Appearance Day of Srila Iswarpuripad
শ্রীমদ্ শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন – জয় শ্রীমাধবপুরী কৃষ্ণপ্রেমপুর। ভক্তিকল্পতরুর তেঁহো প্রথম অঙ্কুর।। শ্রীঈশ্বর পুরী-রূপে অঙ্কুর পুষ্ট হৈল। আপনে চৈতন্যমালী স্কন্ধ উপজিল।। –(চৈঃ চঃ আদি ৯ম পরিঃ ১০-১১ শ্লোঃ) শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের আদি লীলার নবম পরিচ্ছেদের একাদশ শ্লোকের অনুভাষ্যে শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর লিখেছেন— “শ্রীঈশ্বরপুরী কুমারহট্টে (ই,বি, আর লাইনে হালিশহর ষ্টেশন) বিপ্রকূলে উদ্ভূত ও শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীর প্রিয়তম শিষ্য।” জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় শ্রীঈশ্বর পুরীর আবির্ভাব। শ্রীমদ্ ঈশ্বর পুরীপাদ স্বয়ং কিরূপে শ্রীগুরুপাদপদ্মের সেবা করতেন, তদ্বিষয়ে শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী এরূপ লিখেছেন— “ঈশ্বরপুরী গোসাঞি করে শ্রীপাদ সেবন। স্বহস্তে করেন মলমূত্রাদি মাৰ্জ্জন।। নিরন্তর কৃষ্ণনাম করায় স্মরণ। কৃষ্ণনাম, কৃষ্ণলীলা শুনায় অনুক্ষণ।। তুষ্ট হঞা পুরী তাঁরে কৈলা আলিঙ্গন। বর দিলা—‘কৃষ্ণে তোমার হউক প্রেমধন’।। সেই হৈতে ঈশ্বরপুরী—’প্রেমের সাগর’। রামচন্দ্রপুরী হইল সর্ব নিন্দাকর।।” –(চৈঃ চঃ অন্তঃ ৮ম ২৮-৩১) পূর্ব্বে এক সময় শ্রীঈশ্বরপুরী তীর্থ ভ্রমণ করতে করতে নবদ্বীপ পুরে আগমন করেন এবং শ্রীগোপীনাথ আচার্য্যের গৃহে অবস্থান করেন। তখন শ্রীগৌরসুন্দর অধ্যয়ন সুখে অবস্থান পূর্ব্বক জননী শ্রীশচীদেবীর আনন্দ বর্দ্ধন করছেন। শ্রীঈশ্বর পুরী ছদ্মবেশে নদীয়া পুরে এলেন। কৃষ্ণ-রসে পরম-বিহ্বল মহাশয়। একান্ত কৃষ্ণের প্রিয় অতি দয়াময়।। তান বেশে তানে কেহ চিনিতে না পারে। দৈবে গিয়া উঠিলেন অদ্বৈত-মন্দিরে।। (চৈঃ ভাঃ আদিঃ ১১শ অধ্যায়) যেখানে শ্ৰীঅদ্বৈত আচার্য্য শ্রীকৃষ্ণ সেবা করছেন সেখানে সাবধানে গিয়ে বসলেন। বৈষ্ণবের তেজ বৈষ্ণবের কাছে লুকান সম্ভব নয়। শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য বারবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন; শেষে জিজ্ঞাসা করলেন—বাপ ! তুমি কে? “বৈষ্ণব সন্ন্যাসী তুমি হেন লয় মনে।” শ্রীঈশ্বরপুরী অতিশয় দৈন্য ভরে উত্তর প্রদান করলেন— আমি শূদ্ৰাধম। দেখিবারে আইলাম তোমার চরণ।। বিপ্র শিরোমণি সন্ন্যাসী প্রবর শ্রীঈশ্বরপুরী কত দৈন্য ভরে উত্তর প্রদান করলেন। দৈন্যই সাধুর ভূষণ। শ্রীমুকুন্দ দত্ত তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছেন ইনি বৈষ্ণব সন্ন্যাসী। তখন শ্রীমুকুন্দ অতি সুস্বরে একটী শ্রীকৃষ্ণ লীলা কীর্ত্তন ধরলেন। শ্রীমুকুন্দের মধুর কণ্ঠধ্বনির কাছে কে স্থির থাকতে পারেন ? যেই মাত্র শুনিলেন মুকুন্দের গীতে। পড়িলা ঈশ্বরপুরী ঢলি পৃথিবীতে।। শ্রীঈশ্বরপুরী প্রেমে ঢলে পড়লেন ভূমির উপর। নয়নের জলে ধরাতল সিক্ত হতে লাগল। বৈষ্ণবগণ দেখে অবাক হলেন। পরে বলতে লাগলেন এমন কৃষ্ণভক্ত ত’ কখনও দেখিনি। শ্ৰীঅদ্বৈত আচার্য্য অমনি তাঁকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করলেন। তারপর সকলে চিনতে পারলেন ইনি শ্রীমাধবেন্দ্রের প্রিয় শিষ্য শ্রীঈশ্বরপুরী। সকলে আনন্দে ‘হরি’ ‘হরি’ ধ্বনি করতে লাগলেন। শ্রীঈশ্বরপুরী নবদ্বীপ নগরে অবস্থান করছেন। একদিন দৈবক্রমে পথে শ্রীগৌরসুন্দরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। মহাপ্রভু পাঠশালা থেকে গৃহে ফিরছেন। চাহেন ঈশ্বরপুরী প্রভুর শরীর। সিদ্ধ পুরুষের প্রায় পরম গম্ভীর।। শ্রীঈশ্বরপুরী একদৃষ্টে শ্রীগৌরসুন্দরের দিকে তাকিয়ে পরে জিজ্ঞাসা করলেন বিপ্রবর ! তোমার নাম কি? ঘর কোথায়? ও কি পুঁথি পড়াও? মহাপ্রভু দৈন্য ভরে শ্রীঈশ্বরপুরীকে নমস্কার করলেন। শিষ্যগণ বলতে লাগলেন—এঁর নাম শ্রীনিমাই পণ্ডিত। ঈশ্বর পুরী বললেন—তুমি সেই নিমাই পণ্ডিত! পুরী বড় হরষিত হলেন। মহাপ্রভু বিনীত ভাবে শির নীচু করে বললেন—শ্রীপাদ, কৃপা করে অদ্য আমার ঘরে চলুন। মধ্যাহ্নে তথায় প্রসাদ গ্রহণ করবেন। কত বিনয় ভাবে মধুর বাক্যে আমন্ত্রণ। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শ্রীঈশ্বরপুরী তাঁর গৃহে এলেন। মহাপ্রভু প্রণয় ভরে স্বহস্তে পুরীর চরণ ধৌত করে দিলেন। শ্রীশচীমাতা তাড়াতাড়ি বিবিধ নৈবেদ্য প্রস্তুত করে ভগবানকে নিবেদন করলেন। তারপর সে প্রসাদ শ্রীঈশ্বরপুরীপাদকে ভোজন করতে দিলেন। প্রসাদ অবশেষ মহাপ্রভু গ্রহণ করলেন। বিষ্ণু গৃহে বসে উভয়ে কিছুক্ষণ কৃষ্ণকথা বললেন। উভয়ের মন প্রেমে ভরপুর হয়ে উঠল। শ্রীঈশ্বরপুরী কয়েক মাস এইরূপে শ্রীগোপীনাথ আচার্য্যের ঘরে রইলেন। মহাপ্রভু নিত্য একবার তার শ্রীচরণ দর্শন করতে আসতেন। মাঝে মাঝে তাঁকে স্বীয় গৃহে আমন্ত্রণ করে নিতেন। তখন শ্রীগদাধর অতি শিশু। শ্রীঈশ্বরপুরী তাকে খুব স্নেহ করতেন। পুরীপাদ তাঁকে নিজকৃত ‘শ্রীকৃষ্ণলীলামৃত’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করাতেন। মহাপ্রভু রোজ সন্ধ্যাকালে শ্রীঈশ্বরপুরীকে প্রণাম করতে আসেন। একদিন শ্রীঈশ্বরপুরী মহাপ্রভুকে বলতে লাগলেন— তুমি পরম পণ্ডিত। আমি পুঁথি করিয়াছি কৃষ্ণের চরিত।। সকল বলিবা;– কোথা থাকে কোন দোষ। ইহাতে আমার বড় পরম সন্তোষ৷৷ শ্রীঈশ্বরপুরীপাদের এ কথা শুনে মহাপ্রভু হাস্য করতে করতে বলতে লাগলেন ভক্তবাক্য কৃষ্ণের বর্ণন। ইহাতে যে দোষ দেখে সেই পাপী জন।। ভক্তের কবিত্ব যেতে মতে কেনে নয়। সর্ব্বথা কৃষ্ণের প্রীতি তাহাতে নিশ্চয়।। ভক্ত যে ভাবেই শ্রীকৃষ্ণকে বর্ণন করুন না কেন, তাতেই শ্রীহরি প্রীত হন। ভক্তের বাক্যে যে দোষ দেখে শ্রীহরি তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। ভগবান কেবল ভাব গ্রহণ করেন। মহাপ্রভুর এ কথা শ্রবণে শ্রীঈশ্বরপুরীর ইন্দ্রিয় সমূহে যেন অমৃত সিঞ্চিত হল। শ্রীঈশ্বরপুরী বুঝতে পারলেন শ্রীনিমাই পন্ডিত অসাধারণ মহাপুরুষ। শ্রীঈশ্বর পুরী কিছুদিন নবদ্বীপ পুরে ভক্তসঙ্গে অবস্থান করে তীর্থ পর্যটনে বের হলেন। এদিকে শ্রীগৌরসুন্দর বিদ্যার বিলাস সমাপ্ত করে আত্মপ্রকাশ যুগধর্ম নাম প্রেম বিতরণ করবার ইচ্ছা করলেন। প্রথমে পিতৃ পিন্ড দানের ছলনা করে গয়া ধামে এলেন। সে সময় শ্রীঈশ্বর পুরী গয়৷ ধামে ছিলেন। মহাপ্রভু সর্ব্বত্র পিন্ড দানাদি শেষ করে যখন শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্মে পিন্ড দানের জন্য এলেন, তখন শ্রীপাদপদ্ম দর্শন করে এবং তাঁর মাহাত্ম্য শ্রবণ করে প্রেমাবেশে ধরাতলে মূৰ্চ্ছিত হয়ে পড়লেন। দৈবযোগে হঠাৎ শ্রীঈশ্বরপুরী সেখানে এলেন। শ্রীগৌরসুন্দরকে দেখে তিনি অবাক হলেন এবং শ্রীচন্দ্রশেখর আচার্য্যের নিকট সমস্ত কথা অবগত হ’লেন। কিছুক্ষণ পরে মহাপ্রভু চৈতন্য হলে সামনে ঈশ্বরপুরীপাদকে দেখলেন। অমনি উঠে তাঁকে দন্ডবৎ করলেন। শ্রীঈশ্বরপুরী শ্রীগৌরসুন্দরকে দৃঢ় আলিঙ্গন করলেন। দুজনার প্রেমাশ্রুতে দুজনে ভাসতে লাগলেন। মহাপ্রভু বলতে লাগলেন প্রভু বলে, গয়া যাত্রা সফল আমার। যতক্ষণে দেখিলাঙ চরণ তোমার।। তীর্থে পিন্ড দিলে সে নিস্তরে পিতৃগণ সেহ-যারে পিন্ড দেয়, তরে সেইজন।। তোমা দেখিলেই মাত্র কোটি পিতৃগণ। সেইক্ষণে সববিদ্ধ পায় বিমোচন। অতএব তীর্থ নহে তোমার সমান। তীর্থেরও পরম তুমি মঙ্গল প্রধান।। —(চৈঃ ভাঃ আঃ ১৭|৫০-৫৩) মহাপ্রভু দৈন্যভরে বলতে লাগলেন আমার সমস্ত তীর্থ ভ্রমণ আপনার দর্শন মাত্রই সিদ্ধ হয়েছে। আপনি তীর্থ সমূহের পরম তীর্থ স্বরূপ। আপনার চরণরজঃ তীর্থসমূহ প্রার্থনা করে। হে পুরীপাদ, আমি তাই আপনার শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাচ্ছি আপনি আমাকে সংসার সিন্ধু থেকে পার করুন ও শ্রীকৃষ্ণপাদ-পদ্মের অমৃত রস পান করান। সংসার সমুদ্র হৈতে উদ্ধারহ মোরে। এই আমি দেহ সমর্পিলাও তোমারে।। কৃষ্ণপাদপদ্মের অমৃতরস পান। আমারে করাও তুমি,—এই চাহি দান।। –(চৈঃ ভাঃ আ১৭৫৪-৫৫) এই উক্তি শ্রবণ করে শ্রীঈশ্বরপুরীপাদ বলতে লাগলেন— বলেন ঈশ্বরপুরী, শুনহ পণ্ডিত। তুমি যে ঈশ্বর অংশ জানিনু নিশ্চিত।। আমি তোমার পান্ডিত্য ও চরিত্র দেখেই বুঝতে পেরেছি তুমি ঈশ্বরের অংশে অবতীর্ণ। আমি আজ শুভ স্বপ্ন দেখেছিলাম তার ফল হাতে হাতে পেলাম। পণ্ডিত ! সত্য করে বলছি তোমাকে দর্শন করে আমি পরম আনন্দ লাভ করেছি। আমি যখন তোমাকে নবদ্বীপ পুরে দেখেছি তখন থেকে আমার চিত্ত কেবল তোমার চিন্তা ছাড়া যেন অন্য চিন্তা করতে চায় না। আমি সত্য করে বলছি, তোমার দর্শনে আমি কৃষ্ণ দর্শন সুখ পাচ্ছি। মহাপ্রভু এসব কথা শুনে নম্র শিরে বন্দনা করলেন এবং হাস্য করতে করতে বললেন—আমার পরম সৌভাগ্য। অন্য একদিন মহাপ্রভু বিনীত ভাবে শ্রীপুরীপাদের নিকট বললেন আমাকে কৃপা করে মন্ত্র দীক্ষা প্রদান করুন। মন্ত্র দীক্ষার অভাবে আমার চিত্ত বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পুরীপাদ মহাপ্রভুর কথা শ্রবণ করে অতিশয় আনন্দিত হয়ে বলতে লাগলেন— পুরী বলে,— মন্ত্ৰ বা বলিয়া কোন কথা? প্রাণ আমি দিতে পারি তোমারে সর্ব্বথা।। —(চৈঃ ভাঃ আদিঃ ১৭ অঃ ১০৬ শ্লোক) শ্রীঈশ্বরপুরী শ্রীগৌরসুন্দরকে মন্ত্র দীক্ষা প্রদান করলেন। একদিন শ্রীঈশ্বরপুরী দ্বিপ্রহরে মহাপ্রভুর বাসস্থলে এলেন। মহাপ্রভু তাঁকে দর্শন করে আনন্দে ভাসতে লাগলেন। দন্ডবৎ প্রভৃতি করে মধ্যাহ্ন করবার জন্য প্রার্থনা জানালেন। পুরী বললেন- তোমার হস্তের অন্ন ভোজন করা পরম সৌভাগ্যের কথা। মহাপ্রভু স্বহস্তে রন্ধন করে শ্রীঈশ্বরপুরীপাদকে বহু যত্ন করে ভোজন করালেন। ভোজনানন্তর পুরীপাদের শ্রীঅঙ্গে চন্দন লেপন করলেন এবং পুষ্প মাল্যাদি প্রদান করলেন। স্বয়ং ভগবান শ্রীগৌরসুন্দর জগতে শ্রীগুরু-পাদপদ্মের সেবা পরিচর্য্যা ধর্ম শিক্ষা প্রদান করলেন। মহতের পরিচর্য্যা ছাড়া কখনও কৃষ্ণপ্রেমভক্তি পাওয়া যায় না। শ্রীগুরু-পাদ-পদ্ম সেবাই ভক্তির দ্বার। শ্রীগৌরসুন্দর গয়া থেকে ফিরবার পথে কুমারহট্টে শ্রীঈশ্বরপুরীর জন্মস্থানে এসে প্রেম ভরে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। মহাপ্রভুর নয়নজলে ভূমি সিক্ত হল। পরিশেষে শুরু-পাদপদ্মের জন্মস্থানের ধূলা উড়নীতে বেঁধে নিয়ে নবদ্বীপ অভিমুখে চললেন। বললেন এ ধূলা আমার প্রাণ স্বরূপ। অতঃপর শ্রীগৌরসুন্দর সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন ও জননীর আদেশে শ্রীপুরী ধামে অবস্থান করতে লাগলেন। এ সময় শ্রীঈশ্বর পুরীও অন্তর্ধান লীলা করলেন। অপ্রকট কালে শ্রীঈশ্বর পুরী নিজ সেবক শ্রীগোবিন্দ ও কাশীশ্বর পন্ডিতকে মহাপ্রভুর নিকট যাওয়ার জন্য আদেশ দিলেন। মাধবেন্দ্র পুরীবর শিষ্যবর শ্রীঈশ্বর নিত্যানন্দ শ্রীঅদ্বৈত বিভু। ঈশ্বরপুরীকে ধন্য করিলেন শ্রীচৈতন্য জগদ্গুরু শ্রীগৌর মহাপ্রভু।]]