#GaudiyaMission #Gaudiya #prabhupad #prabhupada #srilaprabhupad #srilaprabhupada #prabhupada150 #prabhupad150 #srilaprabhupad150 #srilaprabhupad #prabhupadglories #puri_goswami #puri_goswami_thakur #acharyadeb #disappearance #saturday #vaishnav_acharya

Disappearance Day of Sri Srimad Bhaktiprasad Puri Goswami Thakur

 
নমঃ ওঁ বিষ্ণুপাদায় গৌরপ্রেষ্ঠ স্বরূপিনে।
শ্রীমদ্ভক্তি প্রসাদাখ্য পুরী গোস্বামিনে নমঃ।।
সন্দর্ভালোকদানেনাভক্তিধবান্তবিনাশিনে।
ভক্তি বীজৰ্পণেনৈব স্বেষ্টস্মৃতিবিধায়িনে।।
নামকৃপৈকনিষ্ঠায় কারুণ্যঘনমূৰ্ত্তয়ে।
ভাগবতরসাম্ভোধৌ নিরন্তরাবগাহিনে।।
শ্রীরাধামাধবপ্রেম প্রোজ্জ্বলারতিবর্ধনে।
বিপ্রলম্ভরসাবিষ্ট রূপানুগায় তে নমঃ।।
 
শ্রীশ্রীভগবানের আবির্ভাব তিথি যেমন পবিত্র, তাঁর ভক্তগণের আবির্ভাব তিথিও তদ্রূপ। ভগবান সব সময় অবতীর্ণ হন না বটে কিন্তু ভাগবত আচার্য্যগণের ভক্তিধারা সর্ব্বকাল প্রবাহিত হয়।
 
গুরু কৃষ্ণরূপ হন শাস্ত্রের প্রমাণে।
গুরুরূপে কৃষ্ণ কৃপা করেন ভক্তগণে।।
(শ্রীচৈঃ চঃ আদি ১।৪৫)
 
 
শ্রীমদ্ পুরী গোস্বামীর আবির্ভাব ১৮৯৫ খৃষ্টাব্দের ২৫শে আগষ্ট বাংলা ১৩০২ সালে ভাদ্র শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে। তার পিতৃদেবের নাম শ্রীযুত রজনীকান্ত বসু। মাতৃদেবীর নাম শ্রীযুক্তা বিধুমুখী বসু। পূর্ব্ববঙ্গে নোয়াখালী জেলার সন্দীপহাতীয়ায় এই মহাপুরুষের জন্মস্থান ৷ শ্রীযুত বসু মহাশয়ের যোগেন্দ্র (শ্রীমদ্ভক্তি প্রদীপ তীর্থ মহারাজ) শ্রীনিবাস, সুদর্শন ও হৃষীকেশ নামে চারটি সন্তান ছিলেন। তাঁরাও শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদের শ্রীচরণাশ্রিত ছিলেন।
 
শ্রীমদ্ পুরী গোস্বামী শিশুকাল থেকে শ্রীকৃষ্ণানুরাগী ছিলেন। তিনি অষ্টম বর্ষ বয়সে রামায়ণ, মহাভারত ও গীতার বহু অংশ মুখে মুখে বলতে পারতেন। ঐ সময় তিনি শ্রীল নরোত্তম ঠাকুরের ও শ্রীমদ্ভক্তি বিনোদ ঠাকুরের প্রার্থনাময়ী গীতগুলি মৃদঙ্গ সহযোগে কীর্ত্তন করতেন। মধুর কণ্ঠধ্বনি ও সুললিত মৃদঙ্গ বাদ্য ধ্বনিতে তিনি সকলকে মুগ্ধ করতেন। এতে তাঁর নিত্য সিদ্ধ ভাগবত স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যেত। তিনি বহরমপুর ‘কৃষ্ণনাথ’ কলেজ থেকে আই, এ, পাশ করার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি, এ, ডিগ্রি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কৈশোর থেকে শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্রের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। তখন থেকে ভাগবতের স্তবাদি মুখস্থ করতেন। তিনি ষোল বৎসর বয়সে পিতা শ্রীযুক্ত রজনীকান্ত বসু ও বড় ভ্রাতা শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্র বসুর (শ্রীমদ্ভক্তি প্রদীপ তীর্থ মহারাজ) সঙ্গে কলিকাতার রামবাগানস্থ ভক্তিভবনে শ্রীশ্রীমদ্ভক্তি বিনোদ ঠাকুরের শ্রীচরণ প্রথম বার দর্শন করেন। শ্রীল ঠাকুর মহাশয় এক কাষ্ঠাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীচরণ পার্শ্বে বসে হরিনাম করছিলেন এবং একটু দূরে বারান্দায় শ্রীমদ্ কৃষ্ণদাস বাবাজী মহাশয় বসে ছিলেন। সকলে শ্রীঠাকুর মহাশয়কে প্রণাম করলে তিনি সহাস্যবদনে বললেন—তোমাদের পরম মঙ্গল হউক। তারপর শ্রীল ঠাকুর মহাশয় কিছুক্ষণ হরিকথা বললেন।
 
শ্রীমদ্ পুরী গোস্বামী শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের অপ্রকটের পর ১৯১৮ সালে বড় ভ্রাতা শ্রীযোগেন্দ্র বাবুর সঙ্গে রামবাগানে ভক্তিভবনে শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীচরণ দর্শনে যান। তাঁরা দণ্ডবৎ করলে প্রভুপাদ সহাস্যবদনে শ্রীমদ্ পুরী দাসকে একটি কীর্ত্তন করতে বললেন। তিনি শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের “কবে হবে বল সে দিন আমার” এই কীর্ত্তনটি শুনান। তাঁর মধুর কণ্ঠধ্বনিতে সকলে স্তম্ভিত হলেন। শ্রীল প্রভুপাদ খুব সুখী হলেন। সেই দিন তিনি শ্রীল প্রভুপাদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রাজা রামমোহন রায় ও জনৈক গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবত শাস্ত্র ও বৈষ্ণবধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করে যে সমস্ত যুক্তি দেখিয়েছেন তা খণ্ডন করে, শ্রীমদ্ভাগবত যে বেদাত্তের অকৃত্রিম ভাষ্য তা স্থাপন করা যায় কিনা। তদুত্তরে শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন—রামমোহন রায়ের এবং গোস্বামীর শ্রুতি বিরুদ্ধ পাষণ্ডমত অচিরাৎ ভাগবত সিদ্ধান্তে খণ্ড-বিখণ্ড হবে। অসৎ সিদ্ধান্ত কখনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
 
১৯১৮ সালের ফাল্গুন পূর্ণিমায় শ্রীগৌর জন্মোৎসব বাসরে শ্রীল প্রভুপাদ ভাগবত ত্রিদণ্ড সন্ন্যাস গ্রহণ করেন, শ্রীচৈতন্য মঠ প্রতিষ্ঠা ও শ্রীশ্রীবিনোদপ্রাণ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় দিন শ্রীল প্রভুপাদ, শ্রীমদ্ পুরী দাস গোস্বামী, শ্রীহরিপদ বিদ্যারত্ন ও ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েকজন শ্রদ্ধালু সজ্জন ব্যক্তিকে মন্ত্র-দীক্ষাদি প্রদান করেন। শ্রীপুরীদাস ঠাকুরের ব্রহ্মচারী নাম হল শ্রীমদ্ অনন্ত বাসুদেব ব্রহ্মচারী। শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে শ্রীনবদ্বীপ ধাম প্রচারিণী সভা থেকে পরবিদ্যা ভূষণ উপাধি প্রদান করেন।
 
১৯২৫ সাল থেকে তিনি শ্রীল প্রভুপাদের সেবায় সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করলেন। এই সময় শ্রীল প্রভুপাদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গে যান। শ্রীল প্রভুপাদের বক্তৃতাদি টুকে নিতেন এবং তার যাবতীয় লেখা পড়ার কার্য্য করতেন। তিনি অদ্ভুত শ্রুতিধর ছিলেন। যা একবার শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীমুখে শুনতেন, অবিকল নকল করতে পারতেন। যে সমস্ত ভাগবতের শ্লোক শ্রীল প্রভুপাদের মুখে শুনতেন, পরক্ষণে তা বলতে পারতেন। সভাস্থলে অনেক সময় শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে যে শ্লোক জিজ্ঞাসা করতেন তা তিনি তৎক্ষণাৎ বলে দিতেন;এরূপ অদ্ভূত মেধা দেখে সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীরা আশ্চর্য্যান্বিত হতেন। যেদিন শ্রীগুরুপাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, সেইদিন থেকে শ্রীল প্রভুপাদের ইচ্ছা ভিন্ন স্বেচ্ছায় কিছু করতেন না। এমন কি শ্রীল প্রভুপাদের পত্রাদি লিখতে। লিখতে ভোজন করবার সময় এলেও প্রভুপাদ ভোজন করতে যেতে না বলা পৰ্য্যন্ত পত্র লিখেই যেতেন। শ্রীল প্রভুপাদের অবশেষ নিয়ে শ্রীমদ্ পুরীদাস ঠাকুর ভোজন করতেন। কতদিন তিনি শ্রীল প্রভুপাদের অবশেষ না পেয়ে উপবাসী থাকতেন। শ্রীল প্রভুপাদ জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ কিছু দুধ কিংবা কলা নিজ অধরে স্পর্শ করে তাকে ডেকে খাওয়াতেন।
 
প্রথম শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীচৈতন্য মঠ প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন তাঁর সঙ্গে ব্রহ্মচারী শ্রীপরমানন্দ বিদ্যারত্ন, শ্রীবাসুদেব প্রভু, শ্রীযুত কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ, শ্ৰীযুত জগদীশ ভক্তিপ্রদীপ বিদ্যাবিনোদ বি, এ, শ্রীযুত হরিপদ কবিভূষণ এম, এ, বি, এল, শ্রীযশোদানন্দন ভাগবত ভূষণাদি কতিপয় ভক্ত অবস্থান করতেন। কলিকাতায় একটি ভক্তি প্রচার কেন্দ্র মঠ স্থাপন করবার আশায় শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীবাসুদেব প্রভুও শ্রীকুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণকে সঙ্গে নিয়ে ১নং উল্টাডিঙ্গি রোডে ৫০ টাকা মাসিক ভাড়া হিসাবে একখানি পুরাতন বাড়ী নেন। গৃহস্থ ভক্তগণই ভাড়া বহন করতেন। ১৯১৮ সালের অগ্রহায়ণ শ্রীল প্রভুপাদ ঐ বাড়ীতে ‘শ্রীভক্তিবিনোদ আসন’ স্থাপন করেন। ১৯১৯ সালে শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর শুভ আবির্ভাব দিবসে (বসন্ত পঞ্চমী) শ্রীভক্তি বিনোদ আসনে ‘শ্রীশ্রীবিশ্ববৈষ্ণব রাজসভা” পুনঃ প্রকট হয়। ১৯২০ সালে শ্রীজগদীশ ভক্তি প্রদীপ ঠাকুরের পত্নী দেহত্যাগ করলে তিনি সম্পূর্ণভাবে শ্রীল প্রভুপাদের গৌরবাণী প্রচার কার্য্যের সহায়তা করবার জন্য আত্মসমর্পণ করেন। এই সময় শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে ত্রিদণ্ড সন্ন্যাস প্রদান করেন। তখন থেকে তিনি শ্রীমদ্ভক্তি প্রদীপ তীর্থ মহারাজ নামে খ্যাত হন। ইনিই শ্রীল প্রভুপাদের প্রথম সন্ন্যাসী। শ্রীল প্রভুপাদ এই বৎসর সপার্ষদ ধানবাদে শ্রীযুত অতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহে শুভ পদার্পণ করেন। বাংলা ১৩২৫ সাল থেকে শ্রীল পুরীদাস ঠাকুর শ্রীভাগবত প্রেস পরিচালনার কার্য্য গ্রহণ করেন। তিনি বহু বর্ষ এই প্রেসের সেবা করেন এবং বহু ভক্তি গ্রন্থ প্রকাশনের কার্য্যও সম্পাদন করেন। শ্রীশ্রীপ্রভুপাদের পঞ্চাশতম প্রকট বর্ষ থেকে শ্রীব্যাস পূজা আরম্ভ হয়। শ্রীপুরী দাস ঠাকুর ব্যাস পূজার প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন এবং তিনিই ব্যাস পূজার প্রথম শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখেছিলেন। বিশ্বের সর্ব্বত্র প্রভুপাদের গৌরবাণী প্রচারের সহায়কদের মধ্যে তিনিই অন্যতম ছিলেন।
 
১৯৩৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর বাংলা ১৩৪৩, ১৬ই পৌষ জগদ্গুরু ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীশ্রীমদ্ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদের অপ্রকট লীলা বিস্তারের পর তিনি গৌড়ীয় মঠ ও গৌড়ীয় মিশনের সভাপতি ও আচার্য্য পদে সমস্ত ভক্তগণের সমর্থনে অধিষ্ঠিত হন। আচার্য্য্যাভিষেক পৌরহিত্যের কার্য্য করেন আচাৰ্য্যাত্রিক শ্রীপাদ কুঞ্জবিহারী বিদ্যাভূষণ। সেই দিন মধ্যাহ্ন কালে শ্রীল পুরীদাস গোস্বামী ঠাকুর প্রায় শতাধিক লোককে হরিনাম মন্ত্র প্রদান করেন। তিনি যেদিন আচার্য্য পদে অধিষ্ঠিত হন সেদিন থেকে তাঁকে আচার্য্যদেব বলা হত। বাংলা ১৩৪৪ সালে ২৮শে বৈশাখ শ্রীল আচার্য্যদেব বহু সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারী নিয়ে পূর্ব্ববঙ্গের ঢাকা নগরীতে প্রচার করতে যান। কয়েক দিন পূর্ব্ব বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বিপুল ভাবে প্রচার কার্য্য করবার পর তিনি কলিকাতা প্রত্যাবর্ত্তন করেন। সে সময় তাঁর অভ্যর্থনার জন্য শ্রীগৌড়ীয় মঠে এক বিশাল জনসভার আয়েজন করা হয়েছিল।
 
১৯৩৮ সালে ২২শে ফেব্রুয়ারী শ্রীল আচার্য্যদেব শ্রীপাদ ভক্তিসারঙ্গ গোস্বামী এবং আরও কয়েকজন সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে প্রচার কার্য্যের জন্য রেঙ্গুন যান। রেঙ্গুনে বড় বড় স্থানে কিছুদিন বিপুলভাবে গৌরবাণী প্রচারিত হয়। অনন্তর ৭ই এপ্রিল শ্রীল আচার্য্যদেব বহু ভক্তসঙ্গে হরিদ্বার কুম্ভমেলায় আগমন করেন এবং তথায় সৎ শিক্ষা প্রদর্শনীর দ্বারোদ্ঘাটন করেন। শ্রীল আচার্য্যদেব প্রভুপাদের শ্রীচরণ স্মরণ করে সর্ব্বত্র বিপুল ভাবে প্রচার কার্য করতে থাকেন। বাংলা ১৩৪৫ সনের ভাদ্র মাসে শ্রীশ্রীল ভক্তিবিনোদ শতবর্ষ পূৰ্ত্তি আবির্ভাব মহোৎসব দুই মাস ব্যাপী কলিকাতার শ্রীগৌড়ীয় মঠে অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় শ্রীল আচার্য্যদেব সমারোহে কলিকাতার বিভিন্ন স্থানে শ্রীহরিকথা প্রচার করেন। তিনি বাংলা ১৩৪৬ সালে আষাঢ় কৃষ্ণ পঞ্চমীতে শ্রীগয়াধামে ত্রিদণ্ড সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং “শ্রীমদ্ভক্তিপ্রসাদ পুরী” এই নাম ধারণ করেন। এই বৎসর ২৯শে আশ্বিন শ্রীল আচার্যদেব পুনর্ব্বার ঢাকায় শুভ পদার্পণ করেন। ঢাকা মাধব গৌড়ীয় মঠে সেবকগণের তরফ থেকে এক বিপুল অভ্যর্থনার আয়োজন করা হয়েছিল। নগরীর বহু গণমান্য ব্যক্তি সভায় উপস্থিত থেকে তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেছিলেন। কয় দিন মঠে নিয়ত হরিকথা ও কীর্ত্তন হয়েছিল। একদিন তিনি কথা প্রসঙ্গে বলতে লাগলেন—
 
আর্ত্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী চার প্রকার লোক ভক্তির অধিকারী। গজেন্দ্র আর্ত্ত হয়ে ভগবানকে ডেকেছিল। পরে তার বিচার হল আমি নিজের সুখের জন্য ভগবানকে খাটালাম। তার যা ইচ্ছা তিনি তা বিধান করুন। গজরাজের আর্ত্তির মধ্যে যে কামনা ছিল, তা ছেড়ে দিল। ধ্রুব মহারাজ অর্থার্থী অর্থাৎ রাজ্য সিংহাসন লাভেচ্ছু। যখন তিনি শ্রীহরির দর্শন পেলেন, তখন স্তুতি করে বললেন—আমি কাচানুসন্ধান করতে করতে দিব্যরত্ন পেয়েছি। অন্য বরের দরকার নাই। ধ্রুব মহারাজ অন্য কামনা ত্যাগ করলেন।
 
শৌনক মুনি জ্ঞান লাভের কৌতুহল বশবর্ত্তী হয়ে শ্রীহরির উপাসনা করেছিলেন। কিন্তু জিজ্ঞাসার মধ্যে যে কামনা ছিল তা তিনি পরে ছেড়েছিলেন। চতুঃসন নবযোগেন্দ্র প্রভৃতি জ্ঞানানুসন্ধান ছেড়ে শ্রীহরির সেবায় আকৃষ্ট হন। শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ ও বলি মহারাজ এঁরা (বৈষ্ণব) শুদ্ধ ভক্ত। মার্কণ্ডেয় শিবের পরম ভক্ত হয়েও শুদ্ধ বৈষ্ণব। ইনি হরমহাদেবকে আশ্রয় বিগ্রহ এবং হরিকে বিষয় বিগ্রহরূপে দর্শন করেন।
 
ব্রজে শান্তরসে যমুনাদেবী সর্ব্বাপেক্ষা শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়তমা। মহানীপ বা মহাকদম্ব বৃক্ষ, যাঁকে কল্পদ্রুম বলা হয়, তিনি শ্রীকৃষ্ণের শান্তরসের সেবক। তার অনুগত ব্রজের মত বৃক্ষরাজি ব্রহ্মর্ষি দেবর্ষি প্রভৃতি ব্রজে শান্তরসে বৃক্ষ ও ভ্রমরাদি রূপে শ্রীকৃষ্ণ সেবা করেন। গোকুলে রক্তক, পত্রক, মধুকণ্ঠ, চন্দ্রহাস, পয়োদ বকুল, রসদ ও শরদ প্রভৃতি অনুগত দাস। ব্রজে সখা, — সুহৃৎ, প্রিয়সখা ও প্রিয়নর্ম-সখা এই চারি প্রকার সখ্যভেদ আছে। দেবপ্রস্থ, বরুথপ, কুসুমপীড়, প্রভৃতি সখা। বলভদ্র ও মণ্ডলীভদ্র প্রভৃতি সুহৃৎ। শ্রীদাম, দাম, সুদাম, বসুদাম ও ভদ্রসেন প্রভৃতি প্রিয়সখা। শ্রীদাম বৃষভানু নন্দিনী শ্রীরাধার ভ্রাতা ৷ ইহাদের কাছে কৃষ্ণের গোপনীয় কিছুই নাই।
 
যশোদার অঙ্গকান্তি নবঘনশ্যামবর্ত্ত, তার বসন বহুরঙ্গে চিত্রিত;তিনি কৃষ্ণকে এক মুহূৰ্ত্ত না দেখলে কোটি প্রলয়সম মনে করতেন। শ্রীনন্দ মহারাজের অঙ্গকান্তি চন্দন শুভবর্ণ স্থূলকায় গুম্ফ স্মশ্রুযুক্ত;তার নয়ন যুগল মধ্যে অনুপম বাৎসল্যরস অঙ্কিত। মধুর রসে সখী, নিত্যসখী, প্রিয়সখী ও পরম শ্রেষ্ঠ সখী পাঁচ প্রকার ভেদ আছে। বৃন্দা, ধনিষ্ঠা ও কুসুমিকা প্রভৃতি সখী। কস্তুরী, চম্পক মঞ্জরী, মণিমঞ্জরী ও কনকমঞ্জরী প্রভৃতি নিত্যসখী। বাসন্তী ও শশীমুখী প্রভৃতি সখী ৷ ললিতা, বিশাখা, চিত্রা, চম্পকলতা, তুঙ্গবিদ্যা, ইন্দু, রঙ্গদেবী ও সুদেবী এই অষ্ট পরম শ্রেষ্ঠা সখী।
 
সান্দীপনি মুনির মাতা পৌর্ণমাসী দেবী। সান্দীপনি মুনির কন্যা নান্দীমুখী, পুত্র মধুমঙ্গল। শ্রীপৌর্ণমাসী দেবী লীলাশক্তি তিনি ব্রজ নবদ্বন্দের মিলন বিধান করেন।
 
সে দিবস শ্রীল আচার্য্যদেব প্রসাদক্রমে বহু নিগূঢ় ভক্তিরসের কথা বলেছিলেন। ৪ঠা ভাদ্র তিনি সপার্ষদ চট্টগ্রামে শ্রীপুণ্ডরীক বিদ্যানিধির শ্রীপাটে শুভবিজয় করেন। শ্রীপাটের সেবক শ্রীযুত হরকুমার স্মৃতিতীর্থ মহাশয় আচার্যদেবের মুখে বহু প্রাচীন তথ্য শ্রবণ করে বলেন—আমি গৌর-পার্ষদ বংশের কুলাঙ্গার, তাঁদের কিছুই জানি না এবং তাঁদের সেবাও করি না।
 
১৯৪০ সালে বাংলা ১৩৪৬–১৫ই ফাল্গুন গৌড়ীয় মিশনের তদানীন্তন সেক্রেটারী মহামহোপদেশক শ্রীপাদ নারায়ণ দাস ভক্তিসুধাকর প্রভু কলিকাতা শ্রীগৌড়ীয় মঠে অপ্রকট হন। শ্রীল আচার্য্যদেব তাঁর জন্য বড় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বলেন—শ্রীপাদ ভক্তিসুধাকর প্রভু সত্যসার, মহাধীর, সারগ্রাহী ও মহাবীর পুরুষ ছিলেন। তিনি যথার্থ আদর্শ পুরুষ ছিলেন। তিনি বাহ্যতঃ সন্ন্যাসী না হলেও সন্ন্যাসিদের গুরু ছিলেন।
 
শ্রীমদ্ পুরীদাস গোস্বামী ঠাকুর সন্ন্যাস গ্রহণের পর একটি নূতন জীবন যাপন করতে থাকেন। তিনি কৌপীন বহির্বাস ছাড়া অন্য বস্ত্র ত্যাগ করেন। পাদুকা ব্যবহার করতেন না। নগ্ন পায়ে চলতেন। ধাতু নির্মিত পাত্রে ভোজন করতেন না। ভূতলে শয়ন ও উপবেশন করতেন। একাদশীর দিন রাত্রি জাগরণ করতেন। শ্রীজগন্নাথ মিশ্রের গৃহভৃত্য শ্রীঈশান ঠাকুরের আনুগত্যে ধামের বাগিচায় জল প্রদান করতেন এবং নিরাণী দ্বারা বাগিচায় তৃণাদি পরিষ্কার করতেন। অন্য লোক দিয়েও এ সেবা করাতেন।
 
বৈশাখমাসে গঙ্গাস্নান, গঙ্গাপূজা, তুলসী সেবা, তুলসীতে ছায়াদান, জলধারা প্রদান করতেন। শ্রীহরিভক্তি বিলাসে বৈশাখমাসে যে সমস্ত কৃত্যাদি আছে তা সমস্তই স্বয়ং পালন করতেন—বৈশাখে শ্রীবিগ্রহাগারে সুগন্ধি পুষ্পাভিষেক, চন্দন প্রদান, সুশীতল পানীয় ও স্নিগ্ধ দ্রব্যাদি ভোগর্পণ, ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব অতিথি সেবা, নিত্য শ্রীধাম পরিক্রমা, সংকীৰ্ত্তন, সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ প্রণতি। শ্রীহরিবাসর, গৌর-জয়ন্তী, নিত্যানন্দ জন্মব্রত উপবাস, অদ্বৈত আচার্য্যের ব্রত পালন ও শ্রীরাধাষ্টমী ব্রত প্রভৃতি পালন প্রথা তিনি প্রবর্তন করেন।
 
বাংলা ১৩৪৯ সাল থেকে ১৩৫২ পৰ্য্যন্ত শ্রীল আচার্য্যদেব শ্রীভক্তি সন্দর্ভ ব্যাখ্যা করেন এবং গোস্বামিগণের বিচার ধারা অনুসরণ করেন। ১৯৫৪ সালে অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা দিবসে শ্রীমদ্ভক্তি প্রদীপ তীর্থ গোস্বামী মহারাজ পুরীধামে অপ্রকট হন। শ্রীল আচার্য্যদেব বাংলা ১৩৪২ সাল থেকে শ্রীশ্রীগোস্বামী গ্রন্থ প্রকাশিত করেন। অনন্তর তিনি ১৯৫৪ শ্রীশ্রীমদ্ভক্তি কেবল ঔডুলোমি মহারাজকে গৌড়ীয় মিশনের আচার্য্য ও সভাপতি পদে প্রতিষ্ঠিত করে স্বয়ং নিষ্কিঞ্চনভাবে শ্রীবৃন্দাবন ধামে অবস্থান করতে থাকেন। তিনি গোস্বামিদিগের আনুগত্যে অতি দীনভাবে ব্রজে বাস করতেন এবং ব্রজের তৃণ শুল্ম লতা, পশু পক্ষী প্রভৃতিকে সাক্ষাৎ কৃষ্ণপ্রিয়জন জ্ঞানে নমস্কার ও দণ্ডবৎ করতেন। তিনি সতত গৌরকৃষ্ণ প্রেমাবিষ্ট হৃদয়ে “শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য শচীসুত গৌর গুণধাম”—এই নামকীর্ত্তন করতেন ও হা রাধে হা কৃষ্ণ বলে রাধাকৃষ্ণকে আহ্বান করতেন। যে ধ্বনি ব্রজ ভূমির দিগদিগন্ত মুখরিত করে তুলত। ধ্বনির তালে তালে ময়ূর ময়ূরিগণ নৃত্য করত।
 
শ্রীল প্রভুপাদের কীর্ত্তন প্রচার যুগে প্রাথমিক দৈববর্ণাশ্রম ধর্ম সম্বন্ধে খুব আলোচনা হয়, অনন্তর মহাপ্রভুর শুদ্ধ ভাগবত আদর্শ ধর্মের বিরোধী প্রাকৃত সহজিয়াবাদ সম্বন্ধে তীব্র আলোচনা হয় এবং সম্বন্ধ জ্ঞানের বিষয় প্রবোধন কল্পে সাংখ্য জ্ঞানের বিচার বিশ্লেষণ বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়। শ্রীল আচার্যদেবের অভ্যুদয়ে শ্রীভক্তিসন্দর্ভ ব্যাখ্যার আলোকসম্পাতে ভক্তিরস বৈচিত্র্য বিশ্লেষণ এবং বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রবর্তন হয়।
 
শ্রীল ভক্তিপ্রসাদ পুরীদাস গোস্বামী ঠাকুর যখন ব্রজধামে বাস করতেন তখন সঙ্গে শ্রীপাদ ভক্তি শ্রীরূপ ভাগবত মহারাজ, শ্রীপাদ শিবদবাস্তব প্রভু ও শ্রীপাদ ব্রজসুন্দর দাস প্রভৃতি ভক্তগণ থাকতেন। তিনি একদিন শ্রীরাধারমণ কুঞ্জ বাটীতে বসে হরিকথা প্রসঙ্গে বললেন—মহামন্ত্রের মধ্যে তিনটি মুখ্য নাম আছে—‘হরি’ ‘কৃষ্ণ’ ও ‘রাম’। ‘হরি’ই শ্রীগোবিন্দদেব, ‘কৃষ্ণ’ই শ্রীমদন মোহন বা মদন গোপাল ও শ্রীরাম’ই শ্রীগোপীনাথ ( গোপীজনবল্লভ) বা শ্রীরাধারমণ। ‘হরি’র সম্বোধনে হরে। হরা (শ্রীরাধার) এর সম্বোধনেও ‘হরে’। ‘হরে’‘হরে’– গোবিন্দ গোবিন্দ। ‘হরে’ ‘হরে’ ‘রাধে’ ‘রাধে’ ‘হরে’ ‘হরে’ – রাধাগোবিন্দ। শ্রীমতী বৃষভানু নন্দিনী শ্রীকৃষ্ণের বিরহে ব্যাকুল হয়ে যখন মহামন্ত্র কীর্ত্তন করতেন, তখন পুনঃ পুনঃ শ্রীগোবিন্দদেবের মুখমণ্ডল মনে পড়ত। সেইজন্য তিনি ‘হরে’ ‘হরে’‘গোবিন্দ’‘গোবিন্দ’ বলে সকাতরে আহ্বান করতেন। (বিশেষ দ্রষ্টব্য শ্রীমদ্ভক্তি প্রসাদ পুরীদাস গোস্বামী ঠাকুর গ্রন্থ)
 
অতঃপর শ্রীবৃন্দাবন ধামে ১৯৫৮ সালে ৮ই মার্চ শ্রীরাধারমণদেবের কুঞ্জ বাটীতে প্রাতঃকালে সমবেত ভক্তগণের কাছে তিনি বলতে লাগলেন অন্তর্মুখী হও। ভিতরে যাও। বাহিরে থাকলে চলবে না। স্বদেশে যেতে হবে। কর্তৃত্বাভিমান ছাড়। হৰ্ত্তা কর্ত্রা পালয়িতা একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ। শরণাগত হও। শরণাগতি ভিন্ন বাঁচবার আর পথ নাই। শ্রীহরিই কর্ম করাচ্ছেন, নিজে কৰ্ত্তা সাজা বড় মূর্খতা।
 
শ্রীশ্যাম—শ্যামই শ্রীগৌর কিশোর শ্যামকিশোরই বর্তমান কলিতে “শ্রীগৌরকিশোর”—ইত্যাদি বলবার পর “শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য শচীসুত গৌর গুণধাম। গাও গাও অবিরাম, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য শচীসুত গৌর গুণধাম।” এই নাম কীৰ্ত্তনটি সকলকে করতে বললেন, এবং অপরাহ্নকালে নিত্যলীলায় প্রবেশ করলেন।
 
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিপ্রসাদ পুরী দাস গোস্বামী ঠাকুর কী জয়।
 
 
 
 

Date

Mar 11 2023
Expired!

Time

All Day