
Disappearance Day of Srila Mukunda Dutt Thakur
শ্রীমুকুল দত্ত শাখা-প্রভুর সমাধ্যায়ী।
যাহার কীর্তনে নাচে চৈতন্য-গোসাকি।।
—(চৈঃ চঃ আদি ১০\৪০ )
শ্রীমুকুন্দ দত্ত ঠাকুর প্রভুর সহপাঠী মিত্র ছিলেন। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার অন্তর্গত ছনহরা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। শ্রীবাসুদেব দত্ত ঠাকুর তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। শ্রীকবিকর্ণপুর গোস্বামী লিখেছেন—
ব্রজে স্থিতৌ গায়কৌ যৌ মধুকণ্ঠ-মধুব্রতৌ।
মুকুন্দ বাসুদেবৌ তৌ দত্তৌ গৌরাঙ্গগায়কৌ।।
পূর্ব্বে ব্রজে যাঁরা মধুকণ্ঠ ও মধুব্রত নামক গায়ক ছিলেন, তাঁরা মুকুন্দ ও বাসুদেব নামে দত্তকুলে জন্মগ্রহণ করে শ্রীগৌরাঙ্গের গায়ক হয়েছেন। শ্রীবাসুদের ও মুকুন্দ দত্ত ঠাকুরের কীর্ত্তনে শ্রীগৌর-নিত্যানন্দ স্বয়ং নৃত্য করতেন। মুকুন্দ মহাপ্রভুর অতিশয় প্রিয়পাত্র ছিলেন। প্রভু ও মুকুন্দ সমবয়স্ক ছিলেন। একসঙ্গে পাঠশালায় অধ্যয়ন করতেন এবং বিবিধ ক্রীড়াদি করতেন। শ্রীমুকুন্দ শিশুকাল থেকে একান্ত কৃষ্ণ-নিষ্ঠ ছিলেন। কৃষ্ণ-কীৰ্ত্তন ছাড়া অন্য কোন গীত পছন্দ করতেন না। ইতর কথা বলতেও বেশী পছন্দ করতেন না। প্রভু মুকুন্দের সঙ্গে কৌতুক করবার জন্য তাঁকে দেখলেই দু’হাতে ধরতেন এবং বলতেন— আমার ন্যায়ের সূত্রের জবাব না দিয়ে যেতে পারবে না। মুকুন্দ ও ন্যায় পড়তেন। প্রভু ফাঁকি জিজ্ঞাসা করে কেবল বাদানুবাদ করতেন, মুকুদের তা পছন্দ হত না। সাহিত্য ও অলঙ্কার শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন, অলঙ্কার জিজ্ঞাসা করে প্রভুকে পরাভূত করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে পেরে উঠতেন না। মুকুন্দ বৃথা বাদানুবাদের ভয়ে প্রভুকে দেখলে অন্য পথ দিয়ে যেতেন। প্রভু তা বুঝতে পারতেন—“আমার সম্ভাষে নাহি কৃষ্ণের কখন। অতএব আমা দেখি করে পলায়ন।।” (চৈতন্য ভাগবত আদি লীলা এগার অধ্যায়) বেটা পালিয়ে যা, দেখি কতদিন থাকতে পারিস? দেখব আমার পথ কেমনে এড়াস? আমি এমন বৈষ্ণব হব আমার দ্বারে সকলকেই আসতে হবে।
আর একদিন প্রভুর মুকুন্দের সঙ্গে দেখা হল। প্রভু তাঁর দুখানি হাত ধরে বললেন- আজ তোমাকে কিছুতেই ছাড়ব না। মুকুন্দ বড় মুস্কিলে পড়ে বললেন ব্যাকরণ শিশুরা পড়ে। তোমার সঙ্গে অলঙ্কার শাস্ত্রের আলোচনা করব। প্রভু বললেন – তুমি জিজ্ঞাসা কর। আমি সমস্ত কথার জবাব দিব। মুকুন্দ প্রভুকে পরাভূত করবার জন্য অলঙ্কারের কঠিন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। সৰ্ব্বশক্তিমান প্রভু তার ঠিক ঠিক জবাব দিতে লাগলেন। কখনও সেই অলঙ্কার তিনি খণ্ডন করতে লাগলেন, কখনও তা পুনঃস্থাপন করতে লাগলেন। প্রভু মুকুন্দকে তাঁর সিদ্ধান্ত খণ্ডন ও স্থাপন করতে বললেন, মুকুন্দ তা খণ্ডন ও স্থাপন করতে পারলেন না। মুকুন্দ চিন্তা করতে লাগলেন কেমনে এঁর হাত থেকে নিস্তার পাব। অন্তর্যামী প্রভু ত বুঝতে পেরে বললেন — মুকুন্দ! আজ ঘরে যাও, কাল আবার বিচার হবে। মুকুন্দ নিস্তার পেয়ে বললেন আচ্ছা তাই হউক। কাল আবার বিচার হবে। এ বলে মুকুন্দ দত্ত প্রভুর শ্রীচরণ ধূলি নিয়ে চললেন এবং চিন্তা করতে লাগলেন।
মনুষ্যের এমত পাণ্ডিত্য আছে কোথা!
হেন শাস্ত্র নাহিক, অভ্যাস নাহি যথা!।
এমত সুবুদ্ধি কৃষ্ণভক্ত হয় যবে।
তিলেকো ইহান সঙ্গ না ছাড়িয়ে তবে।।
মনুষ্যের এমন পান্ডিত্য বুদ্ধি হতে পারে না। এমন বুদ্ধিমান পুরুষ যদি কৃষ্ণ-ভক্ত হয়, তবে তিলার্দ্ধ কালও এঁর সঙ্গ ত্যাগ করব না।
শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য, শ্রীবাস পণ্ডিত ও অন্যান্য বৈষকগণ মুকুন্দের কীর্তন শুনতে বড় ভালবাসতেন। শ্রীমুকুন্দ অদ্বৈত সভায় প্রতিদিন যেতেন এবং কীর্তন করতেন। মুকুন্দের ভক্তি রসময় কীর্তন শুনে বৈষ্ণবগণ প্রেমে গড়াগড়ি দিতেন। অদ্বৈত আচার্য মুকুন্দকে ক্রোড়ে নিয়ে প্রেমাশ্রুসিক্ত করতেন। শ্রীঈশ্বর পুরীপাদ যখন নবদ্বীপে আগমন করেন শ্রীমুকুন্দ দত্তের গান শুনে তিনিও অতিশয় প্রেমাবিষ্ট হয়ে পড়েন। তখনই সকলে চিনতে পারলেন, ইনি শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীর শিষ্য শ্রীঈশ্বর পুরী।
মহাপ্রভু প্রথমে গয়াধামে প্রেম প্রকাশ আরম্ভ করেন। গৃহে ফিরে এলেন এবার নূতন ভাব নিয়ে নিরন্তর কৃষ্ণাবেশ। ব্যাকরণ বা ন্যায় শাস্ত্রের আলোচনা একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন। ব্যাকরণের সমস্ত সূত্রে বা ধাতুতে কেবল কৃষ্ণ-নাম। বৈষ্ণবগণ তা’ শুনে প্রভুকে দেখতে এলেন। প্রভু ‘কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ বলে কেঁদে তাঁদের গলা জড়িয়ে ধরলেন। সকলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন প্রভুর দিকে, কিন্তু প্রভুর নয়নে কৃষ্ণপ্রেমের অশ্রুধারা দেখে তাঁরাও ‘কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ বলে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। সন্ধ্যায় প্রভু নিজ গৃহে কীৰ্ত্তন সমারোহ করলেন। সমস্ত বৈষ্ণব এলেন। প্রথমে শ্রীমুকুন্দ দত্ত ধরলেন কীর্ত্তন। শ্রীগৌরসুন্দর শুনেই প্রেমারিষ্ট হয়ে ভূতলে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন। আর ভক্তগণের যে প্রেমাবস্থা হল তা’ কে বর্ণন করতে পারে? কিছু রাত্র এইরূপ কৃষ্ণ প্রেমানন্দে কেটে গেল।
অতঃপর প্রভু মুকুন্দের কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন —মুকুন্দ তুমি ধন্য আমি মিথ্যা বিদ্যারসে সময় অতিবাহিত করেছি। কৃষ্ণ না পেয়ে আমার জন্ম বৃথা গেল।”
একদিন শ্রীগদাধর পণ্ডিতকে শ্রীমুকুন্দ দত্ত বললেন— বৈষ্ণব দর্শন করবে? গদাধর পণ্ডিত বললেন হাঁ বৈষ্ণব দর্শন করব। মুকুন্দ বললেন তবে আমার সঙ্গে এস। তোমাকে অদ্ভুত বৈষ্ণব দেখাব। গদাধর পণ্ডিত চললেন বৈষ্ণব দর্শন করতে। মুকুন্দ তাঁকে নিয়ে এলেন শ্রীপুরীক বিদ্যানিধির সন্নিধানে। পুণ্ড্ররীক বিদ্যানিধি ও মুকুন্দ এক স্থানে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। মুকুন্দ বললেন— গদাধর এঁর মত বৈষ্ণর পৃথিবীতে দ্বিতীয় আছে কিনা সন্দেহ। শ্রীগদাধর দেখলেন— শ্রীপুণ্ড্ররীক বিদ্যানিধি দুগ্ধফেননির্ভ শয্যার উপর বসে তাম্বুল চর্ব্বন করছেন। ভৃত্যগণ চামর পাখা ব্যক্তন করছে। যেন রাজকুমার বিজয় করছেন। গদাধর পণ্ডিত দেখে অবাক, কেমনতর বৈষ্ণব? মহা বিলাসীদের ন্যায় অবস্থান করছেন? শ্রীগদাধর পণ্ডিত আজন্ম বৈরাগ্যশীল। মুকুন্দ গদাধরের ভাব গতিক বুঝতে পারলেন— তখন তিনি ভাগবতের একটি শ্লোক গীতাকারে মধুর রাগিনী যোগে গান আরম্ভ করলেন। মুকুন্দের সে মধুর গীত শ্রবণ করেই শ্রীপুণ্ডরীক বিদ্যানিধি প্রেমাবিষ্ট হয়ে ‘কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ বলে প্রেমাশ্রু বর্ষণ করতে লাগলেন, বিদ্যানিধির অঙ্গে যুগপৎ অষ্ট সাত্ত্বিক বিকার প্রকাশিত হল। কখন উচ্চ রোদন করতে লাগলেন, কখন ভূতলে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। তখন কোথায় সে দিব্য শয্যা? কোথায় দিব্য বেশ? সমগ্র শরীর ধূলিময় হল। শ্রীগদাধর পণ্ডিত নির্ব্বাক ও স্তম্ভিত হলেন। বিস্ফারিত নেত্রে চিত্র-পুত্তলিকার ন্যায় দাঁড়িয়ে কেবল দেখতে লাগলেন।
শ্রীগদাধর পণ্ডিত মনে মনে বলতে লাগলেন- মুকুন্দ ত ঠিকই বলেছিল; এমন বৈষ্ণব ত পূর্ব্বে কোনদিন দেখি নাই, কিম্বা এমন বৈষ্ণবের কথা কারও মুখে শুনি নাই। আমি কি শুভক্ষণে এঁকে দেখতে এসেছি। একে দেখবার আগে এঁর সম্বন্ধে অন্য রকম মনে করে অপরাধ করেছি। মুকুন্দ তুমি বন্ধুর কার্য করেছে। এমন বৈষ্ণব ত্রিলোকে আছে তা জানতাম না। এঁর দর্শনে আমিও পবিত্র হলাম। আমি তাঁকে বিষয়ীর পরিচ্ছদে দেখে বিষয়ী বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু তুমি মহাপরাধ থেকে আমাকে রক্ষা করলে। আমার অপরাধ হয়েছে, আমি যাতে তাঁর চরণ আশ্রয় করে সে অপরাধ থেকে মুক্তি পাই তুমি তার ব্যবস্থা কর।
শ্রীবাস-অঙ্গন কীৰ্ত্তন-পাঠ; শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের যাবতীয় বিলাস, নৃত্য, কীৰ্ত্তন—শ্রীমুকুন্দ দত্ত তথাকার প্রসিদ্ধ গায়ক। একদিন শ্রীগৌরসুন্দর সাত প্রহর কাল পর্যন্ত মহাভাব প্রকাশ করলেন। এ দিন ভক্তগণকে ডেকে ডেকে তাঁর পূর্ব্ব বিবরণ বলে তাঁদের কৃপা করতে লাগলেন। এরূপে ভক্তগণ মহাপ্রভুর কৃপা পাচ্ছেন ও অভীষ্ট বর গ্রহণ করছেন। প্রায় সমস্ত ভক্তকে ডাকলেন, কিন্তু মুকুন্দকে ডাকেন না। মুকুন্দ গৃহের বাইরে বসে প্রভুর ডাকের অপেক্ষা করছেন। শ্রীবাসাদি ভক্তগণ দেখলেন প্রভু মুকুন্দকে ডাকছেন না; তাঁর অভীষ্ট বর দিচ্ছেন না। মুকুন্দ প্রভুর কৃপা পাবার জন্য অস্থির চিত্তে অবস্থান করছেন। শ্রীবাসের হৃদয় তাঁর জন্য আকুল, তিনি সইতে না পেরে কাছে গিয়ে জানালেন — তুমি দীন-হীন সকলকে কৃপা করছ। মুকুন্দকে ডাকছ না কেন? অভীষ্ট বর দিচ্ছ না কেন?
প্রভু বললেন— ও বেটার কথা আমায় বল না।
শ্রীবাস — ও কি অপরাধ করেছে?
শ্রীগৌরসুন্দর— ও বেটা খড় জাঠিয়া – আমার কৃপা পাবে না। কখনও দন্তে তৃণ ধারণ করে, কখনও বা জাঠি মারে।
শ্রীবাস— প্রভো ! সে কি অন্যায় করেছে তা বুঝতে পারলাম না।
শ্রীগৌরসুন্দর ও যখন নির্বিশেষ জ্ঞানীর সভায় যায় তখন তাদের সমর্থন করে। আবার যখন সমাজে যায় তখন প্রেম দেখিয়ে কেঁদে গড়াগড়ি দেয়। যারা আমার স্বরূপ অবজ্ঞা করে তারা আমাকে জাঠি মারে। যারা আমার স্বরূপের প্রতি ভক্তি দেখায় তারা আমাকে সুখী করে। দন্তে তৃণ ধরে কাঁদে। যারা কখনও নিন্দা করে, কখনও স্তুতি করে, তারা খড় জাঠিয়া আমার কৃপা পায় না।
শ্রীমুকুন্দ দত্ত প্রভুর এ কথা শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হলেন, বললেন— এ শরীর আর রাখব না। অপরাধী শরীর ধারণ করে কি হবে? শ্রীবাস পণ্ডিত আবার প্রভুর কাছে এলেন এবং মুকুন্দের দুঃখের কথা জানালেন। প্রভু বললেন – মুকুন্দ কোটি জন্মের পর দর্শন ও কৃপা পাবে। কোটি জন্ম পরে প্রভুর দর্শন কৃপা পাবেন। মুকুন্দ শুনে আনন্দে নৃত্য করে গাইতে লাগলেন—“কোটি জন্ম পরে হে, কোটি জন্ম পরে হে, দরশন হবে রে, দরশন হবে রে।।” অঙ্গনে নৃত্য করতে করতে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। ভক্তবৎসল শ্রীগৌরহরি আর স্থির থাকতে পারলেন না। ভক্তের প্রেমে চঞ্চল হয়ে উঠলেন, শ্রীবাসকে বললেন—মুকুন্দকে শীঘ্রই আমার কাছে নিয়ে এস. ওর কোটি জন্ম হয়ে গেছে, দর্শন করুক। শ্রীবাস বললেন— মুকুন্দ! তুমি স্থির হও, প্রভু তোমাকে ডাকছেন; মুকুন্দ প্রেমে আত্মহারা, কেবল বলছেন—দরশন পাব হে, কোটি জন্মে দরশন হবে রে। দু’নয়ন জলে বক্ষস্থল সিক্ত হচ্ছে। শ্রীবাস পণ্ডিত দেখলেন মুকুন্দ প্রেমে আত্মহারা ! তাঁর বাহ্য স্মৃতি নাই। অঙ্গে হস্ত দিয়ে তাই ডাকতে লাগলেন— মুকুন্দ! মুকুন্দ! স্থির হও—স্থির হও, প্রভু তোমাকে ডাকছেন। শ্রীবাস পণ্ডিতের স্পর্শে এবার মুকুন্দের চৈতন্য ফিরে এল। বললেন—পণ্ডিত ! কি বলছেন? ‘প্রভু তোমাকে ডাকছেন।’ আমি পাপ দেহ নিয়ে প্রভুর কাছে যাব না, কেঁদে কেঁদে কোটি জন্ম কাটাব। অন্তৰ্য্যামী প্রভু সব বুঝতে পারলেন। তখন স্বয়ং ডাকতে লাগলেন মুকুন্দ! মুকুন্দ! এসএস-আমার দিব্যরূপ দেখ। শ্রীবাস পণ্ডিত মুকুন্দকে ধরে প্রচুর শ্রীচরণে নিয়ে এলেন। মুকুন্দ অশ্রু-নীরে ভাসতে ভাসতে, “হে প্রভো, আমি মহাপরাধী” বলে ধরাতলে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন এবং গড়াগড়ি দিয়ে বলতে লাগলেন—
ভক্তি না মানিলু মুঞি এই ছার মুখে।
দেখিলেই ভক্তিশূন্য কি পাইব সুখে।।
বিশ্বরূপ তোমার দেখিল দুৰ্য্যোধন।
যাহা দেখিবারে বেদে করে অন্বেষণ।।
দেখিয়াও সবংশে মরিল দুর্য্যোধন।
না পাইল সুখ, ভক্তি-শূন্যের কারণ।।
—(চৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ১০।২১৫-২১৭)
এ সব কথা বলে মুকুন্দ উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে লাগলেন। তখন প্রভু তাঁকে ভূমি থেকে উঠিয়ে আলিঙ্গন করে বললেন— মুকুন্দ! কোটি জন্ম পরে তুমি আমার দর্শন পাবে বলেছিলাম, কিন্তু তোমার দৃঢ় বিশ্বাস, অকপট শ্রদ্ধা হেতু কোটি জন্ম তিলার্দ্ধেকের মধ্যেই কেটে গেছে। তুমি আমার নিত্য প্রিয়পাত্র। তোমার কোন অপরাধ নাই। জগতকে শিক্ষা দিবার জন্য এ লীলা করেছি। বস্তুতঃ তোমার শরীর ভক্তিময়। তুমি আমার নিত্য দাস, তোমার জিহ্বায় আমার নিত্য বসতি।
“আমার যেমন তুমি বল্লভ একান্ত।
এই মত হউ তোরে সকল মহান্ত।।
যেখানে যেখানে হয় মোর অবতার।
তথায় গায়ন তুমি হইবে আমার।।”
—(চৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ১০।২৫৯-২৬০ )
শ্রীমুকুন্দের প্রতি প্রভু যখন এ বর দিলেন তখন বৈষকগণ মহা ‘হরি’ ‘হরি’ ধ্বনি করে উঠলেন।
মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের সময় মুকুন্দ কীৰ্ত্তন করেন।
“করিলেন মাত্র প্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ।
মুকুন্দেরে আজ্ঞা হৈল করিতে কীৰ্ত্তন।।
‘বোল’ ‘বোল’ বলি’ প্রভৃ আরম্ভিলা নৃত্য।
চতুৰ্দ্দিকে গাইতে লাগিলা সব ভৃত্য।।
(চৈঃ ডাঃ অন্ত্যঃ ১\৮-৯)।
মহাপ্রভু যখন নীলাচলে অবস্থান করতেন তখনও শ্রীমুকুন্দ দত্ত তাঁর সঙ্গে থাকতেন এবং তাঁকে কীৰ্ত্তন শুনাতেন। রথ যাত্রাকালে বাসুদেব দত্ত, শ্রীগোপীনাথ, শ্রীমুরারি ও শ্রীমুকুন্দ প্রমুখ ভক্তদের এক কীর্তন দল গঠিত হত। মুকুন্দ ও কাশীশ্বর পণ্ডিত দু’জন মহা শক্তিমান পুরুষ ছিলেন। রথ যাত্রা কালে লোকের ভিড় ঠেলে মহাপ্রভুর শ্রীজগন্নাথদেবের দর্শনের ব্যবস্থা করে দিতেন।
জ্যৈষ্ঠী-পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীমুকুন্দ দত্ত ঠাকুরের তিরোভাব হয়।