Appearance Day of Srila Shamananda Prabhu
“গৌরাঙ্গের সঙ্গিগণে, নিত্য সিদ্ধ করি জানে, সে যায় ব্রজেন্দ্র সুত পাশ।।”
শ্রীশ্যামানন্দ, শ্রীনিবাস ও শ্রীনরোত্তম, শ্রীগৌরসুন্দরের নিজজন ছিলেন। শ্রীগৌরকৃষ্ণের বাণী পৃথিবীতে প্রচার করবার জন্য তাঁরা অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু আবির্ভূত হন উৎকলে ধারেন্দা বাহাদুরপুরে। পিতার নাম শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল, মাতার নাম শ্রীদুরিকা । সদ্গোপ বংশে জাত শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডলের বহু পুত্র কন্যা গতাসু হবার পর এ পুত্র জন্মগ্রহণ করে। এজন্য এর নাম রাখা হয়েছিল দুঃখিয়া। সকলে বলতে লাগলেন এ ছেলে মহাপুরুষ হবে। চৈত্র পূর্ণিমার শুভক্ষণে শ্রীশ্রীজগন্নাথের কৃপায় এ জন্মেছে। বোধ হচ্ছে শ্রীজগন্নাথদেব জগতে নিজের কথা প্রচার করবার জন্য একে এনেছেন, একে যত্নে পালন কর। পুত্রটি মদনের ন্যায়। দর্শনে নয়ন মন জুড়িয়ে যায়।
ছেলের ক্রমে অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ ও বিদ্যারম্ভ প্রভৃতি হল। শিশুর অদ্ভুত মেধা দেখে পণ্ডিতগণ বিস্মিত হ’তে লাগলেন। বালক অল্প কাল মধ্যে ব্যাকরণ, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন। গ্রামবাসী বৈষ্ণবগণের মুখে শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের মহিমা শ্রবণ করতে করতে তাঁদের শ্রীচরণে বালকের প্রবল অনুরাগ উৎপন্ন হল। শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল পরম ভাগবত পুরুষ ছিলেন। তিনি পুত্রকে সর্ব্বদা গৌর-নিত্যানন্দের ভাবে আবিষ্ট দেখে মন্ত্র গ্রহণ করতে বললেন।
বালক বললো শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু আমার গুরু, তিনি অম্বিকা কালনায় আছেন। তাঁর গুরু শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিত। শ্রীগৌর-নিত্যানন্দ দুই ভাই তাঁর গৃহে নিত্য বিরাজ করছেন। যদি আজ্ঞা দেন, তথায় গিয়ে তাঁর শিষ্য হই।
শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল বললেন, দুঃখিয়া! তুমি সেখানে কেমনে যাবে?
দুঃখিয়া—বাবা। দেশের অনেক লোক গৌড় দেশে গঙ্গাস্নান করতে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে যাব।
পিতা অনেকক্ষণ চিন্তা করবার পর অনুমতি প্রদান করলেন। দুঃখিয়া পিতা মাতার আশীর্ব্বাদ নিয়ে গৌড় দেশ অভিমুখে যাত্রা করল। ক্রমে নবদ্বীপ শান্তিপুর হয়ে অম্বিকা কালনায় এল এবং লোক মুখে জিজ্ঞাসা করে শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিতের ভবনে এল। মহাপ্রভুর মন্দিরের বহির্দ্বারে দণ্ডবৎ করতেই শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু বাহিরে এসে তার দিকে তাকিয়ে বললেন তুমি কে?
দুঃখিয়া বললে— আমি আপনার শ্রীচরণ সেবা করতে এসেছি। ধারেন্দা বাহাদুরপুরে আমার নিবাস। সদ্গোপ বংশে আমার জন্ম। পিতার নাম শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল। আমার নাম দুঃখিয়া।
শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু বালকের মধুর আলাপে সুখী হলেন। বললেন এখন থেকে তোমার নাম হল কৃষ্ণদাস। আমি অদ্য প্রাতঃকাল থেকে অনুভব করছিলাম কেহ আসবে।
শ্রীকৃষ্ণদাস খুব নিষ্ঠার সহিত সেবা করতে লাগলেন। শুভ দিন দেখে শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু তাঁকে মন্ত্র দীক্ষা প্রদান করলেন। হৃদয় চৈতন্য প্রভু কৃষ্ণদাসের সেবা নিষ্ঠা ভক্তি এবং অগাধ বুদ্ধি মেধা দেখে তাঁকে বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট যেতে আদেশ করলেন এবং তাঁর নিকট গোস্বামী গ্রন্থ প্রভৃতি পড়তে নির্দেশ দিলেন।
শ্রীকৃষ্ণদাস নত শিরে বৃন্দাবনে যেতে স্বীকৃত হলেন। শুভদিন দেখে শ্রীবৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করলেন। যাবার সময় শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু তাঁকে অনেক কথা বললেন ও বৃন্দাবনবাসী গোস্বামিদিগের শ্রীচরণে দণ্ডবন্নতি জ্ঞাপন করলেন। দুঃখী কৃষ্ণদাস প্রথমে নবদ্বীপে এলেন। লোককে জিজ্ঞাসা করে মায়াপুরে শ্রীজগন্নাথ মিশ্র ভবনে প্রবেশ করলেন। গৌর গৃহে শ্রীঈশান ঠাকুরকে দর্শন পূৰ্ব্বক সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করলেন। বৃদ্ধ ঈশান ঠাকুর “কে তুমি” বলে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। কৃষ্ণদাস সমস্ত পরিচয় প্রদান করলেন। শুনে ঈশান ঠাকুর তাঁকে প্রচুর আশীর্ব্বাদ করলেন। এক দিবস নবদ্বীপে অবস্থান করবার পর তিনি মথুরা অভিমুখে যাত্রীগণ সহ যাত্রা করলেন। পথে গয়া ধামে শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শন এবং মহাপ্রভুর শ্রীঈশ্বর পুরী হতে মন্ত্রাদি গ্রহণ প্রভৃতির কথা স্মরণ পূর্ব্বক প্রেমে বিহ্বল হলেন। তথা হতে কাশী ধামে এলেন এবং তপন মিশ্র, চন্দ্রশেখর আদি ভক্তগণের চরণ দর্শন এবং বন্দনাদি করলেন। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণদাসকে প্রচুর আশীর্ব্বাদ করলেন। অনন্তর তিনি মথুরা ধামে প্রবেশ করলেন বিশ্রাম ঘাটে স্নান, আদি কেশব দর্শন করলেন ও শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানে প্রেমে গড়াগড়ি দিলেন। তথা হতে শ্রীবৃন্দাবনের দিকে চললেন। লোক মুখে শ্রীজীব গোস্বামীর কুটীরের ঠিকানা জেনে তথায় পৌঁছিলেন এবং শ্রীমদ্ জীব গোস্বামীর শ্রীপাদপদ্ম সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করলেন। শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। কৃষ্ণদাস সবিশেষ পরিচয় প্রদান করলেন। শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু কৃষ্ণদাসকে তার কাছে সমর্পণ করেছেন—”দুঃখী কৃষ্ণ দাস শিষ্যে সঁপিলু তোমারে। ইহার যে মনোভীষ্ট পুরিবে সৰ্ব্বথা।কত দিন পরে পুনঃ পাঠাইবে এথা।।” (ভক্তি রত্নাকর ১৪09)
শ্রীজীব গোস্বামী, শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু দুঃখী কৃষ্ণদাসকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন, জোনে অতিশয় সুখী হলেন। শ্রীকৃষ্ণদাসকে তাঁর কাছে রাখলেন। শ্রীকৃষ্ণদাস সাবধানে শ্রীজীব গোস্বামীর সেবা এবং গোস্বামী গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে লাগলেন। শ্রীনিবাস ও শ্রীনরোত্তম প্রভু পূৰ্ব্ব হতেই শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট এসেছিলেন এবং গোস্বামী গ্রন্থ অধ্যয়ন করছিলেন। শ্রীকৃষ্ণদাসের তাঁদের সঙ্গে মিলন হল।
শ্রীকৃষ্ণদাস শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট সেবা প্রার্থনা করলেন। শ্রীজীব গোস্বামী উল্লাসের সহিত বললেন তুমি প্রতিদিন কুঞ্জ কানন ঝাড়ু দিবে। দুঃখী কৃষ্ণদাস সেদিন থেকে অতি প্রীতি সহকারে কুঞ্জ ঝাড়ু দিতে লাগলেন। সেবার সুযোগ পেয়ে স্বীয় জীবনকে কৃতার্থ মনে করতে লাগলেন। কুঞ্জ ঝাড়ু দিতে দিতে আনন্দে দুর্নয়ন দিয়ে অশ্রু পড়ত। কখন শ্রীরাধাগোবিন্দের নাম উচ্চেঃস্বরে কীর্ত্তন ও কখন লীলা স্মরণ করতে করতে জড়বৎ অবস্থান করতেন। তিনি কখন কখন রজঃকণাযুক্ত ঝাড়ু খানি শিরে ধারণ তেন। এ রজঃকণা ব্রহ্মা শিবও কামনা করেন।কর
দুঃখী কৃষ্ণদাস এ রূপে কুঞ্জ ঝাড়ু সেবা করতে লাগলেন। তাঁর সেবায় ব্রজেশ্বর ও ব্রজেশ্বরী সুখী হলেন। তাঁকে দর্শন দিতে ইচ্ছা করলেন। একদিন কৃষ্ণদাস প্রেম ভরে কুঞ্জ ঝাড় দিচ্ছেন। এমন সময় দেখলেন কুঞ্জ মধ্যে পড়ে আছে এক অপূর্ব নৃপুর। তিনি বিস্ময়ান্বিত ভাবে নৃপুরখানি তুলে শিরে ঠেকালেন ও আনন্দ ভরে ওড়নীর অঞ্চলে বেঁধে রাখলেন, যাঁর নূপুর তিনি খোঁজ করতে এলে দিবেন।
এদিকে সখিগণ প্রাতঃকালে শ্রীরাধা ঠাকুরাণীর বাম পদে নূপুর না দেখে অবাক হলেন। শ্রীরাধা ঠাকুরাণী বললেন—নিশাকালে কুঞ্জে নৃত্য করবার সময় নূপুরখানি তথায় পড়েছে; তোমরা অনুসন্ধান করে এনে দাও। অনুসন্ধান করতে করতে বিশাখা দেবী কুঞ্জে এলেন এবং কৃষ্ণদাসকে কুঞ্জ ঝাড় দিতে দেখলেন।
বিশাখা দেবী জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কি একখানি নৃপুর পেয়েছে?
দুঃখী কৃষ্ণদাস স্বর্গচ্যুত দেবীর ন্যায় অপূৰ্ব্ব কান্তিযুক্তা সে দেবীর অমৃতের ন্যায় মধুর কথা শুনে স্তম্ভিত ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। বিশাখা দেবী আবার জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কি একখানি নূপুর পেয়েছ? দুঃখী কৃষ্ণদাস নমস্কার করে বিনীত ভাবে বললেন—হ্যাঁ পেয়েছি। আপনি কে? আমি গোপকন্যা। কোথায় থাকেন? এ গ্রামে থাকি। নুপুরখানি আপনার? আমার নয়। আমার ঘরের এক নব বধুর। এখানে কি করে পড়ল? কাল কুঞ্জে ফুল তুলতে এসেছিল, পা থেকে পড়ে গেছে। যাঁর নুপুর তিনি এসে নিয়ে যান। বিশাখা দেবী বললেন তুমি দাঁড়াও।
কিছুক্ষণ পরে বিশাখা দেবীর সঙ্গে শ্রীরাধা ঠাকুরাণী এলেন এবং একটি বৃক্ষের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলেন। বিশাখা দেবী বললেন, ভক্ত! যার নূপুর তিনি এসেছেন। দুঃখী কৃষ্ণদাস দূর হতে শ্রীবৃষভানু নন্দিনীর অপূৰ্ব্ব কান্তিচ্ছটা দেখেই আত্মহারা হলেন। আনন্দে নূপুরখানি বিশাখা দেবীর হাতে দিলেন। গূঢ় রহস্য তিনি কিছু অনুভব করতে পারলেন। প্রেমাশ্রুপূর্ণ নয়নে সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করলেন। আনন্দে রজে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। তখন বিশাখা দেবী বলতে লাগলেন- হে ভক্তবর! আমাদের সখী তোমাকে কৃতজ্ঞতার স্বরূপ কোন বর দিতে চান।
দুঃখী কৃষ্ণদাস বললেন অন্য কোন বর চাই না। কেবল শ্রীচরণ রজঃ প্রার্থনা করি।
বিশাখা বললেন ঐ কুণ্ডে স্নান করে এসো।
দুঃখী কৃষ্ণদাস কুণ্ড-স্নানে চললেন, নমস্কার করে কুণ্ডে যেমনি অবগাহন করলেন অমনি এক সুন্দরী মূর্তি হলেন ও বিশাখা দেবীর কাছে ফিরে এসে, বন্দনা করলেন। বিশাখা দেবী সে নব সখীকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীরাধা ঠাকুরাণীর নিকট এলেন। নব সখী শ্রীরাধা ঠাকুরাণীর শ্রীপাদপদ্মমুলে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন।
সখিগণ তাঁকে ধরে সামনে বসালেন। শ্রীরাধা ঠাকুরাণী চরণের কুমকুম দিয়ে নূপুর দ্বারা তিলক করে দিলেন বললেন এ তিলক তোর ললাটে থাকবে। আজ থেকে তোর নাম হবে “শ্যামানন্দ। তুই চলে যা” শ্রীরাধা ঠাকুরাণী এ বলে সখীদিগের সঙ্গে অন্তর্ধান হলেন। দুঃখী কৃষ্ণদাসের সমাধি ভাঙল। দেখলেন ললাটে নূপুরের উজ্জ্বল তিলক রয়েছে। তিনি ভাবাবিষ্ট হৃদয়ে কি দেখলাম! কি দেখলাম। বলে কিছুক্ষণ ক্রন্দন করলেন। তারপর শ্রীরাধা ঠাকুরাণীর উদ্দেশ্যে শত শত বার বন্দনা করে শ্রীজীব গোস্বামীর শ্রীচরণে ফিরে এলেন।
শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী তাঁর ললাটে নূতন ধরণের উজ্জ্বল তিলক দেখে অবাক হলেন এবং কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। দুঃখী কৃষ্ণদাস দণ্ডবৎ করে সজল নয়নে সমস্ত ঘটনা বললেন। শ্রীজীব গোস্বামী শুনে পরম সুখী হলেন, বললেন— লোকের কাছে এ সব কথা প্রকাশ কর না। আজ থেকে তোমার নাম শ্যামানন্দ হল।
দুঃখী কৃষ্ণদাসের নাম, তিলক বদলে গেছে দেখে বৈষ্ণবদিগের মধ্যে অনেক কথোপকথন হতে লাগল। ক্রমে ক্রমে সে কথা গৌড় দেশে অম্বিকা কালনায় এল। শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু শুনে ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি শীঘ্র ছুটে এলেন বৃন্দাবনে। কৃষ্ণদাস কই? কৃষ্ণদাস সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করে পড়লেন শ্রীগুরু পাদপদ্মে। শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু তাঁর তিলক দেখে রেগে অস্থির হয়ে বলতে লাগলেন— তুমি আমার সঙ্গে গর্হিত আচরণ করছ। তিনি গালি দিতে দিতে প্রহার করতে লাগলেন, বৈষ্ণবগণ শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভুকে ধরে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করলেন। দুঃখী কৃষ্ণদাস অম্লান বদনে সব সহ্য করে গুরুর সেবা করতে লাগলেন।
শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু সে-দিবস রাত্রে স্বপ্নে দেখলেন শ্রীরাধা ঠাকুরাণী স্বয়ং তাকে তিরস্কার করে বলছেন—“আমি দুঃখী কৃষ্ণদাসের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে তিলক করে দিয়েছি ও তার নাম বদলিয়েছি। তাতে অন্যের কিছু বলার কি আছে?” হৃদয় চৈতন্য প্রভু শ্রীব্রজেশ্বরীর শ্রীচরণে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং নিজেকে অপরাধী মনে করতে লাগলেন।
আতঃপর প্রাতঃকালে শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু শ্যামানন্দকে ডেকে কোলে তুলে নিলেন, স্নেহে বারংবার আলিঙ্গন করতে লাগলেন। প্রেমাশ্র, নেত্রে বললেন তুমি ধন্য। শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু কিছু দিন ব্রজ ধামে রইলেন। শ্রীশ্যামানন্দকে আর কিছুদিন জীব গোস্বামীর নিকট থাকবার আদেশ দিয়ে তিনি গৌড় দেশে ফিরে এলেন।
শ্রীশ্যামানন্দ, শ্রীনিবাস ও শ্রীনরোত্তম তিন জন আনন্দে শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট গোস্বামী গ্রন্থ অধ্যয়ন ও ব্রজে মাধুকরী করে দিন কাটাতে লাগলেন। তিনজন ব্রজে মাধুকরী করে একান্তে ভজন করবেন—এইরূপ দৃঢ় নিশ্চয় হলেন।
এদিকে গোস্বামিগণ মন্ত্রণা করলেন এই তিনজনের দ্বারা গৌড় দেশে মহাপ্রভুর বাণী প্রচার এবং গোস্বামী গ্রন্থ প্রচার করতে হবে। একদিন শ্রীজীব গোস্বামী তিনজনকে ডেকে গোস্বামিগণের নির্দেশ জানালেন। তিনজন সে আদেশ অবনত শিরে ধারণ করলেন। অতঃপর শুভ দিন দেখে শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী গোস্বামী-গ্রন্থ সহ তিনজনকে গৌড় দেশে প্রেরণ করলেন। পথে বনবিষ্ণুপুরে রাজা বীর হাম্বীর গ্রন্থ হরণ করলেন। সেই গ্রন্থ উদ্ধারের জন্য তথায় শ্রীনিবাস আচার্য্য রইলেন। শ্রীনরোত্তম ঠাকুর খেতরিতে এবং শ্যামানন্দ অম্বিকা কালনায় চলে এলেন। শ্রীশ্যামানন্দ হৃদয় চৈতন্য প্রভুর চরণ বন্দনা করতেই তিনি সানন্দে তাকে কোলে তুলে নিলেন এবং ব্রজস্থিত গোস্বামিগণের কুশল বার্তাদি জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। পরিশেষে গ্রন্থ অপহরণ বার্তা শুনে বড়ই মর্মাহত হলেন। শ্যামানন্দ শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভুর শ্রীচরণ সেবা করতে লাগলেন। কিছুদিন শ্যামানন্দের সুখে শুরু সেবা করতে করতে দিন কেটে গেল। উৎকল দেশের শ্রীগৌর ভক্তগণ প্রায় একে একে সব অপ্রকট হলেন। গৌরসুন্দরের বাণী প্রচার প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়ল। শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু এ সব কথা বিশেষ ভাবে অনুভব করলেন। অতঃপর তিনি শ্রীশ্যামানন্দকে গৌর বাণী প্রচারের জন্য উৎকল দেশে যাবার আজ্ঞা করলেন। শ্রীশ্যামানন্দ শ্রীগুরুদেবকে ছেড়ে যাবেন ভেবে বড়ই মর্মাহত হয়ে পড়লেন। শ্রীহৃদয় চৈতন৷ প্ৰভু তা বুঝতে পেরে তাকে ডেকে অনেক বুঝালেন। অগত্যা শ্রীশ্যামানন্দ গুরু বাণী শিরে ধরে উৎকলে যাত্রা করলেন। তিনি উৎকলের পথে ধারেন্দা বাহাদুরপুরে নিজ জন্মস্থানে এলেন। বহুদিন পরে গ্রামবাসিগণ তাঁকে দেখে অতিশয় সুখী হলেন। তিনি তথায় কয়েকদিন গৌর বাণী প্রচার করলেন। বহুলোক তা শুনে আকৃষ্ট হলেন এবং তাঁর চরণ আশ্রয় করলেন। তথা হতে দণ্ডেশ্বর নামক স্থানে এলেন। এখানে পূৰ্ব্বে শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল অবস্থান করতেন। দণ্ডেশ্বর গ্রামে শ্যামানন্দ প্রভুর শুভাগমনে ভক্তগণ পরম সুখ প্রাপ্ত হ’লেন। কয়েকদিন তিনি তথায় হরিকথা মহোৎসব অনুষ্ঠান করলেন। অনেক লোক তাঁর দিব্য বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে শিষ্য হলেন। উৎকল দেশে শ্রীশ্যামানন্দের শুভাগমনে পুনঃ সর্ব্বত্র গৌর বাণী প্রচার আরম্ভ হল।
সুবর্ণরেখা নদীর তটে শ্রীঅচ্যুতদেব নামে একজন ধর্মনিষ্ঠ জমিদারবাস করতেন। রসিক নামে তাঁর একমাত্র পুত্র ছিলেন। রসিক শিশুকালথেকে কৃষ্ণভক্তি পরায়ণ। তাঁকে অধ্যয়নের জন্য পিতা পণ্ডিতগণকে নিযুক্তনিযুক্ত করলেন। রসিক পণ্ডিতদের স্থানে অধ্যয়ন করতে লাগলেন। কিন্তু এ জগতের বিদ্যাকে তিনি বহুমানন করলেন না। হরি-ভক্তিই সর্ব্বোত্তম রূপে নির্ণয় করলেন।
শ্রীরসিক শুরু পাদপদ্ম আশ্রয় করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। একদিন নির্জনে বসে চিন্তা করছেন। এমন সময় দৈববাণী শ্রবণ করলেন— ‘রসিক! তুমি কোন চিন্তা কর না। এস্থানে অতি শীঘ্র শ্রীশ্যামানন্দ নামে এক মহাভাগবত পুরুষ আগমন করবেন, তুমি তাঁর চরণ আশ্রয় কর।” দৈব বাণী শুনে রসিক কিছু আশ্বস্ত হলেন, প্রতি ক্ষণে শ্রীশ্যামানন্দের আগমন পথ দেখতে লাগলেন।
কিছুদিন পরে শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু সুবর্ণরেখা নদীতটে রোহিণী নামক গ্রামে শ্রীরসিক দেবের ঘরে শিষ্যগণ সহ শুভাগমন করলেন। শ্রীরসিক দেবের আনন্দের সীমা রইল না। সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ করে অতি বিনীতভাবে তাঁকে স্বগৃহে নিয়ে তাঁর শ্রীপাদ পূজা পূৰ্ব্বক, সমস্ত স্বজন-কলত্র ও পুত্রাদি সহ রসিকদেব আত্মনিবেদন করলেন। শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু শুভ দিনে শ্রীরসিকদেবকে রাধাকৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত করলেন। শ্রীরসিকদেব গৃহে নাম সংকীর্তন যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। সমস্ত বন্ধু-বান্ধব ও প্রজাগণকে আমন্ত্রণ করলেন। সেই সংকীর্ত্তন মহাযজ্ঞে সকলে উপস্থিত হয়ে আচার্য শ্রীশ্যামানন্দ প্রভুর শ্রীচরণ দর্শন পূর্ব্বক সকলেই শ্রীগৌর নিত্যানন্দের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর শ্রীচরণ আশ্রয় করলেন। রোহিণীতে আচার্য্য শ্রীশ্যামানন্দ প্রভুর বহু শিষ্য হল।
রোহিণীতে দামোদর নামে এক বড় যোগী ছিলেন। একদিন তিনি আচার্য্য শ্রীশ্যামানন্দ প্রভুকে দর্শন করতে এলেন। দূর থেকে সূর্য্যসম উজ্জ্বল দিব্য কান্তি দর্শন করে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। অতঃপর নিকটবর্তী হয়ে শ্রীআচার্য্যের চরণে বন্দনা করলেন। আচার্য্য তাঁকে প্রতি-নমস্কার করে সজল নয়নে বললেন—আপনি পবিত্র শুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে নিরন্তর শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের নাম করুন। তাঁরা পরম দয়াল ঠাকুর। আপনাকে কৃষ্ণপ্রেম প্রদান করবেন। আচার্য্যের এই উক্তি শ্রবণে যোগী দামোদরের মন বিগলিত হল। বললেন আমি গৌর নিত্যানন্দের চরণ ভজন করব; আপনি কৃপা করুন। আচার্য্য তাঁকে অনুগ্রহ করলেন। যোগী দামোদর পরম ভক্ত হলেন। নিরন্তর গৌর-নিত্যানন্দের নাম নিয়ে ক্রন্দন করতেন।
বলরামপুরে অনেক ধনীর বসবাস ছিল। সেখানে আচার্য্যের মহিমা শুনে সকলে তাঁকে দর্শনের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। শ্রদ্ধালু কয়েকজন সজ্জন ব্যক্তি এসে আচার্য্যকে বহু অনুনয় সহ প্রার্থনা করলেন বলরামপুরে যাবার জন্য। আচার্য্য তাঁদের প্রতি কৃপা করলেন। আমন্ত্রণ অঙ্গীকার করলেন। শ্রীরসিক ও দামোদর আদি ভক্তগণ সঙ্গে আচার্য্য বলরামপুরে শুভ বিজয় করলেন। বলরামপুরের সজ্জনগণের আনন্দের সীমা রইল না। আচার্য্যের শ্রীচরণ পূজা করে তাঁর ভোজনাদির সুন্দর ব্যবস্থা করলেন। তিনি কয়েকদিন বলরামপুর হরিকথা কীর্ত্তন মহোৎসব করলেন। বহু লোক শ্রীআচার্য্যের পাদপদ্ম আশ্রয় করলেন। শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু তথা হতে শ্রীনৃসিংহপুরে এলেন। নৃসিংহপুরে পূর্ব্বে বহু নাস্তিক পাষণ্ডী ব্যক্তির দল ছিল। কয়েকদিন আচার্য্য তথায় সংকীৰ্ত্তন মহোৎসব অনুষ্ঠান করলেন। আচার্য্যের দর্শনে এবং তাঁর অমৃতপ্রায় কথা শ্রবণে নাস্তিক পাষণ্ডিগণের মন বিগলিত হল। তারাও শ্রীআচার্য্যের চরণ আশ্রয় নিল।
শ্রীশ্যামানন্দ প্রভুর মহিমা দিন দিন উৎকল দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আচার্য্য নৃসিংহপুর হতে শ্রীগোপীবল্লভপুরে এলেন। সেখানে বহু ধনীর বাস ছিল। শ্রীআচার্য্যপাদকে দর্শন করে তাঁরা আকৃষ্ট হলেন। প্রায় লোক শ্রীআচার্য্যের চরণ আশ্রয় করলেন। সকলে আচার্য্যের চরণে প্রার্থনা করলেন তথায় শ্রীবিগ্রহ সেবা প্রকাশ হউক। আচার্য্য ভক্তগণের প্রার্থনা অঙ্গীকার করলেন। অতঃপর তথায় ভক্তগণের সহায়তায় ভগবদ মন্দির, সংকীর্ত্তন গৃহ, ভোগরন্ধন গৃহ, ভক্তগণের আবাস গৃহ, সরোবর ও উদ্যান আদি নির্মাণ করা হল। অতঃপর আচার্য্য শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু মন্দিরে শ্রীরাধাগোবিন্দ জীউর প্রকট উৎসব করলেন। সে উৎসব যেন সমগ্র বঙ্গ ওউৎকল দেশ ভরে গেল। শ্রীবিগ্রহগণের শোভা মাধুরী দেখে সকলের প্রাণ শীতল হল। শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু তথাকার সেবাভার দিলেন শ্রীরসিকানন্দের উপর।
সমগ্র উৎকল দেশ ভরে শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু গৌর-নিত্যানন্দের বাণী প্রচার করে ফিরে এলেন অম্বিকা কালনায় শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভুর শ্রীপাদপদ্মে। শ্রীগুরু পাদপদ্মে সাষ্টাঙ্গ বন্দনা পূৰ্ব্বক উৎকল দেশাদিতে গৌর-নিত্যানন্দের বাণী প্রচারের বিজয় বৈজয়ন্তীর কথা বর্ণন করলেন। শ্রীহৃদয় চৈতন্য শ্রবণ করে শ্যামানন্দকে স্নেহে আলিঙ্গন করতে লাগলেন।
খেতরির প্রসিদ্ধ উৎসবে শ্রীশ্যামানন্দ আমন্ত্রিত হলেন। সশিষ্য শ্যামানন্দ প্রভু খেতরির দিকে যাত্রা করলেন। যথাকালে খেতরিতে উপস্থিত হলেন। তথায় পূৰ্ব্বতম প্রাণের মিত্র শ্রীনিবাস ও শ্রীনরোত্তমের সঙ্গে মিলন হল। পরস্পর কত প্রণয় আলিঙ্গন করে যেন সুখসিন্ধুতে ভাসতে লাগলেন। সে উৎসবে শ্রীজাহবা মাতা, শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর, শ্রীঅচ্যুতানন্দ ও শ্রীবৃন্দাবন দাস ঠাকুর প্রভৃতি গৌর-পার্ষদগণ ও কত মহান্ত শুভাগমন করেছিলেন। উৎসব অন্তে শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু বৈষ্ণবদিগের থেকে বিদায় নিয়ে উৎকল অভিমুখে পুনর্ব্বার যাত্রা করলেন। পথে গৌড়দেশে কন্টকনগরে শ্রীগদাধর দাস ঠাকুরের ভবনে, যাজিগ্রামে শ্রীনিবাস আচার্য ভবনে ও শ্রীখণ্ডে শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুরের গৃহে আগমন করেন। তখন বহু গৌরপার্ষদ অপ্রকট হয়েছেন।
শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু ক্রমে উৎকল দেশে প্রবেশ করলেন। পথে পথে ভক্তগৃহে অবস্থান এবং বহু সজ্জনকে অনুগ্রহ দান করতে করতে শ্রীগোপীবল্লভপুরে আগমন করলেন। এই সময় স্বীয় শ্রীগুরু পাদপদ্ম শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভুর অপ্রকট বার্তা শ্রবণ করলেন। নিদারুণ সংবাদ শ্রবণ মাত্রই শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু মূৰ্চ্ছিত হয়ে পড়লেন। বহু রোদন করতে লাগলেন। তিনি বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়লে শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু স্বপ্নে তাঁকে দর্শন দিলেন এবং আশ্বস্ত করলেন।
উৎকল দেশে আচার্য শ্যামানন্দ প্রভুর মহিম৷ চতুর্দিকে ঘোষিত হল। শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের নিত্য সেবা পূজা স্থানে স্থানে প্রকটিত হল। শ্রীরসিকমুরারি, শ্রীরাধানন্দ, শ্রীপুরুষোত্তম, শ্রীমনোহর, চিন্তামণি, বলভদ্র, শ্রীজগদীশ্বর, শ্রীউদ্ধব, অক্রুর, মধুবন, শ্রীগোবিন্দ, শ্রীজগন্নাথ, গদাধর, আনন্দানন্দ ও শ্রীরাধামোহন প্রভৃতি শ্রীশ্যামানন্দ প্রভুর অন্তরঙ্গ প্রিয় ভক্ত ছিলেন।
শ্রীল শ্যামানন্দ প্রভু সর্ব্বত্র বিজয় করে ফিরে এলেন শ্রীগোপীবল্লভ পুরে এবং তথায় কয়েকদিন ব্যাপী মহোৎসব করলেন। অতঃপর আচার্য্য শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু আষাঢ় কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথিতে অন্তর্হিত হলেন।
অদ্যাপি তাঁর সমাধিপীঠ শ্রীগোপীবল্লভপুরে নিত্য সেবা হচ্ছে।