Appearance Day of Srila Lochan Das
শ্রীলোচনদাস ঠাকুর বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত কোগ্রামে রাঢ়ীয় বৈদ্যকুলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অল্প বয়সে গৌরভক্তগণের সঙ্গ পাবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। তাঁর গুরু শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর ছিলেন।
ঠাকুর শ্রীনরহরি,
দাস প্রাণ অধিকারী,
যাঁর পদ প্রতি আশে আশ।
অধমেহ সাধ করে,
গোরা গুণ গাহিবারে,
সে ভরসা এ লোচন দাস।।
—( শ্রীচৈতন্যমঙ্গল সূত্র খণ্ড)
আমার ঠাকুর শ্রীনরহরি দাস।
প্রণতি বিনতি করোঁ পুর মোর আশ।।
—(চৈঃ মঃ সূত্র খণ্ড)
পূর্ব্ববঙ্গে লক্ষ্মীর পাঁচালী, শনির পাঁচালী ও মনসা ভাসান প্রভৃতি কবিগণ গান করতেন। সেই পাঁচালী অনুকরণে শ্রীলোচনদাস ঠাকুর চৈতন্য মঙ্গল রচনা করেন। পাঁচালী হচ্ছে পাঁচ প্রকার গীতিছন্দে রচিত গ্রন্থ।
শ্রীলোচনদাসের পিতার নাম—শ্রীকমলাকর দাস। মায়ের নাম -শ্রীসদানন্দী। লোচন দাস পিতার একমাত্র পুত্র ছিলেন বলে আদরের দুলাল ছিলেন। তিনি মাতামহ-গৃহে বেশীর ভাগ সময় অবস্থান করতেন এবং তথায় পড়াশুনা করতেন। অতি অল্প বয়সে শ্রীলোচন দাসের বিবাহ হয়েছিল।
শিশু কাল থেকে শ্রীলোচন দাস গৌর-অনুরক্ত এবং বিষয়ে বিরক্ত ছিলেন। যৌবনে অধিক সময় তিনি শ্রীখণ্ডে শ্রীগুরুদেব—নরহরি সরকার ঠাকুরের পাদপদ্মে অবস্থান করতেন। সে স্থানে তাঁর কীর্ত্তন শিক্ষা হয়।
শ্রীলোচনদাস ঠাকুরের চৈতন্য মঙ্গলের প্রধান উপাদান গ্রন্থ হল, শ্রীমুরারি গুপ্তে বিরচিত—”শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতম্” কাব্য। তিনি স্বয়ং একথা লিখেছেন –
“সেই সে মুরারি গুপ্ত বৈসে নদীয়ায়।।
শ্লোক বন্ধে হৈল পুঁথি গৌরাঙ্গ চরিত।
দামোদর সংবাদ—মুরারিমুখোদিত।।
শুনিঞা আমার মনে বাড়িল পিরীত।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহোঁ গৌরাঙ্গচরিত।।”
(চৈঃমঃ সূত্রখণ্ড)
চৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থ লেখার আগে শ্রীলোচনদাস শ্রীবৃন্দাবনদাস ঠাকুরকে বন্দনা করেছেন।
বৃন্দাবন দাস বন্দির একচিতে।
জগত মোহিত যাঁর ভাগবত গীতে।।
(চৈঃমঃসূত্র খণ্ড)
শ্রীবৃন্দাবন দাসের চৈতন্য-ভাগবতের নাম পূর্বে ‘চৈতন্য মঙ্গল’ ছিল। শ্রীলোচনদাস ঠাকুর ও শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বোধ হয় ‘চৈতন্য ভাগবত’ নামকরণ করেন। এস্থলে “ভাগবত গীতে” এ কথাকে স্পষ্ট বোধ হচ্ছে চৈতন্যভাগবতের গানে জগৎ মোহিত।
শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন—
কৃষ্ণ-লীলা ভাগবতে কহে বেদব্যাস।
চৈতন্য লীলার ব্যাস বৃন্দাবন দাস।।
এ পয়ারে চৈতন্য মঙ্গলের নাম “চৈতন্য ভাগবত” হল এ ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
শ্রীমদ্ বৃন্দাবন দাস ঠাকুর শ্রীচৈতন্য ভাগবতে অনেক লীলা স্পষ্ট করে বর্ণন করেন নাই, শ্রীলোচন দাস চৈতন্য মঙ্গলে বর্ণনা করেছেন। মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্ব্বে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর যে কথোপকথন হয়েছিল, শ্রীবৃন্দাবন দাস ঠাকুর তা বর্ণন করেন নাই। শ্রীলোচন দাস কিন্তু বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।
“প্রভুর ব্যগ্রতা দেখি,
বিষ্ণুপ্রিয়া চন্দ্রমুখী,
কহে কিছু গদ্গদ্ স্বরে।।
কহ কহ প্রাণনাথ,
মোর শিরে দিয়া হাত,
সন্ন্যাস করিবে নাকি তুমি।
লোক মুখে শুনি ইহা,
বিদরিতে চাহে হিয়া,
আগুনিতে প্রবেশিব আমি।।
তো লাগি জীবনধন,
রূপ নব যৌবন,
বেশ বিলাস ভাব-কলা।
তুমি যবে ছাড়ি যাবে,
কি কাজ এ ছার জীবে,
হিয়া পোড়ে যেন বিষ জ্বালা।।”
শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর এরূপ করুণ বিলাপ-বাণী শুনে মহাপ্রভু বলতে লাগলেন—
এ বোল শুনিয়া পহুঁ ,
মুচকি হাসিয়া লহুঁ
কহে শুন মোর প্রাণপ্রিয়া।
কিছু না করিহ চিতে,
যে কহিয়ে তোর হিতে
সাবধানে শুন মন দিয়া।।
জগতে যতেক দেখ,
মিছা করি সব লেখ,
সত্য এক সবে ভগবান।
সত্য আর বৈষ্ণব,
তা বিনে যতেক সব,
মিছা করি করহ গেয়ান।।
মিছা সুত পতি নারী,
পিতা-মাতা আদি করি,
পরিণামে কেবা বা কাহার।
শ্রীকৃষ্ণ চরণ বহি,
আর ত কুটুম্ব নাহি,
যত দেখ সব মায়া তাঁর।।
কি নারী পুরুষ দেখ,
আত্মা সে সবার এক
মিছা মায়াবন্ধে ভাবে দুই।
শ্রীকৃষ্ণ সবার পতি,
আর সব প্রকৃতি,
এ কথা না বুঝয়ে কোই।।
রক্তরেত সম্মিলনে,
জন্ম বিষ্ঠা মূত্র স্থানে,
ভূমে পড়ি হয় অগেয়ান।
বাল যুবা বৃদ্ধ হৈয়া,
নানা দুঃখ কষ্ট পাইয়া,
দেহে-গেহে করে অভিমান।।
বন্ধু করি যারে পালি,
তারা সবে দেই গালি,
অভিমানে বৃদ্ধট্ট কাল বঞ্চে ।
শ্রবণ নয়ান অন্ধে,
বিষাদ ভাবিয়া কান্দে,
তবু নাহি ভজয়ে গোবিন্দে।।
কৃষ্ণভাজিবার তবে,
দেহ ধরি এ সংসারে,
মায়া বন্ধে পাসরি আপনা।
অহঙ্কারে মত্ত হৈয়া,
নিজ প্রভু পাসরিয়া,
শেষে পায় নরক যন্ত্রণা।।
তোর নাম বিষ্ণুপ্রিয়া,
সার্থক করহ ইহা,
মিছা শোক না করহ চিতে।
এ তোর কহিলু কথা,
দূর কর আন চিন্তা
মন দেহ কৃষ্ণের চরিতে।।
ভগবান শ্রীগৌরসুন্দর বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর প্রতি এ সমস্ত উপদেশ দিয়ে, নিজ স্বরূপ চতুর্ভুজ মূর্তি দেখালেন।
আপনে ঈশ্বর হৈয়া,
দূর করে নিজ মায়া,
বিষ্ণুপ্রিয়া পরসন্ন চিত।
দূরে গেলে দুঃখ-শোক,
আনন্দে ভরল বুক,
চতুর্ভুজ দেখে আচম্বিত।।
শ্রীগৌরসুন্দর যদিও উপদেশ বলে ও স্বরূপ মূৰ্ত্তি দর্শন দিয়ে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর মোহ দূর করলেন, কিন্তু পতি-বুদ্ধি বিষ্ণুপ্রিয়ার অটুট রইল।
তবে দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া,
চতুর্ভুজ দেখিয়া,
পতি বুদ্ধি নাহি ছাড়ে তবু।
পড়িয়া চরণ তলে,
কাকুতি মিনতি করে,
এক নিবেদন শুন প্রভু।
মো অতি অধম ছার,
জনমিল এ সংসার,
তুমি মোর প্রিয় প্রাণ-পতি।
এ হেন সম্পদ মোর,
দাসী হৈয়াছিলু তোর,
কি লাগিয়া ভেল অধোগতি।।
ইহা বলি বিষ্ণুপ্রিয়া,
কান্দে উতরোলী হৈয়া,
অধিক বাড়িল পরমাদ।
প্রিয়জনে আৰ্ত্তি দেখি,
ছল ছল করে আঁখি,
কোলে করি করিলা প্রসাদ।।
শুন দেবি বিষ্ণুপ্রিয়া,
তোমারে কহিল ইহা,
যখনে যে তুমি মনে কর।
আমি যথা তথা যাই,
আছিয়ে তোমার ঠাঁই,
এই সত্য কহিলাম দঢ়।।
প্রভু আজ্ঞা বাণী শুনি,
বিষ্ণুপ্রিয়া মন গুণি,
স্বতন্ত্র ঈশ্বর এই প্রভু।
নিজ সুখে কর কাজ,
কে দিবে তাহাতে বাধ,
প্রত্যুত্তর না দিলেন তবু।।
বিষ্ণুপ্রিয়া হেট মুখী,
ছল ছল করে আঁখি,
দেখি প্রভু সরস সম্ভাষে ।।
প্রভুর আচরণ কথা
শুনিতে লাগয়ে ব্যথা
গুণ গায় এ লোচন দাসে।।
( চৈঃ মঃ মধ্যঃ ৫৬৯ গীত)
শ্রীলোচন দাস ঠাকুর শ্রীগৌরাঙ্গ-নিত্যানন্দের গুণ মহিমা অতি সরল সুন্দর ভাষায় গান করেছেন—
পরম করুণ,
পহুঁ দুই জন,
নিতাই গৌরচন্দ্র।
সব অবতার,
সার শিরোমণি,
কেবল আনন্দ কন্দ
ভজ ভজ ভাই,
চৈতন্য নিতাই,
সুদৃঢ় বিশ্বাস করি।
বিষয় ছাড়িয়া,
সে রসে মজিয়া,
মুখে বল ‘হরি হরি’।
দেখ ওরে ভাই,
ত্রিভুবনে নাই,
এমন দয়াল দাতা।
পশু-পাখী ঝুরে,
পাষাণ বিদরে,
শুনি যাঁর গুণ-গাঁথা৷৷
সংসারে মজিয়া,
রহিলে পড়িয়া,
সে পদে নহিল আশ।
আপন করম,
ভুঞায়ে শমন,
কহয়ে লোচন দাস।।
নিতাই গুণমণি আমার নিতাই গুণমণি।
আনিয়া প্রেমের বন্যা ভাসাইল অবনী।।
প্রেমের বন্যা লৈঞা নিতাই আইলা গৌড়দেশ।
ডুবিল ভকতগণ দীন-হীন ভাসে।।
দীন হীন পতিত পামর নাহি বাছে।
ব্রহ্মার দুর্লভ প্রেম সবাকারে যাচে।।
আবদ্ধ করুণাসিন্ধু নিতাই কাটিয়া মুহান।
ঘরে ঘরে বুলে প্রেম অমিয়ার বান।।
লোচন বলে মোর নিতাই যেবা না ভজিল।
জানিয়া শুনিয়া সেই আত্মঘাতী হল।।
শ্রীরাধাগোবিন্দের লীলা-বিষয়ক বর্ণনাও শ্রীলোচন দাস ঠাকুর অতি সুন্দরভাবে করেছেন –
আরে নিকুঞ্জ বনে, শ্যামের সনে, কিরূপ দেখিলু রাঁই।
কেমন বিধাতা, গড়ল মুরতি, লখই নাহিক যাই।।
সজল জলদ, কানুর বরণ, চম্প বরণী রাই।
মণি মরকত, কাঞ্চনে জড়িত, ঐছন রহল ঠাই।।
কিয়ে অপরূপ, রাস মণ্ডল, রমণী মণ্ডল ঘটা।
মনমথ মন, পাইল অচেতন, দেখিয়া ও অঙ্গ ছটা।।
বদনে মধুর, হাস অধরে, হৃদয়ে হৃদয়ে সঙ্গ।
কোন রসবতী, রসের আবেশে, কুসুম শয়নে অঙ্গ।।
নবীন মেঘের, নিবিড় আভা, তাহে বিজুরি উজোই।
দাস লোচনের, রাই সরবস ও-রস আবেশে সোই।।
বিশ্বকোষ মতে শ্রীলোচন দাস ঠাকুরের জন্ম শকাব্দ ১৪৪৫, তিরোভাব–শকাব্দ ১৫৩০।তাঁর শ্রীচৈতন্য মঙ্গল ছাড়াও ‘দুর্লভসার’ নামক একখানি গ্ৰন্থ আছে।