Disappearance Day of Srila Raghunath Bhatta
দন্ডপরণাম করি, ভট্ট পড়িলা চরণে।
প্রভু ‘রঘুনাথ’ বলি কৈলা আলিঙ্গনে।।
~~~ (চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ১৩। ১০১ )
কাশীধাম থেকে পদব্রজে শ্রীরঘুনাথ ভট্ট পুরী ধামে এলেন। মহাপ্রভুর পাদপদ্ম বন্দনা করতেই প্রভু, রঘুনাথ বলে আলিঙ্গন করলেন। প্রভুর আলিঙ্গনে রঘুনাথ ভট্টের সমস্ত দুঃখ দূর হল। শ্রীরঘুনাথ ভট্ট চিন্তা করতে করতে এসেছিলেন, বহুদিন পরে প্রভুকে দর্শন করতে যাচ্ছি; তিনি চিনতে পারবেন কিনা জানি না। পূর্ব্বের মত আদর করবেন কি? তাঁর কত প্রিয় ভক্ত রয়েছেন। আমাদের ন্যায় অধম ভক্তদের কথা মনে রেখেছেন কি? কিন্তু মহাপ্রভু যখন সহাস্য বদনে রঘুনাথ বলে আলিঙ্গন করলেন, রঘুনাথ প্রেমাশ্রুতে সিক্ত হতে লাগলেন। সজল নয়নে প্রভুর শ্রীচরণ ধরে বললেন— হে করুণাময় প্রভো! সত্য-সত্যই এ অধমের কথা এখনও মনে রেখেছেন? প্রভু বললেন— রঘুনাথ! তোমার পিতা-মাতার স্নেহের কথা এ জন্মে কেন, কোন জন্মেও ভুলতে পারব না। প্রতিদিন কত স্নেহ করে আমাকে ভোজন করাতেন।
অতঃপর মহাপ্রভু ভক্তগণের নিকট রঘুনাথ ভট্টের পরিচয় করে দিলেন। ভক্তগণ বড় সুখী হলেন। রঘুনাথ পিতা-মাতার দন্ডবন্নতি জ্ঞাপন করলেন; চন্দ্রশেখর প্রভৃতি ভক্তগণের কুশলবার্তা প্রদান করলেন। পরিশেষে স্নেহময়ী জননী প্রভুর জন্য যে-সব খাদ্য সামগ্রী দিয়েছিলেন ঝালি থেকে বের করে একে একে সব তাকে দেখালেন। প্রভু খুব খুশী হয়ে গোবিন্দকে ডেকে সব জিনিস রাখতে বললেন।
শ্রীরঘুনাথ ভট্টের পিতার নাম — শ্রীতপন মিশ্র। প্রভু গার্হস্থ যখন পূর্ব্ববঙ্গে পদ্মানদী তটে অধ্যাপকরূপে শুভাগমন করেছিলেন, তপন মিশ্রের সঙ্গে তখন তার পরিচয় হয়। তপন মিশ্র পূর্ব্ববঙ্গের লোক, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি সাধ্য ও সাধনতত্ত্ব সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করেছিলেন, কিন্তু তার যথার্থ অর্থ নির্ণয় করতে পারলেন না। নির্ব্বিন্ন হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। একদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখছেন, এক দেবতা এসে বললেন তুমি কোন চিন্তা করো না। শ্রীনিমাই পন্ডিতের নিকট গমন কর, তিনি তোমাকে সাধ্য সাধন-তত্ত্ব ভাল করে বুঝিয়ে দেবেন।
“মনুষ্য নহেন তেঁহো—নর-নারায়ণ।
নর-রূপে লীলা তাঁ’র জগৎ-কারণ।।
(চৈঃ ভাঃ আদিঃ ১৪। ১২৩ )
এ বলে দেবতা অন্তধান হলেন। সকাল বেলা প্রাতঃকৃত্যাদি শেষ করে মহাপ্রভুর দর্শনের জন্য চললেন। দেখলেন শ্রীনিমাই পণ্ডিত একটি উচ্চ চৌকির উপর বসে আছেন। গৃহখানি তাঁর অঙ্গ কান্তিতে উদ্ভাসিত হচ্ছে। তাঁর নয়ন যুগল প্রফুল পদ্মদলের ন্যায়, শিরে কুঞ্চিত কেশদাম, বক্ষস্থলে শুভ্র উপবীত ও পরিধানে পীতবস্ত্র। চন্দ্রের চতুর্দিকে নক্ষত্রমালার ন্যায় শিষ্যগণ চারিধারে উপবিষ্ট। তপন মিশ্র দন্ডবৎ করে করযোড়ে বলতে লাগলেন— হে দয়াময়। আমি অতি দীন হীন। আমাকে কৃপা করুন। প্রভু হাস্য সহকারে তাঁকে ধরে বসালেন এবং তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। তপন মিশ্র নিজ পরিচয় ব’লে সাধ্য ও সাধন তত্ত্ব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন।
মহাপ্রভু বললেন—ভগবান যুগে যুগে জীবের কল্যানের জন্য অবতীর্ণ হন এবং কিভাবে তাঁর ভজন করতে হয় তদ্বিষয়ে উপদেশ দেন। সত্যযুগে ধ্যান, ত্রেতায় যজ্ঞ, দ্বাপরে পরিচর্যা ও কলিতে শ্রীনাম সংকীৰ্ত্তন।
“কলিযুগ-ধৰ্ম্ম হয় নাম সংকীর্তন।
চারি যুগে চারিধর্ম জীবের কারণ।। “
(চৈঃ ভাঃ আদি ১৪। ১৩৭ )
জীবের বল, বীর্য্য ও আয়ু বিচার করে শ্রীভগবান আচার্য্যমূর্তিতে এ সমস্ত ধর্ম নির্ণয় করেছেন। অতএব এর অন্যথা করলে কোন ফল হয় না।
“অতএব কলিযুগে নামযজ্ঞ সার।
আর কোন ধর্ম কৈলে নাহি হয় পার।।”
(চৈঃ ভাঃ আদি ১৪। ১৩৯ )
শ্রীনাম সংকীর্তন ব্যতীত অন্য কোন উপায় নাই। অন্য সাধন বাসনা ত্যাগ করে সৰ্ব্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণ নাম সংকীৰ্ত্তন করুন।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
(চৈঃ ভাঃ আদি ১৪।১৪৫ )
এ মন্ত্র-প্রভাবে আপনি সাধ্য ও সাধন তত্ত্বাদি সব কিছু জানতে পারবেন। শ্রীহরিনামই সাধ্য ও ইহাই সাধন। শ্রীনাম ও নামী অভেদ।
তপন মিশ্র প্রভুর উপদেশ শ্রবণে সাষ্টাঙ্গে মহাপ্রভুর শ্রীচরণ বন্দনা করলেন এবং প্রভুসঙ্গে নবদ্বীপে আসতে চাইলেন। প্রভু আদেশ করলেন – আপনি শীঘ্র কাশী যান, সেখানে আমাদের পুনঃ মিলন হবে; তখন বিশেষভাবে সব তত্ত্বোপদেশ দান করব। এ বলে প্রভু নবদ্বীপের দিকে যাত্রা করলেন। তপন মিশ্র সপত্নীক কাশীর দিকে চললেন।
কয়েক বছর পরে করুণাময় গৌরহরি সন্ন্যাস গ্রহণ করে জননীর আদেশে পুরীধামে এলেন। কয়েক মাস পুরীতে অবস্থান করবার পর, ঝারিখণ্ডের (ছোট নাগপুরের ) পথে বৃন্দাবন যাত্রা করে পথে কাশীধানে উপস্থিত হলেন। প্রভু মণিকর্ণিকা ঘাটে ‘হরিবোল হরিবোল ধ্বনি করলেন। তপন মিশ্র তখন সে ঘাটে স্নান করছিলেন। অকস্মাৎ হরিধ্বনি শুনে চমকে উঠলেন। মরুভূমির মধ্যে সমুদ্রের বান, মহা-মায়াবাদীদের মধ্যে ‘হরিধ্বনি’ দেখলেন তীরদেশে এক অপূৰ্ব্ব সন্ন্যাসী; অঙ্গকান্তিতে চারিদিক আলোকিত হচ্ছে। বিস্ময়ান্বিত হয়ে ভারতে লাগলেন—ইনি কে? নবদ্বীপের শ্রীনিমাই পন্ডিত নাকি? শুনেছি তিনি সন্ন্যাসী হয়েছেন। জল থেকে উঠে দেখলেন সত্যই সেই শ্রীনিমাই পণ্ডিত সন্ন্যাসীবেশে এসেছেন। অমনি প্রভুর শ্রীচরণ বন্দনা করে আনন্দে রোদন করতে লাগলেন। প্রভু তাঁকে ভূমি থেকে উঠিয়ে আলিঙ্গন করলেন। অনেক দিনের পর মিলন হল। তপন মিশ্র বহু আদর করে। প্রভুকে গৃহে আনলেন, তারপর তাঁর শ্রীচরণ ধৌত করে, সে জল সপরিবারে পান করলেন। পরম আনন্দ হল। তপন মিশ্রের পুত্র শিশু-রঘুনাথ পাদমূলে বন্দনা করতে প্রভু তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। মিশ্র শীঘ্র রন্ধনের ব্যবস্থা করে দিলেন। বলভদ্র ভট্টাচার্য্য রন্ধন করলেন। প্রভুর স্নানের ব্যবস্থা হল এবং স্নানাদি আবশ্যকীয় কৰ্ম্ম শেষ করে, প্রভু ভোজন করলেন। অবশেষ পাত্র পেলেন মিশ্র। মিশ্র-পুত্র রঘুনাথ প্রভুর শ্রীচরণ সম্বাহন করতে লাগলেন। “মিশ্রপুত্র রঘু করে পাদ সম্বাহন।” (চৈঃ চঃ মধ্যঃ ) প্রভু বিশ্রাম করলেন।
মহাপ্রভুর আগমন-সংবাদ শ্রবণে চন্দ্রশেখর ও মহারাষ্ট্র বিপ্র প্রভৃতি। ভক্তগণ এলেন ও তাঁর শ্রীচরণ বন্দনা করলেন; প্রভু চন্দ্রশেখরকে আলিঙ্গন করলেন ও সকলকে ন
গ্রন্থাদি নকলের কার্য্য করতেন। তিনি বৈদ্য-কুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কাশীতে ব্রহ্ম, আত্মা ও চৈতন্য তিন শব্দ ভিন্ন অন্য শব্দ নাই। প্রভুর আগমনে শ্রীকৃষ্ণনাম সংকীর্ত্তন আরম্ভ হল। মহারাষ্ট্র বিপ্র প্রভুর শ্রীচরণ ধরে। প্রার্থনা করতে লাগলেন— হে প্রভো! কাশীপুর উদ্ধার করুন। সন্ন্যাসীদের গুরু প্রকাশানন্দ সরস্বতীর নিকট আমি তিনবার আপনার শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম উচ্চারণ করলাম কিন্তু তিনি তিন বার কেবল ‘চৈতন্য’ শব্দ বললেন। কৃষ্ণ শব্দ বললেন না। প্রভু বললেন—মায়াবাদীগণ শ্রীকৃষ্ণ চরণে অপরাধী বলে তাদের মুখে শ্রীকৃষ্ণ শব্দ বহির্গত হয় না। শ্রীভগবানের নাম, বিগ্রহ ও স্বরূপ তিনের মধ্যে কোন ভেদ নাই। এ তিনটি চিদানন্দ স্বরূপ। প্রভু এ সমস্ত উপদেশ করে পরদিন বৃন্দাবনাভিমুখে যাত্রা করলেন। যাবার সময় বলে গেলেন কৃষ্ণের কৃপা হলে সব উদ্ধার হবে।
শ্রীবৃন্দাবন ধামে প্রভু কিছুদিন স্বানন্দে ভ্রমণাদি করবার পর পুনঃ কাশী ধামে এলেন। একদিন ছল করে প্রকাশানন্দ সরস্বতীর সঙ্গে প্রভু সাক্ষাৎকার করলেন। প্রকাশানন্দ সরস্বতী প্রভুর দৈন্য, অপরিসীম সৌন্দর্য্য, ওদার্য্য ও বদান্যতা দেখে তাঁর শ্রীচরণ তলে লুটিয়ে পড়লেন। সন্ন্যাসিগণ প্রভুর চরণ বন্দনা করে তাঁর মহিমা গান করতে লাগলেন। এবার কাশীতে হরিনামের বন্যা প্রবাহিত হল, কাশীর মায়াবাদ-রূপ ময়লা যেন ধুয়ে গেল। কাশীতে প্রভু এবার দশদিন রইলেন, ভক্তগণের আনন্দের সীমা রইল না। তপন মিশ্র, চন্দ্রশেখর ও মহারাষ্ট্র বিপ্র প্রভৃতি ভক্তগণ প্রাণ ভরে প্রভুর সেবা করলেন। মিশ্র-পুত্র রঘুনাথ দিন দশেক ইষ্ট-দেবের সেবা করবার পরম সৌভাগ্য লাভ করলেন।
অনন্তর প্রভু ভক্তগণের থেকে বিদায় নিয়ে পুরীর দিকে
ঝেড়ে অনেক বুঝালেন। বললেন — পিতামাতার সেবা কর, মাঝে মাঝে পুরী ধামে এস, দর্শন হবে। তপন মিশ্র ও চন্দ্রশেখর আদি ভক্তগণকে আলিঙ্গন করালেন ও অনেক তত্ত্ব উপদেশ দিয়ে মহাপ্রভু বিদায় হলেন।
শ্রীরঘুনাথ অল্পকাল মধ্যে ব্যাকরণ, কাব্য ও অলঙ্কারাদি শাস্ত্রে পরম পণ্ডিত হলেন। বৃদ্ধ পিতামাতার সেবা করতে লাগলেন। রঘুনাথের একটু বয়স হ’লে পিতা আদেশ করলেন তুমি পুরী ধামে গিয়ে শ্রীগৌরসুন্দরকে দর্শন করে এস। শ্রীরঘুনাথের আনন্দের সীমা রইল না। রঘুনাথের জননী প্রভুর সেবার জন্য বিবিধ খাদ্য সামগ্রী তৈরী করে একটি ঝালি প্রস্তুত করলেন। শ্রীরঘুনাথ পিতামাতার অনুজ্ঞা ও আশীর্ব্বাদ নিয়ে একটি ভৃত্যসহ পুরীর দিকে যাত্রা করলেন। রাস্তায় একজন রাম ভক্ত বৈষ্ণবের সঙ্গে দেখা হল—নাম শ্রীরাম দাস। তিনি জাতিতে কায়স্থ, রাজকর্মচারী ও কাব্য প্রকাশের অধ্যাপক রাম দাস শ্রীরঘুনাথ ভট্টের পদধূলি মাথায় নিলেন এবং ভৃত্যের কাছ থেকে সামগ্রীর ঝালিটি নিয়ে স্বীয় মাথায় করে চলতে লাগলেন।
শ্রীরঘুনাথ ভট্ট বললেন—আপনি পন্ডিত হয়ে এ কি করছেন?
রাম দাস—ভট্ট জী। আমি শূদ্রাধম, ব্রাহ্মণের একটু সেবা করে সুকৃতি সঞ্চয় করি।
শ্রীরঘুনাথ—পণ্ডিত জী! আমি অনুরোধ করছি ঝালিটি ভৃত্যের মাথায় দেন। তথাপি শ্রীরাম দাস আনন্দ ভরে ঝালি নিয়ে চলতে লাগলেন।
শ্রীরঘুনাথ ভট্ট শ্রীরাম দাসের সঙ্গে বিবিধ শাস্ত্র প্রসঙ্গ করতে করতে ক্রমে পুরী ধামে পৌঁছালেন।
শ্রীরঘুনাথ ভট্ট মহাপ্রভুর শ্রীচরণে এলেন ও সাষ্টাঙ্গে দন্ডবৎ করলে প্রভু রঘুনাথ বলে ভূমি থেকে তুলে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। প্রভু তাঁর
পিতা-মাতার কুশল প্রশ্ন করলেন ও চন্দ্রশেখর প্রভৃতি ভক্তগণের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। শ্রীরঘুনাথ একে একে সমস্ত কথা বললেন। শ্রীরামদাসকে প্রভু স্থানে আনলেন। শ্রীরাম প্রভুর শ্রীচরণ বন্দনা করলেও অন্তর্যামী প্রভু তাঁর অন্তরে মুক্তি কামনা আছে দেখে তাকে তত আদর করলেন না। প্রভু রঘুনাথকে সমুদ্র স্নানপূর্ব্বক শ্রীজগন্নাথ দর্শন করে আসতে আড্ডা করলেন। কোন ভক্ত সঙ্গে ভট্ট সমুদ্র স্নান ও জগন্নাথ দর্শন করে ফিরে এলে গোবিন্দ মহাপ্রভুর অবশেষ প্রসাদ তাঁকে প্রদান করলেন। শ্রীরঘুনাথ ভট্টের ভোজনের ও থাকবার ব্যবস্থা মহাপ্রভু করে দিলেন, সেখানে শ্রীরঘুনাথ থাকতেন। কোন কোন দিবস বাসা ঘরে রন্ধন করে প্রভুকে আমন্ত্রণ পূর্ব্বক যত্ন করে ভোজন করাতেন। স্ত্রীরঘুনাথ আট মাস নীলাচলে মহাপ্রভুর শ্রীচরণে মুখে কাটালেন, জগন্নাথ দেবের সামনে মহাপ্রভুর অপূর্ব্ব নৃত্য, গীত ও বিবিধ ভাব বিকারাদি তিনি দর্শন করলেন। তারপর মহাপ্রভু তাকে কাশীতে পিতা-মাতা স্থানে ফিরে যেতে আদেশ করলেন। রঘুনাথ মহাপ্রভুর বিচ্ছেদের কথা ভেবে অস্থির হয়ে পড়লেন। প্রভু তাঁকে বিবিধ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন – বিবাহ কর না, বৃদ্ধ পিতা মাতার সেবা কর ও বৈষ্ণবদের সাথে ভাগবত শাস্ত্র অধ্যয়ন কর পুনর্বার নীলাচলে এসে জগন্নাথ দেবকে দর্শন কর। মহাপ্রভু এ বলে স্বীয় কন্ঠের মালাটি শ্রীরঘুনাথকে দিলেন। প্রভু তাঁর বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য ও অন্যান্য বৈষ্ণবদের জন্য জগন্নাথ দেবের মহাপ্রসাদ দিলেন। বিদায় কালে রঘুনাথ ভট্ট কাতর-চিত্তে প্রভুর পাদপদ্ম মুলে দন্ডবৎ হয়ে পড়লে, প্রভু তাঁকে তুলে দৃঢ় আলিঙ্গন পূর্ব্বক বিদায় করলেন। প্রভুর বিচ্ছেদ বেদনায় ব্যথিত চিত্তে রঘুনাথ ভট্ট কাশী-অভরঘুনাথকে দেখে খুব খুশী হ’লেন। তাঁর বৈষ্ণব পিতা-মাতার সম্বন্ধে অ মহিমা বললেন। রঘুনাথ আনন্দে প্রভু-সন্নিধানে দিন যাপন করতে লাগলেন। আট মাস কেটে গেল। একদিন প্রভু রঘুনাথ ভট্টকে ডেকে বলেন – “তুমি বৃন্দাবনে যাও, ব্রজে তোমার অনেক কাজ আছে। আমি জননীর আদেশে এখানে বসে আছি, ব্রজের কোন কাজ করতে পারছিনা। তোমাদের দ্বারা সে কাজ করাব”। প্রভুকে ছেড়ে যেতে হবে বলে রঘুনাথের মনে খেদ হতে লাগল, প্রভু তা জানতে পেরে বললেন তথায় রূপ ও সনাতনের সঙ্গে অবস্থান কর, সর্বদা ভাগবত শাস্ত্র আলোচনা কর। প্রভুর আদেশে শ্রীরঘুনাথ ভট্ট বৃন্দাবনে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন, অন্যান্য বৈষ্ণবদের থেকে বিদায় নিয়ে প্রভুর শ্রীচরণে এলেন। মহাপ্রভু বিদায় কালে রঘুনাথকে জগন্নাথের চৌদ্দহাত লম্বা প্রসাদি মালা ও তাম্বুল মহাপ্রসাদ প্রভৃতি দিয়ে আলিঙ্গন করলেন। বিদায় হয়ে রঘুনাথ ভট্ট যে পথে প্রভু বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন সে পথে চললেন। স্থানে স্থানে প্রভুর কীৰ্ত্তি দর্শন ও লোকমুখে তাঁর চরিত শুনতে শুনতে ক্রমে বৃন্দাবনে এলেন। শ্রীরূপ ও শ্রীসনাতন গোস্বামী তাঁকে অতি স্নেহ ভরে আলিঙ্গন-পূর্ব্বক স্বাগত করলেন। গোস্বামিগণ অতিশয় সুখী হলেন। আপন ভ্রাতা জ্ঞানে রঘুনাথ ভট্টকে স্নেহ করতে লাগলেন। বিনয়, নম্রতা প্রভৃতি সদ্গুণে তিনি সকলকে বশীভূত করলেন—
রূপ গোসাঞির সভায় করেন ভাগবত-পঠন। ভাগবত পড়িতে প্রেমে আউলায় তাঁর মন।। অশ্রু, কম্প, গদ্গদ্ প্রভুর কৃপাতে। নেত্র কণ্ঠ রোধে বাষ্প না পারে পড়িতে।। ~(চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ১৩। ১২৬-১২৭ )
শ্রীরঘুনাথ ভট্টের কণ্ঠ কোকিলের ন্যায় সুমধুর ছিল। এক এক শ্লোকের কত রকমের রাগ-রাগিণী ফিরাতেন। শ্রীরঘুনাথ ভট্ট গোস্বামী
শ্রীগোবিন্দদেবের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি কোন ধনাঢ্য শিষ্যের দ্বারা শ্রীগোবিন্দদেবের মন্দির নির্মাণ করালেন। মহাপ্রভু তাকে যে মালা দিয়েছিলেন স্মরণ কালে তা কন্ঠে ধারণ করতেন।
গ্রাম্যবার্তা না শুনে, না কহে জিহ্বায় ।
কৃষ্ণকথা পূজাদিতে অষ্টপ্রহর যায়।।
~( চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ১৩। ১৩২ )
শ্রীগৌরগণোদ্দেশ দীপিকায় — “রঘুনাথাখ্যকেন ভট্টঃ পুরা যা রাগমঞ্জরী।” শ্রীব্রজ লীলায় যিনি শ্রীরাগমঞ্জরী সখী ছিলেন, অধুনা তিনি শ্রীরঘুনাথ ভট্ট নামে কীৰ্ত্তিত।
তাঁর জন্ম ১৪২৭ শকাব্দ, ১৫০৫ খৃষ্টাব্দ, আশ্বিন শুক্লদ্বাদশী ও অপ্রকট ১৫০১ শকাব্দ, ১৫৭৯ খৃষ্টাব্দ জ্যৈষ্ঠ শুক্লদশমী ; প্রকট স্থিতি ৭৫ বছর।