Disappearance Day of Srila Nivasacharya Prabhu

শ্রীনিবাস আচার্যের পিতার নাম ছিল শ্রীগঙ্গাধর ভট্টাচার্য্য। উত্তরকালে তাঁর নাম হয় শ্রী চৈতন্য দাস, এঁর পত্নীর নাম ছিল শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়া। ইনি ভাগীরথী তটে চাখন্দি গ্রামে বসবাস করতেন।
 
শ্রীগৌরসুন্দর যখন নদীয়া নীলা সাঙ্গ করে সন্ন্যাস নেবার জন্য কন্টক নগরে শ্রীকেশব ভারতীর আশ্রমে গেলেন, এ সংবাদ সর্ব্বত্র প্রচার হল। চতুর্দিক থেকে সহস্র সহস্র লোক প্রভুর সন্ন্যাস দেখবার জন্য আসতে লাগল । চাখন্দি হতে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য্যও এলেন। প্রভুর মস্তকের সুন্দর চাঁচর কেশ অন্তর্হিত হবে এ ভাবনায় ভক্তগণ কেঁদে আকুল হচ্ছেন। নাপিত ক্ষৌর কর্ম করতে পারছে না, নয়নের জলে ভাসতে ভাসতে কেঁদে আকুল হচ্ছে। মহাপ্রভু তাকে ক্ষৌর করতে অনুরোধ করছেন। বহুক্ষণ পরে শ্রীমধু নাপিত ক্ষৌর কর্ম করল। কিন্তু দুঃখে কি করলাম? কি করলাম? বলে ধরাতলে মূর্ছিত হয়ে পড়ল। চতুর্দিকে ক্রন্দনের রোল উঠল, গঙ্গাধর ভট্টাচার্য ও ধরাতলে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। কে কাকে প্রবোধ দিবে? কি করুণ দৃশ্য। নর-নারীর কথা দুরে থাকুক, এ দৃশ্য দেখে বৃক্ষ ডালে পক্ষিগণও রোদন করছিল।
 
অনেকক্ষণ পরে শ্রীগঙ্গাধর ভট্টাচার্য্যের মূৰ্চ্ছা যদিও ভাঙল, তিনি উম্মাদের মত হলেন। কেবল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বলতে লাগলেন। চাখন্দি গ্রামে ফিরে এলেন। কিন্তু পাগলের ন্যায় ঐ নাম জপ করতে লাগলেন। তাঁর সাধী পত্নীও প্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের কথা শুনে কেঁদে আকুল হলেন। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মাণী এ ভাবে দিন যাপন করতে লাগলেন।
 
লোকে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য্যের নাম দিল চৈতন্যদাস।
শ্রীচৈতন্যদাস মহাপ্রভুর শ্রীচরণ দর্শন বারবার জন্য সস্ত্রীক পুরীধামে এলেন।
 
কতদিনে নীলাচলে উত্তরিলা গিয়া।
প্রভুর দর্শন লাগি’ উৎকণ্ঠিত হিয়া।।
( ভক্তি রত্নাকর ২|৮৭ )
 
শ্রীচৈতন্যদাস দূর থেকে মহাপ্রভুর শ্রীচরণ দর্শন করে সস্ত্রীক কেঁদে ধরাতলে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন। মহাপ্রভু আহ্বান করে তাদের কাছে নিয়ে গেলেন এবং কৃপা দৃষ্টিপাত করে মধুর বাক্যে বলতে লাগলেন—
 
“জগন্নাথ তোমা আনাইলা হৃষ্ট হৈয়া।।
চল চল জগন্নাথ করহ দর্শন।
করিবে কামনা পূর্ণ শ্রী পদ্মালোচন।।
 
শ্রীজগন্নাথ পরম করুণাময়। তিনি করুণা করে তোমাদের এনেছেন, এবং তিনিই করুণা করে তোমাদের বাসনা পূর্ণ করবেন। যাও তোমরা তাঁকে দর্শন কর। শ্রীচেতন্যদাস সস্ত্রীক শ্রীজগন্নাথ দর্শনে চললেন। প্রভুর সেবক গোবিন্দ তাদের সঙ্গে গেলেন। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী শ্রীজগন্নাথ দর্শন করে প্রেমে কত ক্রন্দন স্তব-স্তুতি করলেন। তারপর প্রভু যে স্থানে তাদের থাকতে নির্দ্দেশ দিয়েছিলেন সে স্থানে এলেন। শ্রীচৈতন্যদাস কিছুদিন আনন্দে নীলাচলে প্রভু সন্নিধানে রইলেন।
 
অন্তর্যামী স্ত্রীগৌরসুন্দর একদিন গোবিন্দকে ডেকে বললেন- গোবিন্দ। ব্রাহ্মাণ ব্রাহ্মণী পুত্র কামনা করে এসেছেন। ‘শ্রীনিবাস’ নামে তাঁর এক সুন্দর পুত্র হবে।
 
শ্রীরূপ সনাতনের দ্বারা আমি ভক্তিশাস্ত্র প্রকাশ করেছি। শ্রীনিবাসের সহায়তায় সে শাস্ত্র সর্ববত্র বিতরণ করব। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী শীঘ্র গৌড় দেশে গমন করুক।
 
শ্রীচৈতন্যদাস মহাপ্রভুর শুভ আশীর্বাদ পেয়ে আনন্দে গৌড় দেশে ফিরে এলেন। এ সময় ব্রাহ্মণীর গর্ভে শ্রীচৈতন্যের কৃপাশক্তির অধিষ্ঠান হল । লক্ষ্মীপ্রিয়ার বাবার নাম শ্রীবলরাম বিপ্র। তিনি পণ্ডিত ও জ্যোতিষী ছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন। লক্ষ্মীর গর্ভে কোন মহাপুরুষ জন্ম গ্রহণ করবেন।
 
বৈশাখী পূর্ণিমা দিবা রোহিণী মুহূর্ত্ত ।
শুভক্ষণে লক্ষ্মীপ্রিয়া প্রসবিলা পুত্র ।।
(ভঃ রঃ ২। ১৫৬ )
 
শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়া বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা দিবসে রোহিণী নক্ষত্রে সকল এক অপূর্ব সন্তান প্রসব করলেন। পুত্রের অঙ্গকান্তি যেন স্বর্ণচাঁপার ন্যায়। দীর্ঘ নাসা, আকর্ণ নেত্র, বিস্তৃত বক্ষস্থল, আজানুলম্বিত ভুজ যুগল মহাপুরুষের যাবতীয় লক্ষণ তাতে স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল।
 
শ্রীচৈতন্যদাস পুত্রকে তৎক্ষণাৎ শ্রীচৈতন্য পদ-পদ্মে অর্পণ করলেন। পুত্রের জন্মোৎসব উপলক্ষে ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীগণকে সেবা, দান-দক্ষিণা প্রদান করলেন। পুত্র পেয়ে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মনী বড়ই সুখী হলেন। লক্ষ্মীপ্রিয়া পুত্র কোলে নিয়ে শ্রীগৌরনাম কীর্তন করতেন। পুত্রকে গৌর নাম শিখাতেন। চন্দ্রকলার ন্যায় পুত্র দিন দিন বাড়তে লাগল। ক্রমে চূড়াকরণ যজ্ঞোপবীত প্রভৃতি হল। তারপর শ্রীধনঞ্জয় বিদ্যাবাচস্পতির নিকট ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে লাগলেন। বালক অল্পকালের মধ্যে শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী হলেন।
 
বাল্যকালেই শ্রীনিবাস শ্রীগোবিন্দ ঘোষ ঠাকুর ও শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর প্রভৃতির কৃপা প্রাপ্ত হলেন। কিছুদিন পরে শ্রীনিবাসের পিতৃ বিয়োগ হয়। পিতার অন্তর্ধানে শ্রীনিবাস অত্যন্ত কাতর হলেন। ভক্তগণ শ্রীনিবাসকে অনেক প্রবোধ দিয়ে শান্ত করলেন। শ্রীলক্ষ্মীপ্রিয়া পতি বিয়োগে বড়ই কাতর হলেও পুত্র মুখপানে তাকিয়ে ধৈর্য্য ধারণ করলেন।
 
শ্রীনিবাস জননীকে নিয়ে চাখন্দি থেকে কিছুদিন পরে যাজি গ্রামে মাতামহ শ্রীবলরাম বিপ্রের গৃহে এলেন। যাজি গ্রামে শ্রীনিবাসের আগমনে তথাকার সজ্জনবৃন্দ পরম আনন্দ লাভ করলেন। শ্রীনিবাসের অগাধ পাণ্ডিত্য ও ভক্তিপ্রেম দেখে তথাকার পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ চমৎকৃত হলেন। শ্রীনিবাসের হৃদয় কোন বস্তুর জন্য লালায়িত নয়। তিনি কেবল শ্রীচৈতন্য চরণ দর্শন চিন্তায় বিভোর থাকেন। ক্রমে নীলাচলে যাবার জন্য বড়ই অধীর হয়ে পড়লেন।
 
শ্রীনিবাস শ্রীখণ্ডের শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুরের শ্রীপাদপদ্ম দর্শন করতে শ্রীখণ্ডে এলেন এবং প্রেমে গদগদ চিত্তে তাঁর শ্রীচরণমূলে লুটিয়ে পড়লেন। এতাদৃশ প্রেম দেখে শ্রীসরকার ঠাকুর তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। শ্রীনিবাস গৌরসুন্দরের নাম স্মরণ করে ক্রন্দন করতে লাগলেন। তারপর প্রার্থনা জানালেন নীলাচলে গিয়ে শ্রীগৌরসুন্দরের লীলাস্থান দর্শন করবেন। শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর ও শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর প্রভৃতি তাঁর শুভ প্রস্তাব শুনে সুখী হলেন, বললেন—কয়েকদিন ধৈর্য ধারণ কর। যখন গৌড়ীয় ভক্তগণ পুরী যাবেন তখন তাদের সঙ্গে যেয়ো।
 
শ্রীনিবাস শ্রীখণ্ডের ভক্তগণ থেকে বিদায় নিয়ে যাজিগ্রামে এলেন। এবং জননীকে এই প্রস্তাব জানালেন। জননী বড় কাতর হয়ে পড়লেন। তথাপি পুত্রের একান্ত ইচ্ছা দেখে যাবার অনুমতি দিলেন। অতঃপর কিছুদিন গৌড়ীয় ভক্তদিগের সঙ্গে তিনি পুরীর দিকে যাত্রা করলেন। তিনি বড় বিহ্বল অন্তরে ক্রমে নীলাচলে পৌঁছলেন সন্ধ্যাকালে। রাত্রে সিংহদ্বারের নিকট এক পাণ্ডাগৃহে অবস্থান করলেন। প্রাতঃকালে শ্রীগদাধর পণ্ডিতের গৃহে এলেন। পণ্ডিতকে দেখে শ্রীনিবাস ভূতলে পড়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। শ্রীগদাধর পণ্ডিত, তাকে স্নেহে ধরাতল থেকে উঠিয়ে কোলে করলেন। শ্রীনিবাস গদাধরের কোলে গৌর বিরহে ক্রন্দন করতে লাগলেন।
 
 
শ্রীগদাধর পণ্ডিতের গৃহে একদিন অবস্থানের পর শ্রীনিবাস, শ্রীরামানন্দ রায়, শ্রীসাৰ্ব্বভৌম পণ্ডিত, শ্রীবক্রেশ্বর পণ্ডিত, শ্রীপরমানন্দ পুরী, শ্রীশিখি মাহিতি, গোবিন্দ, শঙ্কর ও গোপীনাথ আচার্য্য প্রভৃতি শ্রীগৌর- পার্ষদগণের শ্রীচরণ দর্শনে চললেন। শ্রীনিবাসকে দর্শন করে ভক্তগণ সকলে সুখী হলেন। শ্রীনিবাসের অপূর্ব্ব গৌর প্রেম দর্শনে ভক্তগণ বুঝতে পারলেন তিনি গৌরশক্তি। তাঁর দ্বারা জগতে ভবিষ্যতে গৌরবাণী ও গ্রন্থাবলী প্রচারিত হবে। ভক্তগণ শ্রীনিবাসকে বিবিধ উপদেশ প্রদান করতে লাগলেন। শ্রীনিবাস কিছুদিন পুরীতে থেকে শ্রীগৌরসুন্দরের যাবতীয় লীলাস্থলী সকল দর্শন করলেন। অনন্তর গৌড় দেশে আসবার জন্য ভক্তগণের কাছে বিদায় প্রার্থনা করলেন। ভক্তগণ শ্রীনিবাসকে স্নেহে আলিঙ্গন আদি করে বিদায় দিলেন। শ্রীনিবাস ভক্তদের থেকে বিদায় নিয়ে গৌড় দেশাভিমুখে আসতে লাগলেন। কিছু পথ চলবার পর সংবাদ পেলেন শ্রীগদাধর পণ্ডিত অপ্রকট হয়েছেন। শ্রীনিবাস তাঁর বিরহে মূৰ্চ্ছা প্রাপ্ত হলেন, অতঃপর বিরহে আর্দ্রস্বরে রোদন করতে লাগলেন। রাত্রে স্বপ্নযোগে শ্রীগদাধর পণ্ডিত তাঁকে দর্শন দিয়ে শান্ত করলেন। শ্রীনিবাস পুনঃ গৌড় দেশাভিমুখে চলতে লাগলেন। পথে শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য প্রভুর ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর অপ্রকট বার্ত্তা শ্রবণ করলেন। শ্রীনিবাস সেদিন তথায় অবস্থান করলেন, বিরহে অবিরাম অশ্রুপাত করতে লাগলেন। স্বপ্নে দর্শন দিয়ে করুণাময় শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য তাঁকে শান্ত করলেন। শ্রীনিবাস ক্রমে গৌড়দেশে এলেন। প্রথম শ্রীখণ্ডে শ্রীনরহরি সরকার, শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর আদির শ্রীচরণ দর্শন করলেন। তাদের আশীর্ব্বাদ নিয়ে তিনি নবদ্বীপ শ্রীমায়াপুরে আগমন করলেন। শ্রীগৌরসুন্দরের জন্মভূমি দর্শন করে শ্রীনিবাস প্রেমে ভূমিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। মহাপ্রভুর গৃহে তখন শ্রীবংশীবদন ঠাকুর অবস্থান করছিলেন। শ্রীনিবাস বংশীবদন ঠাকুরের শ্রীচরণে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন। শ্রীবংশীবদন ঠাকুর তাঁর পরিচয় পেয়ে পরম সুখী হলেন। মহাপ্রভুর নাম স্মরণ করে শ্রীনিবাস উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে লাগলেন। শ্রীনিবাস শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণীর শ্রীচরণ দর্শন প্রার্থনা করলেন। সেইকালে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণী কাকেও দর্শন দিতেন না। শ্রীবংশীবদন ঠাকুর শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণীর শ্রীচরণে শ্রীনিবাসের কথা জ্ঞাপন করলেন। অনেকক্ষণ ভাবার পর আজ্ঞা করলেন, তাঁকে নিয়ে এস।
 
শ্রীনিবাসকে শ্রীবংশীবদন ঠাকুর শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণীর শ্রীচরণে নিয়ে গেলেন। শ্রীনিবাস শ্রীঠাকুরাণীকে দর্শন মাত্রই প্রেমাশ্রু নেত্রে ভূমি তলে সাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ করলেন।
 
“শ্রীনিবাস গেলেন শ্রীঈশ্বরী সাক্ষাতে।।
প্রেমধারা নেত্রেতে বহয়ে নিরন্তর।
ধরণী লোটাঞা কৈল প্রণতি বিস্তর।।
 
– (ভঃ রঃ ৪|8০-৪১ )
 
শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণী তাঁকে আশীর্ব্বাদ করলেন এবং সে দিবস তথায় প্রসাদ পেতে বললেন।
 
গৌর বিরহে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণীর শ্রীঅঙ্গ কৃষ্ণ চতুর্দশীর চাঁদের
 
মত অতি ক্ষীণ। তন্দুলের সাহায্যে শ্রীহরিনামের সংখ্যা রাখতেন, তাতে যে কয়েকটি তণ্ডুল হত তা রন্ধন করে শ্রীগৌর সুন্দরকে অর্পণ করতেন, তা সয়ং গ্রহণ করে জীবনধারণ করতেন।
শ্রীনিবাস নবদ্বীপে শ্রীমুরারি গুপ্ত, শ্রীবাস পণ্ডিত, শ্রীদামোদর পণ্ডিত, শ্রীসঞ্জয়, শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী, দাস গদাধর প্রভৃতির শ্রীচরণ দর্শন করলেন। তিনি কয়েক দিন নবদ্বীপে অবস্থান করবার পর শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈত ভবনে এলেন। এবং সীতা ঠাকুরাণীর শ্রীচরণ দর্শন করলেন
 
প্রাণ মাত্র আছে সীতা মাতার শরীরে।
শ্রীনিবাসে বোলাইয়া লৈল অন্তঃপুরে।।
 
-(ভঃ রঃ ৪ |৭০ )
 
শ্রীসীতা ঠাকুরাণী গৌর বিরহে প্রাণে মাত্র জীবিত আছেন। শ্রীনিবাসকে প্রচুর আশীর্ব্বাদ করলেন। শ্রীনিবাস শান্তিপুরে অন্যান্য ভক্তগণেরও শ্রীচরণ দর্শন-বন্দনাদি করলেন। ক্রমে সেখান থেকে খড়দহ গ্রামে এলেন। খড়দহে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর গৃহে শ্রীপরমেশ্বরী দাস ঠাকুর তখন অবস্থান করছিলেন। তিনি শ্রীনিবাসকে শ্রীবসুধা, শ্রীজাহ্নবা ও শ্রীবীরচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করালেন। শ্রীনিবাস প্রেমাশ্রু পূর্ণ নয়নে দণ্ডবৎ করতেই শ্রীজাহ্নবা ঈশ্বরী তাঁর শিরে শ্রীচরণ ধূলি দিলেন। শ্রীনিবাসকে সকলে পরম স্নেহ করতে লাগলেন। খড়দহ গ্রামে কয়েক দিন তিনি রহিলেন। অনন্তর শ্রীজাহ্নবা মাতা তাকে শ্রীবৃন্দাবন ধামে যেতে আদেশ করলেন। শ্রীনিবাস শ্রীজাহ্নবা দেবীর তাদেশ শিরোধার্য্য করে খানাকুলে শ্রীঅভিরাম গোপাল ঠাকুরের গৃহে এলেন। শ্রীঅভিরাম গোপাল ঠাকুরকে বন্দনা করতেই তিনি তাঁর জয়-মঙ্গল নামক চাবুক তিনবার শ্রীনিবাসের দেহ স্পর্শ করালেন। তাঁর পত্নী শ্রীমালিনী দেবী নিষেধ করলেন।
 
প্রেমাবেশে পুনঃ সে চাবুক স্পর্শাইতে।
শ্রীমালিনী দেবী আসি ধরিলেন হাতে ।।
( ভঃ রঃ ৪ |১৪১ )
 
জয়মঙ্গল চাবুক স্পর্শে শ্রীনিবাসের দেহে প্রেমের সঞ্চার হল। শ্রীনিবাস অভিরাম গোপাল ঠাকুরকে বন্দনা করে তাঁর কৃপাশীর্ব্বাদ নিয়ে শ্রীখণ্ডে এলেন। শ্রীখণ্ডের শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর ও শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর তাকে দেখে অতি সুখী হলেন। অতঃপর তিনি যাজিগ্রামে নিজ গৃহে এলেন এবং স্বীয় জননীর চরণ বন্দনা করলেন। শ্রীনিবাস জননী স্থানে বৃন্দাবনে যাবার আজ্ঞা প্রার্থনা করলেন। জননী সানন্দে অনুমতি দান করলেন। শ্রীনিবাস শীঘ্র বৃন্দাবনাভিমুখে যাত্রা করলেন। পথে গয়াধামে উপস্থিত হয়ে শ্রীবিষ্ণু পাদপদ্ম দর্শন করলেন। এই স্থানে শ্রীঈশ্বর পুরীর সঙ্গে মহাপ্রভুর মিলন হয় এবং প্রভু তাঁর থেকে মন্ত্র দীক্ষা গ্রহণ করেন।
 
গয়াধামে দুই তিন দিন অবস্থান করে কাশীতে শ্রীচন্দ্রশেখরের গৃহে এলেন। শ্রীনিবাসের অন্যান্য ভক্তগণের সহিত তথায় মিলন হল। শ্রীচন্দ্রশেখর ও শ্রীতপন মিশ্রের মুখে কাশীতে মহাপ্রভু যে যে লীলা করেছিলেন তা শ্রবণ করে আনন্দ সাগরে ভাসতে লাগলেন। কয়েকদিন তথায় থাকার পর সেখান থেকে শ্রীমথুরা ধামে এলেন। বিশ্রাম ঘাটে স্নান করলেন। এই স্থানে শ্রীকৃষ্ণ কংসাসুরকে বধ করার পর বিশ্রাম করেছিলেন। তাই বিশ্রামঘাট নাম হয়েছে। শ্রীনিবাস মথুরায় শ্রীকৃষ্ণ জন্মস্থান ও আদিকেশব দর্শন করে শ্রীবৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করলেন, পথে কয়েকজন বৃন্দাবনবাসী ব্রাহ্মণের মুখে শ্রীরূপ সনাতনের তথা রঘুনাথ ভট্ট গোস্বামী প্রভৃতির অপ্রকট কথা শুনে অতি বিষণ্ণ হলেন। “শুনি শ্রীনিবাস ভাসিলেন নেত্র জলে। মূৰ্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন ভূমিতলে।।”(ভঃ রঃ ৪।২০৩ ) তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্মণগণ ছিলেন, তাঁরা শ্রীনিবাসকে অনেক কথা বুঝিয়ে শ্রীজীব গোস্বামীর স্থানে নিয়ে এলেন। শ্রীজীব গোস্বামী পূর্ব্বেই শ্রীনিবাসের পরিচয় শুনেছিলেন। শ্রীনিবাস শ্রীজীব গোস্বামী শ্রীপাদ পদ্ম বন্দনা করলেন। শ্রীজীব গোস্বামী আনন্দে শ্রীনিবাসকে ধরে আলিঙ্গন করলেন। অতঃপর উভয়ে বিবিধ কথোপকথন করতে লাগলেন। শ্রীজীব গোস্বামী গৌড় দেশবাসী ভক্তগণের বিবিধ কুশল বার্তাদি জিজ্ঞাসা করলেন এবং তাঁর থাকবার ও প্রসাদ পাবার ব্যবস্থা করলেন। সেদিন শ্রীগোবিন্দদেবের সেবক শ্রীকৃষ্ণ পণ্ডিত প্রসাদ নিয়ে
এলেন। শ্রীজীব গোস্বামী সে প্রসাদ শ্রীনিবাসের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা দিবসে অপরাহ্নে শ্রীনিবাস বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামী স্থানে এসেছিলেন। প্রাতঃকালে তিনি শ্রীজীব গোস্বামীর সঙ্গে শ্রীরাধারমণ দর্শন করলেন। শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামীর সঙ্গেও দেখা হল। শ্রীগোপালভট্ট গোস্বামী শ্রীনিবাসকে দেখে পরম সুখী হলেন। শ্রীজীব গোস্বামী শ্রীনিবাসের সবিশেষ পরিচয় প্রদান শ্রীনিবাস শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামীর শ্রীপাদপদ্ম বন্দনা পূৰ্ব্বক অতি বিনীত ভাবে মন্ত্র দীক্ষাদি প্রার্থনা করলেন। শ্রীভট্ট গোস্বামী আনন্দের সহিত রাজি হলেন। পরদিবস শ্রীনিবাসকে শ্রীশ্রীরাধারমণ সন্নিধানে শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী মন্ত্র দীক্ষা দান করলেন। শ্রীজীব গোস্বামী পরদিন শ্রীনিবাসকে শ্রীমদ্ রঘুনাথ দাস গোস্বামীর নিকট প্রেরণ করলেন। শ্রীনিবাস আনন্দে শ্রীরাধাকুণ্ডে এসে শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী, শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ, শ্রীরাঘব পণ্ডিত প্রভৃতির শ্রীচরণ বন্দনা করলেন। তিন দিন শ্রীনিবাস রাধাকুণ্ডে গোস্বামিদের সঙ্গে অবস্থান করে অনেক রকমের ভজনোপদেশ লাভ করেন। সকলের অনুমতি নিয়ে শ্রীনিবাস পুনঃ শ্রীবৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামিপাদের নিকট জীব গোস্বামী নিকট ফিরে এলেন ।
 
অনন্তর শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী শ্রীনিবাসকে শ্রীমদ্ভাগবত ও গোস্বামী। গ্রন্থ অধ্যয়ন করাতে লাগলেন। অল্প সময়ের মধ্যে গোস্বামী গ্রন্থের সিদ্ধান্ত সমূহ শ্রীনিবাস হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন। তাঁর প্রতিভা দর্শন করে শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী তাঁকে “আচার্য্য” পদবী প্রদান করলেন। সে দিন থেকে তিনি শ্রীনিবাস আচার্য্য নামে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে খ্যাত হলেন।
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য পূৰ্ব্বে শ্রীনরোত্তমের নাম শ্রবণ করেছিলেন। শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট তাঁর সাক্ষাৎ দর্শন পেলেন। শ্রীনিবাস ও শ্রীনরোত্তমের মিলন হল, চির সৌহার্দ্য ভাব জেগে উঠল। শ্রীজীব গোস্বামী শ্রীনিবাস ও শ্রীনরোত্তমকে শ্রীরাঘব গোস্বামীর সঙ্গে ‘বন’ ভ্রমণের আদেশ দিলেন। শ্রীগোস্বামীর আদেশ পেয়ে তাঁরা আনন্দে ‘বন’ ভ্রমণে যাত্রা করলেন।
 
শ্রীরাঘব গোস্বামী দাক্ষিণাত্য নিবাসী ব্রাহ্মণ। তিনি শ্রীগৌরসুন্দরের একান্ত অনুরক্ত প্রিয়জন ছিলেন।
 
শ্রীমদ্ কবি কর্ণপুর লিখেছেন—
 
শ্রীরাধা প্রাণরূপা যা শ্রীচম্পকলতা ব্ৰজে ।
সাদ্য রাঘব গোস্বামী গোবৰ্দ্ধন কৃতস্থিতিঃ।।
 
পূর্বে যিনি ব্রজে শ্রীরাধার প্রাণসখী চম্পকলতা নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি বর্তমানে শ্রীগৌরলীলায় শ্রীরাঘব গোস্বামী নামে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং নিয়ত গোবর্দ্ধন গিরিরাজে অবস্থান করে গিরিরাজের আনন্দ বর্দ্ধন করছেন।
 
শ্রীনরহরি চক্রবর্ত্তী ভক্তিরত্নাকরের পঞ্চম তরঙ্গে শ্রীনিবাস ও শ্রীনরোত্তম ঠাকুরের শ্রীরাঘব গোস্বামীর সহিত শ্রীমথুরা মণ্ডলের ৮৪ ক্রোশ ভ্রমণ প্রসঙ্গ অতি বিস্তৃত ভাবে বর্ণনা করেছেন।
 
কিছুদিন শ্রীনিবাস ও শ্রীনরোত্তম, শ্রীরাঘর গোস্বামীর সঙ্গে বন ভ্রমণ করে বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট ফিরে এলেন। এমন সময় দুঃখী শ্রীকৃষ্ণদাস (শ্যামানন্দ প্রভু) গৌড়দেশ থেকে ব্রজে এলেন। শ্রীজীব গোস্বামী তাঁকে দেখে বড় আনন্দিত হলেন। দুঃখী কৃষ্ণদাস শ্রীহৃদয়চৈতন্য প্রভুর প্রিয়
শিষ্য। শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু স্বয়ং তাঁকে শ্রীজীবের নিকট পাঠিয়েছেন। দুঃখী কৃষ্ণদাস শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট গৌড় দেশ ও উৎকল দেশবাসী ভক্তগণের কুশল বার্তা প্রদান করলেন।
 
অতঃপর দুঃখী কৃষ্ণদাসের সঙ্গে শ্রীনিবাস আচার্য্যের ও শ্রীনরোত্তমের পরিচয় হল। তিনজন সৰ্ব্বগুণমণ্ডিত, পরস্পর চির মৈত্রী ভাবযুক্ত। তিনজন শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট ‘গোস্বামীগ্রন্থ ‘অনুশীলন করতে লাগলেন। এই সমস্ত গোস্বামী-গ্রন্থ শ্রদ্ধালু প্রিয়জনগণকে অধ্যয়ন করাব, শ্রীজীব গোস্বামীর অন্তরে এরূপ যে বাসনা ছিল, তা যেন সিদ্ধ হল।
 
এ সময় ব্রজের গোস্বামিগণ মিলিত হয়ে ঠিক করলেন। এই তিনজনের দ্বারা গৌড়দেশে গোস্বামি-গ্রন্থ প্রচার করতে হবে। তিনজন মহাবৈরাগ্যশীল ও ভক্তিরস শাস্ত্রে পরম পণ্ডিত। অতঃপর তিনজনকে আহ্বান করে গোস্বামিগণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করলেন। তিনজন অবনত শিরে সে আদেশ পালন করতে রাজি হলেন। শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী গ্রন্থ সম্পুটের অধ্যক্ষ করলেন শ্রীনিবাস আচার্য্যকে। তাঁদের গ্রন্থ নিয়ে যাবার দিন ঠিক হল অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে।
 
অতঃপর শ্রীগোবিন্দ, শ্রীগোপীনাথ ও শ্রীমদন মোহনের বন্দনা করে গোস্বামিদের অনুমতি নিয়ে শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী, শ্রীনিবাস, শ্রীনরোত্তম ও শ্রীদুঃখী কৃষ্ণদাসকে (শ্যামানন্দ) গ্রন্থসহ গৌড়দেশে প্রেরণ করলেন। গ্রন্থের গাড়ী রক্ষার জন্য উপযুক্ত রক্ষক পুরুষগণও চলতে লাগলেন। মথুরা থেকে সুপ্রসিদ্ধ পথ ধরে গাড়ী গৌড়দেশ অভিমুখে চলবার সময় বহু পথিকও গাড়ীর সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল। স্থানে স্থানে বিশ্রাম, সংকীর্ত্তন, ভোগ-রাগ প্রদান প্রভৃতি সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। ক্রমে গাড়ী বনবিষ্ণুপুরে প্রবেশ করল।
 
বনবিষ্ণুপুরের অধিকারী ছিলেন দস্যু দলপতি বীর হাম্বীর। তিনি চরের মুখে জানতে পারলেন যে বহু লোকজনসহ ধনরত্ন পূর্ণ এক গাড়ী গৌড় দেশের দিকে যাবার পথে বনবিষ্ণুপুরে প্রবেশ করেছে। তাই তিনি স্থির করলেন গাড়ী লুঠ করতে হবে। এদিকে গাড়ী বিষ্ণুপুরে প্রবেশ করতে সূর্যদেব অস্ত্রমিত হলেন। তিনজন মন্ত্রণা করে ঐ নগরীর মধ্যে সরোবর তটে উপবন প্রান্তে বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন। সন্ধ্যায় তথায় সঙ্কীর্ত্তন নৃত্য আরম্ভ হল। গ্রামের বহু লোক তা দেখবার জন্য ছুটে এল। বৈষ্ণবগণের অঙ্গ তেজ দেখে, ভজন কীৰ্ত্তনাদি শুনে সকলে আশ্চর্য হল।
 
রাজা বীর হাম্বীর বার বার চর প্রেরণ করে খবর নিচ্ছেন। ভাবছেন বিধাতা বহুদিন পরে মনের সাধ মিটালেন। ক্রমে রাত্রি গভীর হলে বৈষ্ণবগণ প্রসাদ গ্রহণের পর গ্রন্থ পূর্ণ গাড়ীর চারি পার্শ্বে শয়ন করলেন। সকলে নিদ্রিত হলেন। এ সময় দস্যুগণ সাবধানে গাড়ী থেকে গ্রন্থ পূর্ণ সিন্দুকটি নিয়ে বরাবর রাজ অন্তঃপুরে এলে। রাজা গ্রন্থের সিন্দুক দেখে বিবেচনা করলেন – তাতে বহু ধন-রত্ন আছে। তিনি আনন্দে আত্মহারা হলেন। দস্যুগণকে ডেকে বস্তু ভূষণাদি দিয়ে তাদের প্রশংসা করতে লাগলেন।
 
শ্রীবীর হাম্বীর রাজা মনে বিচারয়।
এই গাড়ী পশ্চিম দেশের সুনিশ্চয়।।
বহু দিন বহু অর্থ লাভ হৈল মোরে।
এরূপ আনন্দ কভু না হয় অন্তরে।।
বুঝিলু—অমূল্য রত্ন আছয়া ইহায় ।
এত কহি গ্রন্থের সম্পুট পানে চায় ।।
(ভঃ রঃ ৭|৮০-৮২)
 
রাজা বীর হাম্বীরের একজন গণক ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে তিনিও বললেন সিন্দুকে বহু অমূল্য নিধি আছে।
 
এদিকে বৈষ্ণবগণ প্রাতঃকালে জেগে দেখলেন গাড়ীতে গ্রন্থ সম্পুটটা নাই। অমনি সকলের শিরে যেন বজ্রপাত হল। সকলে চতুর্দিকে অন্বেষণ করতে বের হলেন। কিন্তু কোন সন্ধান পেলেন না। বিষাদে সকলে মৃতপ্রায় হলেন। কিছুক্ষণ পরে বৈষ্ণবগণ একটু ধৈর্য্য ধারণ করে বলতে লাগলেন— শ্রীগোবিন্দেদেবের কি ইচ্ছা, কি জানি? তাঁর শুভ আশীর্ব্বাদ নিয়ে যাত্রা করেছি। তিনি গ্রন্থপূর্ণ সম্পুট বের করে দিবেন। বৈষ্ণবগণ এভাবে বলাবলি করতে লাগলেন। এমন সময় গ্রামবাসীদিগের কাছে শুনতে পেলেন, এ দেশের রাজা দস্যু দলপতি। তিনিই এ সমস্ত জিনিস হরণ করেছেন।
 
এদিকে রাজা সেই রাত্রে গ্রন্থ সম্পুট খুললেন—দেখলেন মূল্যবান বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত গ্রন্থ-রত্নরাজি। পরে গ্রন্থগুলি খুলে যখন ‘শ্রীরূপ গোস্বামী” এ নাম ও তাঁর মুক্তা পাতির ন্যায় শ্রীহস্ত অক্ষর দর্শন করলেন তখন তাঁর জীবনের পুঞ্জীভূত পাপ দূর হয়ে গেল। হৃদয় পবিত্র হল। শুদ্ধ হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার হল। রাজা গ্রন্থ সম্পুট রেখে নিদ্রিত হলেন। তখন স্বপ্নে দেখতে লাগলেন–
 
স্বপ্নচ্ছলে দেখে—এক পুরুষ সুন্দর।
জিনি হেম পৰ্ব্বত অপূর্ব্ব কলেবর ।।
শ্রীচন্দ্রবদনে কহে হাসিয়া হাসিয়া ।
চিন্তা না করিহ তেঁহ মিলিব আসিয়া ।।
হইব তোমার প্রতি প্রসন্ন অন্তর।
জন্মে জন্মে হও তুমি তাহার কিঙ্কর।।
 
(ভঃ রঃ ৭। ১০৩-১০৫ )
 
অপূর্ব্ব গ্রহরত্ন দেখে রাজা মনে মনে বললেন—এ গ্রহরত্ন যাঁদে তাদের বড় দুঃখ দিয়েছি নিশ্চয়ই। আমার কি গতি হবে জানি না। স্বপ্নে এক দিব্য পুরুষ এসে বলতে লাগলেন — “রাজা! তুমি চিন্তা কর না। যাঁর এ অপূর্ব্ব গ্রহরত্ন তিনি সত্বর তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। জন্মে জন্মে তুমি তাঁর কিঙ্কর হও।”
 
শ্রীনরোত্তম ঠাকুরকে খেতরি গ্রামে এবং শ্রীদুঃখী কৃষ্ণদাসকে অম্বিকায় প্রেরণ করে, রাজগৃহ থেকে গ্রন্থ উদ্ধার করবার জন্য শ্রীনিবাস আচার্য্য স্বয়ং বিষ্ণুপুরে রইলেন।
 
বিষ্ণুপুরবাসী শ্রীকৃষ্ণবল্লভ নামক একজন পণ্ডিত ব্রাহ্মণ শ্রীনিবাস আচার্যকে দর্শন করে মুগ্ধ হলেন এবং আচার্য্যকে যত্ন করে গৃহে নিয়ে তাঁর পুজাদি করলেন। অনন্তর তাঁর থেকে মন্ত্র-দীক্ষা গ্রহণ করলেন। তথায় আর কয়েকজন ব্যক্তিও তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়ে মন্ত্র দীক্ষা নিলেন।
 
রাজা নিত্য ভাগবত শুনেন—শুনে শ্রীনিবাস আচার্য্য ইচ্ছা করলেন একদিন রাজগৃহে ভাগবত পাঠ করবেন। এ প্রস্তাব শ্রীকৃষ্ণবল্লভের কাছে করলেন। শ্রীকৃষ্ণবল্লভ বললেন রাজার ভাগবত ও সাধুর প্রতি শ্রদ্ধা আছে। চলুন অদ্যই আমরা রাজগৃহে গমন করি।
 
ভাগবত শুনে রাজা—এ কথা শুনিয়া ।
রাজসভা চলে কৃষ্ণবল্লভে লইয়া ।।
আচার্য্যের তেজ দেখি রাজা সাবধানে।
ভূমে পড়ি প্রণমি আপনা ধন্য মানে ।।
– (ভঃ রঃ ৭/১৩৬-১৩৭ )
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য শ্রীকৃষ্ণবল্লভকে নিয়ে শীঘ্র রাজভবনে এলেন। রাজা বীর হাম্বীর শ্রীআচার্য্যের দিব্য তেজোময় শ্রীঅঙ্গ দর্শন করে ভূমিতলে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন এবং বহু যত্ন করে তাঁকে উত্তম আসনে বসিয়ে গন্ধ পুষ্প মাল্যাদি প্রদান করলেন। অতঃপর শ্রীনিবাস আচার্য্য সুমধুর কণ্ঠে গুরু বন্দনাদি করে শ্রীমদ ভাগবত পাঠ করতে লাগলেন। আচার্য্যের কি অদ্ভূত শ্লোক উচ্চারণ এবং ব্যাখ্যা। তা শুনে সভাসদ সহ রাজা বীর হাম্বীর প্রেমার্দ্র হয়ে পড়লেন।
“দর্শনে পবিত্র বর এই তোমার গুণ।” মহাদস্যু দলপতি রাজা শ্রীনিবাস আচার্য্যকে দর্শন মাত্রই পবিত্র হলেন। বৈষ্ণব দর্শনে পবিত্রতা লাভ হয়। শ্রীনিবাস আচার্য্য ভাগবত পাঠ সমাপ্ত করে শ্রীনাম সংকীর্তন করলেন ও কিছুক্ষণ নৃত্যাদি সহ কীৰ্ত্তন করলেন। অনন্ত রাজা গলে বস্ত্র দিয়ে দৈন্যভরে শ্রীনিবাস আচার্য্যের শ্রীচরণ মূলে সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করলেন এবং বারংবার তাঁর কৃপা প্রার্থনা করতে লাগলেন। শ্রীআচার্য্য তাকে ধরে আলিঙ্গন করলেন। বললেন অচিরাৎ শ্রীগৌরসুন্দর তোমাকে কৃপা করবেন। তারপর রাজা গ্রন্থ সম্পুটসহ নিজেকে আচার্য্য পাদপদ্মে অর্পণ করলেন।
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য শ্রীশ্রীগৌরকৃষ্ণের অসীম কৃপা-মাধুর্য্যের কথা বুঝতে পারলেন। তাঁর ইচ্ছায় সব কিছুই হচ্ছে প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পেলেন।
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য রাজাকে অনুগ্রহ করলেন। সব খবর শীঘ্র তিনি শ্রীবৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট পাঠালেন। শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী অন্যান্য গোস্বামিগণ সব শুনে পরম আশ্চর্য্য ও আনন্দিত হলেন।
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য রাজার থেকে বিদায় নিয়ে গ্রন্থ সম্পুটসহ যাজিগ্রামে এলেন এবং তত্রস্থ ভক্তগণের কাছে সমস্ত কথা বললেন। বৈষ্ণবগণ শুনে সকলেই পরম সুখী হলেন। এই সময় তিনি শ্রীনবদ্বীপে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণীর অন্তৰ্দ্ধান বার্তা শুনলেন। বিষাদে শ্রীনিবাস আচার্য্য ভূতলে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। ভক্তগণ বহু প্রবোধ বাক্যে শ্রীআচার্য্যকে একটু স্থির করালেন। এমন সময় শ্রীখন্ড হতে শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুরের আহবান পত্র এল। শ্রীআচাৰ্য্য বিলম্ব না করে শ্রীখণ্ডে যাত্রা করলেন। শ্রীআচার্য্যকে দর্শন করে শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর,শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর প্রভৃতি প্রভুর পার্ষদগন বড় সুখী হলেন। শ্রীআচার্য পার্ষদগণের শ্রীচরণে সাষ্টাঙ্গ বন্দনা-পূর্ব্বক তাদের নিকট শ্রীবৃন্দাবন ধামবাসী গোস্বামী সমূহের সংবাদ বললেন।
 
এ সময় শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর তাঁকে বলতে লাগলেন—
 
“তোমার জননী তেঁহো পরম বৈষ্ণবী।
কথোদিন রহু যাজিগ্রামে তাঁরে সেবি।।
তাঁর মনোবৃত্তি যাহা করিতেই হয়।
ইথে কিছু তোমার নহিব অপচয়।।
বিবাহ করহ বাপ এই মোর মনে।”
 
– (ভঃ রঃ ৭|৫৮৩-৫৮৫)
শ্রীল নরহরি সরকার ঠাকুর মহাশয়, আচার্য্যকে তাঁর জননীর ইচ্ছা অনুসারে বিবাহ করতে বললেন। শ্রীআচার্য্য দ্বিরুক্তি না করে সে আদেশ শিরে ধারণ করলেন। তিনি কয়েকদিন শ্রীখণ্ডে থাকার পর কন্টক নগরে শ্রীগদাধর দাস ঠাকুরের দর্শনের জন্য এলেন। আচার্য্য শ্রীগদাধর দাস ঠাকুরকে বন্দনা করতেই তিনি তাঁকে কোলে নিয়ে কত স্নেহ করতে লাগলেন। আচার্য্যের কাছে শ্রীগদাধর ঠাকুর বৃন্দাবনস্থ গোস্বামিগণের কুশল সংবাদ শুনলেন। সব শুনে সুখী হলেন। আচার্য্য কয়েকদিন শ্রীগদাধর দাস ঠাকুরের কাছে থাকার পর বিদায় নিলেন। যাবার সময় শ্রীগদাধর দাস ঠাকুর বলতে লাগলেন—
 
“পরম দুর্লভ শ্রীপ্রভুর সংকীৰ্ত্তন।
নিরন্তর আস্বাদিবে লৈয়া নিজগণ ।।
করিবে বিবাহ শীঘ্র—সবার সম্মত।
হইবেন অনেক তোমার অনুগত।।
 
শ্রীগদাধর দাস ঠাকুরের উপদেশ -আশীর্ব্বাদ নিয়ে শ্রীআচার্য যাজীগ্রামে ফিরে এলেন। এ সময় যাজীগ্রামে শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর শুভ বিজয় করলেন। তিনি শ্রীআচার্য্যের বিবাহ উৎসব করতে লাগলেন। যাজীগ্রামে শ্রীগোপাল চক্রবর্তী নামে এক ভক্ত ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর অতি সুন্দরী ভক্তিমতী দ্রৌপদী নামে কন্যা ছিল। শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর সেই কন্যার সঙ্গে আচার্য্যের বিবাহ উদ্যোগ করলেন। বৈশাখ মাসের অক্ষয় তৃতীয়ায় আচার্য্যের বিবাহ কৰ্ম্ম সম্পন্ন হল। আচার্যের পত্নীর পূর্ব্ব নাম ছিল দ্রৌপদী, বিবাহের পর নাম হল ‘ঈশ্বরী’। পরবর্তীকালে শ্রীগোপাল চক্রবর্তী আচার্য্য থেকে মন্ত্র -দীক্ষা গ্রহণ করলেন। শ্রীগোপাল চক্রবত্তীর শ্যামদাস ও রামচন্দ্র নামে দুটি পুত্র ছিলেন। তারাও আচার্য্যের থেকে দীক্ষা নিলেন। শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর আচার্য্যের বিবাহ বার্তা শুনে অতিশয় সুখী হলেন।
 
অনন্তর শ্রীনিবাস আচার্য্য যাজীগ্রামে শিষ্যগণকে গোস্বামী গ্রন্থ অধ্যয়ন করাতে লাগলেন। দ্বিজ হরিদাসের পুত্র শ্রীদাস ও শ্রীগোকুলানন্দ আচার্য্যের থেকে দীক্ষা নিয়ে গোস্বামী গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে লাগলেন। দিন দিন শ্রীআচার্য্যের প্রভাব বিস্তার লাভ করতে লাগল। অল্পকালের মধ্যে তাঁর চরণ আশ্রয় যাজীগ্রামেকরবার জন্য বহু সজ্জন ব্যক্তি আসতে লাগলেন।
 
শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ মিলন
 
একদিন শ্রীনিবাস আচার্য্য যাজিগ্রামে স্বীয় গৃহে ভক্তগণ সঙ্গে বসে ভগবদ কথা বলছেন। এমন সময় তাঁর গৃহের পাশ দিয়ে গৌরপার্ষদ শ্রীচিরঞ্জীব সেনের পুত্র শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ বিবাহ করে নব বধু নিয়ে প্রত্যাবর্তন করছেন। শ্রীনিবাস আচার্য্য দূর থেকে তাঁকে দেখলেন, শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজও দূর থেকে শ্রীআচার্য্যকে দর্শন করলেন। পরস্পরের দর্শনে নিত্যসিদ্ধ সৌহার্দ্যভাব যেন তখন থেকেই জেগে উঠল। দর্শনের পর মিলনের আকাঙ্খা উভয়ের হতে লাগল। শ্রীনিবাস আচার্য্য লোকমুখে শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের পরিচয় নিলেন। শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজও শ্রী নিবাস আচার্য্যের পরিচয় নিলেন।
 
শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ নব বধু সঙ্গে গৃহে এলেন। কোন রকমে দিনটা কাটালেন। রাত্রিকালে গৃহ থেকে বের হয়ে যাজিগ্রামে এসে কোন এক ব্রাহ্মণ গৃহে রাত্রি যাপন করলেন। প্রাতঃকালে শ্রীনিবাস আচার্য্যের গৃহে এলেন এবং তাঁর চরণে সাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন। আচার্য্য শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজকে ভূমি থেকে উঠিয়ে দৃঢ় আলিঙ্গন করলেন এবং বললেন—“জন্মে জন্মে তুমি আমার বান্ধব।” বিধাতা সদয় হয়ে আজ পুনঃ মিলায়ে দিয়েছেন। মিলনে উভয়ের খুব আনন্দ হল। শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের অগাধ পাণ্ডিত্য প্রতিভা জেনে আচার্য। অতিশয় সুখী হলেন। তিনি তখন তাকে গোস্বামী গ্রন্থ শ্রবণ করাতে লাগলেন। কয়েকদিন পরে আচার্য্য তাকে শ্রীরাধা-কৃষ্ণ যুগল মন্ত্রে ীক্ষিত করলেন।
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য পুন: শ্রীবৃন্দাবন ধামাভিমুখে যাত্রা করলেন। সঙ্গে কতিপয় ভক্তও বৃন্দাবন যাত্রা করলেন। আচার্য্য পূর্ব্ব পরিচিত পথে চলতে চলতে গয়াধামে এলেন এবং শ্রীবিষ্ণু পাদপদ্ম দর্শন করলেন। তথা হতে কাশী এলেন। শ্রীচন্দ্রশেখর আদি ভক্ত গণের দর্শন করলেন। দণ্ডবৎ আদি করতেই সকলে শ্রীনিবাস স্নেহে আলিঙ্গন করতে লাগলেন।
 
শ্রীনিবাস কাশীতে দু-এক দিবস অবস্থান করে শ্রীমধুরা ধামে প্রবেশ করলেন। শ্রীবিশ্রাম ঘাটে স্নান করে আদিকেশব ও জন্মস্থানাদি দর্শন করে শ্রীবৃন্দাবন ধামে এলেন। শ্রীজীব গোস্বামী শ্রীনিবাসের দর্শন প্রতীক্ষা করছিলেন। শ্রীনিবাস আচার্য্য এসে তাঁর শ্রীচরণ সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করতেই শ্রীজীব গোস্বামী তাঁকে ভূমি হতে তুলে দৃঢ় আলিঙ্গন করলেন এবং গৌড় দেশের বৈষ্ণবগণের কুশল বার্তাদি জিজ্ঞাসা করলেন। পুরীধাম থেকে এই সময় শ্রী শ্যামানন্দ প্রভুও বৃন্দাবন ধামে এলেন। তিনি গোস্বামী শ্রীচরণ বন্দনাদি করলেন, শ্রীজীব গোস্বামী তাকে স্নেহে আলিঙ্গন পূর্বক বসিয়ে পুরীধামবাসী বৈষ্ণবগণের কুশল বার্তাদি জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। অতঃপর শ্রীনিবাস ও শ্যামানন্দের মিলন হল। পরস্পরকে দণ্ডবৎ আলিঙ্গন প্রভৃতি করলেন। তাদের খুব আনন্দ হল। তথায় তাঁরা দ্বিজ হরিদাসের অপ্রকট বার্তা শুনে অতিশয় দুঃখিত হলেন। উভয়ে শ্রীজীব গোস্বানিপাদের নিকট অবস্থান করতে লাগলেন এবং ষটসন্দর্ভের বিবিধ সিদ্ধান্ত তাঁর কাছ থেকে শুনতে লাগলেন। এই সময় শ্রীমদ জীব গোস্বামী শ্রীগোপাল চম্পু গ্রন্থ রচনা আরম্ভ করেছেন। তিনি শ্রীনিবাস ও শ্যামানন্দকে মঙ্গলাচরণ শ্লোক পড়ে শুনালেন।
 
 
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামী তথা অন্যান্য গোস্বামিদিগের সঙ্গে কয়েকমাস সুখে অবস্থান করলেন। এমন সময় গৌড়দেশ থেকে শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ তাঁকে গৌড় দেশে নেবার জন্য শ্রীবৃন্দাবন ধামে উপস্থিত হলেন। গৌড় দেশবাসী ভক্তগণ তাকে পাঠিয়েছিলেন।
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য শ্রীমদ জীব গোস্বামীর সাথে শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের পরিচয় করিয়ে দিলেন। শ্রীরামচন্দ্র শ্রীজীব গোস্বামীর শ্রীপাদপদ্মে সাষ্টাঙ্গে ভূমিতলে পড়ে বন্দনা করলেন। শ্রীজীব গোস্বামী তাকে তুলে স্নেহে আলিঙ্গন করলেন। শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজকে শ্রীরাধারমণ, শ্রীগোবিন্দ, শ্রীগোপীনাথ আদি বিগ্রহগণকে দর্শন করতে আদেশ করলেন এবং গোস্বামিবৃন্দের শ্রীচরণ দর্শনে আজ্ঞা দিলেন। শ্রীনিবাস ও শ্যামানন্দ প্রভু তাকে সঙ্গে নিয়ে সব দর্শন করাতে লাগলেন। শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের দৈন্য ভক্তি প্রভৃতি দেখে গোস্বামিগণ সকলেই পরম সুখী হলেন। শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজকে বন দর্শনে আদেশ করলেন, তিনি সৰ্ব্বত্র দর্শন করে রাধাকুণ্ডে শ্রীমদ্ রঘুনাথ দাস গোস্বামীর ও শ্রীমদ্ কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর শ্রীচরণ দর্শনে এলেন। এদিকে শ্রীমদ জীব গোস্বামীর আদেশ নিয়ে শ্রীনিবাস আচার্য্য ও শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু গৌড়দেশের দিকে যাত্রা করলেন। বন বিষ্ণুপুরে আগমন করলেন। রাজা বীর হাম্বীর শ্রীনিবাস আচার্য্যের শ্রীচরণ দর্শন করে আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন। রাজপুরে মহাযত্নে নিয়ে শ্রীপাদকে পূজাপূর্ব্বক বিবিধ উপাচারে ভোজন করালেন, রাজগৃহে মহোৎসব আরম্ভ হল। শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু রাজার ভক্তি দেখে চমৎকৃত হলেন। এইবার আচার্য্য প্রভু রাজাকে রাধাকৃষ্ণ মন্ত্র দীক্ষা প্রদান করলেন। রাজার নাম হল ‘শ্রীচৈতন্য দাস’। রাজপুত্র ধাড়ি হাম্বীরও মন্ত্র গ্রহণ করলেন। তাঁর নাম হল শ্রীগোপাল দাস। শ্রীবীর হাম্বীর আচার্য্যের দ্বারা শ্রীকালাচাদের সেবা প্রকট করালেন। শ্রীনিবাস আচাৰ্য্য স্বহস্তে শ্রীবিগ্রহের অভিষেক পূজাদি করলেন। শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু কয়েকদিন তথায় থাকার পর পুরীর দিকে যাত্রা করলেন। শ্রীনিবাস আচার্য্য যাজিগ্রামে আসবার উদ্যোগ করলেন। এই সময় শিখরেশ্বর রাজ শ্রীহরিনারায়ণ দেব নিজ গৃহে শ্রীনিবাস আচার্য্যকে বিশেষ আমন্ত্রণ করলেন। সপার্ষদ শ্রীনিবাস আচার্য্য তাঁর গৃহে শুভ বিজয় করলেন। কয়েক দিন তাঁর গৃহে আচাৰ্য্য অবস্থান পূৰ্ব্বক শ্রীভাগবত কথা-গঙ্গা প্রবাহিত করলেন। বহুলোক শ্রীআচার্যপাদের অনুগ্রহ প্রাপ্ত হলেন।
 
শ্রীনিবাস আচাৰ্য্য কয়েক দিন শিখরেশ্বর দেশে অবস্থান করে শ্রীখণ্ডে আগমন করলেন এবং অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণ একাদশীতে শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুরের অপ্রকট বার্তা শুনে ভূতলে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন। আচার্য্য বহু খেদ পূর্ব্বক ক্রন্দন করতে লাগলেন। তারপর অতি কষ্টে ধৈর্য্য ধারণ করলেন। শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর শ্রীসরকার ঠাকুরের বিরহে বড়ই কাতর হয়েছিলেন। শ্রীনিবাসকে দেখে একটু শান্ত হলেন। কয়েক দিন শ্রীআচার্য্য শ্রীখণ্ডে অবস্থান করার পর কন্টক নগরে এলেন। সেখানে এসে শুনলেন শ্রীগদাধর দাস ঠাকুর কার্ত্তিক মাসে অপ্রকট হয়েছেন। নিদারুণ শোকে আচার্য্যের প্রাণ বিদীর্ণ হতে লাগল। অতি কষ্টে ধৈর্য ধারণপূর্ব্বক যাজিগ্রামে এলেন এবং স্বগৃহে ভাগবতগণকে আহ্বান করে এক মহোৎসবের আয়োজন করলেন। অতঃপর মাঘকৃষ্ণ একাদশীতে দ্বিজ হরিদাসের অপ্রকট মহোৎসব করবার জন্য আচার্য্য কাঞ্চনগড়ি নগর অভিমুখে যাত্রা করলেন। কাঞ্চনগড়িতে দ্বিজ হরিদাসের অপ্রকট মহামহোৎসব মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হল। উৎসবের দিন দ্বিজ হরিদাসের পুত্র শ্রীদাসও শ্রীগোকুলানন্দ আচার্য্য থেকে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করবার পর শ্রীআচার্য্য ফাল্গুন পূর্ণিমায় খেতরির মহোৎসবে যোগ দেবার জন্য যাত্রা করলেন। খেতরিতে এ উৎসবের আয়োজন রাজা সন্তোষ দত্ত করেন। তিনি শ্রীনরোত্তম ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং শিষ্য। এ উৎসবে স্বয়ং শ্রীজাহ্নবাদেবী আগমন করেন। তাঁর সঙ্গে শ্রীনিধি, শ্রীপতি, শ্ৰীকৃষ্ণ মিশ্র, শ্রীগোকুল, শ্রীরঘুনন্দন প্রভৃতি গৌর-পার্যদগণ আগমন করেন।
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য বিগ্রহগণের অভিষেক পূজাদি করেন। ভোগ রন্ধন শ্রীজাহ্নবা মাতা করেন। ফাল্গুন পূর্ণিমা তিথিতে অহোরাত্র শ্রীহরিসঙ্কীৰ্ত্তন মহোৎসব হয়। ঐ কীর্ত্তনে সপার্ষদ শ্রীগৌরসুন্দর আবির্ভূত হয়ে ভক্তগণকে দর্শন দিয়েছিলেন। ফাল্গুন পূর্ণিমা তিথিতে সকলে উপবাস করেন। দ্বিতীয় দিবসে পারণ মহোৎসব করা হয়।
 
শ্রীগৌরাঙ্গ, শ্রীবল্পবীকান্ত, শ্রীব্রজমোহন ।
শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধাকান্ত, শ্রীরাধারমণ ।।
 
এই ছয় বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা উৎসব হয়। বৈষ্ণব জগতে এইরূপ মহোৎসব ইতঃপূৰ্ব্বে বিশেষ হয় নাই। রাজা সন্তোষ দত্ত সমাগত বৈষ্ণবগণকে বস্ত্র মুদ্রাদি দান করেন। বৈষ্ণবগণ রাজা সন্তোষ দত্তকে প্রচুর আশীর্ব্বাদ করেন।
 
উৎসবের পর শ্রীনিবাস আচার্য্য ও শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু যাজি গ্রামে আগমন করেন। বৈষ্ণবগণের আগমনে শ্রীআচার্য্যের গৃহে মহোৎসব আরম্ভ হল। কয়েক দিন পরে তথায় শ্রীনরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ও শুভাগমন করলেন। কয়েক দিন তিনজন যাজিগ্রামে অবস্থানের পর শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু উৎকল দেশাভিমুখে যাত্রা করলেন। শ্রীনিবাস আচার্য্য, শ্রীনরোত্তম ও শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ নবদ্বীপ অভিমুখে যাত্রা করলেন। নবদ্বীপ মায়াপুরে শ্রীগৌর গৃহে তাঁরা আগমন করে অতি বৃদ্ধ শ্রীঈশান ঠাকুরের শ্রীপাদপদ্মে সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করলেন। স্ব-স্ব নাম ধরে তাঁরা পরিচয় জানালেন, ঈশান ঠাকুর উঠে অতি প্রেমভরে সকলকে আলিঙ্গন করলেন। এ সময় শ্রীগৌর-গৃহে একমাত্র ঈশান ঠাকুর অবস্থান করেছিলেন। পরদিবস ভক্তগণ শ্রীঈশান ঠাকুরকে নিয়ে নবদ্বীপ ধাম পরিক্রমায় বের হলেন। ভক্তগণ অতি আনন্দ ভরে ঈশান ঠাকুরের শ্রীমুখে শ্রীগৌরসুন্দরের চরিত সকল শুনতে শুনতে পরিক্রমা করতে লাগলেন। পরিক্রমা সমাপ্ত করে ভক্তগণ শ্রীঈশান ঠাকুরকে বন্দনা পূৰ্ব্বক বিদায় নিলেন এবং শ্রীখণ্ডে আগমন করলেন। ইতিমধ্যে শ্রীঈশান ঠাকুরের অপ্রকট বাৰ্ত্তা মায়াপুর হতে এল। এ কথা শ্রবণ করা মাত্র ভক্তগণ বিরহে হাহাকার করে উঠলেন। এইরূপে নবদ্বীপ ও মায়াপুরে ক্রমে ক্রমে গৌর পার্ষদগণ প্রায় সকলে অপ্রকট লীলা করলেন।
 
একদিন শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর শ্রীআচার্য্যকে আনবার জন্য কোন ভক্তকে যাজিগ্রামে প্রেরণ করলেন। শ্রীনিবাস অতি সত্বর শ্রীখণ্ডে এলেন এবং শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর আচার্য্যকে আশীর্ব্বাদ করে বললেন—“তুমি চিরজীবী হও। প্রভু শ্রীগৌরসুন্দরের বাণী প্রচার কর।” এই সব বলে শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর শ্রীবিগ্রহগণের সামনে এলেন এবং স্বীয় পুত্র কানাইকে ডেকে শ্রীমদন গোপাল ও শ্রীগৌরাঙ্গ দেবের শ্রীচরণে সমর্পণ করলেন। অনন্তর তিন দিন মহাসংকীৰ্ত্তনে মগ্ন হলেন। শেষ দিবস শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুরের শ্রীগৌরাঙ্গের ও শ্রী শ্রীমদন গোপাল দেবের শ্রীরূপে নয়নযুগল সমর্পণ করে অন্তর্ধান করলেন।
 
শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুরের অন্তর্ধান দর্শন করে শ্রীনিবাস আচাৰ্য্য, পুত্র কানাই ঠাকুর অন্যান্য ভক্তগণ বিরহে মূর্খা প্রাপ্ত হলেন এ নামে জলে ভাসতে ভাসতে বিবিধ বিলাপ করতে লাগলেন।
 
অতঃপর শ্রীকানাই ঠাকুর এক মহোৎসবের বিপুল আয়োজন করলেন। চতুদিকে বৈষ্ণবলগণকে প্রেরণ করলেন। মহোৎসবের আমন্ত্রণ বৈষ্ণবগণ সর্বত্রই জানালেন। উৎসব দিবসে বৈষ্ণবগণ উপস্থিত হলেন। মহাসংকীৰ্ত্তন নৃত্য বৈষ্ণবগণ সমাধি প্রাঙ্গনে আরম্ভ করলেন। সে সংকীর্তনে শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর যেন সাক্ষাৎ প্রকট হয়ে নৃত্য করতে লাগলেন। শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুরের অপ্রকট শ্রাবণ আর চতুর্থী তিথিতে শ্রীনিবাস আচার্য্য উৎসবের দেখা শুনার যাবতীয় কার্য করলেন। উৎসব অন্তে বৈষ্ণবগণ সহ তিনিও বিদায় নিয়ে বন বিষ্ণুপুরে রাজা বীর হাম্বিরের গৃহে শুভ বিজয় করলেন। আচার্য্য রাজগৃহে শ্রী মদ ভাগবত পাঠ ও কীর্তন আরম্ভ করলেন। চতুর্দিক থেকে বহু ভক্তের সমাগম হতে লাগল। মহারাজ বহু প্রীতি ভরে ভক্ত সেবা করতে লাগলেন। বন বিষ্ণুপুর তৎকালে প্রকৃত বিষ্ণুপুরে পরিণত হল। বহু শ্রদ্ধালু ব্যক্তি শ্রীআচার্য্যের শ্রীপাদপদ্ম আশ্রয় গ্রহণ করলেন।
 
রাঢ় দেশের মধ্যে গোকুলপুর গ্রামে শ্রীরাঘব চক্রবর্তী নামে একজন পরমভক্ত ব্রাহ্মণ বাস করতেন। শ্রীগৌরাঙ্গ প্রিয়া নাম্নী তাঁর এক কন্যা ছিল। ব্রাহ্মণ কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে উপযুক্ত পাত্রের খোঁজ না পেয়ে বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে শ্রীমন্মহাপ্রভুর শ্রীচরণে সমস্ত কথা ও দায় অর্পণ করলেন। ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মনী এক রাত্রি স্বপ্ন দেখছেন যে তাঁরা শ্রীনিবাস আচার্য্যকে কন্যা দান করছেন। এই আশ্চর্যজনক স্বপ্ন দেখে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী সুখী হলেন। পুনঃ একার্য্য অসম্ভব বলে চিন্তা করলেন। বহুবিধ চিন্তা করতে করতে ব্রাহ্মণ শীঘ্র শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে এলেন এবং বন্দনা পূর্ব্বক করজোড়ে সামনে দাঁড়ালেন। শ্রীআচার্য্য তাঁর অভিপ্রায় বুঝতে পেরে ঈষৎ হাস্য করতে করতে তাঁকে বসতে বললেন এবং আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ব্রাহ্মণ কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর বললেন আপনার শ্রীচরণে একটা নিবেদন করতে এসেছি। কিন্তু যদি আপনার অভয় পাই, বলতে পারি। আচার্য্য বললেন আপনি নির্ভয়ে বলুন। এবার ব্রাহ্মণ স্বীয় কন্যার কথা নিবেদন করলেন। আচার্য্য কথা শুনে হাসা করতে লাগলেন। ভক্তগণ এ সব কথা শুনে বড় সুখী হলেন। পরিশেষে শ্রীআচার্য্য বিবাহ করতে রাজি হলেন।
 
মহা সমারোহের সহিত মহারাজ বীর হাম্বীর শ্রীআচার্য্যের বিবাহের আয়োজন করলেন। শুভলগ্নে শ্রীরাঘব চক্রবর্ত্তী বিবিধ বস্ত্রালঙ্কার সহ কন্যা এনে শ্রীঅচার্য্যের করে সমর্পণ করলেন। শ্রীমতী গৌরাঙ্গ-প্রিয়াকে বিবাহ করবার পর আচার্য্য পত্নীসহ যাজিগ্রামে ফিরে এলেন। ঠিক এই সময় নিত্যানন্দ শক্তি শ্রীজাহ্নবা দেবীও বৃন্দাবন ধাম পরিক্রমা করে যাজিগ্রামে আচার্য্য গৃহে শুভাগমন করলেন। তাঁকে দর্শন করে আচার্য্যের আনন্দের সীমা রইল না। মহা সমাদরে তাঁর পাদপদ্ম ধৌত করে তাঁকে আসনে বসিয়ে পূজাদি করবার পর নববিবাহিতা গৌরাঙ্গ প্রিয়াকে তাঁর শ্রীচরণ বন্দনা করালেন। সুশীলা সুন্দরী সাক্ষাৎ ভক্তি স্বরূপিণী পত্নী দেখে পরম স্নেহ ভরে কোলে তুলে নিলেন।শ্রীজাহ্নবা দেবী আচার্য্যের পত্নী দ্বয়ের প্রতি বহু প্রীতি প্রকাশের পর শ্রীবৃন্দাবন ধামস্থ গোস্বামিবৃন্দের সংবাদ বলতে লাগলেন। পরম সুখে শ্রীজাহ্নবা মাতা শ্রীআচাৰ্য্য-গৃহে কয়েকদিন থাকবার পর খড়দহ গ্রামে ফিরে এলেন।
 
যাজিগ্রামে আচার্য্য লইয়া শিষ্যগণে ।
গোঙায়েন সদা শাস্ত্রালাপ সংকীৰ্ত্তনে।।
 
-( ভঃরঃ ১৪।১৯২ )
 
শ্রীনিবাস আচার্য্য যাজিগ্রামে ভক্ত শিষ্যগণ সঙ্গে পরম আনন্দে গোস্বামী গ্রন্থ অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় সুখে দিন যাপন করতে লাগলেন। আচার্য্যের ঐশ্বর্য্য ও বৈভব দর্শনে সকলে আশ্চর্য হতে লাগলেন। তাঁর প্রভাবে মহাপাষণ্ডিগণও এসে তাঁর শ্রীচরণ আশ্রয় করতে লাগল।
 
শ্রীনিবাস, শ্রীনরোত্তম ও শ্রীরামচন্দ্র তিনজন অভিন্ন হৃদয় ছিলেন। শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর লিখেছেন—
 
দয়া কর শ্রীআচার্য্য প্রভু শ্রীনিবাস ।
রামচন্দ্র সঙ্গ মাগে নরোত্তম দাস ।।
 
শ্রীনিবাস আচার্য্যের তিনটী কন্যা ও তিনটী পুত্র হয়। কন্যাদের নাম কৃষ্ণপ্রিয়া, হেমলতা ও ফুলপি ঠাকুরাণী। পুত্রদের নাম—বৃন্দাবন বল্লভ, রাধাকৃষ্ণ ও শ্রীগতিগোবিন্দ। শ্রীগতিগোবিন্দ ঠাকুরের পুত্র কৃষ্ণ প্রসাদ ঠাকুর তাঁর পুত্র জগদানন্দ ঠাকুর। শ্রীজগদানন্দ ঠাকুরের দুই পত্নী ছিলেন। প্রথম পত্নীর সন্তান যাদবেন্দ্র ঠাকুর ও দ্বিতীয় পত্নীর সন্তান রাধামোহন ঠাকুর, ভুবন মোহন ঠাকুর, গৌর মোহন ঠাকুর, শ্যাম মোহন ঠাকুর ও মদন মোহন ঠাকুর। ভুবন মোহন ঠাকুরের বংশধরগণ মুর্শিদাবাদের মাণিক্যহার গ্রামে এখনও বসবাস করছেন।
 
 
 
 

Date

Nov 01 2022
Expired!

Time

All Day