Srila Prabhupad with Pandit Madan Mohan Malaviya
বাংলা ১৩৩১ সালের ৪ঠা বৈশাখ, ইংরাজী ১৯২৫ সালের ১৭ই এপ্রিল শুক্রবার পণ্ডিত শ্রীযুক্ত মদনমোহন মাল্যব্যজী শ্রীল প্রভুপাদকে দর্শন করিবার জন্য সুপ্রসিদ্ধ শিশিরকুমার ঘোষের কৃতিপুত্র পরলোকগত পীযূষকান্তি ও ভট্টপল্লী-নিবাসী পণ্ডিত শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয়ের পুত্র শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ (এম-এ )প্রভৃতি কয়েক ব্যক্তির সহিত শ্রীগৌড়ীয় মঠে আসিয়াছিলেন । প্রভুপাদকে দর্শন করিয়াই পণ্ডিত মাল্যব্যজী অত্যন্ত আবেগের সহিত বলিয়া উঠিলেন, –
“আজ ধন্য হইলাম ! আজ কৃতার্থ হইলাম ! আজ সত্য-সত্যই আমার ভাগ্যে একজন আদর্শ মহাপুরুষের দর্শন হইল ।”
পণ্ডিতজীর সহিত শ্রীল প্রভুপাদের ব্বত্ত- ব্রহ্মাণতা (বৃত্তি বা লক্ষণানুসারে বর্ণ-নির্ণর) ও পারমার্থিক ব্রাহ্মণতার কথা আলোচনা-প্রসঙ্গে প্রায় সহস্র বৎসর পূর্বের প্রাচীন গ্রন্থ শ্রীরামানুজাচার্যের পরমগুরু শ্রীযামুনাচার্য ঋষি- প্রণীত ‘আগমপ্রামাণ্য’ হইতে বাজসনেয় ও একয়নশাখী বৈষ্ণব-ব্রাহ্মণের কথা পাঠ করিয়া পন্ডিতজীকে শ্রবণ করান এবং বহুবিধ বৈদিক প্রমাণের দ্বারা বৈষ্ণবধর্মই যে সনাতনধর্ম ও শুদ্ধভক্তিই যে আত্মার নিত্যা বৃত্তি, তাহা প্রদর্শন করেন। প্রভুপাদের নিকট এই সকল প্রসঙ্গ শ্রবণ করিয়া পণ্ডিত মাল্যব্যজী বলেন, –
“বঙ্গদেশের গানে-গানে, দ্বারে-দ্বারে, তথা ভারতবর্ষের ও পৃথিবীর সর্বত্র আপনার এই সকল কথা বিশেষ- ভাবে প্রচার হওয়া আবশ্যক। বর্তমান সময়ে দেশে হরিভক্তি-প্রচারে দুর্ভিক্ষের ফলে দেশ বিধর্ম ও অপধর্মের স্রোতে ভাসিয়া যাইতেছে, সুতরাং এখনই হরিভক্তি প্রচারের উপযুক্ত সময় ।”
প্রভুপাদ তদুত্তরে পণ্ডিত মাল্যব্যজীকে বলিলেন,—
“আমরা শ্রদ্ধা ও নির্মলা ভক্তির কথা প্রচার করায় জগতের ভোট-প্রথা আমাদিগকে অধিক সমর্থ করিবেন না। শুনিয়াছি—আপনি ভাগবত পাঠ করেন। অতএব আপনি নিশ্চয় জানেন – ভাগবত ধর্মের ইহাই বৈশিষ্ট্য যে, নিরস্তকুহক সত্যস্বরূপ পরতত্ত্ব ভগবান এশ্রীকৃষ্ণ প্র্রোজি ঋতকৈতব – ধর্মের (শুদ্ধভক্তির) দ্বারাই সেবিত হন। অন্যাভিলাষ, নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম, নিৰ্ভেদ ব্রহ্মনুসন্ধানপর জ্ঞান, অষ্টাঙ্গযোগ বা রাজযোগ, ব্রত, তপস্যা, কৃত্রিম বৈরাগ্য প্রভৃতি প্রোজি খতকৈতধর্ম নহে। ঐ সকলকে কপটতাময় দেহ ও মনোধর্ম বলিয়াছেন। নির্মলাত্মার(নিত্যমুক্তের) যে অহৈতুকী অপ্রতিহতা স্বাভাবিকী বৃত্তি, তাহাই ভগবদ্ভক্তি । বৈদিক উপাসনার নামে যাহা পঞ্চোপাসনা, তাহা শুদ্ধভক্তি নহে ; কেননা পঞ্চোপাসনায় ভক্তির ও ভগবানের নিত্যত্ব স্বীকৃত হয় নাই । কোন ভোগ বা মোক্ষপর কার্যসিদ্ধির জন্য সাময়িক দেবতা-কল্পনায় ভক্তির নিত্যত্ব ও অপকটতা নাই। “
এতৎপ্রসঙ্গে প্রভুপাদ পণ্ডিত মাল্যব্যজীর নিকট আচার্য শঙ্কর, রামানুজ, মধ্ব ও শ্রীমন্মহাপ্রভুর দার্শনিক বিচারের পার্থক্য, ঐক্য, বৈশিষ্ট্য এবং উৎকর্ষও প্রদর্শন করেন।
পণ্ডিত মাল্যব্যজী প্রভুপাদের মুখে যখন ঐ সকল ভাগবতী-সিদ্ধান্ত শ্রবণ করিতেছিলেন, তখন তিনি প্রভুপাদের বাণীর সমর্থনে শ্রীমদ্ভাগবতের বহু শ্লোক উচ্চারণ করিতে করিতে প্রভুপাদকে বলিতে লাগিলেন,
“আপনি ভাগবতরসামৃত-সাগরে অবগাহন করিয়া ভারী হইয়াছেন, কাজেই আপনার গুরুত্ব ও আচার্যত্বের নির্ভীকতা আমাদের আদর্শস্থানীয়। আপনি সেই ভাগবতমৃতরসের বিন্দু বিন্দু আপনার আদর্শ-চরিত্র শিষ্যগণকে পান করাইয়া আপামর সাধারণে সেই রস বিস্তার করুন। প্রকৃত ব্রহ্মণ্যধর্মে, প্রকৃত বৈদিকধর্মে ও প্রকৃত বৈষ্ণবধর্মে কোন ভেদ নাই ৷ প্ৰকৃত ব্রাহ্মণ হইলেই বৈষ্ণব হওয়া যায় ।
পণ্ডিতজী অত্যন্ত আবেগভরে বলিয়া উঠিলেন, –
“Please tell me when you will give me thousands of Brahmin devotees, tell me when I shall get them from you.”
অর্থাৎ আপনি কৰে আমাকে সহ পারমার্থিক-ব্রাহ্মণ-উপদেশক নিতে পারিবেন?
পণ্ডিতজী শ্রীগৌড়য়মঠের কার্য-বিবরণী এবং মঠস্থ সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীরদের আদর্শ-চরিত্র ও ব্যবহার প্রত্যক্ষ করিয়া বলিলেন,-
“I want in no time five thousand disinterested Brahmacharins from you who can preach Bhakti from door to door from Sun-rise to Sun-set.”
অর্থাৎ আমি অবিলম্বে আপনার নিকট হইতে এমন পাঁচ হাজার নিঃস্বার্থ ব্রহ্মচারী চাই, যাঁহারা সূর্যোদয় হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দ্বারে দ্বারে ভগবভক্তি প্রচার করিতে পারেন।
পণ্ডিতজী মঠে শ্রীমন্মহাপ্রভুর শ্রীমূর্তি দর্শন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, — এই মূর্তি হাত উত্তোপন করিয়া রহিয়াছেন কেন ?” প্রভুপাদ বলিলেন,—ইহা শ্রীগৌরসুন্দরের হরিনাম প্রচারের অবস্থাজ্ঞাপক শ্রীমূর্তি।”
পণ্ডিতজী ইহাতে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়া প্ৰভুপাদকে অভিবাদন-পূর্বক বিদায়ের অনুমতি চাহিলেন, যাইবার সময় শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ বলিয়াছিলেন, আমরাও শীঘ্রই আপনাদের সহিত যোগদান করিব।”
[ প্রভুপাদের সহিত পণ্ডিত মালব্যের সাক্ষাৎকারের কথা ১৯২৫ ইং, ১৮ই এপ্রিল তারিখ ইংরাজী দৈনিক
‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ এবং ১৯২৫ ইং, ২৪শে এপ্রিল তারিখের ইংরাজী দৈনিক ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকা প্রভৃতিতে প্রকাশিত হইয়াছিল ]