Dissaperance Day of Srila Baladev Vidyabhusan
শ্রীমৎ বলদেব বিদ্যাভূষণ ছিলেন নিষ্কিঞ্চন পরম ভাগবত। কোন প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা তাঁর বিন্দুমাত্র ছিল না। বহু অমূল্য গ্রন্থ রত্ন লিখে মানব জাতির মহৎ উপকার করে গেছেন। তিনি কোথাও নিজের বংশ, পিতা-মাতা কিম্বা জন্মস্থানের কোন পরিচয় প্রদান করেন নাই। তজন্য় তাঁর জন্ম সম্বন্ধে সঠিক খবর পাওয়া যায় না।
কেহ কেহ অনুমান করেন বালেশ্বর জেলার অন্তর্গত রেমুনার পার্শ্ববর্তী কোন গ্রামে খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে তাঁর জন্ম হয়। অল্প বয়সে ব্যাকরণ কাব্য অলঙ্কার ও ন্যায় শাস্ত্রে বিশেষ সুদক্ষতা লাভ করেন এবং তিনি তীর্থ ভ্রমণে বের হন। এ সময় কিছুদিন তিনি তত্ত্ববাদী শ্রীমধ্বাচার্য্যের মঠে অবস্থান করে তত্ত্ববাদ সিদ্ধান্তে পারঙ্গত হন। পরে তত্ত্ববাদ সিদ্ধান্ত প্রবলভাবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচার করেন।
ভ্রমণ করতে করতে শ্রীমৎ বলদের বিদ্যাভূষণ পুনরায় উৎকল দেশে আগমন করেন এবং কিছুদিন প্রচার কার্য চালান। এ সময় শ্রীরসিকানন্দ দেবের প্রশিষ্য পণ্ডিত শ্রীরাধাদামোদর দেবের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ও বাক্যালাপ হয়।
শ্রীমদ্ রাধাদামোদর দেব গোস্বামী তখন তাঁর কাছে শ্রীশ্রীগৌরসুন্দরের কৃপা অবদানের কথা বর্ণন করেন এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব সিদ্ধান্তের সাব্বভৌমত্বের কথা তাঁকে জানান। শ্রীমদ্ রাধাদামোদর দেব গোস্বামীর কথা শ্রীবলদেব বিদ্যাভূষণের মর্ম স্পর্শ করে। কয়েকদিবস তাঁর কথা শ্রবণের পর তিনি রামকৃষ্ণ মন্ত্র নিয়ে গোস্বামীর নিকট শ্রীমদ্ জীবগোস্বামিপাদের ষটসন্দর্ভ অধ্যয়ন করতে লাগলেন।
শ্রীমদ বলদের বিদ্যাভূষণ অল্পকাল মধ্যে গৌড়ীয় সিদ্ধান্তে পারঙ্গত হলেন। কিছুদিন শ্রীরাধাদামোদর দেব গোস্বামীর নিকট অবস্থান করবার পর, তিনি তাঁর অনুমতি নিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন আর কিছু বিশেষ জানবার আশায় বৃন্দাবনে শ্রীমদ্ বিশ্বনাথ চক্রবর্ভিপাদের নিকট আগমন করেন।
শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তী (শ্রীহরিবল্লভ দাস) শ্রীবলদেবের বিনয়, নম্রতা, বৈরাগ্য ও স্বাধ্যায়শীলতা দর্শন করে বড় সুখী হন। তিনি তাঁকে তাঁর কাছে রেখে গৌড়ীয় অচিন্ত্যভেদাভেদ সম্বন্ধে বিশেষভাবে শিক্ষা প্রদান করতে লাগলেন। শ্রীবলদেব বিদ্যাভূষণ এ সময় থেকে গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত মনে প্রাণে একান্তভাবে গ্রহণ করেন এবং প্রচার করতে থাকেন।
এই সময় জয়পুর রাজ দরবারে গৌড়ীয় সম্প্রদায় সম্বন্ধে শ্রীরামানুজ সম্প্রদায়ের লোকেরা কিছু তর্ক উত্থাপন করেন। তাঁরা রাজাকে জানান গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের কোন ভাষ্য-গ্রন্থ নাই, অতএব তাঁদের মত সিদ্ধান্ত নহে। শ্রীগোবিন্দ গোপীনাথের সেবা তজ্জন্য শ্রী সম্প্রদায়ের হাতে দেওয়া হউক। তখন জয় পুরের রাজা গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের শিষ্য ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ এ সংবাদ বৃন্দাবনে শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তীর নিকট প্রেরণ করেন এবং জানতে চান গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের বেদান্ত ভাষ্যগ্রন্থ আছে কিনা? যদি থাকে তাহা যেন শীঘ্র জয়পুরে শ্রী-সম্প্রদায়ী পণ্ডিতগণের সম্মুখে স্থাপন করা হয়।
তখন শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তীপাদ অতি বৃদ্ধ, দুর্গম পথ অতিক্রম করে জয়পুরে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নহে। তাই তিনি তাঁর শিষ্য ও ছাত্র শ্রীবলদেবকে প্রেরণ করলেন। শ্রীবলদের বিদ্যাভূষণ সৰ্ব্ব দর্শন শাস্ত্রে পারঙ্গত। তিনি বিশাল সভামধ্যে শ্রী-সম্প্রদায়ী রামানন্দী পন্থি পণ্ডিতগণের সহিত তুমুল তর্ক-যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। সিদ্ধান্ত বিচারে তাঁরা শ্রীবলদেবের সম্মুখে দাঁড়াতে পারলেন না। তিনি বললেন- গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীমদ্ভাগবতকেই অকৃত্রিম বেদান্ত ভাষা বলে স্বীকার করেছেন। ষট্সম্পর্ভ তার প্রমাণ। ইহাতে সভাস্থলে শ্রী সম্প্রদায়ী
পণ্ডিতগণ আপত্তি তুললেন—সাক্ষাৎ বেদান্ত ভাষ্য ব্যতীত অন্য কিছু স্বীকার করতে চাইলেন না। অগত্যা শ্রীবলদেব বিদ্যাভূষণ তাঁদের ভাষ্য দেখাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন।
শ্রীবলদের বিদ্যাভূষণ অতি দুঃখিত মনে শ্রীগোবিন্দ মন্দিরে এলেন এবং সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করে সমস্ত কথা শ্রীগোবিন্দ দেবের কাছে নিবেদন করলেন। রাত্রে স্বপ্নে শ্রীগোবিন্দ দেব তাঁকে বললেন তুমি ভাষ্য রচনা কর। উহা আমার সম্মত ভাষ্য হবে। কেহই অগ্রাহ্য করতে পারবে না। স্বপ্ন দর্শনে শ্রীবলদের সুখী হলেন ও হৃদয়ে পূর্ণবল লাভ করলেন। অতঃপর শ্রীগোবিন্দ পাদপদ্মা যুগল ধ্যানপূৰ্ব্বক ভাষ্য লিখতে আরম্ভ করলেন, কয়েক দিবসের মধ্যে সম্পূর্ণ করলেন। ভাষ্যের নাম রাখা হল শ্রীগোবিন্দ ভাষ্য।
ভাষ্যের শেষভাগে শ্রীবলদের বিদ্যাভূষণ লিখলেন
বিদ্যারূপং ভূষণং মে প্রদায় খ্যাতিং নিন্যে তেন যো মামুদারঃ।
শ্রীগোবিন্দ স্বপ্ননির্দিষ্ট ভাষে৷ রাধাবন্ধুবন্ধুরাঙ্গঃ স জীয়াৎ।।
যিনি আমার প্রতি অতি উদার ও দয়া পরবশ হয়ে স্বপ্নাদেশ দিয়ে ভাষ্য লিখিয়েছেন, যে ভাষ্য বিদ্বৎ সমাজে পরম খ্যাতি লাভ করেছে এবং যে ভাষ্যের জন্য বিদ্বানগণ আমাকে বিদ্যাভূষণ উপাধি দান করেছেন, সে শ্রীরাধিকার প্রাণবন্ধু শ্রীগোবিন্দ জয়যুক্ত হউন।
ভাষ্য গ্রন্থ নিয়ে শ্রীবলদেব বিদ্যাভূষণ সভাস্থলে এলেন এবং রামানন্দী পণ্ডিতগণকে দেখালেন। এবার সকলে নির্ব্বাক হল। গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের জয় গোষিত হল। রাজা এবং গৌড়ীয় ভক্তগণ পরম সুখী হলেন। পণ্ডিতগণ শ্রীবলদেবকে বিদ্যাভূষণ উপাধি প্রদান করলেন।
এই সভা জয়পুরের গলতা নামক স্থানে ১৬২৮ শকাব্দতে হয়েছিল। এই দিন থেকে মহারাজ ঘোষণা করেন যে শ্রীশ্রীগোবিন্দজীউর আরতি সর্ব্বাগ্রে হবে।
শ্রী সম্প্রদায়ের পণ্ডিতগণ বলদেব বিদ্যাভূষণের নিকট পরাভব স্বীকার করলেন এবং শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে চাইলেন। শ্রীবলদেব বিদ্যাভূষণ অতি বিনীতভাবে তাতে অস্বীকৃতি জানালেন। চারি সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রী-সম্প্রদায় ভগবদ্ দাস্য ভক্তিতে শ্রেষ্ঠ ও সর্ব্বমান্য। তাঁদের কোন প্রকার মর্যাদাহানি হলেই অপরাধ সম্ভাবনা।
শ্রীপাদ বলদেব বিদ্যাভূষণ জয়পুর থেকে জয় পত্র নিয়ে শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তীর শ্রীপাদপদ্মে অর্পণ করলেন ও সমস্ত কথা নিবেদন করলেন। বৃন্দাবন বাসী বৈষ্ণবগণ পরম সুখী হলেন। শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্তী শ্রীবলদেবকে প্রচুর আশীর্ব্বাদ করলেন। শ্রীবলদের ষট সন্দর্ভের ভাষ্য লিখতে আরম্ভ করলেন।
অতঃপর শ্রীমদ্ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর অপ্রকট হলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব জগতের একটী জ্যোতিষ্ক যেন অস্তমিত হল। সেই সময় শ্রীমদ্ বলদেব বিদ্যাভূষণপাদ গৌড়ীয় বৈষ্ণর সঙ্ঘের পাত্ররাজরূপে অধিষ্ঠিত হন।
শ্রীমদ্ বলদেব বিদ্যাভূষণপাদের—
সিদ্ধান্ত ও শিক্ষা
একমেব পরং তত্ত্বং বাচ্যবাচক ভাবভাক্।
বাচ্যঃ সর্বেশ্বরো দেবো বাচকঃ প্রণবোভবেৎ।।
মৎস্যকুর্মাদিভিরূপৈর্যথা বাচ্যো বহুভবেৎ।
বাচকোপি তথার্থাদিভাবাদ্বরূদীৰ্য্যতে।।
আদ্যন্তরহিতত্বেন স্বয়ং নিত্যং প্ৰকীৰ্ত্তাতে।
আবির্ভাব তিরোভাবৌ স্যাতামস্য যুগে যুগে।
(শ্রীসিদ্ধান্ত দর্পণম্ )
একই পরতত্ত্ব বাচ্য ও বাচক ভাবে দুই প্রকার। পরমেশ্বরই বাচ্য এবং প্রণবই (ওঁ) তাঁহার বাচক। বাচ্য বস্তু পরমেশ্বর কুর্মাদি রূপে যেরূপ বহু, বাচক রূপ প্রণবও তদ্রূপ ঋক্সামাদি রূপে বহুরূপ প্রাপ্ত হয়েছেন। সেই পরমেশ্বরের আদ্যন্ত নাই। এই কারণেই তিনি স্বয়ং নিত্য রূপে প্রকীর্তিত হন। যুগে-যুগে তাঁহার জগতে আবির্ভাব ও তিরোভাব হয়ে থাকে।
ঈশ্বর— জ্ঞান, ক্রিয়া ও ইচ্ছারূপ তিনটী ধর্ম বিশিষ্ট। তিনিই এই জগতের কর্তা এবং নিত্য কারণ। চৈতন্য খণ্ড বা চৈতন্য কণ রূপ বিভিন্নাংশ গণের ইচ্ছা থাকলেও ঈশ্বরের অখণ্ড জ্ঞান ও সত্য সঙ্কলসিদ্ধ ক্রিয়াশক্তি ব্যতীত সৃষ্টি হয় না।
ঈশ্বরের বাক্য বলিয়া বেদ ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করণাপাটব এই দোষ চতুষ্টয়শূন্য। সুতরাং বেদই স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ। জ্ঞানাদি যেরূপ ঈশ্বরের নিত্য ধর্ম বলিয়৷ কীৰ্তিত হইয়াছে। দেবও সেইরূপ ঈশ্বর জ্ঞানের বিস্তৃতিরূপ নিঃশ্বসিত বলিয়া কীৰ্তিত হইয়াছে। বেদের ন্যায় পুরাণ ইতিহাসকেও কর্তৃবর্জিত অনাদি বলিয়া জানিবে।
(শ্রীসিদ্ধান্ত দর্পণ)
“তদেবং সৰ্ব্বতঃ শ্রৈষ্ঠ্যে শব্দস্য স্থিতে তত্ত্বনির্ণায়কস্তু শ্রুতি লক্ষণ এব ন ত্বর্যলক্ষণোপি।।
(বেদান্তস্যমস্তক )
প্রত্যক্ষঃ অনুমান, উপমান, শব্দ, অর্থাপত্তি, অনুপলব্ধি, সম্ভব ও ঐতিহ্য। এই আটটী প্রমাণের মধ্যে শব্দ প্রমাণ সর্বশ্রেষ্ঠ স্থির হওয়ায় শ্রুতিলক্ষণ শব্দই একমাত্র তত্ত্ব নির্ণয় করিতে সক্ষম। আর্য্য লক্ষণ শব্দ প্রমাণ হইতে পারে না। কারণ ঋষিদিগের মধ্যে পরস্পর বিবাদ দেখা যায়। অতএব অপ্রাকৃত নিতা বেদশাস্ত্র শ্রুতি প্রমাণ মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ বেদশাস্ত্র চারি প্রকার দোষ শূন্য সাক্ষাৎ ঈশ্বর তুল্য।
(বেদান্তস্যমন্তক ১/৫১)
প্রমাণ দ্বারা যাহা নির্ণয় করা যায় তাহা প্রমেয়। তাহা পাঁচ প্রকার ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম।
ঈশ্বর– বিভু, সৰ্ব্বজ্ঞ, বিজ্ঞানাত্মক আনন্দময়, গুণবান্ ও পুরুষোত্তম। তিনি সকলের স্বামী, জন্ম বা মৃত্যাদি শূন্য। তিনি ব্রহ্ম৷ শিবাদি দেবতাগণের দেবতা (দেবতানাং পরমঞ্চ দৈবতং) পতিগণের পরম পতি ও পরম স্তবনীয় পুরুষ। তিনি প্রলয় কালাদিতে একমাত্র অবস্থান করেন। ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্র ও বরুণ প্রভৃতি সমস্ত দেবতাগণই তখন বিনাশ প্রাপ্ত হয়।
সেই শ্রীহরির তিনটী শক্তি বিদ্যমান। পরানাম্নী শক্তি, ক্ষেত্রজ্ঞ নাম্নী শক্তি ও মায়া নাম্নী শক্তি (তত্রৈব ২।১৮) পরাশক্তি, স্বরূপশক্তি, ক্ষেত্রজ্ঞশক্তি, জীবশক্তি ও মায়া বহিরংগাশক্তি। বিষ্ণুপুরাণে পরাশক্তি, বিষ্ণু শক্তি, অপরাশক্তি, জীবশক্তি এবং অবিদ্যা কর্ম নাম্নী তৃতীয়া শক্তি।
শ্রীহরি দেহ-দেহী ভেদ-শূন্য। তিনি দ্বিভুজ, বনমালাধারী, সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ, গোপাল ও গোবিন্দ আদি নামে অভিহিত। লক্ষ্মী ভগবদ হইতে অভিন্ন স্বরূপা। ” সেই জগন্মাতা লক্ষ্মী বিষ্ণুর অনপায়িনী শক্তি।” বিষ্ণু যেমন সৰ্ব্বগামী ব্যাপকস্বরূপ এই লক্ষ্মীও সেই প্রকার সর্ব্বগামিনী ব্যাপকস্বরূপা। লক্ষ্মীদেবী হরির ন্যায় বহুরূপা। এই লক্ষ্মীদেবী শ্রীবিষ্ণুর দেবত্বে দেবদেহা এবং মানুষত্বে মানুষীই হন।। (তত্রৈব ২।৩৬) “তেষু সর্ব্বেযু লক্ষ্মীরূপেযু রাধায়াঃ স্বয়ং লক্ষ্মীত্বং মন্তব্যম্। সৰ্ব্বেষু ভগবরূপেষু কৃষ্ণস্য স্বয়ং ভগবত্তবৎ” (তত্রৈব ২/৩৭) সেই লক্ষ্মীগণের মধ্যে শ্রীরাধিকাই স্বয়ং ইহাই বুঝবে। সমস্ত ভগবদরূপের মধ্যে কৃষ্ণাই স্বয়ং ভগবান বৃহদ্ গৌতমীয় তন্ত্রে – শ্রীরাধিকাই দেবী কৃষ্ণময়ী, পরদেবতা সর্ব লক্ষ্মীময়ী , সর্বকান্তি ও সম্মোহিনী এবং পরা বলিয়া কথিত হন। শ্রীমদ্ভাগবতে শৌনক মুনি বললেন সমস্ত অবতার পুরুষের অংশ বা বলা কিন্তু কৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান। অতএব যাবতীয় উপাস্য তত্ত্বের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণই পরম উপাস্য তত্ত্ব।
জীব ঈশ্বরের অনুশক্তি। জীবাত্মা নিত্য অবিনাশী। সেই জীবাত্মা নিত্য জ্ঞান-গুণ বিশিষ্ট। “স চ জীবো ভগবদ্দাসো মন্তব্যা। দাসভূতো হরেরেব নান্যসৈব কদাচনেতি পদ্মাৎ।” সেই জীব তত্ত্বতঃ ভগবানের দাস ইহাই জানিবে। যথা পদ্মপুরাণে—এই জীব শ্রীহরিরই দাস-স্বরূপ, কদাচ অন্য কাহারও নহে। (তত্রৈব ৩।১১) সেই জীব শ্রীগুরু চরণারবিন্দ আশ্রয় দ্বারা এবং শ্রীগুরু কৃপালব্ধ শ্রীহরিভক্তি দ্বারা পুরুষার্থ লাভ করে।
শ্রীবলদের বিদ্যাভূষণপাদ বেদান্ত সামন্তক গ্রন্থের শেষে নিজ শ্রীগুরু পাদপদ্মের এইভাবে বন্দনা করেছেন
রাধাদিদামোদর নাম বিভ্রতা,
বিপ্রেণ বেদান্তময়ঃ স্যমন্তকঃ।
শ্রীরাধিকায়ৈবিনিবেদিতোময়া
তস্যাঃ প্রমোদংস তলোতু সৰ্ব্বদা।।
শ্রীরাধাদামোদর নামক কোন বিপ্র (মদীয় গুরু) কর্তৃক প্রেরিত হইয়া যৎকর্তৃক শ্রীরাধিকার উদ্দেশ্যে বেদান্ত স্যমন্তক বিনিবেদিত হইল স্যমন্তক সতত তাহারই প্রমোদ বৰ্দ্ধন করুক।
শ্রীপাদ বলদের বিদ্যাভূষণপাদ পরবর্তী কালে শ্রীগোবিন্দ দাস নামে পরিচিত হন। তাঁর দুইজন প্রসিদ্ধ শিষ্য ছিলেন—শ্রীউদ্ধব দাস ও শ্রীনন্দন মিশ্র।
বিরচিত গ্রন্থাবলী
শ্রীগোবিন্দ ভাষ্য, শ্রীসিদ্ধান্ত রত্ন, সাহিত্য কৌমুদী, বেদান্ত স্যমন্তক, প্রমেয় রত্নাবলী, সিদ্ধান্ত দর্পণ, কাব্য কৌস্তুভ, ব্যাকরণ কৌমুদী, পদকৌস্তুভ, ঈশাদি উপনিষদ ভাষ্য, গীতাভূষণ ভাষ্য, শ্রীবিষ্ণুজ্জামসহস্রভাষ্য, সংক্ষেপ ভাগবতামৃত টিপ্পনি সারঙ্গবঙ্গদা, তত্ত্বসন্দর্ভ টীকা, স্তবমালা বিভূষণভাষ্য, নাটকচন্দ্রিকা টীকা, চন্দ্রলোক টীকা, সাহিত্য কৌমুদী টীকা—কৃষ্ণানন্দিনী, শ্রীমদ্ভাগবত টীকা (অসম্পূর্ণ) বৈষ্ণবানন্দিনী গোবিন্দভাষ্য সুক্ষ্ম টীকা, সিদ্ধান্ত রত্ন টীকা ও স্তবমালার টীকা (শকাব্দ ১৬৮৬, খৃষ্টাব্দ ১৭৬৪)