Disappearance Day of Srila Krishna Das Kabiraj
শ্রীকবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের আদিলীলায় পঞ্চম পরিচ্ছেদে নিজ পরিচয় কিছু প্রদান করেছেন– ঝামটপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ঝামটপুর বর্ধমান জেলায় নৈহাটী গ্রামের নিকটবর্তী। বর্ত্তমানে তথায় শ্রীকবিরাজ গোস্বামী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের সেবা আছে। পূর্ব্বাশ্রমের আত্মীয় স্বজন কেহ নাই ।
আনন্দ-রত্নাবলী নামক গ্রন্থে শ্রীকবিরাজ গোস্বামীর পূর্ব্ব পরিচয় সম্বন্ধে কিছু লেখা আছে– “পিতার নাম শ্রীভগীরথ। মাতার নাম – শ্রীসুনন্দা , ছোট ভাইয়ের নাম শ্যামদাস। বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা চিকিৎসক ছিলেন।”
শ্রীকবিরাজ গোস্বামী স্বীয় গৃহত্যাগের কারণ এরূপে বর্ণন করেছেন এক সময় তার গৃহে অহোরাত্র শ্রীনাম সংকীর্তন হচ্ছিল। তাতে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর ভৃত্য শ্রীমীনকেতন রামদাস আগমন করেছিলেন। মহান্তগণ শ্রীমীনকেতন রামদাসকে দেখে আনন্দে তাঁকে স্বাগত সৎকার ও দণ্ডবৎ করেন এবং কীৰ্ত্তন মণ্ডপে নিয়ে বসান। তিনি তথায় আনন্দে উপবেশন করলেন। ভাগবতণ সকলে—সম্ভাষণ করতে লাগলেন। সে সময় তিনি প্রেমাবেশে কাকেও গাঢ় আলিঙ্গন, কারও পৃষ্ঠে চাপড় মেরে ক্রোধে ধারণ, কারও শিরে হস্ত দিয়ে আশীর্ব্বাদ প্রভৃতি করতে লাগলেন। তাঁর শুভাগমনে সকলে শ্রীনিত্যানন্দ স্মৃতি উদয় হল। খুব নৃত্য-গীত হতে লাগল। তিনিও প্রেমে মত্ত করীন্দ্রবৎ ভ্রমণ করতে লাগলেন। এভাবে কিছুক্ষণ অতীত হল। তিনি ভক্তগণসহ বিশ্রাম করলেন ।
গুণার্ণব মিশ্র নামে একজন ব্রাহ্মণ শ্রীমূর্ত্তি সেবা করছিলেন। তিনি শ্রীমীনকেতন রামদাসকে কোন প্রকার সম্ভাষণ করলেন না। তা দেখে শ্রীমীনকেতন রামদাস বললেন—
‘এই ত দ্বিতীয় সুত রোমহর্ষণ।’
বলদেব দেখি, যে না কৈল প্রত্যুদ্গম ।।
– (চৈঃ চঃ আদি ৫/১৭০ )
শ্রীমীনকেতন রামদাস একথা বলে পুনঃ নৃত্য-গীত করতে লাগলেন। ভাগবতগণ অজ্ঞের অপরাধ গ্রহণ করেন না। এভাবে উৎসব সমাপ্ত হল। শ্রীমীনকেতন রামদাস সকলকে কৃপা আশীর্ব্বাদ দিয়ে বিদায় হলেন।
একদিবস শ্রীকবিরাজ মহাশয়ের ছোটভাই শ্যামদাসের সঙ্গে শ্রীমীনকেতন শ্রীরামদাসের বাদ-বিতণ্ডা হচ্ছিল। শ্যামদাস শ্রীগৌরসুন্দরকে পূর্ণ ভক্তি করেন কিন্তু শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর প্রতি তাঁর তত ভক্তি নাই। শ্রীরামদাস বললেন দু’জন অভিন্ন দুজন ঈশ্বর। তুমি একজনকে মান, অন্যকে মান না—এতে তোমার সর্ব্বনাশ হবে। এ বলে ক্রোধভরে বংশী ভেঙ্গে চলে গেলেন। শ্রীশ্যামদাসের মহা অপরাধ হল।
শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ ছোট ভায়ের প্রতি রুষ্ট হলেন। তাঁর সঙ্গ থেকে চির বিদায় নিয়ে তিনি বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করলেন। রাত্রে স্বপ্নে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু দর্শন দিয়ে শ্রীকৃষ্ণদাসকে বলছেন
আরে আরে কৃষ্ণদাস, না করহ ভয়।
বৃন্দাবনে যাহ, তাঁহা সৰ্ব্ব লভ্য হয় ।। ( চৈঃ চঃ আদি ৫।১৯৫ )
শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীচরণমূলে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন। তখন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু স্বীয় অভয় শ্রীচরণযুগল তাঁর মস্তকে ধারণ করে বললেন—তুই শীঘ্র বৃন্দাবনে যা। সেখানে তোর সমস্ত আশা পূর্ণ হবে। স্বপ্নে তিনি শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর কৃপাশীর্ব্বাদ লাভ করে আনন্দে শ্রীবৃন্দাবন অভিমুখে চলতে লাগলেন।
শ্রীকবিরাজ মহাশয়ের শ্রীগুরুপাদপদ্ম সাক্ষাৎ নিত্যানন্দ প্রভু—
জয় জয় নিত্যানন্দ, নিত্যানন্দ-রাম।
যাঁহার কৃপাতে পাইনু বৃন্দাবন ধাম।।
জয় জয় নিত্যানন্দ, জয় কৃপাময়।
যাঁহা হৈতে পাইনু রূপ-সনাতনাশ্রয়।।
যাঁহা হৈতে পাইনু রঘুনাথ মহাশয়।
যাঁহা হৈতে পাইনু শ্রীস্বরূপ আশ্রয় ।।
সনাতন কৃপায় পাইনু ভক্তির সিদ্ধান্ত।
শ্রীরূপ কৃপায় পাইনু ভক্তিরসপ্রাপ্ত।।
জয় জয় নিত্যানন্দ চরণারবিন্দ।
যাঁহা হৈতে পাইনু শ্রীরাধাগোবিন্দ ।।
জগাই মাধাই হৈতে মুঞি সে পাপিষ্ঠ ।
পুরীষের কীট হৈতে মুঞি সে লঘিষ্ঠ ।।
মোর নাম শুনে যেই তার পুণ্য ক্ষয়।
মোর নাম লয় যেই তার পাপ হয়।।
এমন নির্ঘণ মোরে কেবা কৃপা করে।
এক নিত্যানন্দ বিনু জগৎ ভিতরে।।
প্রেমে মত্ত নিত্যানন্দ কৃপা অবতার ।
উত্তম, অধম, কিছু না করে বিচার।।
যে আগে পড়য়ে তারে করয়ে নিস্তার।
অতএব নিস্তারিল মো-হেন দুরাচার।।
মে৷ পাপিষ্ঠে আনি শ্রীবৃন্দাবন।
মো-হেন অধমে দিল শ্রীরূপ চরণ।।
( চৈঃ চঃ আদি ৫ । ২০০-২১০)
শ্রীরূপ, শ্রীসনাতন, শ্রীজীব, শ্রীরঘুনাথ ভট্ট, শ্রীরঘুনাথ দাস ও শ্রীগোপাল ভট্ট এই ছয়জন গোস্বামীকে তিনি শিক্ষাগুরু রূপে বরণ করেছেন। তিনি গোস্বামিগণের আজ্ঞায় শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত লিখবার জন্য শ্রীলোকনাথ গোস্বামী ও শ্রীরঘুনাথ ভট্ট গোস্বামীর নিকট কৃপাশীয় প্রার্থনা করতে যান। তখন তাঁরা ঐ গ্রন্থে তাঁদের সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করতে নিষেধ করেন। তাই শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে তাঁদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না।
শ্রীকবিরাজ গোস্বামীর রচিত গ্রন্থাবলী — শ্রীগোবিন্দলীলামৃত, শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত, কৃষ্ণকর্ণামৃতের সারঙ্গ-রঙ্গদা টীকা প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। আর অন্যান্য লিখিত গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় না।
তাঁর আবির্ভাব ১৪৯৬ খৃষ্টাব্দ, তিরোভাবের কাল পাওয়া যায় না। আশ্বিন শুক্লা দ্বাদশীতে তিনি শ্রীবৃন্দাবন ধামে অপ্রকট হন।