শ্রীশ্রীগঙ্গা দশহরা (শ্রীশ্রীগঙ্গাপূজা) গঙ্গাদেবীর ভূতলে অবতরণ

শ্রীশ্রীগঙ্গা দশহরা (শ্রীশ্রীগঙ্গাপূজা)
গঙ্গাদেবীর ভূতলে অবতরণ
শ্রীগঙ্গামাতা গোস্বামিনীর আবির্ভাব
শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রভুর তিরোভাব তিথি
৫ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার
মহাভারত বর্ণনা করে যে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল, যাতে দেবগণ বিজয়ী হয়েছিলেন। অসুররা সমুদ্রে লুকিয়ে ছিল এবং দেবতারা তাদের খুঁজে পাননি। তারা ঋষি অগস্ত্যকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেছিল এবং ঋষি, তার দৈব শক্তি ব্যবহার করে, সমুদ্র পান করেছিলেন। দেবতারা অবশিষ্ট রাক্ষসদের পরাজিত করেন এবং অগস্ত্যকে জল ফিরিয়ে আনতে বলেন। ঋষি উত্তর দিলেন যে তিনি জল হজম করেছেন এবং এটি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন না। বিশ্ব চিন্তিত ছিল কিন্তু ভগবান বিষ্ণু আশ্বস্ত করেছিলেন যে শীঘ্রই সমুদ্র পূর্ণ হবে।
কয়েক বছর পরে, সাগর নামে এক রাজা জাদুকরীভাবে ষাট হাজার পুত্র লাভ করেন। একদিন, রাজা সাগর রাজ্যের মঙ্গলের জন্য একটি পূজার অনুষ্ঠান করলেন। আচারের অবিচ্ছেদ্য অংশগুলির মধ্যে একটি ছিল একটি ঘোড়া, যা ঈর্ষান্বিত ইন্দ্র চুরি করেছিল। ঘোড়ার সন্ধানে সাগর তার সমস্ত পুত্রকে পৃথিবীতে পাঠালেন। তারা এটিকে ভগবান ইন্দ্র (স্বর্গের রাজা) দ্বারা বাঁধা ধ্যানরত ঋষি কপিলের পাশে (পাতাল) পেয়েছিলেন। ঋষি ঘোড়াটি চুরি করেছে বলে বিশ্বাস করে, তারা তাকে অপমান করে এবং তার তপস্যাকে ব্যাহত করে। ঋষি কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম চোখ খুলে সাগরের ছেলেদের দিকে তাকালেন। এই দৃষ্টিতে ষাট হাজারের সবাই পুড়ে মারা গেল।
শেষকৃত্য সম্পন্ন না হওয়ায় সাগরের পুত্রদের আত্মারা ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াত। সাগরের সমস্ত পুত্রের মোক্ষের জন্য, আংশুমান (ওই 60,000 পুত্রের কাকা) তার জীবনের শেষ অবধি গঙ্গাকে পৃথিবীতে আনার জন্য ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করেছিলেন কিন্তু সফল হননি। এরপর তার ছেলে দিলীপও একই কাজ করলেও সফল হননি। যখন ভগীরথ (অর্থাৎ, যিনি মহান কঠোর পরিশ্রম করেন- তিনি গঙ্গাকে পৃথিবীতে আনার জন্য তাঁর দুর্দান্ত পরিশ্রম থেকে এই নামটি পেয়েছেন), দিলীপের পুত্র সাগরের বংশধরদের মধ্যে একজন এই ভাগ্যের কথা জানতে পারলেন, তিনি গঙ্গাকে নামিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। পৃথিবীতে যাতে তার জল তাদের আত্মাকে পরিষ্কার করতে পারে এবং তাদের স্বর্গে ছেড়ে দিতে পারে।
ভগীরথ ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যে গঙ্গা পৃথিবীতে নেমে আসে। ব্রহ্মা রাজি হলেন এবং তিনি গঙ্গাকে পৃথিবীতে এবং তারপরে নীচের অঞ্চলে যাওয়ার আদেশ দিলেন যাতে ভগীরথের পূর্বপুরুষদের আত্মা স্বর্গে যেতে সক্ষম হয়। গঙ্গা অনুভব করেছিলেন যে এটি অপমানজনক ছিল এবং তিনি স্বর্গ থেকে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পুরো পৃথিবীকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শঙ্কিত হয়ে ভগীরথ শিবের কাছে প্রার্থনা করেন যে তিনি গঙ্গার অবতরণ ভেঙে দেন।
গঙ্গা অহংকারে শিবের মাথায় পড়ল। কিন্তু শিব শান্তভাবে তাকে তার চুলে আটকে রেখে ছোট স্রোতে বের করে দেন। শিবের স্পর্শ গঙ্গাকে আরও পবিত্র করেছিল। গঙ্গা যখন উত্তর-বিশ্বে ভ্রমণ করেছিলেন, তিনি সেখানে দুর্ভাগা আত্মাদের শুদ্ধ করতে সাহায্য করার জন্য পৃথিবীতে থাকার জন্য একটি ভিন্ন স্রোত তৈরি করেছিলেন। স্বর্গ (স্বর্গ), পৃথ্বী (পৃথিবী) এবং পাতালা (নরক বা নরক ) – তিনটি জগতের থেকে তিনিই একমাত্র নদী যিনি অনুসরণ করেন। একে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় ত্রিপথগা ( তিন বিশ্ব ভ্রমণকারী )।
ভগীরথের প্রচেষ্টার কারণে, গঙ্গা পৃথিবীতে নেমে এসেছিল এবং তাই নদীটি ভাগীরথী নামেও পরিচিত ।
গঙ্গার আরেকটি নাম যা জাহ্নবী নামে পরিচিত, গল্পে আছে যে একবার গঙ্গা পৃথিবীতে নেমে আসে, ভগীরথের পথে, তার দ্রুত জলরাশি অশান্তি সৃষ্টি করে এবং জাহ্নু নামক এক ঋষির ক্ষেত্র এবং সাধনা ধ্বংস করে। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে গঙ্গার সমস্ত জল পান করেন। এর পরে, দেবতারা জহ্নুর কাছে গঙ্গাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন যাতে তিনি তার মিশনে এগিয়ে যেতে পারেন। তাদের প্রার্থনায় খুশি হয়ে জাহ্নু তার কান থেকে গঙ্গা (তার জল) ছেড়ে দেন। তাই গঙ্গার নাম জাহ্নবী (জাহ্নুর কন্যা)।
গঙ্গা হিন্দু উপাসনা ও সংস্কৃতির মাতা, গঙ্গা মাতা (মাতা=”মা”), সকলকে গ্রহণ করে এবং সকলকে ক্ষমা করে। অন্যান্য দেবীর মতন, তার কোন ধ্বংসাত্মক বা ভয়ঙ্কর দিক নেই, ধ্বংসাত্মক যদিও সে প্রকৃতির নদী হিসাবে হতে পারে। তিনি অন্যান্য দেবতাদেরও মা।
কখনও কখনও এটি বিশ্বাস করা হয় যে কলিযুগের শেষের দিকে নদীটি শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে যাবে, এবং এই যুগ শেষ হবে, পরবর্তীতে (চক্রীয়) ক্রম হবে সত্যযুগ বা সত্যের যুগ।
[[[[শ্রীগঙ্গামাতা গোস্বামিনী—————–
বর্তমান বাংলা দেশের রাজসাহী জেলার অন্তর্গত পুটিয়ার রাজা ছিলেন শ্রীযুত নরেশনারায়ণ। তাঁর শটী নাম্নী একমাত্র কন্যা ছিল। শচী শিশুকাল থেকে ভগবদ্ভক্তি পরায়ণা।শচী অল্পকাল মধ্যে ব্যাকরণ কাব্য প্রভৃতি শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন হন। শচীর বয়স হলে তার নব যৌবন সকলকে মুগ্ধ করতে লাগলেন। কিন্তু শচীর মন জগতের কোন সৌন্দর্য্যশালী কিম্বা ঐশ্বর্যশালী পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হল না। তাঁর মন পড়ে রইল শ্রীমদন গোপালের উপর।
শ্রীযুক্ত নরেশনারায়ণ কন্যার বিবাহের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শ্রী শচী তা জানতে পেরে বললেন— তিনি কোন মর্ত্ত্য মরণশীল পুরুষকে বিবাহ করবেন না। রাজা রাণী শিরে হাত দিয়ে বসলেন। একমাত্র কন্যা বিবাহ করতে চায় না। এ সব চিন্তা করতে করতে রাজা ও রাণী স্বধাম প্রাপ্ত হলেন। রাজ্যভার পড়ল শ্রীশচীর উপর। তিনি কিছু দিন রাজকার্যা দেখাশুনা করবার পর স্বজন প্রতিনিধিগণের উপর ভার দিয়ে তীর্থ পর্যটনে বের হলেন। কোথায়ও চিত্তের সন্তোষ উৎপাদন হল না। সদ্গুরুর অনুসন্ধান করতে লাগলেন। পুরী ধামে এলেন। কয়েক দিন দর্শনাদি করবার পর, কোন এক প্রেরণায় শ্রীব্রজধামে এলেন। এইবার শ্রীশচীর সৌভাগ্য-শশী উদিত হল। তথায় শ্রীগৌর নিত্যানন্দের একান্ত অনুরক্ত শ্রীহরিদাস পণ্ডিত গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার হল। তাঁর দিব্য তেজ এবং বৈরাগ্য মূর্ত্তি দর্শন করে শ্রীশচী পরম আনন্দিত হলেন, মনে মনে চিন্তা করলেন বহু দিন পরে তিনি যেন আশ্রয় পেয়েছেন।
শ্রীশচী হরিদাস পণ্ডিত গোস্বামীর শ্রীচরণে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন ও প্রেমাশ্রুপূর্ণ নয়নে করজোড়ে তাঁর কৃপা প্রার্থনা করলেন।
পণ্ডিত গোসাঞির শিষ্য অনন্ত আচার্য্য।
কৃষ্ণপ্রেমময় তনু উদার সৰ্ব্ব আৰ্য ।।
তাঁর অনন্ত গুণ কে করু প্রকাশ।
তাঁর প্রিয় শিষ্য ইহা পণ্ডিত হরিদাস।।
(চৈঃ চঃ আদিলীলা)
শ্রীগদাধর পণ্ডিত গোস্বামীর শিষ্য শ্রীঅনন্ত আচার্য্য। তিনি সর্ব্বদা কৃষ্ণপ্রেমে বিহ্বল হয়ে থাকতেন। তাঁর প্রিয় শিষ্য ছিলেন শ্রীহরিদাস পণ্ডিত গোস্বামী।
শ্রীহরিদাস পণ্ডিত গোস্বামী শ্রীশচীকে পরীক্ষা করবার জন্য বললেন— রাজকন্যার পক্ষে ব্রজে থেকে নিষ্কিঞ্চন ভাবে ভজন করা সম্ভবপর নয়। গৃহে থেকে ভজন করা তোমার পক্ষে ভাল হবে। শ্রীশচীদেবী বুঝতে পারলেন এ সব কথা ছল করে বলা হল। শ্রীশচী সে কথায় কান দিলেন না। তীব্র বৈরাগের সহিত সেবা করতে লাগলেন। ক্রমে ক্রমে তিনি উত্তম বস্ত্রাদি পরিধান করা কিম্বা অলঙ্কারাদি ব্যবহার করা একবারেই বর্জ্জন করলেন।
একদিন শ্রীহরিদাস পণ্ডিত গোস্বামী শ্রীশচীকে বললেন— যদি লজ্জা, মান ও ভয় ত্যাগ করে ব্রজে মাধুকরী করতে পার তবে কৃপা পেতে পার। শ্রীশচী গুরুবাক্য শ্রবণ করে অতি আনন্দিত হলেন। তখন হতে অভিমান শূন্য হয়ে সামান্য একখানা মলিন বস্ত্রে গাত্র আবৃত করে ব্রজবাসিগণের গৃহে গৃহে মাধুকরী করতে লাগলেন। ব্রজবাসিগণ তাঁর তাঙ্গের দিব্য তেজ দেখে বুঝতে পারতেন তিনি অসাধারণ স্ত্রীলোক। তাঁর তীব্র বৈরাগ্যে বৈষ্ণবগণ চমৎকৃত হলেন।
শ্রীশচীর অঙ্গখানি অতিশয় ক্ষীণ ও মলিন হয়ে পড়ল। তাতে তিনি ভ্রূক্ষেপ না করে নিয়মিত যমুনা স্নান, মন্দির মার্জন, পরিক্রমা, আরাত্রিক দর্শন ও কথা শ্রবণাদি করতে লাগলেন। শ্রীশচীর তীব্র বৈরাগ্য দেখে শ্রীহরিদাস পণ্ডিত গোস্বামীর মনে কৃপার উদ্রেক হল। তিনি শ্রীশচীকে ডেকে হাস্য করতে করতে বললেন—তুমি রাজকুমারী হয়েও শ্রীকৃষ্ণভজন প্রয়াসে যে এত ত্যাগ ও বৈরাগ্য দেখিয়েছ তাতে আমি পরম সুখী হয়েছি। তুমি শীঘ্র মন্ত্র গ্রহণ কর।
অনন্তর শ্রীশচী চৈত্রী শুক্ল-ত্রয়োদশীর দিন শ্রীহরিদাস পণ্ডিত গোস্বামীর থেকে রাধাকৃষ্ণ মন্ত্র দীক্ষা গ্রহণ করলেন। শ্রীশচী অষ্টাদশাক্ষর মন্ত্র পেয়ে শ্রীকৃষ্ণপ্রেমময়ী হলেন। তিনি অতি দীনহীন ভাবে শ্রীগুরু গোবিন্দের সেবা করতে লাগলেন এবং প্রতিদিন পণ্ডিত গোস্বামীর নিকট গোস্বামী শাস্ত্রাদি শ্রবণ করতে লাগলেন। অল্পকালেই শ্রীশচী গোস্বামী সিদ্ধান্তে পারঙ্গত দেখে সকলে পরম সুখী হলেন।
শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়া নাম্নী শ্রীহরিদাস পণ্ডিত গোস্বামীর একজন পরম স্নিগ্ধা শিষ্যা এ সময় বৃন্দাবনে এলেন। লক্ষ্মীপ্রিয়া প্রত্যহ তিন লক্ষ হরিনাম করতেন। পণ্ডিত গোস্বামী তাঁকে আদেশ করলেন তিনি যেন শচীকে নিয়ে শ্রীরাধাকুন্ডে ভজন করেন। শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়া শ্রীগুরুদেবের বাণী শিরে ধারণ করে শ্রীশচীসহ রাধাকুণ্ডে এলেন ও ভজন করতে লাগলেন। শ্রীশচী লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে প্রতিদিন গোবর্দ্ধন পরিক্রমা করতে লাগলেন। শ্রীশচী এভাবে রাধাকুণ্ডে তীব্র ভজন করতে থাকলে শ্রীহরিদাস পণ্ডিত গোস্বামী তাঁকে ডেকে আদেশ করলেন— তুমি শীঘ্র পুরী ধামে গিয়ে ভজন কর এবং শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দরের বাণী শ্রদ্ধালু জনের মধ্যে প্রচার কর। তথাকার গৌর-পার্ষদ গণ প্রায় অপ্রকট লীলা করেছেন। শ্রীশচী বৃন্দাবন থেকে ক্ষেত্র গ্রামে এলেন এবং গুরুদেবের নির্দেশ অনুযায়ী সার্ব্বভৌম পণ্ডিতের গৃহে থেকে ভজন করতে লাগলেন এবং শ্রদ্ধালুজনের নিকট শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করতে লাগলেন। সারাভৌম পণ্ডিতের গৃহটি বহুদিন লোকজন না থাকায় জীর্ণ শীর্ণ হয়েছিল, তথায় কেবল মাত্র সমসতি শ্রীদামোদর শালগ্রাম বিরাজ করছিলেন। শ্রীশচী তথায় অবস্থান পূর্ণাঁক নিয়মিত ভজন করতে লাগলেন। শ্রীশচীদেবীর অপূর্ব ভাগবত সিদ্ধান্ত করবার জন্য শ্রদ্ধা সজ্জন দিনের পর দিন তাঁর স্থানে আসতে লাগলো। অল্পকালের মধ্যে প্রসিদ্ধ ভাগবত বক্তা হিসাবে তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
পুরীর রাজা শ্রীমুকুন্দদেব একদিন শ্রীশচীদেবীর স্থানে ভাগবত শুনতে এলেন। তাঁর অপূর্ব সিদ্ধান্ত শুনে বড়ই আকৃষ্ট হলেন। মনে মনে তাকে কিছু অর্পণ করতে ইচ্ছা করলেন। ঠিক সেই দিবসের রাত্রে স্বপ্নে দেখতে লাগলেন— “শ্রীজগন্নাথ বলছেন শচীকে শ্বেত গঙ্গার নিকটবর্তী স্থানটি অর্পণ কর।” পরদিন প্রাতে রাজা মুকুন্দদেব শ্রীশচী দেবীর নিকট এলেন। অতি বিনীতভাবে রাজাকে বসবার আসন দিয়ে শ্রীশচী তাঁর আসবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। শ্রীমুকুন্দদেব শ্রীজগন্নাথদেবের আদেশের কথা জ্ঞাপন করে শ্বেত গঙ্গার নিকটবর্তী স্থানটি গ্রহণ করতে প্রার্থনা করলেন। শ্রীশচী বিষয় সম্পত্তি গ্রহণে অসম্মতা হলেন। রাজা বার বার বলতে লাগলেন। তখন শ্রীজগন্নাথের আদেশ জেনে রাজী হলেন। শ্রীমুকুন্দদেব শ্রীশচীর নামে শ্বেতগঙ্গার নিকটবর্ত্তী ভূসম্পত্তি দান পত্র করে দিলেন। শ্রীশচী যে একজন রাজকুমারী তা পূর্ব্বেই পুরীধামে প্রচারিত হয়েছিল।
একবার মহাবারুণী স্নানের যোগ উপস্থিত হলে শ্রীশচী গঙ্গা স্নানে যাবার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু শ্রীগুরুদেবের নির্দেশ শ্রীক্ষেত্রেই অবস্থান করা।শ্রীগুরুদেবের কথা স্মরণ করে তিনি গঙ্গা স্নানে যাবার ইচ্ছা ত্যাগ করলেন। সেই রাত্রে শ্রীজগন্নাথদেব শ্রীশচীকে স্বপ্নে বললেন- শচী কোন চিন্তা কর না। যে দিন বারুণী স্নান হবে, সে দিন তুমি শ্বেত গঙ্গায় স্নান কর। গঙ্গা দেবী তোমার সঙ্গ-প্রার্থিনী হয়ে শ্বেত গঙ্গায় আসবে। স্বপ্ন দর্শন করে শ্রীশচীদেবী বড় আনন্দিত হলেন। বারুণী স্নানের যোগ উপস্থিত হল। শ্রীশচী একাকী মধ্যরাত্রে শ্বেত গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন। তিনি যেমন শ্বেত গঙ্গায় নামলেন অমনি গঙ্গাদেবী মহাস্রোতে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চললেন। তিনি ভাসতে ভাসতে শ্রীজগন্নাথের মন্দিরের অভ্যন্তরে এসে উপস্থিত হলেন। তথায় দেখলেন ক্ষেত্রবাসী সহস্র সহস্র লোক সানন্দে স্নান করছেন। চতুর্দ্দিকে স্তব স্তুতি আনন্দ কোলাহল। তিনি সেই আনন্দ কোলাহলের মধ্যে আনন্দে স্নান করছেন।
এ কোলাহলে মন্দিরের দ্বার রক্ষকগণের নিদ্রা ভেঙ্গে গেল। তারা অবাক হয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলেন। শুনলেন ঐ মহাশব্দ মন্দিরের ভিতর থেকে আসছে। দ্বার-রক্ষকগণ তাড়াতাড়ি ঐ সংবাদ কাৰ্য্যাধ্যক্ষগণকে জানাল, তাঁরা এ সংবাদ রাজার নিকট উপস্থিত করলেন। রাজা মন্দির খুলে দেখতে আদেশ দিলেন। অতঃপর মন্দির খোলা হল। অদ্ভুত ব্যাপার, ভাগবত পাঠিকা শ্রীশচীদেবী একাকী দাঁড়িয়ে আছেন। জগন্নাথের সেবক পান্ডাগণ মনে করতে লাগলেন— তিনি জগন্নাথ দেবের অলঙ্কার পত্রাদি হরণ করবার জন্য অলক্ষ্যে প্রবেশ করেছেন। অনেকে বললেন তা হতে পারে না। নিশ্চয় কোন রহস্য আছে। অনন্তর শ্রীশচী দেবীকে বিচারাধীন করে বন্দীশালে রাখা হল। শ্রীশচীদেবী এতে মুহ্যমান হলেন না। তিনি সানন্দে কৃষ্ণনাম করতে লাগলেন। রাজা মুকুন্দদেব শেষ রাত্রে স্বপ্ন দেখছেন শ্রীজগন্নাথদেব রাগ করে বলছেন শচীকে এখনই বন্দীশালা হতে মুক্ত করে দে। আমি তাঁর স্নানার্থে নিজ চরণ থেকে গঙ্গা নিঃসৃত করে মন্দিরে আনিয়েছি। মঙ্গল যদি তুমি চাও পূজক পান্ডাগণসহ শচী-চরণে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁর থেকে মন্ত্র গ্রহণ কর। এ স্বপ্ন দেখে রাজা খুব সন্ত্রস্ত হলেন এবং প্রাতে শীঘ্র স্নানাদি সেরে পূজারী পান্ডাগণসহ যেখানে শ্রীশচীদেবীকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, সেখানে এলেন ও শীঘ্র তাঁকে মুক্ত করে তাঁর চরণে সাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন। রাজা বহু অনুনয়-বিনয় সহ শ্রীশচীদেবীর চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং জগন্নাথদেবের আদেশ জানিয়ে মন্ত্র প্রার্থনা করতে লাগলেন। শ্রীজগন্নাথদেবের এ লীলা দেখে শ্রীশচীদেবী প্রেমে ক্রন্দন করতে লাগলেন ও রাজাকে ভাগ্যবান্ বলে শিরে হস্ত দিয়ে আশীর্ব্বাদ করলেন। অতঃপর শ্রীশচীদেবী শ্রীজগন্নাথদেবের আদেশ জেনে এক শুভদিনে শ্রীমুকুন্দদেবকে রাধাকৃষ্ণ মন্ত্র দীক্ষা প্রদান করলেন। রাজার সঙ্গে বহু পূজারীও তাঁর চরণ আশ্রয় করলেন। সেই দিন থেকে শ্রীশচীর নাম হল শ্রীগঙ্গামাতা গোস্বামিনী।
মহারাজ শ্রীমুকুন্দদেব গুরু দক্ষিণা স্বরূপ কিছু ভূসম্পত্তি শ্রীগঙ্গা মাতাকে দিতে চাইলেন। তিনি রাজী হলেন না, বললেন তোমার শ্রীকৃষ্ণচরণে ভক্তি হউক এইমাত্র আমি চাই। অন্য কোন দক্ষিণা গ্রহণের অধিকারিণী আমি নহি। রাজা বারংবার শ্রীগঙ্গামাতার চরণে কাতর প্রার্থনা করতে লাগলেন। অবশেষে শ্রীগঙ্গামাতা বৈষ্ণর সেবার্থে দুই ভাণ্ড মহাপ্রসাদ, এক ভাণ্ড তরকারী, একখানি প্রসাদী বস্তু, দুই পণ কড়ি (১৬০ পয়সা) প্রত্যহ মধ্যাহ্ন ধূপের পর মঠে প্রেরণ করবার অনুমতি দিলেন। অদ্যাবধি সে মহাপ্রসাদ নিয়মিত শ্রীগঙ্গামাতা মঠে প্রেরিত হয় এবং উহা শ্রীগঙ্গামাতার সমাধি পীঠে অৰ্পণ করা হয়।
একবার মহীধর শর্মা নামক একজন স্মাৰ্ত্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শ্বেত গঙ্গার তীরে পিতৃ-পুরুষগণের তর্পণাদি করতে আসেন এবং শ্রীগঙ্গামাতা গোস্বামিনীর মহিমা শুনে তাঁর চরণ দর্শন করতে যান। শ্রীগঙ্গামাতা পণ্ডিতকে বহু সম্মান দিয়ে আসনে বসান এবং তাঁর অভিপ্রায় শুনতে চাইলেন। পণ্ডিত ব্রাহ্মণ সরলতার সহিত অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। তাঁর সরলতা দেখে শ্রীগঙ্গামাতা তাঁকে ভাগবত সিদ্ধান্ত শুনাতে লাগলেন। ব্রাহ্মণ সেই অপূৰ্ব্ব ভাগবত সিদ্ধান্ত সকল শ্রবণ করতে করতে একেবারেই মুগ্ধ হয়ে পড়লেন। পরে তিনি শ্রীগঙ্গামাতার চরণে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। শ্রীগঙ্গামাতা শুভদিনে তাঁকে রাধাকৃষ্ণ মন্ত্র দীক্ষা প্রদান করলেন। মহীধর শর্মার জন্মস্থান ধনঞ্জয়পুর। শ্রীগঙ্গামাতার আদেশে তিনি গঞ্জাম জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের নাম প্রেম প্রচার করতেন।]]]]

Hare Krishna

Related Article

BLOG

শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের ১১১ তম বিরহ তিথি পূজা

নমোভক্তিবিনোদায় সচ্চিদানন্দ নামিনে।গৌরশক্তি স্বরূপায় রূপানুগবরায়তে।।শ্রীশ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনেদ ঠাকুর মহাশয় শ্রীগৌর সুন্দরের নিজ জন ছিলেন। তিনি রূপানুগ ধারায় শ্রীগৌর সুন্দরের লুপ্ত প্রায় বাণী মর্ত্যলোকে পুনঃ প্রচার

Read More »
BLOG

শ্রীগদাধর পন্ডিত গোস্বামীর তিরোভাব তিথি

শ্রীগদাধর পন্ডিত শিশুকাল থেকেই মহাপ্রভুর সঙ্গী। শ্রীগদাধরের পিতার নাম শ্রীমাধব মিশ্র, মাতার নাম শ্রীরত্নাবতী দেবী। তিনি মায়াপুরে শ্রীজগন্নাথ মিশ্রের গৃহ সন্নিকটে থাকতেন। রত্নাবতী দেবী শচীদেবীকে

Read More »
BLOG

শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা মহোৎসব

শ্রীরথযাত্রা উৎসব শ্রীপুরুষোত্তম-ধামের সর্বপ্রধান উৎসব; ইহার অপর নাম—‘নবযাত্রা’, ‘গুণ্ডিচাযাত্রা’, ‘নন্দিঘোষ-যাত্রা’, ‘পতিতপাবন-যাত্রা’, বা ‘মহাবেদী-উৎসব’”। শ্রীজগন্নাথদেব মহারাজ শ্রীইন্দ্রদ্যুম্নকে বলিয়াছিলেন “আষাঢ়-মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে সুভদ্রার সহিত আমাকে ও

Read More »