Appearance Day of Sri Janhabi Matathakurani
শ্রীনিত্যানন্দ শক্তি শ্রীজাহ্নবী মাতা ঠাকুরানীর আবির্ভাব তিথি
২৯ এপ্রিল ২০২৩
শ্রীসূর্য্যদাস সরখেল শালি গ্রামে বাস করতেন। দামোদর, জগন্নাথ, গৌরীদাস, কৃষ্ণদাস ও নৃসিংহচৈতন্য- শ্রীসূর্য্যদাসের এই পাঁচজন ভাই ছিলেন। পিতার নাম শ্রীকংসারি মিশ্র। মাতার নাম শ্রীকমলা দেবী। সূৰ্য্যদাস গৌড়ের রাজার পয়সাকড়ির হিসাব রক্ষকের কার্য্য করতেন বলে তাঁকে সরখেল উপাধি দেওয়া হয়।
শ্রীসূর্যদাস সরখেলের দুটি কন্যা ছিল। বড় জনের নাম শ্রীবসুধা ও ছোটজনের নাম শ্রীজাহবা। গৌর গণোদ্দেশ দীপিকাতে কবিকর্ণপুর বলেছেন—
শ্রীবারুণী বেবত্যোরংশসম্ভবে।
তস্য প্রিয়ে শ্রীবসুধা চ জাহ্নবা ।।
শ্রীসূৰ্য্যাদাসাখ্যমহাত্মনঃ সুতে।
ককুস্মিরূপস্য চ সূর্য্যতেজসঃ।।
শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর প্রিয়াদ্বয় শ্রীবসুধা ও জাহ্নবা দেবী, বারুণী এবং রেবতীর অংশে জন্ম। শ্রীসূর্যাদাস পণ্ডিত সূর্য্যের ন্যায় কান্তি বিশিষ্ট রৈবতরাজ কুকুদ্মীর অংশসস্তৃত ছিলেন। শ্রীসূর্যাদাস সরখেল শ্রীনিত্যানন্দের ও শ্রীগৌরাঙ্গের প্রিয় পাত্র ছিলেন। তিনি কন্যাদ্বয়ের যৌবন দশা দেখে তাহাদের বিবাহের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
সূর্যদাস পণ্ডিত চিন্তিয়া মনে মনে।
করিতে শয়ন নিদ্রা হইল সেইক্ষণে।।
স্বপ্নচ্ছলে দেখে মহামনের আনন্দে।
দুই কন্যা সম্প্রদান করে নিত্যানন্দে।।
( শ্রীভক্তি রত্নাকর দ্বাদশ তরঙ্গ– ৩৯০০-৩৯০১)
অদ্ভুত স্বপ্ন দর্শন করে সূর্যাদাস পণ্ডিত আনন্দ-সাগরে ভাসতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর নিদ্রা ভঙ্গ হল । প্রাতঃকালে একজন মিত্র ব্রাহ্মণের নিকট স্বপ্ন কথা বলতে লাগলেন-আমি দেখছি নিত্যানন্দ প্রভু সাক্ষাৎ বলরাম। তাঁর অপূর্বা অঙ্গকান্তিতে দশদিক আলোকিত। নানা রত্নালঙ্কারে অঙ্গ সুশোভিত। আমার কন্যা দুটি দুই পার্শ্বে বারুণী ও রেবর্তী রূপে শোভা পাচ্ছে। অতএব শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীচরণে আমি কন্যা দান করব।তা না করা পর্যন্ত আমার চিত্তে কোন শান্তি নাই। এরূপ অনেক কথা বলে শ্রীসূর্য্যদাস সরখেল মিত্র ব্রাহ্মণটিকে নবদ্বীপে শ্রীবাস পণ্ডিত গৃহে প্রেরণ করলেন। অতি দ্রুত ব্রাহ্মণটি শ্রীবাস পণ্ডিত গৃহে এলেন। তখন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু শ্রীবাসের গৃহে অবস্থান করছিলেন। ব্রাহ্মণটি সূর্য্যদাস সরখেলের নিবেদন শ্রীবাস পণ্ডিতকে সব জানালে, শ্রীবাস পণ্ডিত শুনে সুখী হলেন ও সেই কথা সময়মত শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীচরণে নিবেদন করলেন। করুণাময় শ্রীনিত্যানন্দ সূর্য্যদাস পণ্ডিতের অভিপ্রায় পূর্ণ করবেন বলে ব্রাহ্মণকে আশ্বাস দিলেন। এ কথা শ্রবণে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য ও পরম সুখী হলেন। শীঘ্র এ কার্য হউক এরূপ বললেন। ব্রাহ্মণ শালিগ্রামে ফিরে এসে সূর্য্যদাস পণ্ডিতকে শুভ সমাচার দিলেন। ইহা শুনে সূর্য্যদাসের আনন্দের সীমা রইল না।
বড়গাছি গ্রাম নিবাসী রাজা হরিহোড়ের পুত্র শ্রীকৃষ্ণদাস, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর একান্ত প্রিয় ভক্ত। তিনি এ বিবাহের যাবতীয় ব্যয় বহন করবেন এবং তার গৃহেই এ সমস্ত কার্য সম্পন্ন হবে–সংকল্প করে শীঘ্র শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে প্রার্থনা করে বড়গাছি গ্রামে আনলেন ও বিবাহের উদ্যোগ আরম্ভ করলেন। শ্রীবাস, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য, শ্রীচন্দ্রশেখর ও শ্রীমুরারি গুপ্ত প্রভৃতি যাবতীয় গৌরভক্তবৃন্দ সমবেত হয়ে সংকীর্তন আরম্ভ করলেন। শ্রীসূর্য্যাদাস পণ্ডিতের ভ্রাতা শ্রীকৃষ্ণদাস শীঘ্র বড়গাছি গ্রামে এলেন ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তথ্য যাবতীয় বৈষ্ণবগণকে নিয়ে শালিগ্রামে এলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে ও যাবতীয় ভক্তগণকে দর্শন করে সূর্যাদাস পণ্ডিত পরমানন্দে কিছু পথ অগ্রসর হয়ে অভিনন্দন পূৰ্ব্বক স্বীয় গৃহে আনলেন এবং শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীপাদপদ্মে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন।
লোটাইয়া পড়ে নিত্যানন্দ পদতলে।
সূর্যাদাস ভাসে দুই নয়নের জলে।।
দুই হাতে ধরি’ চরণ দু’খানি।
কহিতে চাহয়ে কিছু না স্ফুরয়ে বাণী।।
মন্দ মন্দ হাসি’ নিত্যানন্দ প্রেমাবেশে।
কৃপা করি’ কৈলা আলিঙ্গন সূৰ্য্যদাসে।
সূৰ্য্যদাস আনন্দে বিহ্বল নিরন্তর।
কে বুঝিতে পারে সূর্যাদাসের অন্তর।।
দেখিয়া ভ্রাতার প্রেমচেষ্টা গৌরীদাস।
না ধরে ধৈরয়, অতি অন্তরে উল্লাস।।
— (ভক্তিরত্নাকর দ্বাদশ তরঙ্গ-৩৯৪৩-৩৯৪৭)
অতঃপর শ্রীসূর্যাদাস পণ্ডিত শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীপাদ পদ্মযুগল পূজা করে শ্রীবসুধা ও শ্রীজাহ্নবা দেবীকে তাঁর হাতে সমর্পণ করলেন।
লোক শাস্ত্রমতে সূৰ্য্যদাস ভাগ্যবান।
নিত্যানন্দ চন্দ্রে দুই কন্যা কৈল দান।।
–(ভঃ রঃ ১২।৩৯৮৩)
এবারে শুভ পরিণয় হবার পর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কয়েকদিন শালিগ্রামে অবস্থান করে পত্নীদ্বয় সঙ্গে বড়গাছি শ্রীকৃষ্ণ দাসের গৃহে এলেন। তথায় কয়েক দিন অবস্থান করবার পর শ্রীনবদ্বীপ এলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু দুই প্রিয়াসহ শ্রীশচীমাতার গৃহে এসে শ্রীশচী মাতাকে নমস্কার করলেন। বসুধা জাহবা দেবীকে দেখে শ্রীশচী মাতা অতিশয় হর্ষিত হলেন এবং স্নেহ করে। কোলে নিয়ে বার বার তাদের চিবুক স্পর্শ করতে লাগলেন। “শ্রীবসু, জাহ্নুবা দোঁহে দেখি’ এথা আই। করিল যতেক স্নেহ–কহি সাধ্য নাই”।। ― (ভঃ বঃ ১২/৪০১০)
বৈষ্ণব গৃহিণীগণ বধুদ্বয়কে পরম স্নেহ করতে লাগলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু অতঃপর শ্রীশচীমাতার আজ্ঞা নিয়ে শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের গৃহে এলেন। শ্রীসীতা ঠাকুরাণী বসুধা জাহ্নুবা দর্শন করে আনন্দ সাগরে ভাসতে লাগলেন, কোলে নিয়ে কত স্নেহ করলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কিছুদিন অদ্বৈতাচার্যের ভবনে অবস্থান করে শ্রীউদ্ধারণ দত্ত ঠাকুরের বিশেষ প্রার্থনায় সপ্তগ্রামে তাঁর ভবনে এলেন। তথায় কয়েকদিন সংকীৰ্ত্তন মহামহোৎসব সমাপনান্তে খড়দহ গ্রামে আগমন করলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু ভক্তগণ সঙ্গে অনন্তর সংকীর্ত্তন রঙ্গে সর্ব্বত্র পরিভ্রমণ করতে বাহির হলেন।
শ্রীবসুধা দেবীর গর্ভে শ্রীগঙ্গা নাম্নী কন্যা ও বীরচন্দ্র নামে পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। জাহ্নুবা দেবীর কোন পুত্র সন্তান হয় নাই।
* * *
শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য, শ্রীবাস পণ্ডিত ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু এবং অন্যান্য গৌরপার্ষদগণের অপ্রকটের পর পুনঃ সংকীর্ত্তন-বন্যা প্রবাহিত করেন শ্রীগৌরসুন্দরের করুণা শক্তিত্রয় শ্রীনিবাস আচার্য্য, নরোত্তম ঠাকুর তথা শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু। আচার্য্যত্রয় যে লোক বিশ্রুত মহামহোৎসব করেছিলেন খেতরি গ্রামে রাজা সন্তোষ দত্তের গৃহে, সে-উৎসবে শ্রীনিত্যানন্দ শক্তি শ্রীজাহ্নুবা মাতা আচার্য্যবৃন্দের বিশেষ প্রার্থনায় শুভাগমন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণদাস মিশ্র (শ্রীজাহবা দেবীর কাকা) মীনকেতন, রামদাস, মুরারি চৈতন্য, জ্ঞানদাস, শ্রীপরমেশ্বরী দাস, বলরাম দাস ও শ্রীবৃন্দাবন দাস ঠাকুর প্রভৃতি শ্রীনিত্যানন্দের প্রিয়তম ভক্তগণ। শ্রীজাহ্নবা মাতা প্রথমে ভক্তগণ সঙ্গে অম্বিকা কালনা তাঁর কাকা শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিতের গৃহে এলেন,শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিতের শিষা শ্রীহৃদয় চৈতন্য দাস অতি সাদরে ঈশ্বরী শ্রীজাহ্নবা মাতাকে ও যাবতীয় ভক্তবৃন্দকে অভ্যর্থনা করলেন। শ্রীজাহ্নবা মাতা তথায় স্বহস্তে বন্ধন করে শ্রীগৌরনিত্যানন্দকে ভোগ লাগান। একরাত্র তথায় মহোৎসব করে শ্রীনবদ্বীপে এলেন। মহাপ্রভুর গৃহে এসে এবার শ্রীশচীমাতার দর্শন না পেয়ে, তাঁর বিরহে শ্রীজাহ্নবা দেবী বহু খেদ করলেন। শ্রীপতি ও শ্রীনিধি এসে শ্রীঈশ্বরীকে অতি আদর করে নিজ গৃহে নিয়ে এলেন। তথায় শ্রীঈশ্বরী শ্রীবাস পণ্ডিত ও শ্রীমালিনী দেবীর চরণ দর্শন না পেয়ে অতিশয় কাতর হৃদয়ে কত ক্রন্দন করেন। একদিন তথায় অবস্থান পূৰ্ব্বক শান্তিপুরে আগমন করেন। শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য ও শ্রীসীতা ঠাকুরাণীর অপ্রকটে শ্রীজাহ্নবা মাতা বহু খেদ করলেন। আচার্য্যের পুত্রদ্বয় শ্রী অচ্যুতানন্দ ও শ্রী গোপাল বনু আদর পূবর্বক শ্রীজাহ্নবা মাতাকে ও তাঁর সঙ্গী সমস্ত বৈষ্ণবকে সৎকার করেন। অনন্তর শ্রীজাহ্নবা মাতা ভক্তগণ সঙ্গে কণ্টক নগর হয়ে তেলিয়াবুধরি গ্রামে এলে, শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের ভ্রাতা শ্রীগোবিন্দ কবিরাজ শ্রীঈশ্বরীকে বহু সম্মান পুরঃসর পূজা এবং সৎকার করেন। একরাত্র তথায় অবস্থান করে খেতরি গ্রাম অভিমুখে রওনা হলেন। রাজা সন্তোষ দত্ত পদ্মানদী পারের ব্যবস্থা এবং পালকী করে তথা হতে খেতরি গ্রাম পর্য্যন্ত যাবার ব্যবস্থা সুন্দরভাবে করে রেখেছিলেন। রাজা সন্তোষ দত্ত মার্গের বহু দূর এসে শ্রীজাহ্নবা মাতাকে ও সমস্ত বৈষ্ণবগণকে পুষ্প মাল্যাদি দিয়ে স্বাগত জানান। বৈষ্ণবগণ মহাসংকীৰ্ত্তন মুখে খেতরি গ্রামে প্রবেশ করেন। এ সময় শ্রীনিবাস আচার্য্য, শ্রীনরোত্তম ঠাকুর ও শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু অগ্রসর হয়ে তাঁদের স্বাগত জানান এবং ভূমিষ্ঠ
হয়ে দণ্ডবন্নতি করেন। বৈষ্ণবগণ পরস্পর প্রেমে আলিঙ্গন করতে লাগলেন।চতুৰ্দ্দিক মহা আনন্দ-কোলাহলে মুখরিত হল।
রাজা সন্তোষ দত্ত শ্রীজাহ্নবা মাতার জন্য ও বৈষ্ণবগণের জন্য নবনির্মিত সুন্দর গৃহ এবং দুটি করে ভৃত্য ও যাবতীয় সেবা-সম্ভার পূর্ব্ব হতেই প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। শ্রীজাহ্নবা মাতা ও বৈষ্ণবগণ নিজ নিজ ভবনে প্রবিষ্ট হলেন এবং প্রসাদ গ্রহণ অন্তে বিশ্রাম করলেন। রাজা সন্তোষ দত্তের সেবা পরিপাটী দেখে সকলে পরম সুখী হলেন।
পরদিবস শ্রীগৌরসুন্দরের শুভ আবির্ভাব তিথি। নবনির্মিত মন্দিরে ছয়টী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হবার বিপুল আয়োজন হতে লাগল। সন্ধ্যায় অধিবাস সংকীর্ত্তন। শ্রীখণ্ডের রঘুনন্দন ঠাকুর মঙ্গল অধিবাস কীর্ত্তন আরম্ভ করলেন। খেতরি গ্রাম লোকে লোকে পূর্ণ হল। সভা মধ্যে শ্রীনিত্যানন্দ শক্তি শ্রীজাহ্নবা মাতা অতিশয় শোভা পেতে লাগলেন। তাকে দর্শন করে এবং বৈষ্ণব গণের দর্শন পেয়ে ও কীৰ্ত্তন শ্রবণ করে পাপী-পাষণ্ডিগণও পরম শুদ্ধ হলেন। সকলে গৃহ কার্যাদি পরিত্যাগ করে বৈষ্ণব দর্শন ও মধুর কীর্ত্তন শ্রবণে মগ্ন হলেন। সকলে আনন্দ-সমুদ্রে ভাসতে লাগলেন। বৈকুণ্ঠানন্দে সকলে নিমগ্ন। মধ্যরাত্র পর্যান্ত অধিবাস কীৰ্ত্তন মহোৎসব হল।
দ্বিতীয় দিবসে মহাসমারোহে শ্রীনিবাস আচার্য্য স্বয়ং ছয়টা বিগ্রহের অভিষেক কার্যাদি করলেন। শ্রীনরোত্তম ঠাকুর মহাশয় বৈষ্ণবগণের ও শ্রীজাহ্নবা মাতার আদেশে কীর্ত্তন আরম্ভ করলেন। সেই কীৰ্ত্তনে স্বয়ং স্বপার্ষদ শ্রীগৌর-নিত্যানন্দ আবির্ভূত হলেন। এ দিনে যে কি সুখ-সিন্ধু খেতরি গ্রামে উদ্বেলিত হয়েছিল তা কে বর্ণন করতে পারে? সে উৎসব এক স্মরণীয় ঘটনা বলে খ্যাতি লাভ করল।
তৃতীয় দিবসে মহামহোৎসব। শ্রীবিগ্রহগণের জন্য স্বয়ং শ্রীজাহ্নবা মাতা ভোগ রন্ধন করলেন।
শ্রীজাহ্নবা ঈশ্বরী পরম হৰ্ষ হৈয়া।
প্রাতঃকালে করিলেন স্নানাহ্নিক ক্রিয়া।।
পরম উৎসাহে কৈল অপূর্ব্ব রন্ধন।
অন্ন ব্যঞ্জনাদি যত না হয় বর্ণন।।
—( ভক্তি রত্নাকর দশম তরঙ্গে-৬৮৬-৬৮৭)
মহামহোৎসবের প্রসাদ মহান্তগণকে স্বয়ং শ্রীজাহ্নবা মাতা পরিবেশন করলেন। সবশেষে শ্রীজাহ্নবা মাতা প্রসাদ গ্রহণ করলেন। শ্রীজাহ্নবা মাতার চরিত্রে বৈষ্ণব মহান্তগণ পরম মুগ্ধ হলেন ।
শ্রীজাহ্নবা মাতা খেতরীর উৎসব শেষ করে ভক্তবৃন্দ সাথে শ্রীবৃন্দাবনাভিমুখে যাত্রা করলেন। পথে প্রয়াগ, কাশী হয়ে মথুরায় এলেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি দর্শন, আদি কেশব ও বিশ্রাম ঘাটে স্নানাদি করে বৃন্দাবনে আগমন করলেন। শ্রীজাহ্নবা মাতাকে অভ্যর্থনা করবার জন্য বৃন্দাবন থেকে বৈষ্ণবগণ মথুরায় এলেন। শ্রীপরমেশ্বরী দাস বৈষ্ণবগণের পরিচয় শ্রীজাহ্নবা মাতার নিকট বলতে লাগলেন–
ইহ শ্রীগোপালভট্ট গৌর প্রেমময়।
এই ভূগর্ভ, লোকনাথ গুণালয় ।।
কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী, এ শ্রীকৃষ্ণ পণ্ডিত।
শ্রীমধু পণ্ডিত, ইঁহ শ্রীজীব বিদিত।।
ঐছে সকলের নাম, ক্রিয়া জানাইল।
শুনি ঈশ্বরীর মহা আনন্দ বাঢ়িল।
– (ভক্তিরত্নাকর, ১১ তরঙ্গ-১০৪-১০৬)
শ্রীগোস্বামিগণ শ্রীঈশ্বরীর নিকট এসে তাঁকে প্রণাম করতেই তিনিও তাঁদের প্রতি প্রণাম করলেন। শ্রীজাহ্নবা মাতা, গোস্বামিগণের প্রেম চেষ্টা নিরীক্ষণ করে বড় আনন্দিত হলেন। অনন্তর শ্রীগোবিন্দদেব, শ্রীগোপীনাথ, শ্রীমদনমোহন ও শ্রীরাধারমণ প্রভৃতি বিগ্রহ দর্শন করলেন। গোস্বামিগণ শ্রীঈশ্বরীর থাকবার উত্তম ব্যবস্থা করেছিলেন। কয়েকদিন তিনি শ্রীবৃন্দাবনে অবস্থান করবার পর গোবর্দ্ধন, শ্রীরাধাকুন্ড, শ্যামকুণ্ড প্রভৃতি দর্শনের জন্য বহির্গত হলেন। শ্রীভগবানের লীলাস্থলী সকল দর্শনে শ্রীঈশ্বরীর যে সমস্ত দিব্য ভাব সকল উদয় হয়েছিল তা বর্ণনাতীত। কিছুদিন সুখে শ্রীবৃন্দাবন ধাম ভ্রমণ করবার পর তিনি গৌড়দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
গৌড়মণ্ডলে পৌঁছে শ্রীঈশ্বরী প্রথমে খেতরি গ্রামে এলেন। শ্রীনরোত্তম, রামচন্দ্র কবিরাজ প্রভৃতি বৈষ্ণবগণ অগ্রসর হয়ে তাঁকে স্বাগত অভ্যর্থনা জানালেন। কয়েকদিন তিনি তথায় অবস্থান করবার পর বুধরি গ্রাম এলেন। বুধরি গ্রামে শ্রীবংশীদাসের ভ্রাতা শ্রীশ্যামদাস চক্রবর্তী বাস করতেন। তাঁর কন্যা শ্রীহেমলতাকে বড় গঙ্গাদাসের সঙ্গে ঈশ্বরী বিবাহের প্রস্তাব করলে শ্রীশ্যামদাস ঈশ্বরীর আদেশমত বড় গঙ্গাদাসকে কন্যা দান করলেন। বিবাহের পর ঈশ্বরী বড় গঙ্গাদাসকে শ্যামসুন্দর জীউর সেবা ভার দিলেন। কয়েকদিন শ্রীজাহ্নবা মাতা বুধরি গ্রামে থাকবার পর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর জন্মস্থান দর্শনের জন্য একচক্রা গ্রামে এলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর জন্মস্থান দর্শন, পিতা হাড়াই পণ্ডিতের ও মাতা পদ্মাবতী দেবীর কথা শ্রবণ করতেই শ্রীজাহ্নবা মাতা শ্বশুর-শাশুড়ীর কথা স্মরণ পূর্ব্বক অশ্রুসিক্ত নয়নে ক্রন্দন করতে লাগলেন। স্থানীয় কোন ব্রাহ্মণ নিত্যানন্দ প্রভৃর বাল্যলীলা স্থান সকল দর্শনাদি করালেন।
যদ্যপি ভবন শূন্য ভগ্ন অতিশয়।
তথাপি কার না চিত্ত আকর্ষয়?
নিত্যানন্দ লীলাস্থলী করিয়া দর্শন।
হৈলা প্ৰেমাবিষ্ট যৈছে না হয় বর্ণন।।
সে দিবস ভগ্ন ভবনেতে বাস কৈলা।
শ্রীনাম-কীৰ্ত্তনে কথো রাত্রি গোঙাইলা।।
—শ্রীভক্তিরত্নাকর দশম তরঙ্গে)
একরাত্র একচক্রাপুরে থাকবার পর কন্টক নগরে এলেন। প্রভুর সন্ন্যাস স্থান দর্শন করে ঈশ্বরী ক্রন্দন করতে লাগলেন। তথা হতে যাজীগ্রামে শ্রীনিবাস আচার্য্য গৃহে প্রবেশ করলেন। শ্রীনিবাস আচার্য্য বৈষ্ণবগণসহ বহু ভক্তি পুরঃসর শ্রীঈশ্বরীকে অভ্যর্থনা পূৰ্ব্বক স্বীয় গৃহে নিলেন এবং তাঁর পূজাদি করলেন। আচার্য্য ভার্য্যাদ্বয় শ্রীঈশ্বরীর সেবায় নিমগ্ন হলেন। কয়েকদিন যাজীগ্রামে অবস্থান করে শ্রীঈশ্বরী শ্রীনবদ্বীপে শ্রীগৌরসুন্দরের জন্মস্থান দর্শনে এলেন। এ সময়ে শ্রীগৌরগৃহে একমাত্র বৃদ্ধ শ্রীঈশান ঠাকুর ছিলেন। শ্রীগৌরসুন্দরের ভবনে প্রবেশ করতেই শ্রীঈশ্বরী প্রেমাবেশে মূৰ্চ্ছিত হয়ে পড়লেন। ভক্তগণ তাঁর তাদৃশ প্রেমাবেশ দেখে তাঁরাও প্রেমে ক্রন্দন করতে লাগলেন। মহাপ্রভুর ভবন থেকে শ্রীঈশ্বরী শ্রীবাস অঙ্গনে এসে তথায় রাত্রিবাস করলেন। রাত্রিকালে শ্রীবাস অঙ্গনে ভক্তগণ মহাসংকীর্তন নৃত্যাদি করলেন। শ্রীঈশ্বরী রাত্রে স্বপ্নে শ্রীগৌরসুন্দরের ভক্তগণসহ বিচিত্র লীলা বিলাসাদির দর্শন পেলেন। পরদিন বার বার নবদ্বীপ ধামকে বন্দনা করে অম্বিকা কালনা অভিমুখে যাত্রা করলেন।
পুনঃ শ্রীজাহ্নবা মাতার শুভাগমনে অম্বিকাবাসী ভক্তগণ আনন্দে আত্মহারা হলেন। শ্রীঈশ্বরী শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিতকে স্মরণ পূর্ব্বক ক্রন্দন করতে করতে শ্রীগৌড়-নিত্যানন্দের শ্রীপাদপদ্মযুগল বন্দনা করলেন। ভক্তগণ সংকীর্ত্তন আরম্ভ করলে সে মহাসংকীর্তনে শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের আবির্ভাব হল। রাত্রে ঈশ্বরী রন্ধনপূর্ব্বক শ্রীগৌর-নিত্যানন্দকে ভোগ অর্পন করলেন। সেই প্রসাদ ভক্তগণকে পরিবেশন করে স্বয়ং গ্রহণ করলেন। রাত্রে বিশ্রামকালে, স্বপ্নে শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিত ও শ্রীগৌরনিত্যানন্দের দর্শন পেলেন। সকলেই শ্রীজাহ্নবা মাতাকে আশীর্ব্বাদ করলেন।
পরদিবস শ্রীজাহ্নবা মাতা ভক্তদের থেকে বিদায় নিয়ে শ্রীউদ্ধারণ দত্ত ঠাকুরের গৃহে এলেন। তথায় একরাত্র মহোৎসব করবার পর নৌকা যোগে স্বীয় গৃহে খড়দহ গ্রামে পৌঁছালেন। খড়দহবাসী ভক্তগণের আনন্দের সীমা রইল না। অতি উল্লাসের সহিত সকলেই শ্রীজাহ্নবা মাতাকে দর্শন করবার জন্য অগ্রসর হলেন। ভক্তগণ সংকীৰ্ত্তনসহ শ্রীঈশ্বরীকে অভ্যর্থনা করলেন। পুত্র শ্রীবীরচন্দ্র ও কন্যা শ্রীগঙ্গা শ্রীঈশ্বরীর চরণ বন্দনা করতেই তিনি তাঁদের কোলে তুলে নিয়ে আনন্দে চিবুক ঘ্রাণ নিতে লাগলেন। ঈশ্বরী বসুধাদেবীকে প্রণাম করতেই উভয়ের প্রেমোচ্ছ্বাস হল। অতঃপর ঈশ্বরী ভক্তগণের কাছে ব্রজমণ্ডলের ও গৌড়মণ্ডলের যাবতীয় ভ্রমণ বৃত্তান্ত বলতে লাগলেন। শ্রীপরমেশ্বরী দাস শ্রীঈশ্বরীর সেবায় রইলেন। অন্যান্য বৈষ্ণবগণ বিদায় গ্রহণ করলেন।
শ্রীজাহ্নবা মাতা গৌড়মণ্ডল ও ব্রজমণ্ডল ভ্রমণ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে এক অপূর্ব কান্তি রেখে গেছেন। শ্রীজাহ্নবা মাতা প্রেমভক্তির আধার এবং অভিন্ন নিত্যানন্দ স্বরূপিণী। বহু পাপী পাষণ্ডীকে তিনি উদ্ধার করেছেন। তাঁর দিবা ঐশ্বর্য ও মাধুর্য্যে সকলেই আকৃষ্ট হয়েছেন। বৈশাখ শুক্লাষ্টমীতে শ্রীনিত্যানন্দ শক্তি শ্রীজাহ্নবা মাতা আবির্ভূত হন।
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর শ্রীজাহ্নবা মাতার শ্রীচরণে এইরূপ প্রার্থনা করেছেন—
ভবার্ণবে প’ড়ে মোর আকুল পরাণ।
কিসে কূল পা’ব তা’র না পাই সন্ধান।।
না আছে করম-বল, নাহি জ্ঞান-বল।
যাগ-যোগ-তপোধৰ্ম্ম – না আছে সম্বল।
নিতান্ত দুর্ব্বল আমি, না জানি সাঁতার।
এ বিপদে কে আমারে করিবে উদ্ধার।।
বিষয়-কুম্ভীর তাহে ভীষণ-দর্শন।
কামের তরঙ্গ সদা করে উত্তেজন।।
প্রাক্তন-বায়ুর বেগ সহিতে না পারি।
কাদিয়া অস্থির মন, না দেখি কাণ্ডারী।।
ওগো শ্রীজাহ্নবা দেবী! এ দাসে করুণা।
কর’ আজি নিজ গুণে, ঘুচাও যন্ত্রণা।।
তোমার চরণ-তরী করিয়া আশ্রয়।
ভবার্ণব পার হ’ব করেছি নিশ্চয়।।
তুমি নিত্যানন্দ-শক্তি কৃষ্ণভক্তি-গুরু।
এ দাসে করহ দান পদকল্পতরু।।
কত কত পামরেরে করেছ উদ্ধার।
তোমার চরণে আজ এ কাঙ্গাল ছার।।
—(কল্যাণকল্পতরু)