Disappearance Day of Sri dhar Pandit
জয় শ্রীধরঠাকুর দয়াময়।
যাঁর কলা মুলা খায় গৌরাঙ্গরায় ।।
শ্রীধরঠাকুর শ্রীমায়াপুর গ্রামের শেষ সীমায় বাস করতেন। তিনি যৎসামান্য কলা-মূলা বিক্রি করে জীবন-যাপন করতেন। রাতভোর উচ্চস্বরে হরিনাম করতেন। ভক্তি বহির্মুখ পাষন্ড হিন্দুগণ তা সইতে পারত না। অকথ্য ভাষায় তাঁকে নানাপ্রকার গালি দিত—
মহাচাষা-বেটা ভাতে পেট নাহি ভরে।
ক্ষুধায় ব্যাকুল হঞা রাত্রি জাগি-মরে।।
(চৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ৯।১৪৮)
চাষা বেটার ভাতে পেট ভরে না। ক্ষুধার জ্বালায় রাত্রে চিৎকার করে পাষন্ডিগণ এরূপ অনেক কথা বলত; কিন্তু শ্রীধর কারও কথায় কর্ণপাত করতেন না। আনন্দে নিজে কাজ করে যেতেন। বামন পুকুরের বাজারে ছিল তাঁর দোকান। তিনি খুব সত্যবাদী লোক ছিলেন। এক কথায় বেচা-কেনা করতেন। নিরন্তর শ্রীনাম স্মরণ করতেন। বেশী কথা বলতে ভালবাসতেন না। খরিদ্দারেরা যথার্থ দাম রেখে কলা-মূলাদি নিয়ে যেতেন।
থোড় কলা-মুলা বিক্রি করে শ্রীধর যে পয়সা পেতেন, তার অর্দ্ধেক দিয়ে শ্রীগঙ্গাদেবীর পূজার ফুল মিষ্টি প্রভৃতি খরিদ করতেন, আর অর্দ্ধেকে তাঁর সংসার নির্ব্বাহ হ’ত।
কোন কোন দিন জননীর আদেশে কলা-মূলা শাক প্রভৃতি কিনতে শ্রীগৌরসুন্দর বাজারে যেতেন। তিনি শ্রীধরের দোকান থেকে জিনিস কিনতে। শ্রীগৌরসুন্দর কোন কোন দিন বড় রহস্য করতেন।
শ্রীধর এক দরে বিক্রি করতেন। শ্রীগৌরসুন্দর তার অর্দ্ধেক দাম বলতেন। শ্রীধর উঠে শ্রীগৌরসুন্দরের হাত থেকে কলাটি মূলাটি কেড়ে নেবার চেষ্টা করতেন। গৌরসুন্দর ছেড়ে দিতেন না। পরিশেষে দুইজনের মধ্যে জিনিসটা নিয়ে টানাটানি হ’ত। তামাসা দেখবার জন্য অনেক লোক জড় হত।
একদিন মহাপ্রভু একটা মোচা নিয়ে দর কষাকষি করছিলেন শ্রীধরের সঙ্গে। শ্রীধর মোচাটী কেড়ে নিতে চাইলে মহাপ্রভু বললেন—
প্রভু বলে,—“কেনে ভাই শ্রীধর তপস্বী।
অনেক তোমার অর্থ আছে হেন বাসি।।
আমার হাতের দ্রব্য লহ যে কাড়িয়া।
এতদিন কে আমি, না জানিস্ ইহা।।”
যে গঙ্গা পূজহ তুমি, আমি তা’র পিতা।
সত্য সত্য তোমারে কহিল এই কথা।।
― (চৈঃ ভাঃ মধ্য ৯/১৬৬-১৬৭, ১৭৯)
শ্রীধর! তোমার একি ব্যবহার? আমি ব্রাহ্মণের ছেলে। আমার হাত থেকে তুমি জিনিস কেড়ে নিচ্ছ? তুমি একজন তপস্বী। তোমার ত’ অনেক পয়সা-কড়ি আছে। আমায় কিছু দিলে ক্ষতি কি? শ্রীধর! এতদিন তুমি কি জান না আমি কে? তুমি প্রতিদিন যে গঙ্গার পূজা কর, আমি তাঁ’র পিতা।
কর্ণে হস্ত দেই, শ্রীধর ‘বিষ্ণু’ ‘বিষ্ণু’ বলে।
উদ্ধত দেখিয়ে তারে দেই পাত খোলে।।
—(চৈঃ ভাঃ মধ্য ৯\১৮০)
প্রভুর কথা শুনে শ্রীধর ‘বিষ্ণু’ ‘বিষ্ণু’ বলে কানে আঙ্গুল দিলেন। ভাবলেন শিশু পাগল হয়েছে। শ্রীধর শ্রীগৌরসুন্দরকে ভালভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন
মদনমোহন রূপ গৌরাঙ্গসুন্দর।
ললাটে তিলক শোভে ঊর্দ্ধ মনোহর।।
ত্ৰিকচ্ছ বসন শোভে কুটিল কুন্তল।
প্রকৃতি, নয়ন—দুই পরম চঞ্চল।।
শুক্ল যজ্ঞ সূত্র শোভে বেড়িয়া শরীরে।
সুক্ষ্মরূপে অনন্ত যে-হেন কলেবরে।।
অধরে তাম্বুল হাসে, শ্রীধরে চাহিয়া।
আরবার খোলা লয় আপনে তুলিয়া।।
—(চৈঃ ভাঃ মধ্য ৯।১৬৯-১৭২)
কি অপূর্ব্ব মদনমোহন রূপ। ললাটে ঊর্দ্ধ পুণ্ড্র তিলক, পরিধানে ত্রিকচ্ছ বসন, শিরে কুঞ্চিত কেশদাম, গলদেশে শুভ্র যজ্ঞোপবীত ও নয়ন যুগলের সুষমা বর্ণন করা যায় না। অধর তাম্বুল রাগে রঞ্জিত।
এভাবে দুইজনের মধ্যে যখন কথোপকথন হচ্ছিল তখন শ্রীগৌরসুন্দর মোচাটি ভূমিতে রেখে দিয়েছিলেন। হাস্য করতে করতে তিনি আবার মোচাটি হাতে নিলেন।
শ্রীধর বললেন— শুন ঠাকুর! আমি তোমার কুকুর, তুমি আমায় ক্ষমা কর, মূল্য দিতে হবে না। তুমি এমনি নিয়ে যাও।
মহাপ্রভু বললেন শ্রীধর। তুমি বড় চতুর লোক। তোমার কলা বেচা অনেক অর্থ আছে। ঠাকুর এ বাজারে আর কি দোকান নাই?
অনেক দোকান আছে, তাতে আমার কি? তুমি আমার যোগানদার,তোমাকে ছাড়ব কেন?
ঠাকুর, বেশ কথা, তোমার পায়ে পড়ি। তোমার কাছে আমি পরাজিত। আজ থেকে বিনা কড়িতে তোমায় জিনিস দিব।
যত খারাপ জিনিস তাই দিবে ত?
ব্রাহ্মণ ঠাকুর। খারাপ জিনিস দিব কেন?
আচ্ছা ভাল, ভাল, তাই হউক।
কিছুক্ষণ এভাবে কলহ করে মহাপ্রভু চললেন। শ্রীধর তাকিয়ে রইলেন। এ শিশু একদিন কোন অতিমুক্ত পুরুষ হবেন। কি মধুময় ভাষা! কিরূপ চাহনি! এত চঞ্চলতা করলেও মনে কোন দুঃখ হয় না। বাজারে আর কোথাও যায় না। শুধু আমার কাছে আসে। আমার কত ভাগ্য।
শ্রীগৌরসুন্দর প্রতিদিন শ্রীধরের থোড় মোচার তরকারী তাঁর কলার খোলায় ভোজন করতেন।
ভক্তের পদার্থ প্রভু হেনমতে খায়।
কোটি হৈলেও অভক্তের উলটি’ না চায়।।
–(চৈঃ ভাঃ ৯।১৮৫)
ভগবান ভক্তের দ্রব্য কেড়ে কেড়ে খান, অভক্তের কোটি দ্রব্যের প্রতিও দৃষ্টিপাত করেন না।
শ্রীগৌরসুন্দর প্রতিদিন শিষ্যগণসহ নগর ভ্রমণ করতেন। একদিন ভ্রমণ করতে করতে শ্রীধরের ঘরে এলেন। শ্রীধর তাঁকে ভালভাবে চিনতেন। তাঁর সঙ্গে প্রভু দু’চার দন্ড পরিহাসাদি না করে ছাড়লেন না।
শ্রীধর শ্রীগৌরসুন্দরকে বসবার আসন দিলেন। শ্রীগৌরসুন্দর বসে বলতে লাগলেন—
শ্রীধর! তুমি সারাদিন ‘হরি’ ‘হরি’ কর ও লক্ষ্মী-নারায়ণের পূজা কর,কিন্তু তোমার অন্ন-বস্ত্রের এত দুঃখ কেন?
ঠাকুর ! উপবাস ত করি না। ছোট হউক, বড় হউক কাপড় ত’ পরি।
শ্রীধর! বস্ত্র ত’ পরিধান কর, কিন্তু দেখছি দশ জায়গায় সেলাই রয়েছে। ঘরে আছ, কিন্তু ঘরের ছাউনিতে ত’ খড় নাই। দেখ, এ নবদ্বীপে চন্ডী-দূর্গার পূজা করে লোক কত সুখে আছে।
ঠাকুর! তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু দিন সকলের সমান যাচ্ছে।
রত্ন ঘরে থাকে, রাজা দিব্য খায় পরে।
পক্ষিগণ থাকে, দেখ, বৃক্ষের উপরে।।
কাল পুনঃ সবার সমান হই’ যায়।
সবে নিজ কর্ম ভুঞ্জে ঈশ্বর-ইচ্ছায়।।
—(চৈঃ ভাঃ আদি ১২।১৮৯-১৯০)
শ্রীধর! তোমার অনেক ধন আছে। তুমি লুকিয়ে রেখেছ। আমি জগতে প্রচার করব। দেখি তুমি কেমন লোককে বঞ্চনা কর।
ঠাকুর ! তুমি এখন ঘরে যাও। তোমার সঙ্গে আমি দ্বন্দ্ব করতে চাই না।
শ্রীধর ! তুমি আমায় কি দিবে দাও। তোমার থেকে কিছু না নিয়ে কেমনে যাই?
পন্ডিত। আমি গরীব মানুষ। থোড় কলা বেচে খাই। ইথে তোমায় দেওয়ার মত কিছু তা দেখছি না।
শ্রীধর! তোমার যে পোতা ধন আছে, এখন তা থাকুক। বৰ্ত্তমানে বিনা দামে থোড়, কলা ও মোচা ত দাও।
শ্রীধর চিন্তা করতে লাগলেন—এ-বিপ্ৰশিশু ত’ পাগল মনে হয়। বেশী কিছু বললে মারতেও পারে। ব্রাহ্মণের ছেলে মারলেও কিছু করতে পারব না। আবার রোজ বিনা পয়সায় দিতেও পারি না। তবে সে যে ছলে বলে নেয় না, সেও আমার ভাগ্য।
ঠাকুর! তোমাকে পয়সা-কড়ি দিতে হবে না, এ থোড় কলা মোচা নিয়ে যাও। আমার সঙ্গে আর ঝগড়া কর না।
শ্রীধর! ভালয় ভালয় দিলে কেইবা ঝগড়া করে? তবে ভাল জিনিস। দিও। বামনকে কানা গরু দান কর না।
কতক্ষণ শ্রীধরের সঙ্গে এরূপ বাক্যালাপ করে শ্রীগৌরসুন্দর শিষ্যগণসহ গৃহাভিমুখে ফিরে যেতে উদ্যত হলেন। এমন সময় পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন—শ্রীধর, তুমি আমায় কি মনে কর তা’ বললেই আমি চলে যাব।
তুমি ব্রাহ্মণের ছেলে। বিষ্ণুর অংশ।
শ্রীধর! তুমি আমায় জানতে পারলে না। আমি গোপ। তোমার যে গঙ্গার মহিমা, তাও আমার কারণে।
পন্ডিত! তোমার গঙ্গারও ভয় হয় না। লোকের যত বয়স হয়, তত শান্ত দান্ত হয়। তোমার যত বয়স হচ্ছে ততই চঞ্চলতা বাড়ছে। এখন ঘরে যাও। আমার সঙ্গে আর কলহ কর না।
শ্রীধরের কথা শুনে শ্রীগৌরসুন্দর হাস্য করতে করতে গৃহাভিমুখে চললেন।
ভগবান যতক্ষণ নিজের পরিচয় না দেন, ততক্ষণ কেহ তাঁকে জানতে পারে না।
শ্রীগৌরসুন্দর কিছুদিন বিদ্যার বিলাস করলেন। তারপর গয়াধামে গেলেন। সেখান থেকে দিব্যভাব প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। যখন গৃহে ফিরলেন তখন তাঁর সম্পূর্ণ নতুন ভাব। নিরন্তর ভাবাবেশ। শ্রীবাস অঙ্গনই এ বিলাসের প্রধান কেন্দ্র হল। দিনের পর দিন কত দিব্য ভাব প্রকট করতে লাগলেন তা’ বর্ণন করা যায় না।
একদিন মহাপ্রভু শ্রীবাস মন্দিরে বিষ্ণু-খট্টার উপর বসে মহাভাবাবেশে ভক্তগণকে আদেশ করলেন, — শ্রীধরকে নিয়ে এস, সে আমার স্বরূপ দর্শন করুক। আমাকে দেখবার জন্য সে কত সাধন করেছে, দুঃখ সহ্য করেছে। রাত্রিকালে ভক্তগণ শ্রীধরকে আনতে গেলেন। দূর থেকে ভক্তগণ শুনতে পেলেন শ্রীধর উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম করছেন।
ভক্তগণ শ্রীধরের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ‘শ্রীধর’ ‘শ্রীধর’ বলে ডাকতে লাগলেন। শ্রীধর এত জোরে হরিনাম করে যাচ্ছিলেন যে ভক্তদের ডাকাডাকি প্রথম শুনতেই পেলেন না। আর কিছুক্ষণ ডাকহাঁক দিবার পর শ্রীধর বাইরে এসে চন্দ্রালোকে ভক্তদের দেখে অবাক হলেন এবং এত রাত্রে কেন এসেছেন জিজ্ঞাসা করলেন। ভক্তগণ বললেন— শ্রীধর। আর কাল বিলম্ব কর না। প্রভু তোমাকে ডেকেছেন। তোমাকে নেবার জন্য আমরা এসেছি “শুনিয়া প্রভুর নাম শ্রীধর মূর্চ্ছিত”। আনন্দে বিহ্বল হই পড়িলা ভূমিত–(চৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ৯।১৫৪) প্রভুর নাম শুনে শ্রীধর ভূতলে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন।ভক্তগন ধরাধরি করে তাকে মহাপ্রভুর কাছে আনলেন। মহাপ্রভু আনন্দ ভরে বলতে লাগলেন শ্রীধর। এস এস আমাকে দেখবার জন্য তুমি বহু জন্ম সাধন করেছ। এ জন্মেও আমার অনেক সেবা করেছ। তোমার শাক, কলা ও মোচার তরকারী আমি বড় প্রীতিতে ভোজন করেছি এবং কলার খোলায় অন্ন খেয়েছি। শ্রীধর ! তুমি কি এ সব ভুলে গেছ? শ্রীধর। তুমি উঠ— আমার দিব্যরূপ দর্শন কর। এ রূপ শ্রুতিগণও দর্শন করতে পারেন না। ধীরে ধীরে ভূমি থেকে উঠে শ্রীধর প্রভুর দিব্যরূপ দেখতে লাগলেন—
তমাল শ্যামল দেখে সেই বিশ্বস্তর।
হাতে মোহন বংশী দক্ষিণে বলরাম।।
মহাজ্যোতিৰ্ম্ময় সব দেখে বিদ্যমান।
কমলা তাম্বুল দেই হাতের উপরে।
চতুর্মুখ পঞ্চমুখ আগে স্তুতি করে।।
–(চৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ৯।১৯০-১৯৩)
শ্রীশ্যামসুন্দররূপে গৌরসুন্দরকে দেখে শ্রীধর পুনরায় ধরাতলে প্রেম মূৰ্চ্ছা প্রাপ্ত হলেন। মহাপ্রভু শ্রীধরকে স্পর্শ করে তাঁর চৈতন্য ফিরালেন এবং তাঁকে স্তুতি করতে বললেন।
শ্রীধর বললেন— ঠাকুর ! আমি ত কিছুই জানি না।
মহাপ্রভু বললেন—শ্রীধর ! তোমার বাক্যই আমার স্তুতি।
আমি বর প্রদান করছি, তোমার জিহ্বায় শুদ্ধা সরস্বতী অধিষ্ঠান হউক।
শ্রীধর স্তব করতে লাগলেন—
জয় জয় মহাপ্রভু জয় বিশ্বস্তর।
জয় জয় জয় নবদ্বীপ পুরন্দর।।
জয় জয় অনন্ত ব্রহ্মান্ড কোটিনাথ।
জয় জয় শচীপুণ্যবতী গর্ভজাত।।
জয় জয় বেদগোপ্য জয় দ্বিজরাজ।
যুগে যুগে ধর্ম পাল করি নানা সাজ।।
-(চৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ৯ ।২০০-২০২)
এভাবে শ্রীধর প্রায় অর্দ্ধপ্রহর কাল কত স্তুতি করলেন। প্রভু তাতে সুখী হয়ে বললেন— শ্রীধর! তুমি বর গ্রহণ কর। শ্রীধর বললেন— ঠাকুর! আমি কোন বর চাই না। যদি বর দাও ত এ বর দাও—
যে ব্রাহ্মণ কাড়ি নিল মোর খোলাপাত।
সে ব্রাহ্মণ হউক মোর জন্ম জন্ম নাথ।।
যে ব্রাহ্মণ মোর সঙ্গে করিল কোন্দল।
মোর প্রভু হউক তাঁর চরণ যুগল।।
(চৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ৯।২২৪-২২৫)
শ্রীধর এ বলে উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে লাগলেন। শ্রীধরের সে প্রেমক্রন্দন শুনে বৈষ্ণবগণও প্রেমে ক্রন্দন করতে লাগলেন।
মহাপ্রভু শ্রীধরকে বললেন—শ্রীধর। জন্মে জন্মে তুমি আমার দাস। আমি তোমায় অনেক পরীক্ষা করেছি। তোমার আচরণে আমি বড় তুষ্ট হয়েছি। তোমার সেবা ও প্রেমে তোমার কাছে আমি ঋণী। মহাপ্রভুর এ কথা শুনে, চতুৰ্দ্দিকে বৈষ্ণবগণ ‘হরি’ ‘হরি’ ধ্বনি করে উঠলেন।
ধন নাহি জ্ঞান নাহি নাহিক পাণ্ডিত্য।
কে চিনিবে এ সকল চৈতন্যের ভৃত্য।।
কি করিবে বিদ্যা, ধন, রূপ, যশ, কুলে।
অহঙ্কার বাড়ি সব পড়য়ে নির্মূলে।।
কলা মূলা বেচিয়া শ্রীধর পাইল যাহা।
কোটি কল্পে কোটীশ্বর না দেখিবা তাহা।।
(চৈঃ ভাঃ ৯।২৩৩-২৩৫)
শচীনন্দন শ্রীগৌরহরি নদীয়া নগরে ভক্তগণসহ কত বিচিত্র লীলাবিলাস করতে করতে সমগ্র জীব উদ্ধারের জন্য সন্ন্যাস লীলাভিনয় করতে ইচ্ছা করলেন।
সন্ন্যাসে যাবার দিন ভক্তগণকে নিয়ে মহাপ্রভু নগরে নগরে বহু নৃত্য কীর্ত্তন করলেন। সন্ধ্যার সময় নিজ গৃহে বসে আছেন। ভক্তগণ তথায় সমবেত হতে লাগলেন। আজ প্রভুর কি অপূর্ব্ব দিব্য বেশ। হাসতে হাসতে ভক্তগণকে নিজ কন্ঠের মাল্য দান করছেন। চতুর্দিকে ভক্তগণ আনন্দ সাগরে ভাসছেন। শ্রীঅদ্বৈত আচাৰ্য্য এলেন, শ্রীবাস পণ্ডিত এলেন, শ্রীবক্রেশ্বর পন্ডিত এলেন। এমন সময় শ্রীধর একটি লাউ হাতে করে এলেন এবং প্রভুকে ভেট দিলেন। মহাপ্রভু স্বহস্তে লাউটী নিয়ে হাসতে লাগলেন। মনে মনে চিন্তা করলেন—শ্রীধরের লাউ না খেয়ে সন্ন্যাসে যাব—তা হতেই পারে না—ভক্তের জিনিস উপেক্ষা করতে পারি না। শচীমাতাকে ডেকে বললেন—আই! শ্রীধর কষ্ট করে লাউ এনেছে। এ লাউ এখনি শ্রীকৃষ্ণের ভোগে লাগাও। এমন সময় আর একজন ভক্ত দুধ নিয়ে এলেন। শচীমাতা তখনি লাউ দিয়ে হালুয়া তৈরী করলেন ও ঠাকুরকে ভোগ দিয়ে শ্রীগৌরসুন্দরের হাতে এনে দিলেন। সে প্রসাদ গৌরসুন্দর স্বহস্তে ভক্তগণকে খাইয়ে নিজে খেলেন। তিনি শ্রীধরকে বললেন—শ্রীধর। তোমার দ্রব্য কি আমি না খেয়ে পারি? শ্রীধর ! তুমি কি আমার কথা রাখবে? ঠাকুর। কি কথা বল? কেন রাখব না? শ্রীধর। এ ভাবে তুমি রোজ আমার বাড়ী এসে দেখা দিও।
মহাপ্রভু ভক্তগণের সঙ্গে কত রকমের হাস্য পরিহাস করবার পর সকলকে শ্রীকৃষ্ণ সঙ্কীর্ত্তন করবার আদেশ করে বিদায় করলেন। অতঃপর তিনি অন্ত-নিশায় সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য যাত্রা করলেন।
সন্ন্যাস গ্রহণান্ত মহাপ্রভু যখন পুরীতে অবস্থান করতেন তখন গৌড়ীয় ভক্তগণের সঙ্গে প্রভুর দর্শনে শ্রীধর প্রতিবর্ষ যেতেন।
জয় শ্রীধর ঠাকুর কী জয়!