দই চিড়া পাকা কলাদি নিয়ে পসার বসাল। শ্রীরঘুনাথ দাস মুল্য দিয়ে সমস্ত দ্রব্য খরিদপূর্ব্বক নিতে লাগলেন। এদিকে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে ভক্তগণ সজ্জন ব্রাহ্মণগণ আসতে লাগলেন। বড় বড় মৃৎকুত্তিকার মধ্যে পাঁচ-সাত জন ব্রাহ্মণ চিড়া ভিজাতে লাগলেন। একজন ভক্ত শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্য চিড়া ভিজাতে লাগলেন। অৰ্দ্ধেক চিড়া দই কলা দিয়ে, আর অৰ্দ্ধেক ঘন দুধ, চিনি চাঁপা কলা দিয়ে মাখতে লাগলেন। অনন্তর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বৃক্ষমূলে পিণ্ডার উপর উপবেশন করলেন। তখন তাঁর সামনে চিড়া-দইপূর্ণ সাতটী মৃৎকুণ্ডিকা রাখা হল। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর চারি পার্শ্বে রামদাস, সুন্দরানন্দ দাস, গদাধর, শ্রীমুরারি, কমলাকর, শ্রীপুরন্দর, ধনঞ্জয়, শ্রীজগদীশ, শ্রীপরমেশ্বর দাস, মহেশ পণ্ডিত, শ্রীগৌরীদাস, হোড়কৃষ্ণ দাস, ও উদ্ধারণ দত্ত ঠাকুর প্রভৃতি ভক্তগণ উপবেশন করলেন। নীচে বসলেন অভ্যাগত পণ্ডিত ভট্টাচাৰ্য্যগণ। গঙ্গাতটে স্থান না পেয়ে কেহ কেহ গঙ্গায় নেমে চিড়া-দই নিচ্ছেন। সে দিন শ্রীরাঘব পণ্ডিতের ঘরে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর আমন্ত্রণ ছিল। বিলম্ব দেখে শ্রীরাঘব পণ্ডিত স্বয়ং এলেন। দেখলেন—বিরাট মহোৎসবের ঘটা, ঠিক যেন সখাগণ সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বন্য-ভোজন লীলা। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বললেন—রাঘব ! তোমার ঘরের প্রসাদ রাত্রে গ্রহণ করব। এখন রঘুনাথ দাসের উৎসব হউক। তুমিও বস। এ বলে তাঁকে নিকটে বসালেন এবং দই চিড়া ও দুধ-চিড়াপূর্ণ দুটা মৃৎকুণ্ডিকা এনে দিলেন। সকলের চিড়া দেওয়া শেষ হলে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু মহাপ্রভুর ধ্যানে বসলেন। অন্তর্যামী শ্রীগৌরসুন্দর তাঁর ধ্যানে জানতে পেরে তথায় এলেন।
“মহাপ্রভু আইল দেখি নিতাই উঠিলা। তাঁরে লঞা সবার চিড়া দেখিতে লাগিলা।।” (চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ)
শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু হাস্য করতে করতে সবাকার হোলনা থেকে এক এক গ্রাস নিয়ে মহাপ্রভুর মুখে দিতে লাগলেন। এ রূপ লীলাপূৰ্ব্বক শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কিছুক্ষণ ভ্রমণ করতে লাগলেন। তারপর নিজ আসনে তিনি বসলেন ও ভক্তগণকে ভোজন করতে আদেশ দিলেন। মহা ‘হরি’ ‘হরি’ ধ্বনিতে ভক্তগণ দশদিক মুখরিত করতে লাগলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু ভোজন করছেন না দেখে কেহই ভোজন করছেন না। ভক্তগণ অগ্রে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে ভোজন করবার প্রার্থনা জানালেন, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু ভোজন আরম্ভ করলেন। সমস্ত ভক্তগণ আনন্দভরে ভোজন করতে লাগলেন। সকলের পুলিন ভোজনের কথা মনে হতে লাগল। ভোজন শেষ হলে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু শ্রীরঘুনাথ দাসকে ডেকে অবশেষ প্রদান করলেন। এবার শ্রীরঘুনাথ দাস শ্রীনিত্যানন্দ কৃপা-প্রসাদে শ্রীগৌরসুন্দরের কৃপা পাবেন এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন। তারপর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তাঁর শিরে হাত দিয়ে আশীর্ব্বাদ করলেন— “অচিরাৎ প্রভু তোমাকে কৃপা করবেন।”