Chandan Yatra
শ্রীজগন্নাথ শ্রীইন্দ্রদ্যুম্নকে (উৎকলখণ্ড, ২৯শ অ) বলিয়াছিলেন,—
“বৈশাখস্য সিতে পক্ষে তৃতীয়াক্ষয়সংজ্ঞিকা।
তত্র মাং লেপয়েদ্গন্ধলেপনৈরতিশোভনম্ ৷৷
অর্থাৎ বৈশাখমাসের শুক্লপক্ষে অক্ষয়তৃতীয়া-নাম্নী তিথিতে সুগন্ধি চন্দনদ্বারা আমার অঙ্গ লেপন করিবে।
শ্রীবিষ্ণুধর্মোত্তরে লিখিত আছে— অনুলেপনমুখ্যন্তু চন্দনং পরিকীর্তিতম্।
অর্থাৎ অনুলেপন দ্রব্যসমূহের মধ্যে চন্দনই শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিকীর্তিত।
শ্রীনারদপুরাণে লিখিত আছে–
যথা বিষ্ণোঃ সদাভিষ্টং নৈবেদ্যৎ শালিসম্ভবম্।
শুকেনোক্তং পুরাণে চ তথা তুলসীচন্দনম্ ॥
পুরাণসমূহে ও শ্রীশুকদেব-কর্তৃক উক্ত হইয়াছে যে, যেরূপ শালিধান্যোৎপন্ন অন্ন শ্রীহরির প্রীতিকর, তুলসী-চন্দনও সেইরূপ প্রীতিকর।
শ্রীপুরুষোত্তমদেব তৎ-সেবক বৈষ্ণবরাজ শ্রীইন্দ্রদ্যুম্নদেবকে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের অক্ষয়-তৃতীয়া-নাম্নী তিথিতে নিজ শ্রীঅঙ্গে সুগন্ধি চন্দনলেপনের আজ্ঞা প্রদান করিয়াছিলেন; আজও তদনুসারে অক্ষয়-তৃতীয়া হইতে আরম্ভ করিয়া জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লা অষ্টমী তিথি পর্যন্ত প্রত্যহ শ্রীজগন্নাথদেবের বিজয়-বিগ্রহস্বরূপ শ্রীমদনমোহনদেবকে শ্রীমন্দির হইতে বিমানে আরোহণ করাইয়া শ্রীনরেন্দ্রসরোবরকূলে আনয়ন করা হয়। শ্রীমদনমোহনদেব স্বীয় মন্ত্রী শ্রীলোকনাথ-মহাদেবাদির সহিত সরোবরে নৌকাবিলাস করেন। শ্রীমদনমোহনের শ্রীচন্দনযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় বলিয়া শ্রীনরেন্দ্রসরোবরকে ‘চন্দন-পুকুর’ও বলা হয়।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে’ শ্রীল কবিরাজ গোস্বামিপাদ লিখিয়াছেন,—
এইমতে বৈষ্ণবসব নীলাচলে আইলা।
দৈবে জগন্নাথের সেদিন জল-লীলা ॥
নরেন্দ্রের জলে ‘গোবিন্দ’ নৌকাতে চড়িয়া।
জলক্রীড়া করে সব ভক্তগণ লঞা ॥
সেইকালে মহাপ্রভু ভক্তগণ-সঙ্গে।
নরেন্দ্রে আইলা দেখিতে জলকেলি রঙ্গে ॥
অক্ষয়-তৃতীয়া হইতে প্রত্যহ অপরাহ্নে শ্রীজগন্নাথদেবের প্রতিনিধি শ্রীমদনমোহন, শ্রীলক্ষ্মী ও সরস্বতীদেবীর’ সহিত বিমানারোহণে শ্রীনরেন্দ্রসরোবর-তীরে গমন করেন। কিংবদন্তী এই যে, তিনশত বৎসর পূর্বে বঙ্গাধিপ প্রতাপাদিত্য উৎকল-জয়ার্থ যাত্রা করিয়া শ্রীজগন্নাথদেবের প্রতিনিধি শ্রীগোবিন্দদেবকে শ্রীপুরুষোত্তম হইতে টাকীর সন্নিকটে রায়পুরে স্থাপন করেন। তদবধি শ্রীচন্দনযাত্রায় শ্রীনরেন্দ্রসরোবরে শ্রীগোবিন্দদেবের পরিবর্তে শ্রীমদনমোহনের বিজয় হইয়া থাকে; আর একটি বিমানে শ্রীশ্রীরাম-কৃষ্ণ, এবং পাঁচটি পৃথক্ বিমানে শ্রীলোকনাথ, শ্রীযমেশ্বর, শ্রীকপালমোচন, শ্রীমার্কণ্ডেয়েশ্বর ও শ্রীনীলকণ্ঠেশ্বর—এই পঞ্চমহাদেবের বিজয়মূর্তি বিজয় করেন। একবিংশ-দিবসব্যাপী এই যাত্রা অনুষ্ঠিত হয় এবং শ্রীজগন্নাথদেবের শ্রীমন্দির হইতে শ্রীনরেন্দ্র সরোবর পর্যন্ত রাজপথের স্থানে স্থানে পত্রপুষ্পফলাদি-শোভিত ছায়ামণ্ডপ নির্মিত হয়। শ্রীমদনমোহন বিমানারোহণে শ্রীনরেন্দ্রসরোবরে গমনকালে সেই সকল ছায়ামণ্ডপে উপনীত হইয়া বিশ্রাম, পঙ্ক্তি-ভোগগ্রহ, নৃত্যগীতাদি দর্শন ও শ্রবণ করেন। এইরূপে ভোগগ্রহণ করিতে করিতে শ্রীনরেন্দ্রসরোবর সমীপে উপনীত হন। শ্রীনরেন্দ্রের বক্ষে একটি সুসজ্জিত নৌকায় শ্রীশ্রীলক্ষ্মী-সরস্বতীর সহিত শ্রীমদনমোহন এবং আর একটি পৃথক্ নৌকায় মন্ত্রী পঞ্চমহাদেবের সহিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ আরোহণ করেন। প্রথমটিতে দেবদাসীগণের নৃত্য ও দ্বিতীয়টিতে ‘নাটুয়া পিলা’র (নৃত্যকারী বালকের) নৃত্য হয়।
সরোবরের মধ্যবর্তী স্থানে যে তিনটি মন্দির আছে, তাহার মধ্যে বৃহত্তমটির মধ্যভাগে একটি কূপ আছে। সেই কুপোদকে শ্রীমদনমোহন, শ্রীলক্ষ্মীদেবী ও শ্রীসরস্বতীকে স্নান করান হয়। দ্বিতীয় মন্দিরে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ও তৃতীয়টিতে পঞ্চমহাদেব বিরাজ করেন। এখানে তাঁহাদের পূজা ও ভোগ হয়। সরোবরের উভয়-তট ও উক্ত মন্দিরসমূহ দীপ-মালায় বিভূষিত করা হয়। উৎসব সম্পন্ন হইলে পূর্ববৎ সাতটি বিমানে আরোহণ করিয়া শ্রীমূর্তিগণ শ্রীমন্দিরে প্রত্যাবর্তন করেন। গন্তব্যস্থানে উপনীত হইতে প্রায় রাত্রি দ্বিপ্রহর হয়। একবিংশ দিবসই এক প্রকার গমনাগমন হইয়া থাকে এবং প্রত্যহ শ্রীশ্রীমদনমোহনকে পৃথক্ পৃথক্ বেশে ভূষিত করা হয়। অক্ষয়-তৃতীয়া তিথিতে ‘নটবর’-বেশ, চতুর্থীতে ‘শ্রীকৃষ্ণজন্ম’-বেশ, পঞ্চমীতে ‘রাজাধিরাজ’-বেশ, ষষ্ঠীতে ‘শ্রীবনবিহারী’-বেশ, সপ্তমীতে ‘বৎসহরণ’-বেশ, অষ্টমীতে ‘গোমতীকৃষ্ণ’-বেশ, নবমীতে ‘খটদোলি’-বেশ, দশমীতে ‘চক্রনারায়ণ’-বেশ, একাদশীতে ‘নৌ-কেলি’-বেশ, দ্বাদশীতে ‘নটবর’-বেশ, ত্রয়োদশীতে ‘শ্রীরাসমণ্ডল’-বেশ, চতুর্দশীতে ‘কন্দর্পরথ’-বেশ, পূর্ণিমাতে ‘অঘাসুরবধ’-বেশ, কৃষ্ণা প্রতিপদে ‘রঘুনাথ’-বেশ, দ্বিতীয়াতে ‘শ্রীচৈতন্য’-বেশ, তৃতীয়াতে ‘গিরিগোবর্ধন’ বেশ, চতুর্থীতে ‘গিরিধারী’ বেশ, পঞ্চমীতে ‘বস্ত্রহরণ’-বেশ, ষষ্ঠীতে ‘চিত্তামণিকৃষ্ণ’-বেশ, সপ্তমীতে ‘গজ উদ্ধারণ’-বেশ হয়; অষ্টমীতে কোন স্বতন্ত্র বেশ হয় না। চন্দনযাত্রার বিংশতিতম দিবসে ‘ভাউরি’ অর্থাৎ নৌকাকে শ্রীবিজয়বিগ্রহগণসহ শ্রীনরেন্দ্রসরোবরের জলে ঘোরানো হয়। একবিংশতিতম দিবসে অর্থাৎ যাত্রার শেষ দিনে নৌকা দুইটিতে হলুদজল ছিটান হইয়া থাকে। চন্দনযাত্রার অন্য নাম ‘গন্ধলেপন-যাত্রা‘।