Bisnupriya Devi Appearance Day
‘শ্রী’, ‘ভূ’, ‘নীলা’ নামে ভগবানের তিনটি শক্তি আছে; শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া হলেন ‘ভূ’শক্তি-স্বরূপিণী। তিনি ‘সত্যভামা’ বলেও কথিত হন। শ্রীগৌর অবতারে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণী শ্রীনাম প্রচারের সহায়রূপে অবতীর্ণ। হয়েছিলেন।
শ্রীনবদ্বীপ ধামে সনাতন মিশ্র নামে এক পরম বিষ্ণু-ভক্ত ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তিনি বহু লোকের ভরণ-পোষণ করতেন। রাজ-পণ্ডিতবলে সৰ্ব্বত্র তাঁর খ্যাতি ছিল। ইনি দ্বাপরে সত্রাজিত রাজা ছিলেন। বিপ্রশ্রেষ্ঠ সনাতন মিশ্র বিষ্ণু আরাধনার ফলে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া নামে সদগুণ সম্পন্না এক পরমা সুন্দরী কন্যারত্ন লাভ করেন। অতি শিশুকাল থেকে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া দিনে দুই তিন বার গঙ্গাস্নান করতেন এবং বড়দের অনুকরণ করে যাবতীয় পূজা, অর্চ্চনা, তুলসী সেবা, ব্রত প্রভৃতি করতেন। গঙ্গাঘাটে যখন শ্রীশচীমাতাকে দেখতেন অতি নম্রভাবে তাঁকে নমস্কার করতেন। শচীমাতাও ‘যোগ্য পতি হউক’ বলে আশীর্ব্বাদ করতেন। শচীমাতা মনে মনে বিষ্ণুপ্রিয়াকে পুত্রবধুরূপে কামনা করতেন।
এদিকে শ্রীগৌরসুন্দরের লক্ষ্মীপ্রিয়া নাম্নী প্রথমা পত্নী পরলোক গমন করেন। মা শচীর হৃদয়ে বড় দুঃখ হল। কিছুদিন কেটে গেল। পূনঃর্বার পুত্রের বিবাহ দিবার জন্য মা শচীদেবী বড় উদ্গ্রীব হলেন। আত্মীয়-স্বজনগণ ও শীঘ্র একার্য সম্পন্ন করতে বললেন। গৌরসুন্দর জননীর মতের বিরোধিতা করলেন
না। বিবাহ করতে সম্মত হলেন। শচীমাতা এক ভৃত্যকে ঘটক কাশীনাথ পণ্ডিতের বাড়ী পাঠালেন। মা শচীর আহ্বান পাওয়া মাত্র পণ্ডিত তাঁর গৃহে এলেন শচীমাতা গৌরসুন্দরের বিবাহের কথা উত্থাপন করলেন। কাশীনাথ পণ্ডিত বললেন ইহা উত্তম প্রস্তাব, এ কাৰ্য্য শীঘ্র হউক। পাত্রীর কথা উত্থাপন করে শচীমাতা সনাতন মিশ্রের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার নাম বললেন। ঘটক সহাস্য বদনে বললে –“ঠাকুরাণী! আমিও ঐ কন্যার নাম উল্লেখ করব ভাবছিলাম।” শচীমাতা বললেন— “আমি ত গরীব, সনাতন মিশ্র আমার ঘরে কন্যা দিবে কি? আপনি এ-বিষয় নিয়ে শীঘ্র আলাপ করুন। কাশীনাথ পণ্ডিত বললেন— “ঠাকুরাণী, আপনার নিমাইয়ের ন্যায় এত সুন্দর পুত্রকে সনাতন যদি কন্যা না দেয়, কাকে দিবে?” এ কথা বলে পণ্ডিত সনাতন মিশ্রের গৃহ অভিমুখে চললেন।
কন্যার বয়স দেখে সনাতন মিশ্রও একটি উপযুক্ত পাত্র অনুসন্ধান করছিলেন। নদীয়াতে উত্তম পাত্র বলতে একমাত্র নিমাই পণ্ডিত। রূপে-গুণে অতুলনীয়, বয়সও কম। এমন পাত্রকে কন্যা দেওয়া বড় ভাগ্যের কথা। এসব কথা কাকে বলতেও সনাতনের লজ্জা বোধ হচ্ছিল। মনে মনে শুধু ভগবানের কাছে জানাতেন, হে হরি! পূর্ব্ব জন্মে যদি সুকৃতি করে থাকি আমার কন্যার জন্য যেন নিমাই পণ্ডিতকে বররূপে পাই।
ঐ দিন ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী বসে কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে আলাপ করছেন, ঠিক এমন সময় ঘটক কাশীনাথ পণ্ডিত উপস্থিত হলেন। সনাতন মিশ্র ব্যস্তসমস্ত হয়ে পণ্ডিতকে স্বাগত জানিয়ে বসতে আসন দিলেন। মিষ্ট জলাদি দিয়া সৎকার করলেন। সনাতন মিশ্র ভাবলেন উত্তম পাত্রের সংবাদ নিশ্চয় এসেছে। মিশ্র জিজ্ঞাসা করলেন— “পণ্ডিত! খবর কি?” পণ্ডিত হাস্য করতে করতে বললেন—
“বিশ্বম্ভর-পণ্ডিতের তোমার দুহিতা। দান কর’-এ সম্বন্ধ উচিত সৰ্ব্বথা।। তোমার কন্যার যোগ্য সেই দিব্য পতি। তাহার উচিত এই কন্যা মহা-সতী।। যেন কৃষ্ণ রুক্মিণীতে অন্যোহন্য-উচিত। সেইমত বিষ্ণুপ্রিয়া-নিমাঞি পণ্ডিত।।” —(শ্রীচৈঃ ভাঃ আদি ১৫।৫৭-৫৯)
ঘটক কাশীনাথের এই প্রস্তাব শুনে সনাতন মিশ্র ও তাঁহার পত্নী আনন্দে আত্মহারা হলেন। অন্তর্যামী ভগবান ভাবনানুরূপ ফল মিলিয়ে দিয়েছেন। সনাতন মিশ্র বললেন—“কাশীনাথ, এ বিষয়ে আর কি বল? যদি আমার গোষ্ঠীর সৌভাগ্য থাকে এ হেন জামাতা পাব।” অন্যান্য স্বজনগণ বলতে লাগলেন –“সৌভাগ্য ছাড়া এরকম ছেলে পাওয়া যায় না। তোমার কন্যার ভাগ্যে থাকলে উত্তম বর পাবেই।” তারপর কাশীনাথ পণ্ডিতের সঙ্গে আবশ্যকীয় অন্যান্য বিষয় মিশ্র মহোদয় আলোচনা করলেন। এরূপে কাশীনাথ পণ্ডিত সব ঠিক করে শচীমাতার ঘরে ফিরে এলেন এবং তাঁকে সব কথা জানালেন। শচী বললেন- “আমার তো আর কেউ নাই, একমাত্র হরিই আছেন।”
শ্রীনিমাই পণ্ডিতের বিবাহ হবে শুনে সকলে বড় আনন্দিত হলেন। শিষ্যগণ বলতে লাগলেন— “পণ্ডিতের বিবাহে আমরা যথাসাধ্য কিছু কিছু দান করব।” ধনাঢ্য বুদ্ধিমত্ত খান বললেন –“সমস্ত খরচ আমি বহন করব।” মিত্র মুকুন্দ-সঞ্জয় বললেন – “ভাই, খরচের ভার কিছুটা আমাদের উপরও দাও। এ বিবাহের আয়োজন এমন করতে হবে যাহা কোন রাজকুমারের বিবাহেও হয় নাই।”
সমস্ত সাড়া পড়ে গেল। নিমাই পণ্ডিতের বিবাহ। বিবাহের
আয়োজন হতে লাগল। বিবাহ মণ্ডপের উপর বড় বড় চন্দ্রাতপ খাটান হল। ভূমিতে আলিপনা দেওয়া হল এবং স্থানটি কদলীবৃক্ষ, পূর্ণঘট, আম্রসার, দীপ, ধান্য, দধি প্রভৃতি মাঙ্গলিক দ্রব্যাদি দ্বারা সজ্জিত করা হল। নবদ্বীপে তখন যত বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ সজ্জন বাস করতেন সকলে অধিবাস উৎসবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হলেন। সন্ধ্যায় অধিবাসের সময় বাদ্যকরগণ আনন্দে নানাবিধ বাদ্য বাজাতে লাগল। শচীর অঙ্গন ক্রমে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবে পূর্ণ হতে লাগল। ভগবদ্-পূজা, আরাত্রিক, ভোগরাগ মহা সমারোহের সহিত হল এবং গৌরসুন্দরের অধিবাস-ক্রিয়া সুসম্পন্ন হল। অন্দর মহলে নারীগণ আনন্দভরে ঘন ঘন উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি করছিলেন। বৈষ্ণবগণ হরিধ্বনি করতে লাগলেন। ঈশ্বরের বিবাহ, চতুর্দিকে সুখসিন্ধু যেন উথলে উঠল। অধিবাসে মিষ্টি পান ও সুপারির আয়োজন করা হয়েছিল। যে যত চায়, পানের বিটীকা দেওয়া হচ্ছিল। যত ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব এসেছিলেন তাঁদের গলায় গৌরসুন্দর চন্দন ও সুগন্ধ ফুলের মালা পরিয়ে প্রফুল্ল মনে সকলে শুভাশীষ অর্পণ করলেন। এমন সুন্দর সুখময় বিবাহ-অধিবাস কেহ কখনও দেখেনি। নদীয়া-পুরী সুখসিন্ধু মাঝে ভাসতে লাগল।
পরদিন বিবাহ উৎসবের বিপুল আয়োজন হল। অপরাহ্নে গৌরসুন্দর বরোচিত পোষাক-পরিচ্ছদ পরে জননী এবং গুরুজনের চরণ বন্দনা করে এক সুসজ্জিত দোলায় আরোহন করলেন। প্রথমে গঙ্গাতটে এলেন, শ্রীগৌরসুন্দর দোলা থেকে নেমে গঙ্গাদেবীকে নমস্কার করে আবার দোলায় আরোহণ করলেন। ‘জয় জয়’ মঙ্গল ধ্বনি ও বিবিধ বাদ্যধ্বনির দ্বারা চতুর্দিক মুখরিত করে গঙ্গাতট দিয়ে বরযাত্রা আরম্ভ হল। সহস্র সহস্ৰ দীপ জ্বলছিল, নানা রকম বাজী পোড়ান হচ্ছিল, নৃত্যগীত হচ্ছিল। গোধূলি লগ্নে বর ও বরযাত্রীরা শ্রীসনাতন মিশ্রের গৃহে প্রবেশ করলেন। শ্রীসনাতন মিশ্র ও তাঁর পত্নী জামাতাকে বরণ ও আশীর্ব্বাদ করলেন।
অতঃপর বিষ্ণুপ্রিয়াকে নানা আভরণে ভূষিত করে বিবাহ স্থানে আনয়ন করা হল। মহালক্ষ্মী বিষ্ণুপ্রিয়া স্বীয় নিত্যকান্ত গৌর-নারায়ণকে সপ্তবার প্রদক্ষিণ করে তাঁর শ্রীচরণে আত্মনিবেদন করলেন। শ্রীগৌরসুন্দর নিত্য প্রিয়াকে বাম অঙ্গে স্থাপন করলেন। অনন্তর পরস্পরের গলায় পুষ্পমাল্য প্রদান করলেন।
আগে লক্ষ্মী জগন্মাতা প্রভুর চরণে। মালা দিয়া করিলেন আত্মসমর্পণে।। তবে গৌরচন্দ্র প্রভু ঈষৎ হাসিয়া। লক্ষ্মীর গলায় মালা দিলেন তুলিয়া।। তবে লক্ষ্মী নারায়ণে পুষ্প ফেলাফেলি। করিতে লাগিলা হই মহা কুতূহলী।। —(শ্ৰীচৈঃ ভাঃ আদি ১৫।১৭৬-১৭৮)
শ্রীসনাতন মিশ্র শ্রীগৌরসুন্দরকে বহু যৌতুকের সহিত কন্যা সম্প্রদান করলেন। তিনি গৌর-নারায়ণকে কন্যাদান করে কৃত-কৃত্য হলেন। জনক রাজা যেমন রামচন্দ্রকে সীতা সম্প্রদান করেছিলেন, ভীষ্মক রাজা যেমন কৃষ্ণকে রুক্মিণী সম্প্রদান করেছিলেন, সনাতন মিশ্রও সেরূপ গৌরসুন্দরকে বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদান করলেন। বিবাহের পর শুভ রাত্রিতে বাসর-গৃহে শ্রীলক্ষ্মী নারায়ণ পুষ্পশয্যায় অবস্থান করিলেন। শ্রীসনাতন মিশ্রের গৃহে বৈকুণ্ঠানন্দ অবতরণ করল।
প্রায় সমস্ত রাত্রি সনাতন মিশ্রের গৃহ নৃত্য-গীত ও বাদ্য-ধ্বনিতে মুখরিত হল। প্রাতে গৌরসুন্দর পত্নী লক্ষ্মীসহ শয্যা ত্যাগ করলেন। হস্ত-মুখ প্রক্ষালন করবার পর নিত্য কৃত্য জপাদি সমাপ্ত করলেন। সনাতন মিশ্র মহোৎসবের আয়োজন করেছিলেন। তাঁর স্বজনবর্গ গৌর নারায়ণকে দর্শন করে কৃতার্থ হলেন।
সনাতন পণ্ডিতের গোষ্ঠীর সহিতে। যে সুখ হইল তাহা কে পারে কহিতে।।
— (শ্রীচৈঃ ভাঃ আদি ১৫।১৯৪)
অপরাহ্নে শ্রীগৌরসুন্দর নব বধূকে নিয়ে নৃত্য-গীত-বাদ্যসহ স্বীয় গৃহাভিমুখে যাত্রা করলেন। নগর পরিক্রমা করে গঙ্গাতট দিয়ে যখন বরযাত্রীরা চলছিলেন তখন নগরবাসীগণ শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ও গৌরসুন্দরের অপূর্ব্ব নয়নাভিরাম দিব্য রূপ দর্শন করে আনন্দভরে বলাবলি করতে লাগলেন—
এই ভাগ্যবতী।
কত জন্ম সেবিলেন কমলা পাৰ্ব্বতী ।।
কেহ বলে,—“এই হেন বুঝি হরগৌরী।”
কেহ বলে,—“হেন বুঝি কমলা-শ্রীহরি।।” কেহ বলে,—“এই দুই কামদেব রতি।”
কেহ বলে,—“ইন্দ্ৰ শচী লয় মোর মতি।।”
কেহ বলে,—“হেন বুঝি রামচন্দ্র-সীতা।”
এই মত বলে যত সুকৃতি-বনিতা।।
—(শ্ৰীচৈঃ ভাঃ আদি ১৫।২০৫-২০৮)
শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ও শ্রীগৌরসুন্দরের শুভ দৃষ্টিপাতে সমস্ত নবদ্বীপ সুখময় হয়ে উঠল। নৃত্য-গীত-বাদ্য ও পুষ্পবৃষ্টিসহ পরম আনন্দ কোলাহলের মধ্যে সর্গ শুভক্ষণে শ্রীগৌরসুন্দর শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে গৃহে প্রবেশ করলেন। শচীমাতা অন্যান্য কুলবধূসহ প্রসন্ন বদনে পুত্রবধূকে বরণ করলেন। নবদম্পতি দোলা থেকে অবতরণ করে প্রথমে শ্রীশচীর শ্রীচরণ কদনা করলেন। স্নেহভরে সকলে বর-বধূর চিবুক ঘ্রাণ ও আশীর্ব্বাদ করলেন এবং বিবিধ যৌতুক প্রদান করলেন।
গৃহে আসি বসিলেন লক্ষ্মী-নারায়ণ। জয়ধ্বনিময় হইল সকল ভুবন।। কি আনন্দ হইল সে অকথ্য কথন। সে মহিমা কোন জনে করিবে বর্ণন।।
তারপর বৃন্দাবন দাস ঠাকুর মহাশয় ভগবানের বিবাহ দর্শনের মহিমা
বর্ণন করেছেন।
যাঁহার মূর্ত্তির বিভা দেখিলে নয়নে।
পাপমুক্ত হই যায় বৈকুণ্ঠ ভুবনে।। সে প্রভুর বিভা লোক দেখয়ে সাক্ষাৎ। তেঞি তান নাম ‘দয়াময়’ দীননাথ।। —(শ্ৰীচৈঃ ভাঃ আদি ১৫।২১৬-২১৭)
ভগবানের এই দিব্য লীলা বহু সাধন করেও যোগিগণ পর্য্যন্ত দর্শন করতে পারেন না। কিন্তু সে লীলা নবদ্বীপবাসী আপামর জনসাধারণ দেখতে পেল। দয়াময় ভগবানের অশেষ কৃপা- তাই তাঁর এক নাম দীননাথ।
বিবাহে যত নট, ভাট, ভিক্ষুক এসেছিল শ্রীগৌরসুন্দর তাদের অর্থ ও
বস্ত্র দিয়ে তুষ্ট করলেন। ব্রাহ্মণ ও আত্মীয় স্বজনকে মূল্যবান্ বস্ত্র দান করলেন।
বুদ্ধিমন্ত খানকে প্রেমে আলিঙ্গন করলেন। তিনিই বিবাহের সমস্ত ব্যয়ভার
বহন করেছিলেন।
শ্রীমদ্ বৃন্দাবন দাস বিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণীর আর বিশেষ বর্ণনা দেন নাই। কোন প্রসঙ্গে কদাচিৎ নাম উল্লেখমাত্র করেছেন। গয়াধাম হতে গৃহে এলে—
“লক্ষ্মীর জনক কুলে আনন্দ উঠিল। পতি-মুখ দেখিয়া লক্ষ্মীর দুঃখ দূরে গেল।।”
—(শ্ৰীচৈঃ ভাঃ মঃ ১।১৯)
মহাপ্রভু গয়াধাম থেকে গৃহে ফিরে এলেন এবং অনন্তর কৃষ্ণ প্রেম প্রকাশ করতে লাগলেন প্রভুর দিব্যভাব-সকল দেখে শচী মাতা ভাবতেন পুত্রের কোন কঠিন রোগ হয়েছে না কি? পুত্রের মঙ্গল কামনায় গঙ্গা-বিষ্ণুর পূজা দিতেন এবং –
“লক্ষ্মীরে আনিয়া পুত্র সমীপে বসায়। দৃষ্টিপাত করিয়াও প্রভু নাহি চায়।।”
—(শ্ৰীচৈ ভাঃ মধ্যঃ ১।১৩৭)
প্রভু বিষ্ণুপ্রিয়াকে দেখেও দেখেন না। “কৃষ্ণ”—কৃষ্ণ” বলে নিয়ত রোদন করেন। শ্রীকৃষ্ণের প্রসাদী-অন্নের থালা পুত্রের সম্মুখে দিয়ে শচীমাতা তথায় বসলেন। “ঘরের ভিতর দেখে লক্ষ্মী পতিব্রতা।”-(শ্ৰীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ১।১৯১)—বিষ্ণুপ্রিয়া গৃহের ভিতর থেকে সব দেখতে লাগলেন। প্রভু সব সময় কৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হয়ে থাকেন। কোনদিন পাযগণের অত্যাচারের কথা শুনে ‘আমি সংহার করব, সংহার করব’ বলে হুঙ্কার দেন। শচীমাতা কিছুই বুঝতে পারেন না। বিষ্ণুপ্রিয়াকে প্রভুর কাছে গিয়ে বসতে বলেন। “লক্ষ্মীরে দেখিয়া ক্ষণে মারিবারে যায়।।” (শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ২৮৭) বাহ্যদশা শূন্য প্রভু বিষ্ণুপ্রিয়াকেই প্রহার করবার জন্য উদ্যত হন। পুনঃ বাহাদশা ফিরে এলে লজ্জিত হন। একদিন শচীমাতা ও গৌরসুন্দর গৃহমধ্যে বসে আলাপ করছিলেন। কপাটের আড়ালে বসে বিষ্ণুপ্রিয়া শুনছিলেন। শচীমাতা বললেন— “আজ রাত্রি শেষে স্বপ্ন দেখেছি আমাদের ঘরে যে রাম ও কৃষ্ণ মূর্ত্তি আছেন, তাঁদের সঙ্গে তুমি ও নিত্যানন্দ খেলছ। তাঁদের সঙ্গে খেতে খেতে মারামারি করছ। এরূপ আরও কত রঙ্গ করছ।” গৌরসুন্দর বললেন— “বড় ভাল স্বপ্ন, মা! কাকেও বল না। আমাদের গৃহে সাক্ষাৎ রাম-কৃষ্ণ বিরাজ করছেন। অনেকদিন দেখি পূজার নৈবেদ্য কে খেয়ে যায়। আমার সন্দেহ হত তোমার পুত্রবধূ খায়। কিন্তু আজ আমার সে সন্দেহ ঘুচল।”
“তোমার বধূরে মোর সন্দেহ আছিল। আজি সে আমার মনে সন্দেহ ঘুচিল।।”
শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ৮।৪৯)
শচীমাতা বললেন, “বাবা, তামন কথা বলতে নাই।” স্বামীর নর্মালাপ শুনে বিষ্ণুপ্রিয়া হাসতে লাগলেন।
“একদিন নিজ গৃহে প্রভু বিশ্বম্ভর।
বসি আছে লক্ষ্মী সঙ্গে পরম সুন্দর।। যোগায় তাম্বুল লক্ষ্মী পরম হরিষে। প্রভুর আনন্দে না জানয়ে রাত্রি দিশে।। যখন থাকয়ে লক্ষ্মী সনে বিশ্বম্ভর। শচীর চিত্তেতে হয় আনন্দ বিস্তর।।” —(শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ১১।৬৫-৬৭)
শ্রীমদ্ বৃন্দাবন দাস ঠাকুর বিষ্ণুপ্রিয়া সহ গৌরসুন্দরের মধুর বিহারের কথা বর্ণনা করেছেন। এ হচ্ছে গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়ার নিত্য বিলাস। ভগবান্ গৌর নারায়ণ রূপে লক্ষ্মীসহ নবদ্বীপে নিত্যবিহার করছেন। বিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণী মহাপ্রভুকে তাম্বুল দিচ্ছেন। বিষ্ণুপ্রিয়া-প্রদত্ত তাম্বুল চর্বণ করতে করতে মহাপ্রভু আনন্দ প্রকট করছেন। মহাপ্রভুর আনন্দ দর্শনে বিষ্ণুপ্রিয়ারও আনন্দে দিবানিশি জ্ঞান নাই। ‘যোগায় তাম্বুল লক্ষ্মী’—এ হচ্ছে গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়ার নিত্য উপাসক ভক্তের ধ্যানের বিষয়।
জননীবৎসল প্রভু জননীকে সুখী করার জন্য বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে বসে
থাকতেন।
মায়ের চিত্তের সুখ ঠাকুর জানিয়া। লক্ষ্মীর সঙ্গেতে প্রভু থাকেন বসিয়া।।
(শ্ৰীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ১১/৬৮)
চন্দ্রশেখর-ভবনে যখন মহাপ্রভু রুক্মিণী ভাবে নৃত্যাভিনয় করেছিলেন। বিষ্ণুপ্রিয়া ও শচীমাতার সঙ্গে সে অভিনয় দর্শন করতে গিয়েছিলেন– “আই চলিলেন নিজ বধূ সহিতে।।” (শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ১৮।২৯)
এরপরে গৌরসুন্দর যে সন্ন্যাস-শীলা করেছেন তা বর্ণনা করতে বৃন্দাবন দাস ঠাকুর কোন স্থানে বিষ্ণুপ্রিয়ার নাম উল্লেখ করেন নাই। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী আদি পঞ্চদশ অধ্যায়ে কেবল বিবাহ-লীলা বর্ণন করেছেন।
যেদিন মহাপ্রভু সন্ন্যাসে গিয়েছিলেন সেদিন রাত্রে বিষ্ণুপ্রিয়াকে যে তত্ত্বোপদেশ দিয়েছিলেন তার এরূপ বর্ণনা শ্রীলোচন দাস ঠাকুরের শ্রীচৈতন্য মঙ্গলে আছে
জগতে যতেক দেখ
মিছা করি সব লেখ
সত্য এক সবে ভগবান।
তা বিনে যতেক সব
সত্য আর বৈষ্ণব মিছা করি করহ গেয়ান।।
—(চৈঃ মঃ মধ্যঃ)
“পুত্র, পতি, সখা, স্বজন-সম্বন্ধ সব মিথ্যা। পরিণামে কেহ কারও নয়। শ্রীকৃষ্ণের চরণ ছাড়া আমাদের অন্য গতি নাই। কৃষ্ণ সকলের পতি, আর সব কিছু শক্তি—এ কথা কেহ বুঝে না। তোমার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া, তুমি বিষ্ণু ভজন করে তোমার নাম সার্থক কর। মিথ্যা শোক কর না, আমি তোমায় এই যথার্থ কথা বলে যাচ্ছি। তুমি কৃষ্ণ চরণে মনোনিবেশ কর।”
বিষ্ণুপ্রিয়া বললেন—“তুমি ঈশ্বর, তুমি নিজ মায়া দূর কর। তাহলে বিষ্ণুপ্রিয়া প্রসন্ন হবে।” বিষ্ণুপ্রিয়ার দুঃখ শোক দুর হল। আনন্দে হৃদয় ভরে উঠল। “চতুর্ভুজ দেখে আচম্বিত”— এমন সময় বিষ্ণুপ্রিয়া মহাপ্রভুর চতুর্ভুজ -মূর্ত্তি দর্শন করলেন। কিন্তু তাঁর পতি-বুদ্ধি গেল না, অতঃপর বিষ্ণুপ্রিয়া
মহাপ্রভুর চরণ তলে প্রণত হয়ে বললেন—”এক নিবেদন শুন প্রভু। মো অতি অধম ছার, জলমিল ও সংসার, তুমি মোর প্রিয় প্রাণ পতি। এ হেন সম্পদ মোর, দাসী হৈয়াছিলু তোর, কি লাগিয়া ভেল অধোগতি।।”
তখন শ্রীগৌরসুন্দর নিত্য প্রিয়া বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলতে লাগলেন
শুন দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া
এ তোর কহিল হিয়া
যখনে যে তুমি মনে কর।
আমি যথা তথা যাই
আছিয়ে তোমার ঠাই
সত্য সত্য কহিলাম দৃঢ়।
অনন্তর শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া বললেন
কৃষ্ণ আজ্ঞা বাণী শুনি
বিষ্ণুপ্রিয়া মনে গুণি
স্বতন্ত্র ঈশ্বর তুমি প্রভু।
নিজ সুখে কর কাজ
কে দিবে তাহাতে বাধ
প্রত্যুত্তর না দিলেক তবু ।।
—(চৈঃ মঃ মধ্যঃ)
অতঃপর রাত্রিকালে নিদ্রিত বিষ্ণুপ্রিয়াকে ত্যাগ করে মহাপ্রভু জননী শচীদেবীর দ্বারে এসে তাঁকে বন্দনা করলেন। কিছু ঐশ্বর্য্য প্রকট পূর্ব্বক কথোপকথনে শচীমাতাকে মোহিত করে সাঁতার দিয়ে গঙ্গা পার হয়ে কাটোয়ার দিকে যাত্রা করলেন।
নিশান্তে বিষ্ণুপ্রিয়া ও শচীমাতা জেগে উঠে কি করলেন তার বিশদ
বিবরণ দিয়েছেন বাসু ঘোষ ঠাকুর। নিশাস্তে নিদ্রাভঙ্গ হলে বিষ্ণুপ্রিয়া খাটের উপর মহাপ্রভু শয়ন করে আছেন মনে করে হাত দিয়ে দেখলেন খাট শূন্য পড়ে আছে, প্রভু নাই। “শূন্য খাটে দিল হাত, বজ্র পড়িল মাথাত, বুঝি বিধি মোরে বিড়ম্বিল। করুণা করিয়া কান্দে, কেশ বেশ নাহি বান্ধে, শচীর মন্দির কাছে গেল।।”
মহাপ্রভুর বিয়োগে অসহ্য বেদনায় বিষ্ণুপ্রিয়া যে করুণ ক্রন্দন করেছিলেন তার কিছু বর্ণনা শ্রীলোচনদাস চৈতন্য মঙ্গলে দিয়েছেন—
বিষ্ণুপ্রিয়া কান্দনেতে পৃথিবী বিদরে। পশু পক্ষী লতা তরু এ পাষাণ ঝুরে।।
পাপিষ্ঠ শরীর মোর প্রাণ নাহি যায়।
ভূমিতে লোটাঞা দেবী করে হায় হায়।। বিরহ অনল শ্বাস বহে অনিবার। অধর শুকায়–কম্প হয় কলেবর।।
–(চৈঃ মঃ মধ্যঃ) মহাপ্রভুর গৃহত্যাগের পর শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া দেবী কিভাবে দিনযাপন ও নিত্যকৃত্যাদি করতেন ভক্তি রত্নাকরে শ্রীঘনশ্যাম চক্রবর্তী তার অপূর্ব্ব বর্ণনা দিয়েছেন—
প্রভুর বিচ্ছেদে নিদ্রা ত্যজিল নেত্রেতে। কদাচিৎ নিদ্রা হইলে শয়ন ভূমিতে।। কনক জিনিয়া অঙ্গ সে অতি মলিন। কৃষ্ণ চতুৰ্দ্দশীর শশীর প্রায় ক্ষীণ।। হরিনাম সংখ্যা পূর্ণ তণ্ডুলে করয়। সে তণ্ডুল পাক করি প্রভুরে অপয়।। তাহারই কিঞ্চিন্মাত্র করয়ে ভক্ষণ।।
কেহ না জানয়ে কেনে রাখয়ে জীবন।।
–(ভঃরঃ ৪।৪৮-৫১)
শ্রীমুরারি গুপ্তের কড়চায় আছে শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণী সর্বপ্রথম শ্রীগৌরমূর্তি প্রকাশ ও পূজা করেন।
প্রকাশরূপেণ নিজপ্রিয়ায়াঃ
সমীপমাসাদ্য নিজাংহি মূৰ্ত্তিম। সা লক্ষ্মীরূপা চ নিষেবতে প্রভৃম্।।
বিধায় তস্যাৎ স্থিত এবঃ কৃষ্ণঃ
—–(৪র্থ খ্রঃ: ১৪শ সঃ ৮ম শ্লোক)
‘প্রকাশরূপেণ নিজাং হি মূৰ্ত্তিম বিধায়’—নিজেই নিজের প্রকাশরূপী মূর্ত্তি নির্ম্মাণ করিয়ে “সমীপমাসাদ্য নিজপ্রিয়ায়াঃ — নিজপ্রিয়া লক্ষ্মী বিষ্ণুপ্রিয়ার সমীপে অবস্থান কালে (তাঁকে বলেছিলেন) ‘স্থিত এযঃ কৃষ্ণঃ– ইহাতে কৃষ্ণ অবস্থান করেন। “সা লক্ষ্মীরূপা চ নিষেতে প্রভুম্’ (মহাপ্রভুর এ বাক্য অনুসারে) লক্ষ্মীরূপা বিষ্ণুপ্রিয়া মহাপ্রভুর সে মূর্তিটির সেবা করতে থাকেন।
মহাপ্রভু গৃহত্যাগ করে যাবার পর ভৃত্য ঈশান ঠাকুর তাঁদের দেখাশুনা করতেন। শ্রীবংশীবদন ঠাকুর শচীমাতা ও বিষ্ণুপ্রিয়ার সন্নিধানে সর্ব্বদা অবস্থান করতেন। তিনি শ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরাণীর কৃপাভাজন হয়েছিলেন। পদকর্তা বংশীবদন একটি গৌর-বিরহ গীত লিখেছেন
“আর না হেরিব ও চাঁদ কপালে নয়ন খণ্ডর নাচ” –
ইত্যাদি— (পদকল্পতরু)
শ্রীনিবাস আচার্য্য যখন মায়াপুরে এসেছিলেন বৃদ্ধ ঈশান ঠাকুর ও বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। বংশীবদন ঠাকুর তাঁকে বহু কৃপা করেছিলেন।
শ্রীবিষ্ণু ঠাকুরাণী সাক্ষাৎ ভূ-শক্তি-স্বরূপিণী। তাঁর শ্রীচরণ কৃপা প্রার্থনা পূর্ব্বক এ প্রবন্ধ শেষ করছি। (সাপ্তাহিক গৌড়ীয় ২০শ খণ্ড ২৬।২৭ সংখ্যা)