মধ্যাহ্নে শ্রীশ্রীরাধাঠাকুরানীর শুভ জন্মাভিষেক
নন্দীশ্বর গিরির দক্ষিণে বরসানু নামে একটী ভূধররাজ বিরাজিত আছে। উক্ত বরসানু পর্ব্বতের অধিত্যকায় বৃষভানু নামে এক গোপরাজ বাস করিতেন। বৃষভানু সহধর্ম্মিনী কৃত্তিকার সহিত তথায় বাস করিয়া শ্রীহরির আরাধনা করিতেছিলেন। ভাদ্র মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে বিশাখা নক্ষত্রে মধ্যাহ্নকালে বৃষভানুরাজের গৃহে একটী কন্যারত্ব আবির্ভূত হইলেন; কন্যারত্নের আবির্ভাব সময়ে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম সময়ের ন্যায় চতুর্দিক সুপ্রসন্ন হইয়া উঠিল, সজ্জনগণের হৃদয়ে প্রচুর আনন্দের সঞ্চার হইতে থাকিল। বৃষভানুপুরে গোপরাজ বৃষভানু, রত্নভানু ও সুভানু ভ্রাতৃদ্বয়ের সহিত আনন্দে নৃত্য করিতে থাকিলেন। মহাভাগ্যবতী কৃত্তিকা চন্দ্রকলিকা কন্যারত্নের মুখকমল দর্শনে আনন্দে আত্মহারা হইলেন; সুরপুরে ও ব্রজপুরে বিপুল আনন্দোৎসব হইল। এই কন্যারত্নই জগতে ‘বৃষভানু-নন্দিনী রাধা’ নামে খ্যাতা হইলেন।
“তত আরভ্য নন্দসা ব্রজঃ সৰ্ব্বসমৃদ্ধিমান।
হরেনিবাসাত্মগুণৈ রমাক্রীড়মভূপ।।”
(ভাঃ ১০|৫|১৮)
—এই ভাগবতীয় শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় ব্রজরামাশিরোমণি শ্রীমতী বৃষভানুরাজকুমারী শ্রীরাধিকার প্রাকট্যমাত্র-জন্ম সুচিত হইয়াছে। শ্রীকৃষ্ণ ব্ৰজে নিত্য অবস্থান করেন। শ্রীকৃষ্ণের নিত্য-বিহার-ভূমি বলিয়া ব্রজ সদা সৰ্ব্বসমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ। কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব আরম্ভ করিয়া এই নন্দ-ব্রজ সর্ব্বলক্ষ্মীগণের অংশিনী ব্রজকিশোরিকা-শিরোরত্ন বৃষভানুরাজকুমারীর ক্রীড়াভূমি হইয়াছিল। ‘ব্রজভূমি শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবকাল হইতে শ্রীরাধিকা প্রমুখা ব্রজরামাগণের বিহারাস্পদ হইয়াছিল’—এই বাক্যে যে কেবল তখনই শ্রীরাধিকাপ্রমুখা ব্রজদেবীগণ তথায় বিহার করিতেছিলেন, তাহা নহে; শ্রীহরির নিবাস ভূমিস্বরূপ শ্রীনন্দগোকুলে শ্রীনন্দনন্দন যাবৎ নিগুঢ়ভাবে বিহার করেন, তাবৎ শ্রীরাধাপ্রমুখা ব্রজরামাগণও নিগূঢ়ভাবে বিহার করিয়া থাকেন। আর শ্রীনন্দকুমার যখন প্রকটরূপে বিহার করেন, তখন ব্রজরামা-শিরোমণি শ্রীরাধা তাঁহার কায়ব্যুহস্বরূপ গোপীগণের সহিত প্রকটরূপে বিহার করিয়া থাকেন; —ইহাই ‘তোষণী’ ও ‘সন্দর্ভ’ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন।
যেমন “যাঁহার শ্রীকৃষ্ণে নিষ্কামা সেবন-প্রবৃত্তি বিদ্যমানা, তাঁহাতে নিখিল দেবতা নিখিল সদ্গুণরাশির সহিত নিত্য বাস করেন”, তদ্রূপ যাঁহাতে প্রেম-বৈশিষ্ট্য আছে, ঐশ্বর্য্যাদিরূপা অন্য নিখিল শক্তি – অতিশয় আদৃতা না হইলেও তাঁহার অনুগমন করিয়া থাকে, এই জন্য শ্রীবৃন্দাবনে শ্রীমতী রাধিকাতেই স্বয়ংলক্ষ্মীত্ব। শ্রীমতী রাধিকা কৃষ্ণপ্রেমোৎকর্ষ পরাকাষ্ঠারূপিণী বলিয়া অন্য নিখিল শক্তি তাঁহার অনুগামিনী; তিনি সৰ্ব্বলক্ষ্মীময়ী—নিখিল শক্তিবর্গের অংশিনী। অতএব অন্যান্য প্রেয়সী বর্তমান থাকিলেও শ্রীমতী রাধিকার পরম-মুখ্যত্বাভিপ্রায়ে বৃন্দাবনাধিকারিণীরূপে তাঁহার নাম গ্রহণ করা হইয়াছে। পাদ্মে কাৰ্ত্তিকমাহাত্ম্যে শৌনক নারদ-সংবাদে এইরূপ উক্তি দৃষ্ট হয়,—
“বৃন্দাবনাধিপত্যঞ্চ দত্ত তস্মৈ প্রত্যূষ্যতা।
কৃষ্ণেনান্যত্র দেবী তু রাধা বৃন্দাবনে বনে।।”
শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতী রাধিকাকে বৃন্দাবনাধিপত্য প্রদান করিয়াছেন। প্রাকৃত বা সাধারণ দেশে দেবী তাহার অধিকারিণী, কিন্তু দেবীধামের পরপারে বিরজা, ব্রহ্মালোক, বৈকুণ্ঠ অতিক্রম করিয়া সর্ব্বোপরি যে বৃন্দাবন নামক অপ্রাকৃত কৃষ্ণবিহার-স্থল বিরাজিত, সেই বৃন্দাবন নামক বনে শ্রীরাধিকাই একমাত্র অধীশ্বরী। স্কন্দপুরাণ এবং মৎস্যপুরাণেও দৃষ্ট হয়,— “বারাণসীতে বিশালাক্ষী, পুরুষোত্তমে বিমলা, দ্বারাবতী তে রুক্মিণী এবং বৃন্দাবন-বনে রাধিকা।”—এই শ্লোক অবলম্বন করিয়া শ্রীল জীবগোস্বামিপাদ সন্দর্ভে এইরূপ বলিয়াছেন, —“শক্তিত্বমাত্র সাধারণ্যেনৈব লক্ষ্মীসীতারুক্মিণী-রাধানামপি দেব্যা সহ গণনম্। বৈশিষ্ট্যন্ত লক্ষ্মীবৎ সীতাদিস্বপি জ্ঞেয়ম্। তস্মান্ন দেব্যা সহ লক্ষ্ম্যাদীনামৈক্যম্। শ্রীরামতাপনী শ্রীগোপালতাপন্যাদৌ তাসাং স্বরূপভূতত্বেন কথনাৎ। শ্রীরাধিকায়াশ্চ যামলে পূর্ব্বোদাহৃতপদ্যত্রয়ানস্তরং, ‘ভুজদ্বয়যুতঃ কৃষ্ণো ন কদাচিচ্চতুর্ভুজঃ। গোপ্যৈকয়া যুতস্তত্র পরিক্রীড়তি সৰ্ব্বদেতি।’ অত্র বৃন্দাবন-বিষয়ক-তৎসহিত সর্ব্বদাক্রীড়িত্বলিঙ্গাবগতেন পরস্পরাব্যভিচারেণ স্বরূপশক্তিত্বম্। সতীপ্যন্যাসু একয়া ইত্যনেন তত্রাপি পরমমুখ্যাত্বমভিহিতম্।” উপরি-উক্ত শ্লোকে দেবীধামেশ্বরী শ্রীদুর্গাদেবী বা মায়াশক্তির সহিত যে শ্রীলক্ষ্মী, সীতা, রুক্মিণী ও শ্রীরাধার একত্র উল্লেখ দৃষ্ট হয়, তাহা দ্বারা সকলের সমত্ব মনে করা উচিত নহে। দেবী ধামেশ্বরী মহামায়া দুর্গাদেবী কৃষ্ণের স্বরূপশক্তির বহিরঙ্গ- প্রকাশ-স্বরূপিণী বিরূপশক্তি; কি স্বরূপাশ্রিতা, কি অপাশ্রিতা—সকলেই শক্তিতত্ত্ব বলিয়া অন্তরঙ্গাশক্তি শ্রীলক্ষ্মী, সীতা, রুক্মিণী, রাজা প্রভৃতিকেও দুর্গাদেবীর সহিত গণনা করা হইয়াছে। দেবী হইতে লক্ষ্মীর বৈশিষ্ট্যের ন্যায় শ্রীসীতা প্রভৃতিরও বৈশিষ্ট্য জানিতে হইবে। এই জন্যই দেবীর সহিত লক্ষ্মী প্রভৃতির ঐক্য স্থাপিত হইতে পারে না, যেহেতু শ্রীরামতাপনীতে শ্রীসীতাদেবীর এবং শ্রীগোপালতাপনী প্রভৃতিতে শ্রীরুক্মিণী ও শ্রীরাধার স্বরূপভূতত্ব উক্ত হইয়াছে। শ্রীযামলে উক্ত হইয়াছে যে,—“শ্রীকৃষ্ণ ভুজদ্বয়বিশিষ্ট, তিনি কখনও চতুর্ভুজ নহেন; তিনি একটী গোপীর সহিত মিলিত হইয়াই অনুক্ষণ ক্রীড়া করেন।” এস্থানে ‘দ্বিভুজ শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে একটী গোপীর সহিতই সর্ব্বদা ক্রীড়া করেন’——এই বাক্য হইতে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার পরস্পরের অব্যভিচার-হেতু স্বরূপ-শক্তিত্ব নিশ্চিত হইয়াছে। অন্য বহু গোপী বিদ্যমান থাকিলেও একটী গোপীর সহিত ক্রীড়া করেন—এইরূপ বিশেষ উল্লেখ থাকায় শ্রীরাধার পরমমূখ্যত্ব প্রতিপাদিত হইয়াছে। অতএব শ্রীরাধার স্বরূপশক্তিত্ব নিবন্ধন বৃহদ্ গৌতমীতন্ত্রের প্রসিদ্ধ বাক্য – “শ্রীরাধা ‘সর্ব্বলক্ষ্মীময়ী’, ‘সৰ্ব্বকান্তি ‘ভুবনমোহন মনমোহিনী’, ‘পরাশক্তি”—সৰ্ব্বতোভাবে সার্থকতা লাভ করিতেছে। এই সকল প্রমাণ দ্বারা জানা যায় যে, মূলাশ্রয় রাধিকা হইতেই আশ্রয়-বৈভব ব্রজললনাসমূহ, রেবতী প্রমুখা প্রকাশাশ্রয়বৃন্দ, দ্বাবকাদিতে মহিষীবৃন্দ, পরব্যোমে লক্ষ্মীগণ, নৈমিত্তিক অবতারাদিতে সীতাপ্রভৃতি তত্তদ্-বিষ্ণুবতারের স্বরূপ শক্তিগণ এবং নিত্যবদ্ধ জীবগণের কারা বা দুর্গরক্ষত্রিয়ী কায়াস্বরূপা-অন্তরঙ্গা স্বরূপশক্তির ছায়াস্বরূপা বহিরঙ্গা বিরূপশক্তিরূপে দেবীধামে নিত্যকাল কৃষ্ণবহির্মুখ-প্রাকৃতজন পূজিতা হইয়া প্রকাশিতা আছেন।
ঋক্ পরিশিষ্টশ্রুতিও আমরা শ্রীকৃষ্ণের স্ব্যাপশক্তিরূপে শ্রীরাধার উল্লেখ দেখিতে পাই, যথা—”রাধয়া মাধবো দেবো মাধবেনৈব রাধিকা।” নিজ-জনসমূহে শ্রীরাধার দ্বারা শ্রীমাধব বিহারশীল বা দ্রুতিমান, মাধব দ্বারা রাধিকা সর্ব্বতোভাবে দীপ্তি পাইতেছেন।
বেদান্তের অকৃত্রিম ভাষ্যের মূর্দ্ধণ্য শ্লোকে অর্থাৎ ‘জন্মাদ্যস্য’-শ্লোকে শ্রীরাধাকৃষ্ণের পরম-মাধুরী পরমমুখ্যা বৃত্তির দ্বারা কীৰ্ত্তিত হইয়াছে। শ্রীমদ্ভাগবতের মূর্দ্ধণ্য শ্লোকটী এই—
“জন্মাদ্যস্য যতোহন্বয়াদিতরতশ্চার্থেষভিজ্ঞঃস্বরাট্
তেনে ব্রহ্ম হৃদা য আদিকবয়ে মুহ্যন্তি যৎ সূরয়ঃ।
তেজোবারিমৃদাং যথা বিনিময়ো যত্র ত্রিসর্গ মৃষা
ধাম্না স্নেন সদা নিরস্তকুহকং সত্যং পরং ধীমহি।।”
অনু + অয় = অন্বয়ঃ, অনু–পশ্চাৎ, অয়–ই’ (ইন—গত্যর্থে) ধাতু নিষ্পন্ন, নিজ-পরমানন্দ শক্তিরূ পা শ্রীরাধিকার সর্ব্বদা অনুগতি করেন বা আসক্ত থাকেন বলিয়া শ্রীকৃষ্ণ ‘অন্বয়, ন্যায় পরিভাষানুসারে “তাহা থাকিলে তাহা থাকা’র নাম ‘অন্বয় ‘ অর্থাৎ স্বরূপশক্তি শ্রীরাধা ব্যতীত কৃষ্ণের অবস্থান নাই। এই জন্য শ্রীকৃষ্ণ ‘অন্বয় ‘। শ্রীকৃষ্ণের ইতরা অর্থাৎ সর্ব্বদা দ্বিতীয়া বলিয়া ইতরা বা সর্ব্বদা দ্বিতীয়াই ‘শ্রীরাধা”। শ্রীরাধা ও কৃষ্ণ একস্বরূপ হইয়াও আস্বাদক ও আস্বাদিতরূপে দুই দেহ; শ্রীল কবিরাজ গোস্বামিপ্রভুর ভাষায় ইহা অতি সুন্দররূপে ব্যক্ত হইয়াছে, যথা (চৈঃ চঃ আ ৪ র্থ )–
“মৃগমদ, তার গন্ধ,– যৈছে অবিচ্ছেদ।
অগ্নি, জ্বালাতে, যৈছে কচু নাহি ভেদ।।
রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ।
লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুই রূপ।।”
যে অন্বয় (শ্রীকৃষ্ণ) ও ইতর (শ্রীরাধা) হইতে ‘আদ্য’ অর্থাৎ আদিরসের জন্ম (তদুভয়কে ধ্যান করি)। শ্রীরাধা ও কৃষ্ণই আদিরসবিদ্যার পরম নিধান। যিনি ‘অর্থ’-সমূহে অর্থাৎ তত্তদবিলাস-কলাপে ‘অভিজ্ঞ’ বিদগ্ধ, আর যে স্বরূপশক্তি তথাবিধ বিলাসবিদগ্ধ স্বরূপে বিরাজ করেন—বিলাস করেন বলিয়া স্বরাট ‘: যাঁহারা ‘আদি কবি’ অর্থাৎ সর্ব্বপ্রথমে তাঁহাদের লীলাবর্ণন আরম্ভকারী শ্রীবেদব্যাসকে অন্তঃকরণ দ্বারাই ‘ব্রহ্ম’- নিজ লীলা- প্রতিপাদক শব্দব্রহ্ম বিস্তার করিয়াছিলেন অর্থাৎ যাঁহারা আরম্ভসমকালেই সমগ্র ভাগবত আমার (শ্রীবেদ- ব্যাসের) হৃদয়ে প্রকাশ করিয়াছিলেন (তদুভয়কে আমি ধ্যান করি)। এতৎগ্রসঙ্গে (ভাঃ (১|৭|৪) – ভক্তিযোগেন মনসি’ শ্লোকটী আলোচ্য। যে শ্রীরাধার বিষয়ে ‘সুরয়ঃ’—শেষাদি পর্যন্ত মোহপ্রাপ্ত হন, অর্থাৎ স্বরূপসৌন্দর্য্য-গুণ প্রভৃতি দ্বারা অত্যদ্ভতা শ্রীরাধাকে নিশ্চয়রূপে বলিতে আরম্ভ করিয়া নিশ্চয় করিতে সমর্থ হন না।
তেজঃ,বারি, মৃত্তিকা—ইহাদের যে প্ৰকার বিনিময় অর্থাৎ পরস্পর স্বভাব-বিপর্য্যয় সংঘটিত হয়, তদ্রূপ যে শ্রীকৃষ্ণ বিরাজ করেন। তেজঃ পদার্থ চন্দ্রাদি জ্যোতির্ম্ময় বস্তু যে শ্রীকৃষ্ণের পদনখ-কান্তি-দ্বারা বারি মৃত্তিকার নিস্তেজস্তব ধর্ম প্রাপ্ত হয়, বারি–নদ্যাদি যাঁহার বংশী বাদ্যাদি দ্বারা বহ্ন্যাদি তেজঃপদার্থের মত উর্দ্ধগমনশীলতা এবং পাষাণাদি মুৎপদার্থের মত স্তম্ভভাব প্রাপ্ত হয়; মৃৎ-পদার্থ পাষাণাদি যাঁহার বিচ্ছুরিত কান্তিকলা দ্বারা তেজোবৎ ঔজ্জ্বল্য এবং বেণুবাদনাদি দ্বারা বারিবৎ দ্রবতা প্রাপ্ত হয়।
যাহাতে—শ্রীরাধা বিদ্যমানে,ত্রিসর্গ —শ্রী ভূ-লীলা — এই শক্তিয়ের প্রাদুর্ভাব অথবা দ্বারকা মথুরা বৃন্দাবন -এই স্থানত্রয়গত শক্তিবর্গত্রয়ের প্রাদুর্ভাব মৃষা -মিথ্যা অর্থাৎ সৌন্দর্য্যাদি গুণসম্পদ দ্বারা তাঁহারা শ্রীরাধা ব্যতীত শ্রীকৃষ্ণের কিঞ্চিতমাত্রও প্রয়োজন-কারণ হন না। শ্রীল কবিরাজ গোস্বামীর ভাষায় ইহা অতি সুন্দররূপে ব্যক্ত হইয়াছে —
“রাধাসহ ক্রীড়া-রস-বৃদ্ধির কারণ।
আর সব গোপীগণ রসোপকরণ।।
কৃষ্ণের বল্লভা রাধা কৃষ্ণ-প্ৰাণধন।
তাঁহা বিনু সুখহেতু নহে গোপীগণ।।”
(চৈঃ চঃ আ ৪।২১৭-২১৮)
শতকোটি গোপীতে নহে কাম-নিৰ্ব্বাপণ।
তাহাতেই অনুমানি শ্রীরাধিকার গুণ।।
(চৈঃ চঃ ম ৮।১১৫)
সেই দুইজন অর্থাৎ শ্রীরাধামাধবের নিজ-প্রভাবে লীলাপ্রতিবন্ধক জরতী এবংপ্রতিপক্ষ নায়িকাগণের ‘কুহক’- মায়া সর্ব্বদা নিরস্ত হইয়াছে।
তাদৃশরূপে ‘-সত্য ‘- নিত্যসিদ্ধ অথবা পরস্পর-বিলাসাদি দ্বারা আনন্দ-সন্দোহ-দানে কৃতসত্য অর্থাৎ নিশ্চল ; আতএব ‘পর’-এরূপ আর অন্যত্র কোথায়ও দৃষ্ট হয় না।গুণলীলাদি দ্বারা বিশ্ব বিস্মাপকহেতু সর্ব্বোৎকৃষ্ট। এইরূপে যুগলিত শ্রীরাধামাধবকে শ্রীমদ্বেদব্যাস আপন অন্তরঙ্গ-জন শ্রীশুকদেবাদির সহিত ধ্যান করিতেছেন।
যদি এখানে এইরূপ পূর্ব্বপক্ষ হয় যে, যদি স্বরূপ শক্তি শ্রীমতী রাধার সহিত শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পরম সত্য ও পরম সত্যাশ্রয়ী অপ্রাকৃত রসিক ভক্তগণের নিত্য ধ্যেয় বস্তু হইবেন, তাহা হইলে শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রীল গুরুদেব গোস্বামী প্রভু শ্রীরাধিকার নাম উল্লেখ করেন নাই কেন?
এই পূর্ব্বপক্ষের উত্তর ভাগবতগণ প্রদান করিয়াছেন—প্রকৃত ভজন পরায়ণ অপ্রাকৃত-সাহজিক প্রেমিক পুরুষগণ স্বীয় নিগূঢ় ভজনীয় বস্তুর কথা কখনও যথা তথা প্রকাশ করেন না, তবে অপর যোগ্যজনকে তাহাতে আকৃষ্ট করিবার জন্য তাহার মহিমামাএ কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। শ্রীল শুকদেব গোস্বামী প্রভুও শ্রীমদ্ভাগবতে পরমরস চমৎকার মাধুর্য্য পরাকাষ্ঠা মুলাশ্রয়া গোবিন্দানন্দিনী শ্রীমতী বার্ষ ভানবীর মহিমার কথা “অনয়ারাধিতো নুনং ” (ভাঃ ১০|৩০ |২৮), “বরিষ্ঠ সর্ববযোষিতাম্ ” (ভাঃ ১0|৩0|৩৬), ২০|৩০।২৬ প্রভৃতি বহু বহু শ্লোকে কীৰ্ত্তন করিয়াছেন; কিন্তু সাধারণ্যে একমাত্র সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ভজনীয় বস্তুর নামটী সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন নাই। কোন কোন ভাগবদ্গণ বলেন যে, পরমহमেকুলশিক্ষামণি শ্রীল শুকদেব গোস্বামী প্রভু যদিও কৃষ্ণরসাবিষ্ট হইয়া শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁহার প্রিয়া রুক্মিণ্যাদি মহিষীগণের নামাবলী সর্ব্বদাই কীৰ্ত্তন করিতেন, তথাপি শ্রীরাধা প্রভৃতি সমঅর্থারতি -বিগ্রহ ব্রজ-গোপীগণের নাম কখনও মুখে উচ্চারণ করিতে পারিতেন না। তিনি যে গৌরব-নিবন্ধন শ্রীবার্যভানবীর নাম উচ্চারণ করিতেন না, তাহা নহে, কারণ তিনি কৃষ্ণরসাবিষ্ট হইয়াই নাম-কীৰ্ত্তন করিতেন। তাহাতে গৌরব বা মর্য্যাদার অবকাশ নাই। তবে অতি বিস্তৃত, সৰ্ব্ব- বিলক্ষণ, পরম প্রকটিত প্রেমানল-শিখার তাপে দগ্ধ গোপীগণের নাম-কীৰ্ত্তন করিলে তাহাদের স্মরণে তৎসমন্ধীয় তীক্ষ্ণ প্রেমানল হইতে সমুত্থিত উচ্চ শিখাগ্রকণিকার স্পর্শমাত্র বৈকল্যের উদয় হয় বলিয়া তিনি ব্রজবধূগণের নাম মুখে উচ্চারণ করিতে পারিতেন না। এইজন্য শ্রীমাগবত ১০ম স্কন্ধে গোপীগণের কথা সামান্যভাবে উক্ত হইয়াছে অর্থাৎ তাঁহাদের আচরিত ব্যাপার সমূহ বর্ণিত হইলেও নাম-গ্রহণাদি দ্বারা বিশেষভাবে বর্ণিত হয় নাই।।
এইরূপভাবে শ্রীমদ্ভাগবতাদিতে শ্রীবার্যভানবী প্রভৃতি পরমমুখ্যা গোপীগণের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকায় যুগপৎ দুইটী পরমোপকার সাধিত হইয়াছে। পরম গুপ্ত ভজনীয় নিধি গোপীশিরোমণি শ্রীবার্যভাননীয় কথা অজ্ঞরূঢ়ি ও সাধারণরূঢ়িবৃত্তি চালিত জগতের যোগ্যতার নিকট অপ্রকাশিত রহিয়াছে। তাঁহারা সৰ্ব্বশ্ৰেষ্ঠ কৃষ্ণভজনের সন্ধান না পাইয়া কেহ বা ‘বিষ্ণুমায়া’, কেহবা “বিষ্ণুর ভজনে যোগ্যতা’ মাত্র প্রাপ্ত হইয়াছেন। জীবের স্বরূপ ‘কৃষ্ণের নিত্যদাস’ হইলেও পরমসত্যস্বরূপ পরিপূর্ণ বস্তু শ্রীকৃষ্ণ প্রেমিক ভক্ত ব্যতীত অপর কাহারও নিকট সুপ্রকাশিত হন না। একমাত্র আত্মার লৌল্যই তাঁহার মূল্য স্বরূপ, উহা ঐশ্বর্য্য- শিথিলভজনে কিম্বা প্রাকৃত অস্মিতায় বিচরণশীল ব্যক্তিতে অসম্ভব। ঐশ্বর্য্য-কামগন্ধহীন প্রেমিক পুরুষে সেই অপ্রাকৃত লৌল্য প্রচুর বলিয়া আজিও শ্রীকৃষ্ণ তাঁহারই নিকট জিত হন অর্থাৎ পরম- নিজ অন্তরঙ্গাশক্তি পরম-মুখ্যাশ্রয় শ্রীবার্যভানবী ব্যতীত যে শ্রীকৃষ্ণের উপাসনার চেষ্টা, তাহা প্রকৃতপ্রস্তাবে বিষ্ণুরই উপাসনা। উহাকে যথার্থ কৃষ্ণোপাসনা বলা যাইতে পারে না। ব্রজের শাস্ত-দাস্য সখ্য বাৎসল্যরসরসিকগণ শ্রীরাধিকার সহিত শ্রীকৃষ্ণের ক্রীড়ারসের সহায়ক বলিয়া তাঁহাদের উপাসনাও শ্রীকৃষ্ণোপাসনা।
অতএব শ্রীল শুকদেব গোস্বামী প্রভু শ্ৰুতিগুহ্য শ্রীবার্যভানবীর নাম স্পষ্টভাবে প্রকাশ না করিয়া একাধারে প্রেমিক ভক্তগণের তোষণ ও ঐশ্বর্য্য- শিথিল ভক্ত ও অভক্তগণের মোহন করিয়াছেন। কবিরাজ গোস্বামী প্রভুর ভাষায় শ্রীল শুরুদেব গোস্বামী প্রভুর উদ্দেশ্য এইরূপভাবে বর্ণিত হইতে পারে (চৈঃচঃ আ ৪র্থ)–
“অতএব কহি কিছু করিঞা নিগূঢ়।
বুঝিবে রসিক ভক্ত, না বুঝিবে মূঢ়।।
অভক্ত উষ্ট্রের ইথে না হয় প্রবেশ।।
তবে চিত্তে হয় মোর আনন্দ বিশেষ।।
যে লাগি’ কহিতে ভয়, সে যদি না জানে।
ইহা বই কিবা সুখ আছে ত্রিভুবনে।।”
রাধাভজন ব্যতীত কৃষ্ণভজন হইতে পারে না, রাধা- বিরহিত মাধব বলিয়া কোন বস্তু থাকিতে পারে না; স্বরূপশক্তি ব্যতীত শক্তিমান্ অদ্বয়তত্ত্বের অবস্থান নাই। শ্রীমতী রাধিকাকে বাদ দিয়া অদ্বয়জ্ঞান ব্রজেন্দ্রনন্দনের অস্তিত্ব স্বীকৃত হইতে পারে না। তাই শ্রীল দাসগোস্বামী প্রভুর ‘বিলাপকুসুমাঞ্জলি’তে আমরা দেখিতে পাই ।
“আশাভরৈবমৃতসিন্ধুময়ৈঃ কথঞ্চিৎ কালো ময়াতিগমিতঃ কিল সাম্প্রতং হি ।
ত্বঞ্চেৎ কৃপাং ময়ি বিধাস্যসি নৈব কিং মে প্রাণৈব্রজেন চ বরোরু বকারিণাপি।।”
হে বরোরু। এখন আমি অমৃতসাগররূপ আশাতিশয়-কদম্বে অতি কষ্টেসৃষ্টে কালাতিপাত করিলাম, তুমি যদি আমাকে কৃপা না কর, তবে এ প্রাণ বা ব্রজবাস অধিক কি শ্রীকৃষ্ণেও আমার প্রয়োজন নাই। ঠাকুর ভক্তিবিনোদ গাহিয়াছেন–
“রাধাভজনে যদি মতি নাহি ভেলা।
কৃষ্ণভজন তব অকারণ গেলা।।
আতপ-রহিত সুরয নাহি জানি।
রাধা-বিরহিত মাধব নাহি মানি।।
কেবল মাধব পূজয়ে সো অজ্ঞানী।
রাধা-অনাদর করই অভিমানী।।
কবহি নাহি করবি তাঁকর সঙ্গ।
চিত্তে ইচ্ছসি যদি ব্রজরস-রঙ্গ।।
রাধিকা দাসী যদি হোএ অভিমান।
শীঘ্রই মিলই তব গোকুল-কান।।
ব্রহ্মা-শিব-নারদ-শ্রুতি নারায়ণী।
রাধিকাপদরজঃ পূজয়ে মানি।।
উমা -রমা – সত্য- শচী চন্দ্রা -রুক্মিণী।
রাধা অবতার সবে আম্নায় -বাণী।।
হেন রাধা পরিচর্য্যা যাঁকর ধন।
ভকতি -বিনোদ তাঁর মাগয়ে চরণ।।
একমাত্র বিষয়-বিগ্রহ শ্রীগৌরসুন্দারই আশ্রয় ভাবাঙ্গীকারে মূল আশ্রয় শ্রীবৃষভানুনন্দিনীর কথায় যে জীব মাত্রের প্রয়োজন আছে, তাহা জগতে জানাইয়াছেন। অণু সচ্চিদানন্দ জীব অদ্বয়জ্ঞানের সন্ধিনী শক্ত্যধিষ্ঠিত বিগ্রহ শ্রীবলদেব , সখিশকার্দিষ্ঠিত বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণ এবং ভ্লাদিনী শক্তাধিষ্ঠিত বিগ্রহ শ্রীগোবিন্দা নন্দিনী ও ভক্তানন্দদারিনীর সেবা ব্যতীত কখনও তাঁহার স্বরূপত্ব রক্ষা করিতে পারেন না। এই জন্য মায়াবিলাসী ভোগীর বা মায়াবাদী নির্বিশেষ ব্রহ্মানুসন্ধিৎসু ত্যাগীর নিকট কার্যতঃ সচ্চিদানন্দোপলব্ধি খপুষ্পের ন্যায় নিরর্থক। তাঁহারা উভয়েই আত্মঘাতী। মধুররসে বলদেরই শ্রীবার্যভানবীর কনিষ্ঠাভগিনী অনঙ্গমঞ্জরীরূপে অবস্থিত হইয়া শ্রীরাধামাধবের সেবার সন্ধান প্রদাতা। শ্রীরাধারস-সুধানিধিকার বলিয়াছেন,—
“প্রেমা নামাদ্ভুতার্থঃ শ্রবণপথগতা কথা নাম্নাংমহিম্নঃ
কো বেত্তা কস্য বৃন্দাবনবিপিন মহামাধুরীষু প্রবেশঃ।
কো বা জানাতি রাধাং পরমরসচমৎকারমাধুর্যসীমা
মেকশ্চৈতন্যচন্দ্রাঃ পরমকরুণয়া সর্ব্বমাবিশ্চকার।।”
—’প্রেম’ নামক পরমপুরুষার্থ কাহারই বা শ্রবণগোচর হইয়াছিল? কে-ই বা শ্রীনামের মহিমা জানিত? কাহারই বা বৃন্দারণ্যের গহন-মহামাধুরী-কদম্বে প্রবেশ ছিল? কে-ই বা পরম চমৎকার অধিরূঢ়মহাভাব মাধুর্য্যের পরাকাষ্ঠা শ্রীবার্যভানবীকে (উপাস্য বস্তুরূপে) জানিত। এক চৈতন্যচন্দ্রই পরম ঔদার্য্য- লীলা প্রকট করিয়া এই সমস্ত আবিষ্কার করিয়াছেন।
সুধানিধিকার আরও বলিয়াছেন,—
“যথা যথা গৌরপদারবিন্দে বিন্দেত ভক্তিং কৃতপুণ্যরাশিঃ।
তথাতথোৎসপতি হৃদ্যকস্মাৎ রাধাপদাম্ভোজসুধাম্বুরাশিঃ।।”
–পুঞ্জ পুঞ্জ সুকৃতিসম্পন্ন পুরুষ শ্রীগৌর পদকমলে যাদৃশী ভক্তিলাভ করেন, অকস্মাৎ তাঁহার হৃদে শ্রীশ্রীরাধা পাদপদ্মের প্রেমসুধা-সমুদ্রও তাদৃশ ভাবেই উদ্গত হইয়া থাকে।
অতএব গৌর-পদাজভৃঙ্গ বিপ্রলম্ভরস-পোষ্টা শ্রীগুরু ও গৌরভক্তগণের আনুগত্যে বিপ্রলম্ভ-বিগ্রহ শ্রীগৌরসুন্দরের পরিপূর্ণ সেবা ফলেই পরিপূর্ণ শ্রীরাধাদাস্য লাভ হইতে পারে।
আত্মবৃত্তিতে রাধা দাস্যাভিলাষের সহিত নিরন্তর গৌর-বিহিত কৃষ্ণনাম কীর্তনই গৌরারাধনা।