Divine Disappearance of Srila Prabhupad
Bhakti Siddhanta Saraswati Goswami Thakur
নমঃ ওঁ বিষ্ণুপাদায় কৃষ্ণপ্রেষ্ঠায় ভূতলে।, শ্রীমতে ভক্তিসিদ্ধান্তসরস্বতীতি-নামিনে।।
শ্রীবার্যভানবীদেবীদয়িতায় কৃপাজয়ে।, কৃষ্ণসম্বদ্ধবিজ্ঞানদায়িনে প্ৰভবে নমঃ।।
মাধুর্য্যোজ্জ্বলপ্রেমাঢ্য শ্রীরূপানুগভক্তিদ।, শ্রীগৌর করুণাশক্তিবিগ্রহায় নমোস্তুতে।।
নমস্তে গৌরবাণী-শ্রীমূর্তয়ে দীনতারিণে।, রূপানুগবিরুদ্ধাপসিদ্ধান্তদ্ধান্ত হারিণে।।
শ্রীশ্রীমভুক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদের সঙ্গে যাঁদের নিতা সম্বন্ধ ছিল তাঁরা তাঁর অপ্রাকৃত ভজনশীল জীবনের কথা বলতে পারেন। জাগতিক কর্মবীর কিংবা ধর্মবীরের মত তাঁর জীবন গঠিত হয় নাই। শিশুকাল থেকে শুদ্ধ ভাগবত সঙ্গে ভাগবত জীবন গঠিত হয়েছিল। জাগতিক চমৎকারিতায় জগতের লোক মুগ্ধ হয়। কিন্তু শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর জীবনে এরূপ কোন জড় বিভূতি দেখানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি বরং ঐ প্রকার জড় বিভূতিকে বড় ঘৃণা করতেন। সর্ব্ব বিভূতিময় ভগবান যাঁদের বশীভূত হন, তাঁদের কোন বিভূতি লাভ করতে কি আর বাকী থাকে? “সর্বসিদ্ধি করতলে তাঁর।
শ্রীমদ্ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ করবার সময় যখন শ্রীশ্রীজগন্নাথ পুরীধামে শ্রীমন্দির—সন্নিকটে নারায়ণ ছাতা নামক ভবনে বাস করছিলেন, তাঁর গৃহে শ্রীমদ্ভক্তিক সিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দের (১২৮০ বঙ্গাব্দের) ৬ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার মাঘী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে আবির্ভূত হন। এই মহাপুরুষের জননীর নাম ছিল শ্রীমতী ভগবতী দেবী।শ্রীমদ্ভক্তিবিনোদ ঠাকুর শ্রীবিমলা দেবীর প্রসাদ দ্বারা শিশুর অন্নপ্রাশন করিয়ে নামকরণ করলেন “বিমলা প্রসাদ”।
শ্রীশ্রীসরস্বতী ঠাকুরের আবির্ভাবের ছয় মাস পরে রথযাত্রা হয়। এই রথ যাত্রার সময় তিন দিন শ্রীজগন্নাথের রথ বড় দাঁড়ের উপর সরস্বতী ঠাকুরের জন্ম গৃহের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন জননী ভগবতী দেবী শিশুকে নিয়ে রথোপরি আরোহণ করলেন এবং তাকে শ্রীজগন্নাথের শ্রীপাদপদ্মমূলে ছেড়ে দিলেন। শ্রীজগন্নাথদেব যেন শিশুর কত কালের পরিচিত। আনন্দভরে শ্রীজগদীশকে শিশু জড়িয়ে ধরল। ঠিক সেই সময়ে শ্রীজগন্নাথদেবের কণ্ঠ থেকে একটি ফুলের মালা ছিন্ন হয়ে শিশুর শিরে পতিত হল। তা দেখে পূজারী পাণ্ডাগণ আনন্দে ‘হরি হরি’ ধ্বনি করে উঠলেন। বললেন মা! তোমার এই শিশু কালে একজন মহাপুরুষ হবে। শ্রীজগন্নাথদেব একে আশীৰ্ব্বাদী মালা দিয়েছেন। এ তাঁর কথা জগতে প্রচার করবে। জ্ঞানী ব্রাহ্মণের আশীর্ব্বাদ শুনে আনন্দে অশ্রুসিক্ত নয়নে শিশুকে কোলে নিলেন এবং বারংবার ব্রাহ্মণগণকে এবং জগন্নাথদেবকে বন্দনা করতে লাগলেন। আবির্ভাবের পরে শিশু জননীর সহিত দশমাস কাল পুরী থাকার পর পাল্কীতে স্থল পথে রাণাঘাটে উপনীত হন।
শ্রীমদ্ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় পরম নিষ্ঠাবান সদাচার সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন। তাঁর পত্নী শ্রীভগবতী দেবীও তদ্রূপ সদগুণ সম্পন্না ছিলেন। তাঁরা পুত্র-কন্যাগণকে কদাপি ভগবদ প্রসাদ ছাড়া অন্য কোন বস্তু খেতে দিতেন না। কোন অসৎ সঙ্গেও মিশতে দিতেন না। ১৮৮১ সালে কলিকাতার রামবাগানে ভক্তি ভবনের ভিত্তি খনন কালে এক শ্রী কুর্মদেবের মূর্তি প্রকট হয়। সপ্তমবর্ষ বয়স্ক শ্রীসরস্বতী ঠাকুরকে শ্রীভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় শ্রীনাম ও মন্ত্র দিয়ে সেই কুর্মদেবের সেবা করতে নির্দেশ দিলেন।
১৮৮৪ সালে ১লা এপ্রিল শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় শ্রীরামপুরের সিনিয়ার ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হন। এই সময় সরস্বতী ঠাকুরকে শ্রীরামপুর হাইস্কুলে ভক্তি করান হয়। তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যয়ন করতেন বিকৃত্তি বা Bicanto নামে এক নূতন লেখন প্রণালী আবিষ্কার করেন। এই সময় তিনি পণ্ডিতবর মহেশচন্দ্র চূড়ামণির নিকট গণিত ও জ্যোতিষ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।
প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। তিনি লাইব্রেরীতে বসে বিভিন্ন দর্শন গ্রন্থ অধ্যয়ন করতেন। এই সময় তিনি শ্রীযুত পৃথ্বীধর শর্মার নিকট বেদও অধ্যয়ন করতেন। শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর বেশী দিন কলেজে অধ্যয়ন করতে পারলেন না। কলেজ ত্যাগের কারণ সম্বন্ধে তিনি আত্মচরিতে লিখেছেন – “আমি যদি মনোযোগ সহকারে বিদ্যালয়ের পাঠ শিক্ষা করতে থাকি তাহা হইলে সংসারে প্রবেশের জন্য আমার প্রতি যৎপরোনাস্তি পীড়ন হইবে। আর যদি মূর্খ তাকর্মন্য রূপে প্রতিপন্ন হই, তাহা হইলে সাংসারিক উন্নতির জন্য প্রবৃত্ত হইতে কেহ আর তাদৃশী প্ররোচনা করিবে না।
পাঠ্যাবস্থায় তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় পারমার্থিক প্রবন্ধাদি লিখতেন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের সহিত গৌড় মণ্ডলের বিভিন্ন শ্রীগৌর পার্ষদগণের শ্রীপাট সকল দর্শন করেন। শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর ১৮৯৮ সালে সারস্বত চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা করবার সময় পৃথকভাবে ‘ভক্তি ভবনে’ পণ্ডিতবর শ্রীযুত পৃথ্বীধর শর্মার নিকট সিদ্ধান্ত কৌমুদী অধ্যয়ন করেন। অল্প কালের মধ্যে তিনি সিদ্ধান্ত কৌমুদীতে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি ভক্তিভবনে স্বতন্ত্র একটি সারস্বত “চতুষ্পাঠী” স্থাপন করেন। তাতে ছাত্রগণকে জ্যোতিষ শাস্ত্র অধ্যয়ন করান।’সারস্বত চতুষ্পাঠি’ হতে সরস্বতী ঠাকুর জ্যোতির্ব্বিদ, বৃহস্পতি প্রভৃতি মাসিক পত্রিকা এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রে অনেক প্রাচীন গ্রন্থ প্রকাশিত করেন। শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর কিছুদিন স্বাধীন ত্রিপুরা এস্টেটে কর্ম গ্রহণ করে ত্রিপুরার রাজন্যবর্গের জীবন চরিত ‘রাজরত্নাকর’ গ্রন্থ প্রকাশের সম্পাদকতা করতে লাগলেন। পরে তিনি যুবরাজ ব্রজেন্দ্র কিশোরের সংস্কৃত ও বাংলা শিক্ষার ভার গ্রহণ করেন। কিছুদিন এই কার্য্য করার পর তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন কার্য্য পরিদর্শনের ভার নেন। বৈষয়িক কার্য্য মধ্যে বিবিধ প্রকারের হিংসা দ্বেষ মাৎসর্য্য প্রভৃতি দেখে তিনি উহা শীঘ্রই ত্যাগ করতে ইচ্ছা করলেন। মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য বাহাদুর তা’ অনুমোদন করে তাঁকে পূর্ণ বেতনে পেন্সন প্রদান করেন। শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর তিন বছর পেন্সন ভোগ করে তা নিজেই বন্ধ করে দেন।
১৮৯৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শ্রীভক্তিবিনোদ ঠাকুরের সহিত কাশী, প্রয়াগ ও গয়া প্রভৃতি তীর্থস্থানে গমন করেন। কাশীতে শ্রীরামমিশ্র শাস্ত্রীর সহিত রামানুজ সম্প্রদায় সম্বন্ধে নানা আলাপ আলোচনা হয়। তখন থেকে তাঁর অদ্ভুত বৈরাগ্যময় জীবন বিকশিত হতে থাকে। তিনি মনে মনে সদ্গুরুর অনুসন্ধান করতে লাগলেন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে তাঁকে বৃন্দাবনে সিদ্ধ বাবা শ্রীশ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের শ্রীপাদপদ্ম আশ্রয় করতে নির্দেশ দিলেন।
শ্রীল সরস্বতী ঠাকুর শ্রীল ভক্তিবিনোদের উপদেশ মত শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজীর নিকট দীক্ষা প্রার্থনা করেন। প্রথম দিন শ্রীল বাবাজী মহারাজ বললেন—আমি আপনাকে কৃপা করতে পারি কিনা মহাপ্রভুকে জিজ্ঞাসা না করে বলতে পারব না। দ্বিতীয় দিন সরস্বতী ঠাকুর শ্রীল বাবাজী মহারাজের নিকট উপস্থিত হলেন। বাবাজী মহারাজ বললেন আমি মহাপ্রভুকে জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছি। তৃতীয়দিন সরস্বতী ঠাকুর উপস্থিত হলেন। শ্রীল বাবাজী মহারাজ বললেন—আমি মহাপ্রভুকে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি বললেন—সুনীতি বা পাণ্ডিত্য ভগবদ্ভক্তির কাছে অতি তুচ্ছ। তদ্ভবণে সরস্বতী ঠাকুর বললেন আপনি কপট চূড়ামণির সেবা করেন তাই বঞ্চনা করছেন, আমায় কৃপা করতে চান না। গোষ্ঠিপূর্ণের নিকট শ্রীরামানুজ আচার্য্য অষ্টাদশ বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে পরে তাঁর কৃপালাভ করেছিলেন। আমিও তার আপনার শ্রীপাদপদ্মের কৃপালাভ একদিন না একদিন করবই। শ্রীল বাবাজী মহারাজ সরস্বতী ঠাকুরের এইরূপ সুদৃঢ় নিষ্ঠা দেখে, শ্রীগোদ্রুমের জন সুখদ কুঞ্জে তাঁকে ভাগবতী দীক্ষা প্রদান করলেন। শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ সাক্ষাদ্বৈরাগ্য মূর্তি। কাকেও মন্ত্র-দীক্ষাদি দিতে চাইতেন না। তিনি গঙ্গাতটে বৃক্ষমূলে বাস করতেন। গঙ্গায় পরিত্যক্ত মৃত ব্যক্তির বস্ত্র কৌপীনরূপে ব্যবহার করতেন। কখনও গঙ্গাজলে চাল ভিজিয়ে লঙ্কা ও লবণ দিয়ে তা খেতেন। কখনও পরিত্যক্ত মৃদ্ভান্ড গঙ্গাজলে ধুয়ে তাতে অন্ন রান্না করে ঠাকুরের ভোগ দিয়ে তা’ গ্রহণ করতেন।
১৯০০ সালের মার্চ মাসে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের সহিত সরস্বতী ঠাকুর বালেশ্বর, রেমুণা, ভুবনেশ্বর ও পুরী প্রভৃতি স্থানে পরিভ্রমণ করেন। স্থানে স্থানে ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের নির্দেশ মত শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতাদি ব্যাখ্যা করেন। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের দৌলতে শুদ্ধ ভক্তির মন্দাকিনী পুনঃ প্রবাহিত হয়। শ্রীগৌর পার্ষদগণের অপ্রকটের পর গৌড়ীয় বৈষ্ণার জগতে এক অন্ধকার যুগ এসেছিল। সেই যুগের অবসানে ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের বাণী জগতে প্রচার করেন। তিনি শুদ্ধ ভক্তি সিদ্ধান্ত বিষয়ক বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, বহু পারমার্থিক পত্রিকাও প্রকাশ করেন। তাঁর কৃপায় বহু সজ্জন ব্যক্তি গৌরসুন্দরের ভজন করতেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে শ্রীনামহট্ট ও প্রপন্নাশ্রমাদি সংস্থাপন করেন।
১৯১৬ সালে বঙ্গাব্দ ১৩২১, ৯ই আষাঢ় গৌর শক্তি পণ্ডিতের তিরোভাব তিথির দিন শ্রীমদ্ভক্তিবিনোদ ঠাকুর অপ্রকট হন। ঠাকুর মহাশয় নিত্যলীলা প্রবেশ করবার পূর্বে শ্রীসরস্বতী ঠাকুরকে বললেন ষড়-গোস্বামীর গ্রন্থ ও শ্রীগৌরসুন্দরের শিক্ষা বিশেষভাবে সর্ব্বত্র প্রচার কর। মহাপ্রভুর জন্মস্থানের উন্নতিও করা চাই। জননী শ্রীভগবতী দেবীও কয়েক বৎসর পরে পরলোক গমন করেন। যাবার সময় তাঁর হাত ধরে বললেন তুমি অব্যশ্যই আমার গৌরসুন্দরের কথা ও তাঁর ধাম শ্রীমায়াপুর সর্ব্বত্রই প্রচার করবে। শ্রীসরস্বতী ঠাকুর পিতৃ মাতৃ আজ্ঞা শিরে ধারণ করে বিপুল উদ্যমে শ্রীগৌরসুন্দরের বাণী প্রচার করতে আরম্ভ করলেন।
ইতঃপূর্ব্বে শ্রীসরস্বতী ঠাকুর শ্রীমায়াপুরে অবস্থান করে শতকোটি মহামন্ত্র জপ ব্রতের উদযাপন করেছিলেন। সমস্ত বাংলাদেশে আচার্য্য সন্তানগণ স্মার্ত্ত জাতিবাদ দিয়ে বৈষ্ণবদের অবজ্ঞা ও নির্যাতন করছিল। এই বিষয় নিয়ে মেদিনীপুর বালীঘাই নামক স্থানে একটি বিরাট সভার আয়োজন করা হয়। এই সভাতে শ্রীবৃন্দাবন ধামের শ্রীযুত মধুসূদন দাস গোস্বামী ও গোপীবল্লভ পুরের পণ্ডিতবর শ্রীবিশ্বম্ভরানন্দ দেব গোস্বামী উপস্থিত ছিলেন। তথায় গোস্বামীদ্বয়ের আহ্বানে শ্রীসরস্বতী ঠাকুরও উপস্থিত হন। সভার কার্যা আরম্ভ হল। স্মার্ত্ত পণ্ডিত নিজ নিজ মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করতে থাকলে গোস্বামীদ্বয়ের অনুমোদনে শ্রীসরস্বতী ঠাকুর ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব তত্ত্ব সম্বন্ধে একটি সুদীর্ঘ বক্তৃতা প্রদান করেন। শ্রীসরস্বতী ঠাকুরের যথার্থ শাস্ত্র যুক্তি সম্পন্ন সে বক্তৃতা শ্রবণে স্মার্ত্ত আচার্য্য সম্ভানগণ মোহিত ও আশ্চার্য্যান্বিত হন। সকলে ব্রাহ্মণগণ অপেক্ষা বৈষ্ণবগণের মহিমা উপলব্ধি করতে পারলেন।
১৯১২ সালে কাশিম বাজারের মহারাজ শ্রীমণীন্দ্র নন্দী নিজ ভবনে একটি বৃহৎ বৈষ্ণব সম্মিলনীর আয়োজন করেন। সেই সম্মিলনীতে মহারাজ শ্রীসরস্বতী ঠাকুরকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করে নিয়েছিলেন। শ্রীসরস্বতী ঠাকুর চারদিন যাবৎশুদ্ধাভক্তি সম্বন্ধে চারটি বক্তৃতা প্রদান করেন। কিন্তু তথায় তথাকথিত প্রাকৃত সহজিয়াগণের সমাবেশ ও কেবলমাত্র লোক দেখানো ভাব দেখে তিনি চারদিন কিছু ভোজন করেন নাই। এ চারদিন উপবাসাস্তে শ্রীমায়াপুরে এসে মহাপ্রভুর প্রসাদ গ্রহণ করেন। তথায় কোন কোন লোক তাঁকে ভোজনের জন্য অনুরোধ জানালে তিনি বলেছিলেন—অভক্তি বিচার পর বারোয়ারী স্থানে ভোজন করতে নাই। পরে মহারাজা মণীন্দ্র নন্দী এ ব্যাপার বুঝতে পেরে দুঃখিত হন এবং মায়াপুরে আগমন করে তাঁর চরণে অনেক অনুনয় বিনয় প্রকাশ করেন।
তখন সারা বাংলাদেশ আউল, বাউল, কৰ্ত্তাভজা, নেড়া নেড়ী দরবেশ ও সাঁই প্রভৃতি প্রাকৃত সহজিয়া রূপ অপসম্প্রদায়ে ভরা ছিল। শ্রীসরস্বতী ঠাকুর এ সমস্ত অপসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অনেক সংগ্রাম করেন। তিনি এই সমস্ত মহাপ্রভুর নামের কলঙ্ককারী অপসম্প্রদায়কে কিছুমাত্র প্রশ্রয় দিতেন না। এই সময় অনেক প্রসিদ্ধ গোস্বামী নামধারী ব্যক্তিও এই প্রাকৃত সাহজিয়াগণকে প্রশ্রয় দিতেন। প্রাকৃত সাহজিয়াবাদীর দল যখন পরমহংস গোস্বামী গুরুবর্গের পরমহংস বেষ ধারণ পূর্ব্বক জগৎকে প্রবঞ্চনা করতে লাগল তখন শ্রীসরস্বতী ঠাকুর দুঃখে অসৎসঙ্গ বর্জন পূৰ্ব্বক নির্জ্জনে ভজন করতে আরম্ভ করলেন। সে সময় অকস্মাৎ একদিন দিব্য মূৰ্ত্তিতে মহাপ্রভু ও ষড়গোস্বামী পূর্বতন আচার্য্যগণ যেন আবির্ভূত হয়ে বলতে লাগলেন—তুমি নিরুৎসাহ হয়ো না। উৎসাহের সহিত পুনঃ দৈববর্ণাশ্রম ধর্ম স্থাপন কর ও বৈধমার্গে ক্রমবিধিতে ভগবদ্ ভজন প্রণালী প্রচার কর। তিনি সে দিব্য প্রেরণা পেয়ে সেদিন থেকে বিপুল উদ্যমে জগতে গৌরবাণী পুনঃ প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। শ্রীসরস্বতী ঠাকুর ১৯১৮ সালের ৭ই মার্চ শ্রীগৌরজয়ন্তী বাসরে শ্রীধাম মায়াপুরে ভাগবত ত্ৰিদণ্ডী সন্ন্যাস লীলা প্রবর্তন করলেন। সেদিন শ্রীচন্দ্রশেখর ভবনে শ্রীচৈতন্য মঠ স্থাপন করলেন ও শ্রীগুরু গৌরাঙ্গ এবং শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ বিগ্রহ স্থাপন করলেন।
বরিশালের ভোলা নিবাসী ভূতপূর্ব্ব হাইকোর্টের বিচারপতি চন্দ্রমাধব ঘোষের ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীরোহিণী কুমার ঘোষ হরিভজন করবার আশায় সংসার ত্যাগ করে নবদ্বীপ কুলিয়ায় আসেন এবং একজন বাউলের চরণাশ্রয় করে। তাঁদের শিক্ষাদীক্ষানুসারে চলতে লাগলেন। কিন্তু বাউলদের সেবাদাসী ব্যাপার দেখে তাঁর মনে মনে ঘৃণা হতে লাগল। রোহিণীবাবু একদিন মায়াপুরে যোগপীঠ দর্শনে এলেন। সেদিন শ্রীল প্রভুপাদ যোগপীঠে হরিকথা বলছেন। রোহিণীবাবু শ্রীল প্রভুপাদের অপূর্ব্ব তেজপুঞ্জ বিশিষ্ট শ্রীমূর্ত্তি এবং অদ্ভুত সিদ্ধান্ত পূর্ণ বাণী সকল শুনে অতি আনন্দ অনুভব করতে লাগলেন। সেদিন শ্রীপ্রভুপাদের সমস্ত কথা শুনে তিনি কুলিয়ার বাউল গুরুর আশ্রমে ফিরে এলেন। একটু রাত্র হয়েছিল। রোহিণীবাবু শ্রীল প্রভুপাদের মুখে যে সমস্ত শুদ্ধ ভক্তিময়ী কথা শুনেছেন তা চিন্তা করতে করতে শুয়ে পড়লেন, কিছু খেলেন না। নিদ্রিত হলে স্বপ্নে দেখছেন সেই বাউলটি একটা ব্যাঘ্র মূর্তিতে ও সেবাদাসী ব্যাঘ্ৰী মূর্তিতে তাকে খাবার জন্য যাচ্ছে। রোহিনীবাবু ভয়ে কম্পিত কলেবরে মহাপ্রভুকে ডাকছেন। এমন সময় দেখলেন শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করছেন। রোহিণীবাবু সেইদিনই চিরতরে বাউল গুরুকে ত্যাগ করে শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীচরণ আশ্রয় করলেন।
শ্রীশ্রীঅন্নদাপ্রসাদ দত্ত (শ্রীল প্রভুপাদের বড় ভাই) দেহত্যাগের কিছুদিন পূর্ব্বে ভীষণ শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হন। তাঁর নির্ধান দিবসে শ্রীল প্রভুপাদ সমস্ত রাত্র তাঁর নিকট উপস্থিত থেকে তাঁকে হরিনাম শুনান। অতঃপর দেহত্যাগের কিছু পূর্ব্বে তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। তখন তিনি শ্রীল প্রভুপাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন। শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে শ্রীহরি স্মরণ করতে বললেন। সে সময় এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। অন্নদাপ্রসাদ বাবুর ললাটে এ অপূর্ব্ব রামানুজীয় তিলক চিহ্ন স্পষ্ট ভাবে দেখা যেতে লাগল। তিনি সকলের সামনে পূর্ব্ব জীবনের কথা বলতে লাগলেন। তিনি রামানুজীয় বৈষ্ণব ছিলেন। শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীচরণে কিছু অপরাধ করার ফলে তাঁর পুনর্ব্বার জন্ম হয়। পূৰ্ব্বকৃত সুকৃতি ফলে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের ঘরে আগমন হয়। এই সমস্ত কথা বলবার পর অন্নদাপ্রসাদ বাবু দেহত্যাগ করেন। এক সময়ে মায়াপুরে শ্রীব্রজপত্তনে শ্রীল প্রভুপাদ ভজন করছেন। ভাদ্রমাসে জন্মাষ্টমীর আগের দিন, ঠাকুরের নৈবেদ্যে দুগ্ধাদির কোন ব্যবস্থা করতে পারেন নি। শ্রীল প্রভুপাদ চিন্তা করতে লাগলেন আজ দুধ পাওয়া গেলে মহাপ্রভুকে ভোগ দেওয়া যেত। পরক্ষণে প্রভুপাদ চিন্তা করতে লাগলেন, আমার নিজের জন্য এইরূপ চিন্তা হল না কি? অন্যায় হয়। তখন বর্ষাকাল। গৌর জন্মভিটা জলমগ্ন। নৌকা ছাড়া চলা দুষ্কর। এই অবস্থায় অপরাহকালে একজন গোয়ালা সেই জল কাদা ভেঙ্গে প্রচুর পরিমাণে দুধ, ক্ষীর, মাখন ও ছানা প্রভৃতি নিয়ে উপস্থিত হলো। তখন জানতে পারা গেল গোয়ালাটিকে জমিদার হরিনারায়ণ চক্রবর্তী মহাশয় মহাপ্রভুর প্রেরণা অনুযায়ী এই সমস্ত জিনিষ দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঠাকুরের ভোগের পর সেই প্রসাদ শ্রী প্রভুপাদের কাছে নেওয়া হল। এত প্রসাদ দেখে তিনি অবাক হলেন। তারপর সমস্ত কথা শুনলেন। অনন্তর তিনি প্রসাদ নিয়ে মহাপ্রভুকে বলতে লাগলেন —“আমি আপনাকে কত কষ্টই না দিলাম। কেন আমার এইরূপ একটি দুবুদ্ধির উদয় হল ? আপনি আমার জন্য অপরলোকের হৃদয়ে প্রেরণা দিয়া এই সকল দ্রব্য পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছেন।”
শ্রীল প্রভুপাদের অলৌকিক প্রভাবে জগৎ মুগ্ধ হল। তাঁর আকর্ষণে বহু সম্ভ্রান্ত কূলের বিদ্বান ব্যক্তি শ্রীগৌরসেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। ১৯১৮ সাল থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে শ্রীনবদ্বীপ, মায়াপুর, কলিকাতা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম মেদিনীপুর, রেমুণা বালেশ্বর, পুরী, আলালনাথ, মাদ্রাজ, কতুর, দিল্লী, পার্টনা, গয়া, লক্ষ্মৌ, কাশী, হরিদ্বার, এলাহাবাদ, মথুরা, বৃন্দাবন, আসাম, কুরুক্ষেত্র, ভারতের বহির্দেশে রেঙ্গুন ও লন্ডন প্রভৃতি স্থানে শ্রীল প্রভুপাদ ৬৬টি শুদ্ধভক্তি মঠ স্থাপন করেন এবং মন্দার পর্ব্বতোপরি, শ্রীনৃসিংহাচল এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে শ্রীগৌরপাদপীঠ স্থাপন করেন। প্রাচ্য তথা পাশ্চাত্য উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ২৫ জন ব্যক্তিকে ভাগবত ত্রিদণ্ডি সন্ন্যাস প্রদান করেন। তিনি জগতে বৈকুণ্ঠবানী প্রচারের জন্য বহু শুদ্ধভক্তি পত্রিকা প্রকাশ করেন। (১)সজ্জনতোষণী বা (The Harmonist) পাক্ষিক পত্রিকা, (২) সাপ্তাহিক গৌড়ীয় পরিকা, (৩) হিন্দী পাক্ষিক ভাগবত নামক পত্রিকা, (৪) দৈনিক নদীয়া প্রকাশ, (৫) আাসামী ভাষায় মাসিক কীৰ্ত্তন নামক পত্রিকা, (৬) উড়িষ্যা ভাষায় পরমার্থী নামক পত্রিকা। এতদ্ব্যতীত বহু বৈষ্ণব গ্রন্থও প্রকাশ করেন। তিনি পারমার্থিত জগতে একটি নুতন যুগ আনয়ন করেছিলেন। তিনি পৃথিবীর সর্বত্র গৌর বাণী প্রচারের জন্য শুদ্ধ আচরণশীল-ত্রিদণ্ডি সন্ন্যাসীদের প্রেরণ করলেন। মহা উদ্যমে শ্রীগৌরকৃষ্ণের বাণী পৃথিবীতলে প্রচার হতে লাগল। তিনি ষষ্টি বর্ষ পর্যান্ত এইরূপ উদ্যমে গৌর বাণী প্রচার করে যখন সঙ্কল্প কতকটা সিদ্ধ হয়েছে দেখলেন তখন হৃষ্ট মনে শ্রীগৌরকৃষ্ণের নিত্য সেবায় প্রবেশ করতে ইচ্ছা করলেন। নিত্য লীলায় প্রবেশ করার কয়েকদিন পূর্বে তিনি প্রধান প্রধান শিষ্য ভক্তগণকে সমবেত করে তাঁদের প্রচুর আশীর্ব্বাদ প্রদান করলেন। পরিশেষে উপস্থিত অনুপস্থিত ভক্তগণকে আশীর্ব্বাদ করে বললেন—“সকলে রূপরঘুনাথের কথা পরমোৎসাহের সহিত প্রচার করবেন। শ্রীরূপানুগগণের পাদপদ্ম ধুলি হওয়াই আমাদের চরম আকাঙ্খা। আপনারা সকলে এক অন্বয় জ্ঞানের অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয় তৃপ্তির উদ্দেশ্যে আশ্রয় বিগ্রহের আনুগত্যে মিলেমিশে থাকবেন।” শ্রীল প্রভুপাদ এইরূপ বহু মূল্যবান উপদেশ নিয়ম নীতি প্রভৃতি দিবার পর, গত ৪ নারায়ণ গৌরাব্দ ৪৫০, ১৭ই পৌষ বঙ্গাব্দ ১০৪, ১ জানুয়ারী ১৯৩৭ সালে শুরুবার নিশান্তঃকালে শ্রীশ্রীরাধা গোবিন্দের নিত্যলীলায় প্রবেশ করেন।
জয় নিতালীলা প্রবিষ্ট জগদগুরু ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীশ্রীমদ্ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদ কি জয়।