#gopalbhatta #gopal Gaudiya #Gaudiyamission

Appearance Day of Srila Gopal Bhatta Goswami

করুণাময় শ্রীগৌরহরি প্রেম বিতরণ করতে করতে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণ দেশের প্রতি নগরে নগরে শ্রীনাম-প্রেম বিতরণ করছেন। তাঁর শ্রীমুখনিঃসৃত হরিনামামৃত পান করে সহস্র সহস্র নরনারীর প্রাণ শীতল হয়। দীন হীন পতিত জনগণ কৃষ্ণ নামামৃত পান করে জীবন ধন্যাতিধন্য করল। শ্রীমহাপ্রভু নাম প্রেম বর্ষণ করতে করতে মহাতীর্থ শ্রীরঙ্গক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। শ্রীরঙ্গনাথ দেবের সুবিশাল গগনভেদী চূড়াযুক্ত শ্রীমন্দির। তার সাতটি প্রকার। দিন রাত লক্ষ লক্ষ দর্শকের সমাগম। ব্রাহ্মণগণ দ্বারা উচ্চারিত মন্ত্রধ্বনিতে মন্দিরটী সর্ব্বদা মুখরিত। শ্রীগৌরসুন্দর যখন সে মন্দিরে কোটী গন্ধর্ব বিনিন্দিত সুমধুর কণ্ঠে “হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ” নামকীর্ত্তন ধরলেন, সকলে স্তম্ভিত, বিস্মিত ও পুলকিত হয়ে উঠলেন। কি অপূৰ্ব্ব শ্রীমূর্তিখানি, যার কাছে তপ্ত সোনার কান্তিও নিষ্প্রভ হয়। তাতে প্রস্ফুটিত কমল তুল্য দীর্ঘ নয়নযুগল দিয়ে দরদর করে প্রেমবারি ঝরছে। প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সুষমা যেন মদনের মন হরণ করছে। ব্রাহ্মণগণ ভাবতে লাগলেন—এ কি কোন দেব? মনুষ্যের শরীরে কি এত অপূর্ব্ব ভাবের উদয় হতে পারে? পুনঃ ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ করে নেত্র নীরে ভাসতে ভাসতে যখন শ্রীবিগ্রহের সামনে বাতাহত তরুর ন্যায় পতিত হলেন, তখন মনে হল,— যেন কনকগিরি ভূতলে লুটাচ্ছে। শ্রীব্যেঙ্কট ভট্ট দিব্য পুরুষটিকে দেখে আর স্থির থাকতে পারলেন না। ভক্তিপ্লুত হৃদয়ে উঠে লোকজনকে সরিয়ে তিনি প্রভুর নৃত্য-কীৰ্ত্তনের সুবিধা করে দিতে লাগলেন। তারপর প্রভু যখন একটু স্থির হলেন, তখন বেঙ্কট তাঁর শ্রীচরণ রজঃ গ্রহণ করলেন। প্রভু তাঁর দিকে তাকিয়ে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে তাকে দৃঢ় আলিঙ্গন করলেন। শ্রীব্যেঙ্কট ভট্ট প্রভুকে আমন্ত্রণ করে স্বীয় গৃহে নিয়ে গেলেন। তাঁর শ্রীচরণ ধৌত করে উদক সপরিবারে পান করলেন। ভট্টের গৃহ আনন্দময় হল।
 
মহাপ্রভু ১৫১১ খৃষ্টাব্দে বোঙ্কট ভট্টের গৃহে আগমন করেছিলেন। ভট্টের ত্রিমল্লভট্ট ও প্রবোধানন্দ সরস্বতী নামে আরও দু’টি ভাই ছিলেন। শ্রীপ্রবোধানন্দ সরস্বতীপাদ ছিলেন শ্রীরামানুজ সম্প্রদায়ী ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাসী। শ্রীব্যেঙ্কট ভট্ট ও ত্রিমল্লভট্ট রামানুজ সম্প্রদায়ী বৈষ্ণব ছিলেন। শ্রীব্যেঙ্কট ভট্টের পুত্র শ্রীগোপাল ভট্ট। ইনি তখন শিশু। মহাপ্রভুর শ্রীচরণে প্রণাম করতে প্রভু তাঁকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। প্রভু ভোজনান্তর অবশেষ গোপালকে ডেকে দিলেন। এভাবে প্রসাদ দিয়ে তাঁকে ভবিষ্যৎ আচার্য্য পদবীতে অভিষিক্ত করলেন।
 
প্রভু যখন শ্রীরঙ্গক্ষেত্রে এলেন তখন চাতুম্মাস্য কাল। এ সময়টী প্রভৃ ভট্টের গৃহে যাপন করবার জন্য রইলেন। শ্রীরঙ্গক্ষেত্রে বহু ‘শ্রী’ সম্প্রদায়ী বৈষ্ণবের বাস, প্রভুর দিব্য-ভাব দেখে সকলে তাঁর প্রেমে আবিষ্ট হলেন। প্রতিদিন এক এক বৈষ্ণব-ব্রাহ্মণ-গৃহস্থ প্রভুকে ভোজন করাতেন। চার মাস কাল এরূপে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও অনেক বৈষ্ণব গৃহস্থ আমন্ত্রণ করবার সুযোগ পেলেন না।
 
প্রভু ভট্ট গৃহে অবস্থান করতেন। শ্রীগোপাল প্রতিদিন প্রভুর পরিচর্য্যা করতেন। ভট্ট শ্রীলক্ষ্মী-নারায়ণের উপাসনা করতেন। প্রভু তাঁদের সঙ্গে হাস্য পরিহাসাদি করতেন।
 
প্রভু বললেন—ভট্ট, তোমার লক্ষ্মী সাধ্বী শিরোমণি। আমার কৃষ্ণ গোপ, গো-চারক। তাঁর সঙ্গ কেন চান?
ব্যেঙ্কট ভট্ট বললেন –- কৃষ্ণ ও নারায়ণ একই স্বরূপ। কৃষ্ণেতে অধিক লীলা বৈদগ্ধ্যিতাদি গুণ আছে। তাঁর স্পর্শে পতিব্রতা ধর্ম যায় না, কৌতুক করে লক্ষ্মী তাঁর স্পর্শ করতে চান। এতে আপনি পরিহাস করছেন কেন?
প্রভু — লক্ষ্মীদেবী তপস্যা করে কৃষ্ণকে পেলেন না। শ্রুতিগণ তপস্যা করে কৃষ্ণ পেলেন কি করে?
ভট্ট— এ বিষয়ে আমি কিছু বুঝতে পারি না।
 
“তুমি সাক্ষাৎ সেই কৃষ্ণ, জান নিজ কর্ম।
 
যারে জানাহ, সেই জানে তোমার লীলা-মৰ্ম্ম।।”
 
(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ৯।১২৬)
 
প্রভু—কৃষ্ণের ইহাই বিশেষ লক্ষণ। স্বমাধুর্য্য দ্বারা সকলের চিত্ত আকর্ষণ করেন। কৃষ্ণকে একমাত্র ব্রজগোপীর ভাবে পাওয়া যায়। কৃষ্ণ নিত্য গোপরাজ-নন্দন। নিজেকে সতত গোপ অভিমান করেন। গোপীভিন্ন অন্য কাকেও তিনি স্পর্শ করেন না। লক্ষ্মীদেবী বৈকুণ্ঠেশ্বরী। তিনি কদাপি গোপীর আনুগত্য স্বীকার করতে চান না। শ্রুতিগণ গোপীর আনুগত্যের জন্য তপস্যা করে গোপগৃহে গোপকন্যারূপে জন্মগ্রহণ করবার পর শ্রীকৃষ্ণকে পেয়েছিলেন। লক্ষ্মীদেবী সে দেহে শ্রীনন্দ নন্দনের সঙ্গ চান। সেজন্য তপস্যা করেও তিনি পান নি। ব্রজবাসীগণ জানেন কৃষ্ণ ব্রজেন্দ্র নন্দন। কেহ পুত্র জ্ঞানে, কেহ মিত্র জ্ঞানে ও কেহ কান্ত জ্ঞানে হৃদয়ভরে স্নেহ করে। যশোদার শুদ্ধ বাৎসল্য, তাঁর ঐশ্বর্য্য দেখলেও মুগ্ধ হন না। তাতে তাঁর বাৎসল্য-প্রীতি আরও বেড়ে যায়। দেবকীর ঐশ্বর্য্য-মিশ্র বাৎসল্য, ঐশ্বর্য্য মুগ্ধ হয়ে স্তুতি করেন। ভগবান্ কেবল বাৎসল্যভাবে যত প্রীত হন ঐশ্বর্য্যমিশ্র ভাবে তত প্রীত হন না।
 
ব্রজবাসীগণ কৃষ্ণের ঐশ্বর্য্যে মুগ্ধ হন না, তাকে ভগবান বলে মানেন না। এভাবে ভগবান্ বড়ই প্রীত হন। শ্রীকৃষ্ণের বিলাস-মূর্তি শ্রীনারায়ণ। সেজন্য লক্ষ্মী প্রভৃতির মন হরণ করতে পারেন। কিন্তু শ্রীনারায়ণ গোপীগণের মন হরণ করতে পারেন না। এক সময় কৃষ্ণ গোপীগণের সঙ্গে বিলাস করতে করতে অন্তর্ধান হলেন। গোপীগণ কাতরভাবে কুঞ্জে কুঞ্জে অন্বেষণ করতে লাগলেন। কোথাও পেলেন না। কৃষ্ণ গোপীগণকে বঞ্চনা করবার জন্য এক কুঞ্জের মধ্যে চতুর্ভুজরূপে অবস্থান করতে লাগলেন। গোপীগণ অনেক খোঁজ করতে করতে সে কুঞ্জে এলেন। চতুর্ভুজধারীকে দেখলেন, নারায়ণ জ্ঞান করে নমস্কার করলেন এবং তার কাছে প্রার্থনা করলেন- হে নারায়ণ ! কৃপা করে নন্দনন্দনকে মিলিয়ে দাও। এ বলে গোপীগণ অন্যত্র কৃষ্ণ অণ্বেষণ করতে লাগলেন। অবশেষে শ্রীরাধা ঠাকুরাণী অনুসন্ধান করতে করতে সেখানে এলেন এবং মূর্ত্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। তখন কৃষ্ণ আর চতুর্ভুজ রাখতে পারলেন না, দ্বিভূজ হলেন।
 
শ্রীরাধা বললেন—হে সখি ললিতে ! শীঘ্র এস বংশীধারীকে পেয়েছি।
 
ললিতা—বংশীধারী কোথায়?
 
শ্রীরাধা—এই তো বংশীধারী।
 
ললিতা—উনি ত’ নারায়ণ?
 
বিশাখা—আমরা ত দেখে এলাম।
 
শ্রীরাধা— তোমরা কি চোখের মাথা খেয়েছ?
 
তখন সখিগণ সকলে সমবেত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ উচ্চ হাস্য করতে লাগলেন।
 
গোপীগণ কখন নারায়ণ স্বরূপ দেখে মুগ্ধ হন না।
 
ভট্ট-পরিবার প্রভুর শ্রীমুখে এবম্বিধ শ্রীকৃষ্ণ লীলা শ্রবণ করে যেন আনন্দ-সাগরে ভাসতে লাগলেন। ব্যেঙ্কট ভট্ট প্রভুর শ্রীচরণে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন। প্রভু তাঁকে তুলে আলিঙ্গন করলেন ও অনেক প্রশংসা করলেন।
 
ভট্টের গৃহে চার মাস প্রভু এরূপে কৃষ্ণ-কথা-রঙ্গে অতিবাহিত করলেন। তারপর বিদায় চাইলেন। ভট্ট-গৃহে ক্রন্দনের রোল উঠল। ভট্ট পুত্র শ্রীগোপাল কেঁদে প্রভুর শ্রীচরণ তলে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন। প্রভু আর কয়েক দিন থেকে প্রবোধ দিয়ে গোপালকে বললেন,— তুমি এখন গৃহে মাতা-পিতার সেবা কর। পরে বৃন্দাবনে এস। নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণ নাম শ্রবণ কীর্তন কর। প্রভু সকলকে এরূপ উপদেশ করে তীর্থ যাত্রা করলেন।
 
শ্রীগোপাল ভট্ট অল্পকাল মধ্যে ব্যাকরণ কাব্য অলঙ্কার ও বেদান্ত শাস্ত্রাদিতে পারদর্শী হলেন। তাঁর পিতৃব্য শ্রীপাদ প্রবোধানন্দ সরস্বতীপাদ বিশেষ করে ভক্তিশাস্ত্র শিক্ষা দিতে লাগলেন। “পিতৃব্য কৃপায় সৰ্ব্ব-শাস্ত্রে হৈল জ্ঞান। গোপালের সম এথা নাই বিদ্যাবান্।।” (ভক্তিরত্নাকর প্রথম তরঙ্গ)
 
প্রভুর শ্রীচরণ দর্শনের পর হতে শ্রীগোপাল ভট্টের মন নিয়ত প্রভুর চরণ চিন্তায় মগ্ন হল। কবে পুনঃ প্রভুর দর্শন পাব ? সর্ব্বদা এ চিন্তায় দিনাতিপাত করতেন। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ত্যাগ করে যেতে পারেন না। এরূপে কিছুদিন কেটে গেল। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর অন্তিম সময় উপস্থিত হল। গোপালকে ডেকে বললেন—বৎস ! আমার অন্তর্ধানের পর তুমি শ্রীমহাপ্রভুর শ্রীচরণে বৃন্দাবনে চলে যাও। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী এরূপ আদেশ করে শ্রীমন্মহাপ্রভুর চরণ স্মরণ করতে করতে স্বধামে প্রবেশ করলেন।
 
বৃন্দাবনে যাইতে পুত্রেরে আজ্ঞা দিয়া।
দোঁহে সঙ্গোপন হৈলা প্রভু সোঙরিয়া।।
 
– (ভক্তিরত্নাকর ১ম তরঙ্গ-১৬৪ শ্লোক )
 
 
বৈষ্ণব পিতা-মাতার অপ্রকটের পর শ্রীগোপল ভট্ট গোস্বামী বৃন্দাবনাভিমুখে যাত্রা করলেন। বৃন্দাবনে শ্রীগোপাল ভট্ট এলে শ্রীরূপ গোস্বামী পুরীতে প্রভুর নিকট তৎক্ষণাৎ লোক প্রেরণ পূর্ব্বক সংবাদ পাঠিয়ে দিলেন।
 
প্রভু শ্রীরূপ ও শ্রীসনাতনকে পুব্বেই জানিয়ে রেখেছিলেন বৃন্দাবনে শ্রীগোপল ভট্ট আগমন করবেন। শ্রীরূপ ও শ্রীসনাতন গোস্বামী তাঁকে আপন ভ্রাতার ন্যায় আদর-যত্ন করতে লাগলেন। তাদের মধ্যে অনবদ্য প্রেম-মৈত্র ভাব প্রকট হল।
 
শ্রীরূপ গোস্বামীর প্রেরিত লোক পত্রসহ পুরীতে মহাপ্রভুর সন্নিকট উপস্থিত হলেন। প্রভু পত্রখানি দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বৈষ্ণবগণের নিকট শ্রীগোপাল ভট্টের বিবরণ বলতে লাগলেন। প্রভু বৃন্দাবন থেকে শ্রীরূপ গোস্বামীর প্রেরিত লোকের দ্বারা শ্রীরূপের নিকট পত্র ও শ্রীগোপাল ভট্টের জন্য ডোর কৌপীন ও বহির্বাস প্রেরণ করলেন। শ্রীরূপ গোস্বামী সে লোকের মাধ্যমে প্রভুর পত্র ও শ্রীগোপাল ভট্টের জন্য কৌপীন বহির্বাসাদি পেয়ে অতিশয় আনন্দিত হলেন।
 
শ্রীগোপাল ভট্ট প্রভু-দত্ত ডোর-কৌপীন পেয়ে বড়ই সুখী হলেন। এবং উহা প্রভুর কৃপা-প্রসাদ জ্ঞানে ধারণ করলেন। শ্রীরূপের পত্রে কি কি করণীয় তাও জ্ঞাত হলেন। সেইভাবে তিনি চলতে লাগলেন। তিনিও শ্রীরূপ সনাতনের ন্যায় অনিকেত ছিলেন। কুঞ্জে কুঞ্জে রাত্রি যাপন করতেন এবং ভক্তি-গ্রন্থাদি অধ্যয়ন লিখনাদি কাজ করতেন।
 
শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী দ্বাদশটী শালগ্রাম সেবা করতেন। যেখানে যেতেন ঝোলায় করে নিয়ে যেতেন। তাঁর মনে শ্রীবিগ্রহ সেবার ইচ্ছা হল। এ সময় একজন ধনী ব্যবসায়ী শ্রীভট্ট গোস্বামীর দর্শনের জন্য এলেন। শেঠ শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামীকে দর্শন সম্ভাষণ করে বড়ই সুখী হলেন। শ্রীভগবানের সেবার জন্য বহু উপকরণ বস্ত্রালঙ্কার অর্পণ করলেন। শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী সমস্ত দ্রব্য শালগ্রামের সামনে রেখে দিলেন।
 
শেঠজী শ্রীগোস্বামিপাদের থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন। শ্রীভট্ট গোস্বামী সন্ধ্যাকালে শালগ্রামের আরতি করলেন এবং ভোগাদি অর্পণ করে শালগ্রামগণকে শয়ণ দিলেন। উপরে একখানি ঝুড়ি চাপা দিলেন। শ্রীগোস্বামিপাদ কিছু রাত্র পর্য্যন্ত ভজনাদি করবার পর কিছু সামান্য প্রসাদ নিয়ে শয়ন করলেন। প্রাতঃকালে যমুনা স্নান করে যখন শালগ্রাম জাগরণ করতে গেলেন, ঝুড়ি তুলে দেখলেন, শালগ্রামগুলির মধ্যে একটী শালগ্রাম দিব্য বংশীধারণ করে ত্রিভঙ্গরূপে অবস্থান করছেন। শ্রীভট্ট গোস্বামী সে অপূর্ব্ব শ্রীমূর্ত্তি দর্শন করে আনন্দ সাগরে ভাসতে লাগলেন। সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করে বিবিধ স্তব ও স্তুতি করতে লাগলেন। এ শুভ সংবাদ শুনে শ্রীরূপ গোস্বামী, শ্রীসনাতন গোস্বামী ও অন্যান্য বৈষ্ণব গোস্বামিগণ শীঘ্র তথায় উপস্থিত হলেন এবং ভুবনমোহন রূপ দর্শন করে প্রেমাশ্রু ধারায় সিক্ত হতে লাগলেন। সম্বৎ ১৫৯৯, খৃষ্টাব্দ ১৫৪২ বৈশাখী পূর্ণিমাতে এ শ্রীবিগ্রহ প্রকট হন। গোস্বামিগণ নামকরণ করলেন—“শ্রীরাধারমণ দেব।”
 
কোন সময় শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী হরিদ্বারের নিকট সাহারণ পুরে দেববন্দ্য গ্রামে শুভ বিজয় করেন। একদিন গ্রামাত্তরে এক ভক্ত-গৃহে শুভ বিজয় করছেন। অপরাহু কাল হঠাৎ বৃষ্টি আরম্ভ হল। পথে এক ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় নিলেন। ব্রাহ্মণটি পরম ভক্তিমান। শ্রীভট্ট গোস্বামীকে খুব আদর যত্ন করতে লাগলেন। গোস্বামিপাদ তাতে খুব সুখী হলেন। ব্রাহ্মণটী অপুত্রক ছিলেন। তিনি আশীর্ব্বাদ করলেন, তোমার হরি-ভক্তিপরায়ণ পুত্র হবে। ব্রাহ্মণ বললেন—প্রথম পুত্র আপনার সেবার জন্য দিব।
 
শ্রীভট্ট গোস্বামী কিছুদিন সাহারণপুরে হরিনাম প্রচার করে বৃন্দাবনে ফিরে এলেন। আসবার সময় গণ্ডকী নদী থেকে বারটী শালগ্রাম এনেছিলেন।
 
সে বারটী শালগ্রামের মধ্যে একটা মূর্তি প্রকট করে শ্রীরাধারমণদের নাম। ধারণ করেন।
 
প্রায় দশ বছর পরের কথা। একদিন শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী মধ্যাহ্নকালে যমুনা স্নান করে ভজন কুটিরে ফিরছেন। দূর থেকে দেখলেন একটী শিশু দরজায় বসে আছে। শিশুটী শ্রীগোস্বামিপাদকে দেখে গাত্রোত্থান করলেন, তাঁকে দণ্ডবৎ করলেন। শ্রীভট্ট গোস্বামী জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কে? কুমারটি উত্তর করল আমি সাহারণপুর দেববন্দ্য গ্রাম থেকে এসেছি।।
 
শ্রীভট্ট গোস্বামী – তোমার পিতার নাম কি? কেন আমার কাছে এসেছ? কুমার বললে আপনার সেবা করবার জন্য পিতা আমাকে পাঠিয়েছেন। আমার নাম গোপীনাথ। তখন শ্রীভট্ট গোস্বামী পূর্ব্ব কথাসমূহ মনে পড়ল। বালকটিকে সেবক করে রেখে দিলেন। গোপীনাথ অতি সাবধানে শ্রীভট্ট গোস্বামীর সেবা করতে লাগলেন।
 
পরবর্তীকালে শ্রীগোপীনাথ পূজারী গোস্বামী নামে পরিচিত হন। ব্রহ্মচারীরূপে ইনি আজীবন শ্রীরাধারমণ দেবের সেবা করেছিলেন। এঁর ছোট ভাই শ্রীদামোদর দাস স-পরিবার শ্রীগোপীনাথজীর নিকট থেকে মন্ত্র দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং শ্রীরাধারমণ দেবের সেবায় নিযুক্ত হন। শ্রীদামোদর দাসের তিন পুত্র হরিনাথ, মথুরানাথ ও হরিরাম।
 
শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী শ্রীরাধারমণ দেবের সেবা করতে করতে মহাপ্রভুর কথা স্মরণে বিহ্বল হতেন। শ্রীভট্টের দু’নয়ন দিয়ে অশ্র-ধারা ঝরত । তখন শ্রীরাধারমণ দেব শ্রীগৌরাঙ্গস্বরূপে শ্রীভট্টকে দর্শন দিতেন।
 
গোপালের প্রেমাধীন শ্রীরাধারমণ।
শ্রীগৌরসুন্দর মূর্ত্তি হৈলা সেইক্ষণ।।
 
(শ্রীভক্তিরত্নাকর ৪র্থ তরঙ্গ – ৩৪৫ শ্লোক)
 
শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী শ্রীনিবাস আচার্য্যকে মন্ত্র-দীক্ষা প্রদান করেন। শ্রীমদ্ সনাতন গোস্বামী শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামীর নামে শ্রীহরিভক্তিবিলাস রচনা করেন। শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামীর ষট্ সন্দর্ভের কারিকা, কৃষ্ণকর্ণামৃতের টীকা, সৎ ক্রিয়াসার দীপিকা প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।
 
শ্রীগৌরগণোদ্দেশ দীপিকায় শ্রীকবি কর্ণপুর গোস্বামী লিখেছেন—
 
অনঙ্গমঞ্জরী সাদ্য গোপাল ভট্টকঃ ।
ভট্ট গোস্বামিনাং কোচিদাহুঃ শ্রীগুণ মঞ্জুরী।।
 
যিনি পূর্ব্বে ব্রজে অনঙ্গ মঞ্জরী ছিলেন, তিনিই বর্তমানে শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী। কেহ কেহ বলেন ভট্ট গোস্বামী শ্রীগুণ মঞ্জরী ছিলেন। জন্ম শকাব্দ ১৪২৫, খৃষ্টাব্দ ১৫০৩ পৌষ কৃষ্ণ-তৃতীয়া।
 
শ্রীমদ্ গোপাল ভট্ট গোস্বামী ৭৫ বছর প্রকট ছিলেন। শকাব্দ ১৫০০, খৃষ্টাব্দ ১৫৭৮ শ্রাবণ কৃষ্ণ-ষষ্ঠী তিথিতে শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামিপাদ অপ্রকট হন।
 
শ্রীগোপাল ভট্টের রচিত শ্লোক—
 
ভাণ্ডীরেশ শিখন্ডমন্ডন বর শ্রীখণ্ডলিপ্তাঙ্গ হে !
বৃন্দারণ্য পুরন্দর স্ফুরদমন্দেন্দীবর-শ্যামল।।
কালিন্দীপ্রিয় নন্দনন্দন পরানন্দারবিন্দেক্ষণ।
শ্রীগোবিন্দ মুকুন্দ সুন্দরতনো মাং দীনমানন্দয়।।
 
(পদ্যাবলী)
“শ্রীগোপাল ভট্ট আশ,
বৃন্দাবন কুঞ্জে বাস,
শয়ন স্বপন নয়নে হেরি’
ভুলল মন আপ হেঁ।
শাঙ্গর চীত উনতে নাগিও
পলকন নারে আঁখি।
যুথ যুথ,মন মথ ঝুলত,
গোপাল ভট্ট ইথে সাখি।।
ঐছে হট পুনঃ উলটি বৈঠলি,
কানুক বদন নিতান্ত না হেরলি,
গোপাল ভট্ট ভনয়ে,
ভামিনী পীরিতি টুটলো গো।।”
 
 

Date

Jan 10 2023
Expired!

Time

All Day
Category