Nirjala Ekadashi

 
একাদশীতে কী কী করা এবং খাওয়া উচিত নয়
 
একাদশী একটি চান্দ্র তিথি। চাঁদের শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথি, হিন্দু ধর্মমতানুসারে পূণ্যতিথি হিসেবে বিবেচিত। হিন্দুধর্মমতে এ দিন বিধবাদের, বিশেষত উচ্চবর্ণীয় বিধবাদের নিরম্বু উপবাস বিহিত। অবশ্য বর্ণ ও লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কেউ একাদশী পালন করতে পারেন। এই সময় সাধারণত ফলমূল ও বিভিন্ন সবজি এবং দুধ খাওয়া যায়। তবে একাদশীতে পঞ্চরবি শস্য বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।
 
এখন দেখে নেওয়া যাক একাদশীতে কোন পাঁচ প্রকার রবিশস্য গ্রহণ নিষিদ্ধ:
 
১। ধান জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন চাল, মুড়ি, চিড়া, সুজি, পায়েস, খিচুড়ি, চালের পিঠা, খই ইত্যাদি
 
২। গম জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন আটা, ময়দা, সুজি, বেকারির রুটি, সব রকম বিস্কুট, হরলিকস ইত্যাদি।
 
৩। যব বা ভূট্টা জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন ছাতু, খই, রুটি ইত্যাদি।
 
৪। ডাল জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন মুগ, মাসকলাই, খেসারি, মুসুরী, ছোলা, অড়হর, মটরশুঁটি, বরবটি ও সিম ইত্যাদি।
 
৫। সরষের তেল, সয়াবিন তেল, তিল তেল ইত্যাদি। উপরোক্ত পঞ্চ রবিশস্য যে কোনও একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত নষ্ট হয়।)
 
 
অদ্য ভগবান্ শ্রীশ্রীহৃষীকেশদেবের দশ বা ষোড়শ উপচারে পূজা প্রাতঃ স্নানান্তে দ্বাদশ অঙ্গে তিলকধারণ পূর্ব্বক আচমন—ওঁ কেশবায় নমঃ, ওঁ নারায়ণায় নমঃ ও ওঁ মাধবায় নমঃ’ মন্ত্রোচ্চারণ পূর্ব্বক সংকল্প বাক্য বলিয়া প্রার্থনা করবে—“কৃপয়া স্বাগতংকুরু, ওঁ হৃষীকেশায় নমঃ, ইদং আসন ও হৃষীকেশায় নমঃ, ইদং পাদ্যং ওঁ হৃষীকেশায় নমঃ”ইত্যাদি অর্ঘ্য, মধুপর্ক, আচমন, তৈল্য, স্নান, বস্ত্র, উপবীত, তিল, গন্ধ পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য ও মাল্য প্রভৃতি দানে এই মন্ত্র উচ্চারণ করবে।
 
পঞ্চামৃত–দধি, দুগ্ধ ঘৃত, মধু ও শর্করা দ্বারা শালগ্রামকে স্নান করাবে।
 
নৈবেদ্য–সুগন্ধি তণ্ডুলের অন্ন, ডালি-ডালনা, ব্যঞ্জন, পায়স, ক্ষীর, পিঠা পানা, দধি-দুগ্ধ, অপুপ, শস্কুলী প্রভৃতি বিবিধ ফল-মূল অর্পণ করবে। ফুল পদ্ম, জুঁই, কুন্দ ও তৎপরে ফল প্রভৃতি অর্পণ করবে। মহারাজোপচারে পূজা হোমাদি করবে।
 
স্নান মন্ত্র—“সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ”ইত্যাদি।
 
প্রণাম মন্ত্র—“নমো ব্রহ্মাণ্যদেবায়” ইত্যাদি।
 
স্তুতি মন্ত্ৰ—“নমঃ পাপ প্রণাশায় গোবর্দ্ধন ধরায় চ।
পূতনা জীবিতান্তায় তৃণাবর্ত্তাসুরিণে।।
নিস্কলায় বিমোহায় শুদ্ধায়াশুদ্ধ বৈরিণে।
অদ্বিতীয়ায় মহতে শ্রীকৃষ্ণায় নমো নমঃ।।
প্রসীদ পরমানন্দ প্রসীদ পরমেশ্বর।
আধিব্যাধিভুজঙ্গেন দষ্টং মামুদ্ধর প্রভো।।”
 
দ্বিপ্রহরে ভোগরাগাস্তে আরত্রিক মহোৎসব, সঙ্কীৰ্ত্তন, নৃত্য, গীতাদি দণ্ডবৎ অনন্তর সৎসঙ্গ গীতা-ভাগবত পাঠ, রাত্র জাগরণ হরিকীর্ত্তন।
 
অতঃপর দ্বাদশীর প্রাতঃস্নান, ধৌতবস্ত্রাদি ধারণ, শ্রীশালগ্রাম শিলার্চ্চন, নৈবেদ্য প্রদানে পারণ, বৈষ্ণব, ব্রাহ্মণ সেবা, দক্ষিণা, অতিথি সেবনান্তর সবান্ধব প্রসাদ সেবা করবে। নির্জ্জলা একাদশীতে জল দান, ফল, মিষ্টি, ধূপ, দীপ, বস্ত্র, ছত্র ও পাদুকা দান করা মহাপুণ্যজনক।
 
শ্রীহৃষীকেশ মাহাত্ম্য
শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ
 
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরঞ্চৈব নরোত্তমম্।
দেবিং-সরস্বতীং-ব্যাসং ততোজয়মুদীরয়েৎ।।
অব্যাকৃত বিহারায় সৰ্ব্বব্যাকৃত সিদ্ধয়ে।
হৃষীকেশনমস্তেস্ত মুনয়ে মৌনশালিনে।।
(মুকুন্দ্দমালা-স্তোত্র )
মহাভারত সভাপর্বে—
 
একদা মহারাজ জন্মেজয় মহামুনি বৈশম্পায়নকে জিজ্ঞাসা করলেন- পূর্ব্বপুরুষ পাণ্ডুরাজ স্বর্গলোকে গমন করেও কেন সুখী হ’তে পারেননি?
 
শ্রীবৈশম্পায়ন মুনি বললেন—হে পাণ্ডুকুল বংশধর! ইহার নিগূঢ় কারণ বলছি শ্রবণ কর—
 
লোকাননুচরণ সর্ব্বানাগমত্তাং সভাং নৃপ।
নারদঃ সুমহতেজা ঋষিভিঃ সহিতস্তদা।।
(মহাভারত সভাপর্ব )
 
ঋষিগণ সমাবৃত শ্রীনারদ মুনি সহসা একদিন যুধিষ্ঠির মহারাজের সভাস্থলে উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির মহারাজ ভ্রাতৃবর্গ ও সদস্যগণসহ নারদমুনিকে তথা তাঁর সঙ্গের মুনিগণকে বহু সম্মানপুরঃসর স্বাগত পূজাদি করলেন। যুধিষ্ঠির মহারাজ নারদ মুনির নিকট বিবিধ প্রশ্ন করবার পর জিজ্ঞাসা করলেন—স্বর্গপুরে তাঁর পিতৃদেব-পাণ্ডুরাজাকে দর্শন এবং তাঁর সঙ্গে কিছু কথোপকথন হয়েছে কিনা?
 
 
শ্রীনারদ বললেন—হ্যাঁ, পাণ্ডুরাজের দর্শন এবং তাঁর সঙ্গে কথোপকথন হয়েছে।
 
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন—–—পিতৃদেব আমাদের প্রতি কি কিছু বলেছেন?
 
নারদ মুনি—হ্যাঁ, তিনি বলেছেন—পুত্রগণের কর্মে আমি তৃপ্তি লাভ করতে পারিনি। যখন তারা লক্ষ্মীপতি হৃষিকেশ শ্রীকৃষ্ণকে রাজসূয় যজ্ঞানুষ্ঠান করবার পর মহাপূজা করবে তখনই আমার আত্মার পূর্ণ সুখোদয় হবে। পুত্রগণের সাক্ষাৎকার হলে আপনি একথা তাঁদের বলবেন।
 
যুধিষ্ঠির বললেন-হে মুনিবর! রাজসূয় যজ্ঞ পূর্ব্বে বরুণদেব করেছিলেন। এ যজ্ঞ সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দুর্লভ যজ্ঞ। ইহা আমি কিভাবে করব, তা ভেবে কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে যদি আপনাদের ন্যায় মহদ গণের এবং সাক্ষাৎ শ্রীহরির কৃপা হয়, তাহলে সম্ভব।
 
নারদ মুনি বললেন-হে পাণ্ডুনন্দন! এ বিষয় চিন্তা কর না। এ কথা বলে মুনিবর তৎক্ষণাৎ বীণা বাদনে শ্রীহরিনাম গান করতে করতে গগন পথে দ্বারকা, যাদবগণের সভায় এলেন। সভায় দ্বারকানাথ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র বিদ্যমান ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ যাদবগণ সঙ্গে মহামুনিকে খুব আদরের সহিত স্বাগত পূর্ব্বক যাদব সভামধ্যে বসালেন এবং স্বহস্তে মুনিবরের পূজাদি করলেন। পিঙ্গল জটাধারী দিব্য কান্তিময় দেবর্ষি নারদ মুনিকে পেয়ে সমস্ত যাদবগণের সহ যদুনাথ খুব সুখী হলেন। তারপর শ্রীকৃষ্ণ বিনীতভাবে নারদমুনিকে জিজ্ঞাস করতে লাগলেন-হে মুনিশ্রেষ্ঠ! আপনি সর্ব্বদা ত্রিলোক পরিভ্রমণ করেন, তজ্জন্য ত্রিলোকের খবর বলতে পারেন। আপনি বলুন, পাণ্ডবগণ সম্প্রতি কোন কর্ম সম্পাদনের ইচ্ছাবিশিষ্ট হয়েছেন কি?
 
শ্রীনারদ বললেন-হে সৰ্ব্বান্তৰ্য্যামী। আপনি যখন জিজ্ঞাসা করলেন তখন শুনুন। সাম্রাজ্যাভিলাসী রাজা যুধিষ্ঠির রাজসূয় নামক মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান দ্বারা আপনার আরাধনা করতে ইচ্ছাবিশিষ্ট। কিন্তু আপনার কৃপা ছাড়া তা কখনই সম্পাদন হবে না। আপনি তাদের এই কর্ম অনুমোদন করুন এবং কিভাবে সেই যজ্ঞ সম্পূর্ণ হতে পারে তদ্বিষয়ে যত্নবান হউন। মহাযজ্ঞে আপনার দর্শনাভিলাযে দেবতাগণ, ঋষিগণ ও মহর্ষিগণ তথা রাজন্যবর্গ উপস্থিত হবেন।
 
শ্রীযদুপতি কৃষ্ণ বললেন—হে মুনিশ্রেষ্ঠ। আপনি যখন সেই পাণ্ডবগণের শুভানুসন্ধান করছেন, তখন তাঁদের এ কার্য্য নিশ্চয় সম্পন্ন হবে। এ কথা শ্রবণানন্তর মুনিবর বীণাবাদনপূর্ব্বক হরিগুণ গান করতে করতে প্রস্থান করলেন।
 
অনন্তর শ্রীযদুপতি শ্রীকৃষ্ণ, উদ্ধব ও শ্রেষ্ঠ যাদবগণ সঙ্গে আর আবশ্যকীয়
কথোপকথনানন্তর কৌরবপুরে পাণ্ডবগণের সন্নিধানে যাবার প্রস্তাব করলেন। উহা পূজ্য যাদবগণ অনুমোদন করলেন। অতঃপর দ্বিতীয় দিবস শ্রীকৃষ্ণ পত্নীগণ ও পরিজন যাদবগণ তথা বহু দ্রব্য, সৈন্যসামন্তসহ কুরুরাজ ধামাভিমুখে যাত্রা করলেন। দ্বারকা হ’তে আসবার সময় মার্গ মধ্যে যে সমস্ত দেশ পড়েছিল। তত্তৎ দেশবাসী প্রজা ও দেশাধিপতিগণ শ্রীকৃষ্ণকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এরূপে ক্রমে শ্রীকৃষ্ণ কুরু রাজধানী সন্নিকটবর্তী হলে শ্রীকৃষ্ণের প্রেরিত দূতমুখে পাণ্ডবগণ শ্রীকৃষ্ণ আগমন বার্তা শ্রবণে অতিশয় আনন্দিত হন এবং শ্রীকৃষ্ণ আগমন মহামহোৎসবের উদ্যোগ করতে লাগলেন। গৃহদ্বার-মার্গ এবং সমগ্র নগর সুসজ্জিত, সুমার্জ্জিত এবং গৃহোপরি স্বর্ণকুম্ভ বিচিত্র বিচিত্র ধ্বজা পতাকা উড্ডীয়মান করলেন; নৃত্য-গীত বিবিধ বাদ্যযন্ত্র বাদিত হ’তে লাগলো।যুধিষ্ঠির মহারাজ ভ্রাতৃবর্গের পুরোহিত স্বজন-বান্ধব, নৰ্ত্তক, বাদক, ভাট ও গায়কগণ সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকে স্বাগত অভিনন্দন দেওয়ার জন্য কিছু পথ অভিগমন করলেন।
 
অতঃপর উভয়পক্ষের মিলন, যেন দুইটি আনন্দ সমুদ্রের মহামিলন উদ্বেলিত তরঙ্গমালা ত্রিলোক গ্লাবিত করে উঠল। কি জয়ধ্বনি, কি বাদ্যধ্বনি, দুন্দুভি, শিংগা, মৃদঙ্গ, জয়ঢাক প্রভৃতি যন্ত্রধ্বনি মিলনক্ষেত্রে এমন বাদিত হতে লাগল যে কেহ কারও কথা আর কর্ণগোচর হল না। এরূপ আনন্দবাদ্য কোলাহলে কিছুক্ষণ কেটে গেল, তারপর পরস্পরের প্রেম সম্ভাষণ—
 
গীতবাদিত্রঘোষেণ ব্রহ্মঘোষেণ ভূয়সা।
অভ্যয়াৎ স হৃষীকেশং প্ৰাণাঃ প্ৰাণমিবাদৃতঃ।।
(ভাঃ ১০।৭১।২৪)
অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গণ যেমন মুখ্যপ্রাণের সমাগমে তদভিগমনে প্রবৃত্ত হয় সেইরূপ যুধিষ্ঠির প্রভূত গীতবাদ্য ও বেদধ্বনি সহকারে হৃষীকেশ শ্রীকৃষ্ণের অভিমুখে গমন করলেন।
 
শ্রীকৃষ্ণ লোকধর্মানুকরণে বয়োজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠির মহারাজকে নমস্কার করলেন। তৎকালে যুধিষ্ঠির দীর্ঘকাল পরে প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণদর্শনে নয়নযুগল হতে আনন্দাশ্রু বিগলিত নেত্রে তাঁকে আলিঙ্গন করতে লাগলেন। তার আনন্দাশ্রুতে শ্রীকৃষ্ণের শিখাদেশ বিধৌত হতে লাগল। এরূপে শ্রীকৃষ্ণ ভীমকে নমস্কার করতে তিনি তাদৃশ প্রেমবিগল নেত্রে শ্রীকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করলেন। তারপর বহুদিন পরে অর্জুনের সঙ্গে মিলন। সখায় সখায় কোলাকুলি, নকুল ও সহদেব শ্রীকৃষ্ণকে বন্দনা করতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের ভূমি হতে তুলে দৃঢ় প্রেমালিঙ্গন করলেন।
 
ভগবান স্বয়ং যথাবিধি ব্রাহ্মণগণকে, কুরুকুল বৃদ্ধ ব্যক্তিগণকে প্রণাম নমস্কারাদি দ্বারা প্রীতি সম্মান প্রদর্শন করলেন। অতঃপর যুধিষ্ঠির সাবধানে বহুসম্মান পুরঃসর তাঁকে কুরু-রাজধানীতে নিয়ে এলেন। উক্তনগর বিচিত্র ধ্বজ, পতাকা, স্বর্ণতোরণ, পূর্ণকুম্ভসমূহে সুশোভিত এবং নব বস্ত্রালঙ্কার, মাল্যদ্বারা বিভূষিত দেহ পুরুষ ও নারীগণ, দুই পার্শ্বে পুষ্পমাল্য, আতপতণ্ডুল , গন্ধোদক পুষ্প, দুর্ব্বাদি ভগবদ্ শিরে অভিবর্ষণ পূৰ্ব্বক স্বাগত অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। ঐ সমস্ত নর-নারীগণ ব্রম্ভাশিবাদি দেবতাগণের নিত্য দর্শনাকাঙ্ক্ষি ভগবানের ত্রিভূবন সুন্দর মূর্ত্তি দর্শন করে ধন্যাতিধন্য হয়েছিলেন।
 
অতঃপর ভগবান্ কুরুপুরে প্রবেশ পূর্ব্বক সৰ্ব্বপ্রথমে পিসিমা শ্রীকৃতিদেবীর চরণ দর্শনে বধুগণের সহিত প্রবিষ্ট হলেন। তিনি ত’ দিন-রাত কবে কৃষ্ণদর্শন পাব এই ভাবনায় প্রেমাশ্রুপাত করছিলেন, আজ কৃষ্ণ যখন স্বীয় নামোল্লেখ পূর্ব্বক চরণমূলে নমস্কার করলেন তখন তিনি পালঙ্ক হতে ত্বরাগতিতে ভূতলে নেমে প্রেম পুলকিত দেহে দুই ভুজের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে যেন তাঁর চিরবিরহ ব্যথিত বক্ষঃস্থল শীতল করলেন। কৃষ্ণও তাঁর প্রেমভরা আলিঙ্গনে বক্ষঃস্থল প্রেমাশ্রুতে সিক্ত করতে লাগলেন। কুন্তিদেবীর নয়ন জলে কৃষ্ণের শিরদেশ প্লাবিত হতে লাগল। কুন্তিদেবী এরূপে কৃষ্ণবধুগণকেও স্নেহালিঙ্গনে আপ্যায়িত করলেন।
 
এ সময় কুন্তিদেবী বহু স্তুতি করে বল্লেন—হে কৃষ্ণ, হে হৃষীকেশ! তুমি যদুরাজার বহু পুণ্যলব্ধ ধন। আজ যদুকুল তোমাকে পেয়ে ত্রিলোকে যশস্বী হয়েছে। তুমি দুর্জ্জনগণের দুর্লভ। এমনকি দেবতাগণেরও দুদর্শনীয়। তথাপি কুরুকুল তোমার দুর্লভ পদরজঃ আজ পেয়ে ধন্যাতিধন্য হল।
 
অনন্তর কুন্তিদেবী কুরুকুল-কুলবধূ দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও উত্তরা প্রভৃতিকে আহ্বান করে শ্রীকৃষ্ণ-বধূগণকে এবং শ্রীকৃষ্ণকে উত্তম পরিচর্য্যা করবার জন্য আদেশ করলেন। যুধিষ্ঠির মহারাজকে নির্দেশ দিলেন যদুপুর থেকে আগত সকলের উত্তম পরিচর্য্যা করবার জন্য। যে কৃষ্ণ পাওয়ার জন্য পাণ্ডবগণ সুদীর্ঘকাল ধরে কত কিছু বিধি রচনা করছিলেন আজ সেই অসাধনের ধন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পাণ্ডব গৃহে উপনীত হলেন। এই হল ভক্তপ্রিয় মাধব। ভক্তের ঘরে ভগবান, না ডাকলেও স্বয়ং উপস্থিত হন। ভক্তের জিনিষ ভগবান চেয়ে চেয়ে খান; অভক্তের জিনিষের দিকে ফিরেও দেখেন না।
 
অতঃপর ভক্তবৎসল ভক্তের-প্রেমাধীন শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জনের সহিত ভ্রমণ করতে লাগলেন। অৰ্জ্জুন কৃষ্ণ সহায়ে স্বর্গপুরে গমন, ইন্দ্রদেবকে যুদ্ধে পরাভব, ইন্দ্রের অর্ধাসন লাভ, অগ্নিদেবকে খাণ্ডব বন দান, খাণ্ডব বন হতে ময়দানবের উদ্ধার প্রভৃতি কর্মে সাফল্য লাভ করলেন। ময়দানব প্রত্যুপকারার্থে পাণ্ডবদিগের যজ্ঞসভা গৃহাদি নির্মাণ করে দিলেন।
 
একদা রাজা যুধিষ্ঠির সভামধ্যে সকলের সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণাকে স্তুতি করে বললেন –হে গোবিন্দ, আমি রাজসূয় নামক উত্তম যজ্ঞের আপনাকে এবং আপনার অংশাংশ স্বরূপ সর্ব্ব দেবতাগণকে আরাধনা কর ইচ্ছা বিশিষ্ট হয়েছি, কিন্তু ইহা আপনার কৃপা ছাড়া কখনই সম্ভব হতে পারে না।
 
শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে মহারাজ, আপনি যে বিষয়ে কৃতসংকল্প হয়েছেন,তা অতীব উত্তম। আপনার সংকল্প সিদ্ধি হউক।
 
বর্তমান দিগ্বিজয়ের জন্য ভ্রাতৃবর্গকে ও সৈন্যসামন্তগণকে নিযুক্ত করুন যাবতীয় নৃপতিমণ্ডলীকে বশীভূত ও আমন্ত্রণ করুন। যজ্ঞীয় দ্রব্যসম্ভার আয়োজন করুন। হে রাজন ! যারা আমাতে আসক্তচিত্ত তাঁদেরকে তেজ বীৰ্য্য, যশঃ কিছুই অভিভূত করতে পারে না।
 
অতঃপর মহারাজ যুধিষ্ঠির শুভকালে স্বর্ণ লাঙ্গল দ্বারা যজ্ঞভূমি কর্ষণপূর্ব্বক ভ্রাতৃবর্গকে দিগ্বিজয়ার্থে প্রেরণ করলেন। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ ভীম ও অর্জুনকে নিয়ে মগধদেশে গমন করলেন এবং মগধদেশাধিপতি জরাসন্ধকে ভীম কর্তৃক নিহত করলেন। জরাসন্ধ কর্তৃক গিরিদ্রোণ নামক স্থানে বিশ হাজার রাজা বন্দী ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাদের মুক্ত করে দিলেন এবং যুধিষ্ঠিরের রাজসূয যজ্ঞে আগমনের আমন্ত্রণ দিয়ে দিলেন।
 
এদিকে অন্যান্য ভ্রাতৃবর্গ বহু দেশ জয় করে বহু ধনরত্নাদি নিয়ে এলেন। রাজসূয় যজ্ঞারম্ভ হল। কোনস্থানে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বেদ মন্ত্র উচ্চারণ, কোনস্থানে বেদশ্রুতি ব্যাখ্যা, কোনস্থানে গায়কগণ গান, কোনস্থানে বাচকগণ উত্তম ব্যাখ্যা, কোনস্থানে নৰ্ত্তকগণ নৃত্য ও কোনস্থানে বাদকগণ বিবিধ মনোহর বাজনা দ্বারা সকলকে রঞ্জিত করছিল। অপরদিকে দীন, দুঃখী, দরিদ্রগণকে মনোবাঞ্ছিত দান করছিল, আর একদিকে ভোজনশালায় মহামহোৎসবের
ভোজন, ব্রাহ্মণ, অতিথি, অভ্যাগত, নিমন্ত্রিত ও আগতজনকে ভূরিভোজন করান হচ্ছিল। ভোজনানন্দে উহারা মহারাজের জয়ধ্বনিতে দিগ্‌মণ্ডল মুখরিত করছিল।
 
মহারাজ যুধিষ্ঠির মহারাণী দ্রৌপদীর সহিত যজ্ঞবেদীর সামনে কুশাসনে কুশ ধারণপূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণের উচ্চারিত বেদমন্ত্রের সহিত হবি আহুতি-প্রদান, করছিলেন। সেইকালে তত্তৎ মন্ত্রদেবতাগণ যেন স্বয়ং প্রকট হয়ে সেই হবি গ্রহণ করছিলেন।
 
যজ্ঞের দান-কার্য্যে দাতাকর্ণ, অর্থাধ্যক্ষ পদে দুৰ্য্যোধন, দ্রব্য, তরিতরকারী ক্রয়াদি ব্যাপারে দুঃশাসনাদি সাত ভাই, সহদেব যজ্ঞীয় দ্রব্য সাধনে প্রতিদিনোপযোগী বাজার কর্মে-নিযুক্ত, নকুল সমস্ত কর্মের তত্ত্বাবধানে, দ্রৌপদীদেবী ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব ভোজনে, অৰ্জ্জুন বিভিন্ন দেশ-বিদেশ হতে আগত রাজন্যবর্গের স্বাগত কর্মে এবং শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবগণের পাদধৌত কর্মে নিযুক্ত হলেন।
 
দিগ্‌দিগন্ত ব্যাপী রাজসূয় যজ্ঞের মহিমাগাথা যেন মুখরিত হতে লাগল। যে কর্মে স্বয়ং সৰ্ব্বলোকপতি, গোলোকপতি ও লক্ষ্মীপতি নিযুক্ত হয়েছেন, সে কার্য্যের গুণগরিমা যে ত্রিজগৎ ব্যাপৃত হবে ইহাতে আশ্চর্যজনক কথা কি আছে। এরূপে মহামহোৎসবে বৎসরেক কাল কেটে গেল। যজ্ঞের শেষ দিবসে সেই যজ্ঞের সভাপতি পদে সর্ব্বাগ্রে পূজা কার হবে? এ প্রশ্ন উত্থাপিত হল। মতামতের জন্য জিজ্ঞাসা করা হল—জগদগুরু শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস, মহামুনি ভরদ্বাজ, সুমন্তমুনি, গৌতম, বশিষ্ঠ, অসিত, চ্যবন, কন্বমুনি, মৈত্রেয়, জৈমিনি, বিশ্বামিত্র, বামদেব, পরাশর, গর্গমুনি, বৈশম্পায়ণ, অথর্ব্বর্ণ, কশ্যপ ও ধৌম্য প্রভৃতি মহামহাঋষিগণকে। তাঁরা সকলেই একবাক্যে বল্লেন—অগ্রে পূজা হবে যদুকুলে অবতীর্ণ স্বয়ং ভগবান্ হৃষীকেশ শ্রীকৃষ্ণের।
 
 
 
শ্রুত্বা দ্বিজেরিতং রাজা জ্ঞাতা হার্দ্দদং সভাসদান।
সমহর্ষদ্বষীকেশং প্রীতঃ প্ৰণয়বিহ্বলঃ।।
 
রাজা যুধিষ্ঠির মহামুনিগণের হার্দ্দিক অভিপ্রায় বুঝতে পেরে শ্রীহৃষীকেশ শ্রীকৃষ্ণের অগ্রে পূজা করলেন।
 
সহদেব মহারাজের মতানুসারে সভামধ্যে ঋষিগণের মত বিঘোষিত করলেন এবং শ্রীকৃষ্ণই যে একমাত্র সর্ব্বপুজ্য তা উত্তমরূপে ব্যাখ্যা করলেন।
 
অতঃপর শ্রীযুধিষ্ঠির মহারাজ ভ্রাতৃবর্গ, বধুবর্গ, আত্মীয়বর্গ প্রভৃতির সহিত হৃষ্টচিত্তে পূজা আরম্ভ করলেন। অগ্রে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্ম প্রক্ষালনপূর্ব্বক সেই লোকপাবন জল (শিব যে পাদোদক শিরে ধারণ করে শিবনাম ধারণ করেছেন) মহারাজ সর্ব্বপরিকরসহ শিরে ধারণ করলেন। অতঃপর অর্ঘ্য, মধুপর্ক, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, বিবিধ নৈবেদ্য, বস্ত্রালঙ্কার, মালা প্রভৃতি দিয়ে শ্রীকৃষ্ণপূজা করলেন। তৎকালে ভক্তবৃন্দ, ঋষিবৃন্দ ও দেববৃন্দ মহানন্দে দশদিক ভরে জয় জয়ধ্বনি, নমঃ নমঃ ধ্বনি ও বিবিধ বাদ্যকার, গায়কগণ সানন্দে বাদ্য কীৰ্ত্তন ধ্বনিতে দিক্‌মণ্ডল প্রমোদিয় করছিলেন।
 
অনন্তর মহারাজ, মহারাণী ও ভ্রাতৃবর্গের সহিত এই মন্ত্র উচ্চারণ পূর্ব্বক আত্মনিবেদন করলেন—
 
“এতৎগৃহাপত্যং কর্মং কর্মফলং সর্বেষাং শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু”
ওঁ প্রিয়তাং পুণ্ডরীকাক্ষং সর্ব্বযজ্ঞেশ্বরোহরি।
তস্মিন্ তুষ্টে জগত্তুষ্টি প্রীণিতে প্ৰীণিতং জগৎ।। ইতি৷৷
শ্রীকৃষ্ণের অভিষেক পুজাকৰ্ম্ম শেষ হল।
 
এদিকে চেদিপতি শিশুপাল শ্রীকৃষ্ণের পূজা ও তাঁর মহিমা সহদেবের মুখে শুনে রোযভরে অসহিষ্ণু হয়ে সভামধ্যে গাত্রোত্থান পূর্বক অকথ্য ভাষায় শ্রীকৃষ্ণনিন্দা করতে আরম্ভ করল, বললো, বৰ্ত্তমান কালই বিষম৷ আজ পিতামহের ও মুনিগণের মতিভ্রম হয়েছে, বালক সহদেবের কথানুসারে কুলদূষণ গোপালকে সভাপতি আসন দেওয়া হল।
 
 
শিশুপালের এরূপ কৃষ্ণসম্বন্ধে নিন্দামন্দ বাণী শ্রবণে শ্রীভীম সেন, অৰ্জ্জুন, অন্যান্য পাণ্ডব পক্ষীয় রাজগণ অসহিষ্ণু হয়ে বিষধর সর্পের ন্যায় গর্জ্জন করে সকলেই স্ব-স্ব অস্ত্রধারণ করতঃ দণ্ডায়মান হলেন। এ সময় শ্রীকৃষ্ণ সকলকে নিষেধ করে বললেন—ওর একশত এক অপরাধ ক্ষমা করবার কথা ছিল, তা আজ পূর্ণ হল, অদ্যই আমি আমার সুদর্শন অস্ত্রদ্বারা ওকে নিহত করব। এ বলে সুদর্শন অস্ত্র ছাড়লেন, চক্রের দ্বারা ক্ষণকাল মধ্যে শিশুপালের শিরচ্ছেদ হল। শিশুপালের শরীর হতে মহাতেজপুঞ্জ, উত্থিত হয়ে উহা শ্রীকৃষ্ণেতে প্রবেশ করল। দেবতা, মুনিগণ সকলে মহাসুরের নিধনে আনন্দে পুষ্পবৃষ্টি, নৃত্যগীত ও দুন্দুভি ধ্বনি প্রভৃতি করতে লাগলেন। মহারাজ যজ্ঞ সমাপ্ত করে অবভূৎ স্নান করলেন। রাজসূয়যজ্ঞে আগত রাজন্যবর্গকে যুধিষ্ঠির মহারাজের প্রার্থনায় নিজস্বরূপ দেখালেন। যজ্ঞ সমাপ্তে দেবলোক, পিতৃলোকাদি সকলেই পরম তৃপ্তিলাভ করলেন।
 
যাঁরা শ্রদ্ধান্বিত চিত্তে শ্রীহরিবাসরে রাজসূয়যজ্ঞে ভগবান হৃষীকেশ শ্রীকৃষ্ণের মহিমা শ্রবণ করবেন, তাঁরা অনায়াসে শ্রীগোবিন্দ পাদপদ্মে রতিমতি লাভে সর্বার্থ সিদ্ধিলাভ করবেন।
 
ইতি পান্ডবা একাদশী শ্রীহরিবাসরে শ্রীহৃষীকেশের মহিমা সমাপ্ত।
 
 
 
  • February 20-21, 2022 Puri, Odisha
  • 3rd of July in 2022 Balasore, Odisha
  • August 24-26, 2022 Kurukshetra, Haryana
  • October 7, 2022 Prayagraj, Uttar Pradesh
  • November 30 -1, 2022 Agartala, Tripura
  • December 3-4, 2022 Lalabazar, Assam
  • December 7, 2022 Guwahati, Assam
  • February 17-18, 2023 Baruipur, West Bengal
  • May 27-28, 2023 Patna, Bihar
  • June 26, 2023 Bhubaneswar, Odisha
  • November 26, 2023 Gaya, Bihar
  • February 8, 2024 Delhi
  • February 13-15, 2024 Balighai, Medinipur
  • March 19, 2024 Nabadwip, West Bengal
  • May 27 2024 Florida, USA
  • June 23-24, 2024 Baripada, Odisha
  • June 26-27, 2024 Paradeep, Odisha
  • June 29-30, 2024 Cuttack, Odisha
  • July 14, 2024 Chennai, Tamilnadu
  • August 31 2024 London
  • September 07 2024 London
  • September 08 2024 Berlin (Germany)
  • September 13 2024 Canada
  • September 14-15 2024 Rochester (USA)
  • September 21 2024 New Jersey (USA)
  • Upcoming Events