Disappearance Day of Srila Rupa Goswamipad

শ্ৰীশ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রিয়তম জন ষড়-গোস্বামীর অন্যতম শ্রীরূপ গোস্বামী। মহাপ্রভু শ্রীরূপ ও সনাতনের দ্বারা পৃথিবী তলে স্ব স্বাভীষ্ট শিক্ষা ও সিদ্ধান্ত প্রচার করেছেন। ভক্তগণ এ দুই জনকে সেনাপতি বলেছেন।
 
শ্রীরূপ গোস্বামীর বংশ পরিচয় শ্রীল জীব গোস্বামী লঘু বৈষ্ণব তোষণীতে দিয়েছেন।
 
উদ্যচ্চারুপদক্রমাশ্রিতবর্তী যস্যামৃতস্রাবিনী
জিহ্বা কল্পলতাত্রয়ী মধুকরী ভূয়োনরীনৃত্যতে।
রেজে রাজসভা সভাজিত পদঃ কর্ণাটভূমিপতিঃ
শ্রীসর্ব্বজ্ঞ জগদ্গুরুভূবি ভরদ্বাজান্বয়গ্রামণীঃ।।
 
অনুবাদঃ — শ্রীসর্ব্বজ্ঞ জগদ্গুরু নামে কর্ণাট দেশাধিপতি পৃথিবীর মধ্যে একজন বিখ্যাত নৃপতিরূপে বিরাজিত ছিলেন। তাঁর উৎকৃষ্ট শব্দবিন্যাসময়ী অমৃত নিঃস্যন্দিনী এবং বেদত্রয়রূপ কল্পতলায় মধুকরীতুল্যা জিহ্বা নিরন্তর নৃত্য করত। তার পাদপদ্মযুগল রাজমন্ডলী কর্তৃক পূজিত হত এবং তিনি ভরদ্বাজ গোত্রের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। এই কর্ণাট-ভূপতি জগদ্গুরু শ্রীসর্ব্বজ্ঞের অভ্যূদয়কাল—দ্বাদশ শক শতাব্দীতে। শ্রীসর্ব্বজ্ঞের আত্মসম পুত্র শ্রীঅনিরুদ্ধ দেব। শ্রীঅনিরুদ্ধের দুই পুত্র শ্রীরূপেশ্বর ও হরিহর। রূপেশ্বর ছিলেন শাস্ত্রে বিচক্ষণ এবং হরিহর ছিলেন অস্ত্রে বিচক্ষণ। পিতার অন্তর্ধানের পর রূপেশ্বর ছোট ভাই হরিহর দ্বারা রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। তৎকালে তিনি অটিটি অশ্বসহ পৌলস্ত্য দেশে আগমন করেন এবং পৌলস্থ্যের রাজা শিখরেশ্বরের সঙ্গে তার মৈত্রীভাব হয়। রূপেশ্বরের পরম সুন্দর এক পুত্র জম্ম গ্রহণ করেন। এ পুত্রের নাম শ্রীপদ্মনাভ দেব। শ্রীপদ্মনাভ গঙ্গাতটে বাস অভিপ্রায়ে নৈহাটি নামক গ্রামে এলেন এবং তথায় সাধ্বী পত্নীসহ সুখে বাস করতে লাগলেন। তিনি শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের শ্রীমূর্তি পূজা করতেন। শ্রীপদ্মনাভ দেবের আঠারটি কন্যা এবং পাঁচটি পুত্র হয়। পুরুষোত্তম, জগন্নাথ, নারায়ণ, মুরারি ও মুকুন্দ পাঁচটি পুত্রের নাম।
 
শ্রীমুকুন্দ দেবের পুত্র শ্রীকুমারদেব, ইনি পরম সদাচারী ও বিপ্রকুলের রত্নসদৃশ ছিলেন এবং নিরন্তর যাগ-যজ্ঞাদি পরায়ণ ছিলেন। পরবর্তীকালে স্বজনগণের দ্বারা তিনি পীড়িত হয়ে নৈহাটী পরিত্যাগ পূর্ব্বক বঙ্গদেশে ‘বালা চন্দ্রদ্বীপ’ গ্রামে এসে বসবাস করতে লাগলেন। তত্রস্থ সজ্জনগণ কর্তৃক তিনি পরম আদৃত হলেন। কুমারদেব যশোরে ফতেয়াবাদ নামক গ্রামেও একখানি বসতবাটী করেছিলেন। শ্রীকুমারদেবের অনেকগুলি সন্তান ছিলেন তাঁর মধ্যে তিনটি পুত্র ছিলেন পরম বৈষ্ণব।
 
কুমার দেবের হৈল অনেক সন্তান।
তার মধ্যে তিন পুত্র বৈষ্ণবের প্রাণ।।
সনাতন, রূপ, শ্রীবল্লভ এই ত্রয়।
সগোত্র অন্যত্র যে অৰ্চ্চিত অতিশয় ৷৷
 
– (ভঃ রঃ ১।৫৬৭-৫৬৮)
 
শ্রীরূপ গোস্বামীর বড় ভাই হলেন শ্রীসনাতন গোস্বামী এবং ছোট ভাই হলেন শ্রীবল্লভ বা অনুপম। শ্রীঅনুপমের পুত্র হলেন শ্রীজীব গোস্বামী ৷
 
শ্রীল কবি কর্ণপুর গৌরগণোদ্দেশ দীপিকাতে ব্রজলীলায় শ্রীরূপ গোস্বামী ‘শ্রীরূপমঞ্জরী’ ছিলেন বলেছেন।
শ্রীরূপমঞ্জরীখ্যাতা যাসীদ্ বৃন্দাবনে পুরা।
সাদ্য রূপাখ্য গোস্বামী ভূত্বা প্রকটতা মিয়াৎ।।
 
যিনি পূর্ব্বে ব্রজলীলায় “শ্রীরূপমঞ্জরী” নামে খ্যাতা ছিলেন, তিনি অধুনা সদ্য শ্রীরূপ গোস্বামী নামে প্রকটিত হয়েছেন।
 
শ্রীরূপ সনাতন ছিলেন এক প্রাণ। তাঁরা এক সঙ্গে অধ্যয়নাদি করেছেন। শ্রীসনাতন গোস্বামী “দশম টিপ্পনীর” বন্দনাতে যাঁদের নিকট বেদান্তাদি শাস্ত্র অধ্যাপনাদি করেছিলেন তাদের বন্দনা করেছেন—
 
ভট্টাচাৰ্য্যং সাৰ্ব্বভৌমং বিদ্যাবাচস্পতী গুরূন ।
বন্দে বিদ্যাভূষণঞ্চগৌড়দেশ বিভূষণম্।।
বন্দে শ্রীপরমানন্দ ভট্টাচার্য্যং রসপ্রিয়ং।
রামভদ্রং তথা বাণীবিলাসং চোপদেশকম্।।
 
অনুবাদঃ— আমি অধ্যাপক সাৰ্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্য, গৌড়দেশ বিভূষণ বিদ্যাভূষণ, বিদ্যা বাচস্পতি, রসপ্রিয় পরমানন্দ ভট্টাচার্য্য, এবং বাচতুর অধ্যাপক রাম ভদ্রাদিকে বন্দনা করি।
 
এ শ্লোকে শ্রীরূপ গোস্বামী যাঁদের নিকট বেদান্তাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন তাঁদের নাম পাওয়া যায়। শ্রীরূপ সনাতন অল্প বয়সে নিখিল বেদশাস্ত্র অধ্যয়নাদি করে পরম বিদ্বান হয়েছিলেন। তারা কিভাবে তৎকালে গৌড়েশ্বর হুসেন সাহ বাদশাহের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। তৎ সম্বন্ধে কিছু প্রবাদ আছে–
 
বাদশাহের যে গুরু মৌলবী ছিলেন তিনি বেশ সাধক পুরুষ ছিলেন, ভূত ভবিষ্যতের কথাদি বলতে পারতেন। কোন সময় বাদশাহ তাঁর কাছে অভ্যুদয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন তোমার এ মহানগরীতে পরম বিদ্বান সৰ্ব্বসগুণসম্পন্ন দুইটা ব্রাহ্মাণ সস্তান বাস করছেন, তাঁদের নাম ‘রূপ’ও ‘সনাতন’। তাদের মন্ত্রীপদ দিলে তোমার বহু বৈভব রাজ্যাদি সম্পদ লাভ হবে। বাদশাহ গুরুর কথানুসারে শ্রীরূপ সনাতনকে মন্ত্রিপদ দান করেন।
 
শ্রীরূপ গোস্বামীর জন্ম খৃষ্টাব্দ ১৪৯৩, শকাব্দ ১৪১৫। তিনি রাজধানী গৌড়ের নিকটে সাকুর্মা নামক এক পল্লীতে মাতুল গৃহে থেকে পড়াশুনা করেন।
 
গৌড়ের বাদশাহ হুসেনসাহ জোর পূর্ব্বক শ্রীরূপ ও সনাতনকে এনে রাজমন্ত্রিত্ব পদ দেন। তারা অনিচ্ছুক হলেও যবনরাজের ভয়ে রাজকার্য্য করতে লাগলেন। বাদশা তাঁদিগকে প্রচুর অর্থ ও সম্পত্তি দান করেন। শ্রীরূপ ও সনাতন তখন থেকে গৌড় রাজধানী রামকেলিতে বসবাস করতে লাগলেন। দেশ বিদেশ থেকে বড় বড় ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ তাঁদের গৃহে আগমন ও বিবিধ শাস্ত্র চর্চ্চাদি করতেন। কর্ণাটক থেকে ব্রাহ্মণগণ এলে বহু যত্ন পূর্ব্বক তাঁদের বাসস্থান প্রদান করতেন। গঙ্গার তটে তাদের বসত বাটী স্থাপিত হওয়ায় অদ্যাপি ঐ গ্রাম ভট্টবাটী নামে খ্যাত।
 
যে সময় শ্রীরূপ ও সনাতন রামকেলিতে বাদশাহের মন্ত্রির কাৰ্য্য করছিলেন ঠিক সেই সময় নবদ্বীপে শ্রীগৌরসুন্দর ভক্তগণকে নিয়ে মহাসংকীৰ্ত্তন বিলাস ও পাপী তাপী উদ্ধার লীলা করছিলেন। শ্রীরূপ ও সনাতন নিয়ত মহাপ্রভু শ্রীগৌরসুন্দরের সেই মহাবদান্যতার ও কৃপালুতার কথা শুনেছিলেন। নিত্যারাধ্যদেব শ্রীগৌরসুন্দরের দর্শনের জন্য তাঁদের হৃদয়ে পরম উৎকণ্ঠা জেগেছিল। শ্রীরূপ গোস্বামী কোন সময়ে শ্রীগৌরসুন্দরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন—তাঁর শ্রীচরণ দর্শনের জন্য। শ্রীরূপের সেই পত্রোত্তরে মহাপ্রভু জানিয়েছিলেন—“পর পুরুষ অনুরক্তা রমণী যেমন বাহ্য স্বামীর সেবায় অনুরক্ততা দেখায়; তদ্রুপ তোমরা চিত্তটি শ্রীকৃষ্ণপদে রেখে বাহ্য রাজকার্য্যে অনুরাগ দেখাও। অচিরাৎ শ্রীকৃষ্ণ তোমাদের প্রতি কৃপা করবেন।”
 
শ্রীরূপ গোস্বামী তৎকালে শ্রীনবদ্বীপ নগরে যেতে পারেননি। তথাপি তিনি নবদ্বীপ নিবাসী জনগণের প্রতি অতিশয় প্রীতি দেখাতেন। এ সম্বন্ধে শ্রীনরহরি চক্রবর্ত্তী ঠাকুর ভক্তিরত্নাকরে সুন্দর বর্ণনা করেছেন—
 
নবদ্বীপ হৈতে আইসে বিপ্লগণ যত।
কহিতে না পারি তা সবারে ভক্তি কত।।
 
— (ভঃ রঃ ১।৫৯৭)
 
শ্রীরামকেলিতে গ্রামে শ্রীরূপ ও সনাতন কিরূপ ঐশ্বর্য্য সমন্বিত ছিলেন। তা ভক্তিরত্নাকরে বর্ণনা করেছেন—
 
গৌড়ে রামকেলি গ্রামে করিলেন বাস।
ঐশ্বর্য্যের সীমা অতি অদ্ভূত বিলাস।।
ইন্দ্রসম সনাতন রূপের সভাতে।
আইসে শাস্ত্রজ্ঞগণ নানা দেশ হৈতে।।
গায়ক বাদক নৰ্ত্তকাদি কবিগণ।
সৰ্ব্বদেশী সকলে নিযুক্ত সৰ্ব্বক্ষণ।।
নিরন্তর করেন অনেক অর্থ ব্যয়।
কোনরূপে কার অসম্মান নাহি হয়।।
সদা চর্চ্চা করে দুইজন।
অনায়াসে করে দোঁহে খন্ডন স্থাপন।।
 
বাড়ীর নিকট অতি নিভৃত স্থানেতে।
কদম্ব কানন, রাধাশ্যাম কুন্ড তা’তে।।
বৃন্দাবন লীলা তথা করয়ে চিন্তন।
না ধরে ধৈর্য নেত্রে ধারা অনুক্ষণ।।
শ্রীবিগ্রহ মদনমোহন সেবায় রত।
সদা খেদ উক্তি তাহা কহিব বা কত।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচন্দ্র বিহরে নদীয়া।
সদা উৎকণ্ঠিত তাঁর দর্শন লাগিয়া।।
 
— (ভঃ রঃ ১।৫৮৫-৬০৭ )
 
অতঃপর শ্রীগৌরসুন্দর সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন এবং নদীয়া ছেড়ে চললেন শ্রীপুরুষোত্তম ক্ষেত্রে। এ কথা শুনে শ্রীরূপ পরম ব্যাকুল হয়ে উঠলেন, জীবনে আর শ্রীগৌরসুন্দরের রাতুল শ্রীচরণ যুগল দর্শন হবে না, বলে প্রাণটি বিদীর্ণ হতে লাগল, অন্তরে অন্তরে অন্তর্য্যামী শ্রীগৌরহরি অভয় পদে দারুণ বেদনার কথা নিবেদন করতে লাগলেন। ভক্তবৎসল প্রভু ভক্তের আহ্বানে স্থির থাকতে পারলেন না, ভক্তকে দেখা দিতেই হবে ভেবে, কিছুদিন শ্রীগৌরসুন্দর পুরীধামে থেকে পুনঃ গৌড় দেশাভিমুখে যাত্রা করলেন। ভক্তের আকর্ষণে ভগবান চঞ্চল হয়ে উঠেন। গৌড়দেশে শ্রীগৌরসুন্দর বিদ্যানগরে সাৰ্ব্বভৌম পন্ডিতের ভ্রাতা বিদ্যা বাচস্পতির ভবনে শুভবিজয় করলেন। তখন ভক্তগণের যেন হৃদয়ের অপহৃত মহাধনের পুনঃ প্রাপ্তি ঘটল, আনন্দের অবধি রইল না।
 
মহাপ্রভু কয়েকদিন বিদ্যানগরে অবস্থানের পর কুলিয়া নগরে শুভবিজয় করলেন।
 
কুলিয়া-গ্রামেতে প্রভুর শুনিয়া আগমন।
কোটি কোটি লোক আসি’ কৈল দরশন।।
কুলিয়া গ্রামে কৈল দেবানন্দেরে প্রসাদ।
গোপাল বিপ্রেরে ক্ষমাইল শ্রীবাসাপরাধ।।
পাষন্ডী নিন্দুক আসি’ পড়িলা চরণে।
অপরাধ ক্ষমি’ তারে দিল কৃষ্ণ প্রেমে।।
-(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ১।১৫২-১৫৪)
 
মহাপ্রভু কুলিয়া নগরে কয়েকদিন থেকে বহু পাপী তাপী জীবের উদ্ধার পূর্ব্বক প্রেমদান করলেন এবং সেখান থেকে শ্রীবৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করলেন, সঙ্গে সহস্র সহস্র লোক চলতে লাগলেন। অকস্মাৎ ভক্ত বৎসল প্রভুর মনে কি ভাবের উদয় হল, তিনি গৌড় রাজধানী রামকেলি গ্রামাভিমুখে চলতে লাগলেন—
 
ঐছে চলি’ আইলা প্রভু ‘রামকেলি’ গ্রাম।
গৌড়ের নিকট গ্রাম অতি অনুপাম ।।
তাঁহা নৃত্য করে প্রভু প্রেমে অচেতন।
কোটি কোটি লোক আইসে দেখিতে চরণ।।
(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ১।১৬৬-১৬৭)
 
গৌড়াধ্যক্ষ বাদশাহ মহাপ্রভুর অপূর্ব্ব প্রভাব শ্রবণ করে বিস্মিত হয়ে কর্মচারীগণের প্রতি বলতে লাগলেন—বিনা দানে এর পিছে এত লোক চলেন, তিনি নিশ্চয় ঈশ্বর জানতে হবে। অতএব তাঁকে যদি কেহ কোন প্রকার হিংসাদি করে তবে তার উচিত শাস্তি প্রদান করা হবে। সেই মহাপুরুষ ইচ্ছামত ভ্রমণ করুক।
 
শ্রীরূপের বাদশাহ দত্ত নাম হল দবির খাস। বাদশাহ পরিশেষে মহাপ্রভুর সম্বন্ধে দবির খাসকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বললেন—
 
যে তোমার রাজ্য দিল, যে তোমার গোসাঞা।
তোমার দেশে তোমার ভাগ্যে জন্মিলা আসিঞা।।
তোমার মঙ্গল বাঞ্ছে, বাক্য সিদ্ধি হয়।
ইহার আশীর্ব্বাদে তোমার সর্ব্বত্রই জয়।।
 
(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ১।১৭৬-১৭৭)
 
রাজা ! তুমি তোমার মনকে জিজ্ঞাসা কর। তুমি নরাধিপ বিষ্ণু অংশ তুল্য। তোমার মনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সম্বন্ধে যে জ্ঞান হয় তাহাই প্রমাণ। বাদশাহ বললেন আমার মনে হয় শ্রীচৈতন্য সাক্ষাৎ ঈশ্বর ইহাতে সংশয় নাই। বাদশাহ এ কথা বলে দরবার গৃহ ত্যাগ পূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। শ্রীরূপ (দবির খাস) নিজ গৃহে এলেন। শ্রীরূপ ও সনাতন দেখলেন বিধাতা যেন অকস্মাৎ সদয় হয়ে অসাধনে গৌর চিন্তামণি মিলিয়ে দিয়েছেন। মহাপ্রভু গঙ্গাতটে এক বকুল বৃক্ষের মুলে অবস্থান করলেন, মহাসংকীৰ্ত্তন রোলে দিক্ দিগন্তে মুখরিত হচ্ছিল, সন্ধ্যাগমনে তা বিরাম লাভ করল, ভক্তগণ মহাপ্রভুর চারিদিকে অবস্থান করছেন, এমন সময় সেই প্রাণের দেবতা শ্রীগৌরসুন্দরের অভয় পাদপদ্ম যুগল দর্শন বাসনায় ছদ্মবেশে সামান্য মাত্র বস্ত্র পরিধান করে শ্রীরূপ ও সনাতন দুই গুচ্ছ তৃণ মুখে ধরে প্রেম পুলকিত প্রেমাশ্রু, স্মরণ নেত্রে সাষ্টাঙ্গ দন্ডবৎ হয়ে পড়লেন শ্রীনিত্যানন্দের শ্রীচরণ যুগল মূলে। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু মহাপ্রভুর নিকট দুই ভাইয়ের কথা নিবেদন করে দুই ভাইকে শ্রীগৌরসুন্দরের শ্রীচরণে সমর্পণ করলেন। দুই ভাই মহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্ম তলে পড়ে অতি দৈন্য ভরে স্তুতিপূর্ব্বক রোদন করতে লাগলেন। তখন শ্রীগৌর তাঁদের ভূমি হতে উঠিয়ে বলতে লাগলেন—
 
—মহাপ্রভু কহে, – শুন দবির খাস।
তুমি দুই ভাই—মোর পুরাতন দাস।।
আজি হৈতে দুহার নাম ‘রূপ সনাতন’।
দৈন্য ছাড়, তোমার দৈন্যে ফাটে মোর মন।।
দৈন্যপত্রী লিখি, মোরে পাঠালে বার বার।
সেই পত্রীদ্বারা জানি তোমার ব্যবহার।।
তোমার হৃদয় আমি জানি পত্রীদ্বারে।
তোমা শিখাইতে শ্লোক পাঠাইল বারে বারে।।
 
গৌড়-নিকটে আসিতে নাহি মোর প্রয়োজন।
তোমা-দুহা দেখিতে মোর ইহাঁ আগমন।।
এই মোর মনের কথা কেহ নাহি জানে।
সবে বলে, কেনে আইলা রামকেলি-গ্রামে।।
ভাল হৈল, দুই ভাই আইলা মোর স্থানে।
ঘরে যাহ, ভয় কিছু না করিহ মনে।।
জন্মে জন্মে তুমি দুই—আমার কিঙ্কর।
অচিরাতে কৃষ্ণ তোমায় করিবে উদ্ধার।।
-(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ১।২০৭-২১৫)
 
মহাপ্রভু দবির খাস (শ্রীরূপ) ও সাকর মল্লিককে (সনাতন) বিবিধ উপদেশ এবং প্রবোধ দিয়ে বিদায় করলেন। তাঁরা যাবার সময় বার বার মহাপ্রভুর শ্রীচরণ যুগল শিরে ধারণ ও প্রার্থনা করতে করতে সমস্ত গৌর ভক্ত অদ্বৈত আচার্য্য, শ্রীহরিদাস ও শ্রীগদাধর প্রভৃতির আশীর্ব্বাদ গ্রহণ পূৰ্ব্বক বিদায় হলেন, সকলে হরিধ্বনি পূর্ব্বক বললেন- তোমাদের কোন ভয় নাই মহাপ্রভুর কৃপা হয়েছে। অতঃপর ভক্তগণসহ শ্রীগৌরহরি কানাইর নাটশালাভিমুখে যাত্রা করলেন।
 
শ্রীরূপ ও সনাতন দুইজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বরণ পূর্ব্বক কৃষ্ণমন্ত্রে দুইটি পুরশ্চরণ করলেন, অচিরাৎ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য চরণ আশ্রয় পাবার জন্য।
 
শ্রীরূপ গোস্বামী যশোহরে ফতেয়াবাদে নিজ গৃহে নৌকাতে করে বহুধন নিয়ে এলেন। সেই ধন কিছু ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবগণকে কিছু কুটুম্ব ভরণ পোষণের এবং ভবিষ্য কোন আপৎ কালাদির জন্য ভাল ভাল বিপ্রস্থানে রেখে দিলেন। গৌড় রামকেলিতে সনাতনের বন্ধন মোচনের জন্য দশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা মুদি ঘরে রেখে দিলেন।
 
অতঃপর শ্রীরূপ যখন শুনলেন শ্রীমহাপ্রভু বৃন্দাবনাভিমুখে যাত্রা করছেন, তখন কাল বিলম্ব না করে ছোট ভাই অনুপমের সহিত তিনি বের হয়ে পড়লেন। শীঘ্র চলতে চলতে শ্রীরূপ অনুপমের সহ প্রয়াগে পৌঁছালেন। প্রভুর দর্শন পেলেন। প্রভু চলেছেন শ্রীবিন্দুমাধব দর্শনে। লক্ষ লক্ষ লোক প্রভু দর্শনের জন্য পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হচ্ছেন। দুই ভাই দূর থেকে প্রভুকে দন্ডবৎ প্রণাম করলেন।
 
অনন্তর তত্রস্থ এক দাক্ষিনাত্য ব্রাহ্মণ গৃহে আমন্ত্রিত হয়ে প্রভু তথায় ভোজন করতে সেইসময় রূপ ও অনুপম প্রভুর সঙ্গে ঐ ব্রাহ্মণ গৃহে সাক্ষাৎভাবে মিলিত হলেন। দুই ভাই মহাপ্রভুর শ্রীচরণ বন্দনা করতেই প্রভু রূপকে ভূমি হতে উঠিয়ে দৃঢ় আলিঙ্গন করলেন এবং শ্রীসনাতনের সমাচার জিজ্ঞাসা করলেন, শ্রীরূপ শ্রীসনাতনের যাবতীয় সমাচার প্রদান করলেন। তা শুনে মহাপ্রভু বললেন—সনাতনের শীঘ্রই বন্ধন মোচন হবে।
 
— শুদ্ধাদ্বৈতবাদী পোষ্টী মার্গের আচার্য্য শ্রীবল্লভ ভট্ট তখন প্রয়াগে আড়াইল গ্রামে বসবাস করতেন, তিনি শ্রীগৌরসুন্দরের দর্শনের জন্য দাক্ষিণাত্য বিপ্রগৃহে আগমন করলেন। বল্লভ ভট্ট দন্ডবৎ করতেই তাঁকে প্রভু ধরে আলিঙ্গন করলেন। অতঃপর দুইজন কৃষ্ণালাপন করতে লাগলেন, কৃষ্ণকথায় মহাপ্রভু প্রেমাবিষ্ট হলেন কিন্তু ভট্টের সঙ্কোচে প্রভু প্রেম সম্বরণ করলেন। তারপর মহাপ্রভু বল্লভ ভট্টের নিকট শ্রীরূপের ও অনুপমের পরিচয় বললেন, তা শুনে বল্লভাচার্য্য রূপকে আলিঙ্গন করতে উঠলেন, রূপ অনুপম দুই ভাই দূরে পলায়ন করলেন এবং বললেন আমরা অস্পৃশ্য, ছুঁইবেন না। এ কথা শ্রবণে বল্লভ ভট্ট বিস্ময়ান্বিত হলেন। মহাপ্রভুও পরীক্ষার জন্য বল্লভ ভট্টকে বললেন আপনি কুলীন বৈদিক ব্রাহ্মণ এদের ছুইবেন না। বল্লভাচার্য্য বললেন এ দুয়ের মুখে নিরন্তর কৃষ্ণনাম বিরাজমান, ইহারা অধম নহে সৰ্ব্বোত্তম।
 
দুহার মুখে কৃষ্ণনাম করিছে নর্তন।
এই-দুই ‘অধম’ নহে হয় সৰ্ব্বোত্তম।।
 
(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ১৯৭১)
 
বল্লভাচার্য্য অনন্তর মহাপ্রভুকে নিমন্ত্রণ করে নিজ গৃহে আড়াইল গ্রামে নৌকা করে নিয়ে এলেন, সঙ্গে শ্রীরূপ ও অনুপম ছিলেন। সেখানে ভোজনের অবশেষ রূপ ও অনুপমকে দিলেন। পুনঃ মহাপ্রভু রূপ ও অনুপমের সঙ্গে প্রয়াগে ফিরে এলেন। প্রভুর দর্শনের জন্য বহু লোকের ভিড় হতে লাগল। তা দেখে মহাপ্রভু রূপ ও অনুপমকে সঙ্গে নিয়ে নির্জ্জা দশাশ্বমেধ ঘাটে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের তলে বসে কৃষ্ণকথা বলতে লাগলেন।
 
কৃষ্ণতত্ত্ব-ভক্তিতত্ত্ব-রসতত্ত্ব-প্রান্ত।
সব শিখাইল প্রভু ভাগবত-সিদ্ধান্ত।।
 
—-(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ১৯।১১৫)
 
শ্রীরূপের হৃদয়ে মহাপ্রভু শক্তিসঞ্চার করে সর্ব্ব তত্ত্ব শিক্ষা দিয়ে প্রবীণ করলেন। শ্রীরূপ শিক্ষা শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ মহোদয় চৈতন্য চরিতামৃতে মধ্যলীলা ঊনবিংশ পরিচ্ছেদে বিশেষ ভাবে বর্ণনা করেছেন। শেষে মহাপ্রভু শ্রীরূপের প্রতি বললেন—আর্মি ভক্তিরসের সামান্য দিগ্‌দর্শন করলাম। ইহা তুমি বিস্তৃতভাবে বর্ণনা কর, ভাবতে ভাবতে শ্রীকৃষ্ণ স্ফূর্ত্তি করাবেন। কৃষ্ণকৃপা হলে অজ্ঞও রসসিন্ধুর পার হতে পারে।
 
অতঃপর মহাপ্রভু শ্রীরূপকে বৃন্দাবনে যাবার আদেশ করে পরে পুরীধামে মিলিত হবার আদেশ করলেন। দুই ভাই বৃন্দাবনাভিমুখে চললেন। মহাপ্রভু বারাণসীর দিকে যাত্রা করলেন।
মহাপ্রভু যখন বারাণসী তপন মিশ্রের গৃহে অবস্থান করছিলেন। সে সময় শ্রীসনাতন গৌড় রাজবন্দী থেকে পালিয়ে বন পথে বহু কষ্টে বারাণসীতে শ্রীমহাপ্রভুর শ্রীপাদপদ্মে উপস্থিত হলেন। মহাপ্রভু সনাতনকে দেখে পরম সুখী হলেন এবং দুই মাস কাশীতে থেকে শ্রীসনাতনকে শিক্ষা দিলেন। সনাতনকে মহাপ্রভু বৃন্দাবনে যাবার আদেশ দিয়ে নিজে পুরীধামের দিকে চললেন।
 
যখন সনাতন বৃন্দাবনাভিমুখে যাত্রা করলেন। তখন শ্রীরূপ বৃন্দাবন থেকে গৌড়দেশ হয়ে পুরীর দিকে যাত্রা করলেন। শ্রীরূপ ক্রমে চলে এলেন কাশীতে। তথায় তপন মিশ্র, চন্দ্রশেখর ও মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ তথা অন্যান্য ভক্তদের সঙ্গে ক্রমে রূপের ও অনুপমের মিলন হল। তপন মিশ্র শ্রীরূপের কাছে শ্রীসনাতনের মিলন বার্তা ও প্রকাশানন্দ সরস্বতীর উদ্ধার প্রভৃতির কথা বললেন,তা শ্রবণে শ্রীরূপ খুব আনন্দিত হলেন। দশ দিন শ্রীরূপ কাশীতে থেকে গৌড় দেশাভিমুখে যাত্রা করলেন।
 
শ্রীরূপ অনুপমের সঙ্গে গৌড়দেশে গঙ্গাতটে আগমন করতেই অকস্মাৎ অনুপম গঙ্গা প্রাপ্তি হলেন। শ্রীরূপ গৌড়দেশে কয়েকদিন অবস্থান করবার পর নীলাচলাভিমুখে যাত্রা করলেন।
 
শ্রীবল্লভ (অনুপম) অপ্রকট হৈলা গঙ্গাতীরে !
নীলাচলে গেলা রূপ কিছুদিন পরে।।
 
— (ভঃ রঃ ১।৬৬৯ )
 
শ্রীরূপ গোস্বামী বৃন্দাবন ধাম থেকেই একখানি কৃষ্ণলীলা নাটক রচনা আরম্ভ করেন। পথে চলতে চলতে কড়চা আকারে ঘটনাগুলি লিখতে লাগলেন। পথে গঙ্গাতটে ভ্রাতা অনুপমের গঙ্গা প্রাপ্তি হল অনন্তর তিনি গৌড়দেশে এসে কয়েক দিবস পরে নীলাচলে যাত্রা করলেন। চলতে চলতে উড়িষ্যার সত্যভামাপুর নামক গ্রামে এলেন, একরাত্র সে গ্রামে শ্রীরূপ অবস্থান করলেন। তথায় রাত্রে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন স্বয়ং সত্যভামাদেবী এসে বলছেন— “আমার নাটক পৃথকভাবে রচনা কর, আমার কৃপায় নাটক সুন্দর হবে।” এ স্বপ্ন দেখে শ্রীরূপ বুঝতে পারলেন সত্যভামাদেবী তার নাটক পৃথকভাবে বর্ণনা করতে আদেশ করছেন।
 
শ্রীরূপ নীলাচলে এলেন এবং শ্রীহরিদাস ঠাকুরের কুটীরে পৌঁছালেন। শ্রীরূপ শ্রীহরিদাস ঠাকুরকে দন্ডবৎ করতেই তিনি বললেন— মহাপ্রভু তোমার আগমন বার্তা আমাকে বলেছিলেন। শ্রীহরিদাস ঠাকুর শ্রীরূপকে অতিশয় সঙ্গে স্বীয় কুটীরে রাখলেন। মহাপ্রভুর প্রতিদিন নিয়ম ছিল, তিনি শ্রীজগন্নাথদেবের উপল ভোগ দর্শন করে শ্রীহরিদাস ঠাকুরের কুটীরে আগমন করা। মহাপ্রভু হরিদাসের কুটীরে আজও এলেন। শ্রীরূপ মহাপ্রভুর সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করলেন তখন হরিদাস ঠাকুর মহাপ্রভুকে বললেন— শ্রীরূপ আপনাকে দন্ডবৎ করছেন। মহাপ্রভু হরিদাস ঠাকুরের সঙ্গে মিলিত হবার পর শ্রীরূপকে ধরে আলিঙ্গন করলেন। শ্রীরূপ অতিশয় দৈন্য প্রকট করতে লাগলেন। অতঃপর মহাপ্রভু তাঁকে নিয়ে উপবেশন এবং কুশল প্রশ্ন ইষ্টগোষ্ঠাদি করবার পর শ্রীসনাতনের বার্তা জিজ্ঞাসা করলেন। শ্রীরূপ বললেন সনাতনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। আমি গঙ্গা পথে এসেছি, তিনি রাজপথে চলে গেছেন। প্রয়াগে শুনলাম তিনি বৃন্দাবনে গেছেন। তারপর আমি গৌড়দেশে ছোট ভ্রাতা অনুপমের সঙ্গে আসতেই গঙ্গাতটে অনুপমের অকস্মাৎ গঙ্গা প্রাপ্তি ঘটে। মহাপ্রভু অনুপমের গঙ্গা প্রাপ্তি শুনে বললেন— “অনুপমের শ্রীরাম নিষ্ঠা অতুলনীয়” ইত্যাদি বলে অনেক প্রশংসা করলেন। শ্রীরূপকে মহাপ্রভু হরিদাসের সন্নিকট থাকবার আদেশ করে স্বীয় বাসভবন গম্ভীরার দিকে চললেন।
 
অপর দিবস মহাপ্রভু সর্ব্ব ভক্তগণ সঙ্গে হরিদাস ঠাকুরের কুটীরে আগমন করলেন, শ্রীহরিদাসের সহ শ্রীরূপ মহাপ্রভুকে সাষ্টাঙ্গে বন্দনা করলেন। শ্রীনিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য্যকে মহাপ্রভু বললেন তোমরা শ্রীরূপকে কৃপা কর। যাতে শ্রীরূপ ব্রজ রসতত্ত্ব বর্ণনা করতে পারে। মহাপ্রভু প্রতিদিন শ্রীহরিদাসের জন্য মন্দিরে প্রাপ্ত প্রসাদ নিয়ে দিতেন। শ্রীরূপের সঙ্গে শ্রীহরিদাস, প্রভুর দেওয়া প্রসাদ অতিশয় আনন্দ ভরে গ্রহণ করতেন। তারপর ভক্তসঙ্গে মহাপ্রভু ইষ্টগোষ্ঠী করতে লাগলেন। স্বরূপ দামোদরের প্রতি লক্ষ্য করে মহাপ্রভু রূপের কথা বলতে লাগলেন—পূর্ব্বে রথযাত্রা কালে আমি ভাবাবিষ্ট ভাবে যে শ্লোক বলেছিলাম একদিন সমুদ্রে স্নান করে রূপের কুটীরে এলে ঐ শ্লোকের প্রত্যুত্তরজনক একটি শ্লোক চালে গোঁজা পেলাম। শ্লোক পড়ে আমি অতিশয় বিস্ময়ান্বিত হলাম শ্রীরূপ আমার মনের খবর কি করে পেল। তদুত্তরে স্বরূপ দামোদর বললেন-
 
“যাতে এই শ্লোক দেখিলু।
তুমি করিয়াছ কৃপা, তাঁহি জানিল।।
 
-(চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ১৯০)
 
শ্রীরূপের লিখিত বিদগ্ধ নাটকের একটি পত্র হাতে নিয়ে প্রভু পড়ে অতিশয় ভাবাবিষ্ট হয়ে শ্রীরূপের হস্তাক্ষরকে স্তুতি করতে লাগলেন-
 
শ্রীরূপের অক্ষর—যেন মুকুতার পাঁতি।
প্রীত হঞা করেন প্রভু অক্ষরের স্তুতি।।
 
-(চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ১৯৭)
 
ভাবাবিষ্ট হৃদয়ে মহাপ্রভু যখন শ্লোকটি পড়তে ছিলেন শ্রীহরিদাস তা শ্রবণ করে নৃত্য করতে করতে বললেন লাগলেন—
 
কৃষ্ণনামের মহিমা শাস্ত্র-সাধু-মুখে জানি।
নামের মাধুরী ঐছে কাঁহা নাহি শুনি।।
(চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ১।১০১)
 
আমি পূৰ্ব্বে শাস্ত্র ও সাধু মুখে অনেক নামের মহিমা শুনেছি কিন্তু শ্রীরূপের বর্ণনার সমান নাম মহিমা কোথাও শুনি নাই।
 
আর একদিন মহাপ্রভু সার্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্য, শ্রীস্বরূপ দামোদর, শ্রীরামানন্দ রায়, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য, শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীগদাধর পন্ডিত প্রভৃতি সঙ্গে শ্রীহরিদাসের কুটিরে এলেন। শ্রীহরিদাস ঠাকুর শ্রীরূপের সহিত সকলকে বন্দনা করলেন। অনন্তর মহাপ্রভু সকলকে নিয়ে বসে ইষ্টগোষ্ঠী করতে করতে শ্রীরূপের বিদগ্ধমাধব নাটক ও ললিত মাধব নাটকের কথা উত্থাপন করলেন। হরিদাস সকলের কাছে ঐ দুই নাটকের ভূরী ভূরী প্রশংসা করতে লাগলেন। তচ্ছুবনে সার্বভৌম পন্ডিত ও রামানন্দ রায় নাটকদ্বয়ের ভূমিকা প্রভৃতি শুনতে চাইলেন। শ্রীরূপ অতিশয় লজ্জা বশতঃ অবনত শিরে বসে রইলেন। মহাপ্রভু বললেন–লজ্জা কিসের? বৈষ্ণবগণ আদর করে শুনতে চাচ্ছেন যখন, তখন তুমি পাঠ করে শুনাও। প্রভুর আদেশে শ্রীরূপ গ্রন্থের নান্দী শ্লোক প্রভৃতি পাঠ করলেন। তা শুনে ভক্তগণ বলতে লাগলেন—
 
কবিত্ব না হয় এই অমৃতের ধার।
নাটক লক্ষণ সৰ্ব্ব সিদ্ধান্তের সার।।
প্রেম পরিপাটী এই অদ্ভুত বর্ণন।
শুনি চিত্ত কর্ণের হয় আনন্দ ঘূর্ণন।।
-(চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ১।১৯৩-১৯৪)
 
এ ত কবিত্ব নয় যেন অমৃতের ধারা, নাটক লক্ষণ সব সিদ্ধান্তের সারস্বরূপ এত প্রেম পরিপার্টিযুক্ত বর্ণনা, যা শুনলে শ্রোতার কর্ণ মনের আনন্দ বর্দ্ধন করে। এ সমস্ত তোমার কৃপা, তুমি শক্তি না দিলে এমন ভাবে রসের বর্ণনা কে করতে পারে?
 
মহাপ্রভু বললেন তোমরা সকলে এঁকে কৃপা কর। যাতে ব্রজলীলা প্রেমরস বর্ণনা করতে পারে। এঁর বড় ভাই শ্রীসনাতন পৃথিবীতে তাঁর সমান বিজ্ঞ ব্যক্তি দেখিনি। শ্রীরূপ সমস্ত গৌরভক্তগণের পাদপদ্ম বন্দনা ও কৃপা প্রার্থনা করলেন। সকলেই শ্রীরূপের প্রতি কৃপা আশীর্ব্বাদ দিলেন। এইরূপ ভাবে নীলাচলে ভক্ত সঙ্গে শ্রীরূপ দোলযাত্রা পর্য্যন্ত অবস্থান করবার পর মহাপ্রভু ও ভক্তগণ থেকে বিদায় নিয়ে গৌড় দেশাভিমুখে যাত্রা করলেন।
 
শ্রীরূপ গৌড়দেশে ফতেয়াবাদ নিজ গৃহে কিছু আবশ্যকীয় কাৰ্য্য পূর্ণ করে শীঘ্র বৃন্দাবনাভিমুখে যাত্রা করলেন। শ্রীরূপের বৃন্দাবনে পৌঁছানোর পূর্ব্বেই শ্রীসনাতন নীলাচলের দিকে যাত্রা করলেন।
 
শ্রীসনাতন নীলাচলে হরিদাস ঠাকুরের কুটীরে পৌঁছালে শ্রীহরিদাস অতিশয় আদর পূর্ব্বক শ্রীসনাতনকে নিজ সন্নিধানে রাখলেন তথায় মহাপ্রভুর সহ মিলন হল। পথের জলবায়ু দোষে সনাতনের সমগ্র শরীরে কন্ডুরসা (খুজলী) হয়েছিল, মহাপ্রভু জোরপূর্ব্বক আলিঙ্গন দিয়ে কন্ডুরসা তৎক্ষণাৎ নিবৃত্ত করলেন। মহাপ্রভু সনাতনের শরীরকে নিজ শরীর জ্ঞান করতেন। প্রভু কয়েকমাস সনাতন গোস্বামীকে কাছে রেখে অনেক সিদ্ধান্ত শিক্ষা দিয়ে পুনঃ ব্রজে প্রেরণ করলেন।
 
বৃন্দাবনে রূপ সনাতনাদি দ্বারায়।
কৈল অলৌকিক কাৰ্য্য প্রভু গৌররায়।।
 
(ভঃ রঃ ২।৩৬০ )
 
শ্রীরূপ মহাপ্রভুর আজ্ঞা পালনার্থে বৃন্দাবনে আগমন করলেন।মহাপ্রভুর নির্দেশে লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার ও শ্রীবিগ্রহ সেবা প্রকাশ হচ্ছে না দেখে শ্রীরূপ বড়ই চিন্তিত হলেন। বিগ্রহ গোবিন্দ কোথা আছেন বনে বনে গৃহে। গৃহে খোঁজ করতে লাগলেন কিন্তু কোথাও পেলেন না। একদিন যমুনার তটে বসে বিষণ্ণ হৃদয়ে ঐ চিন্তায় বিভোর হয়ে আছেন। এমন সময় একজন ব্রজবাসী শ্রীরূপের সন্নিকটে এলেন, ব্রজবাসী অল্পবয়স্ক সুন্দর মূর্ত্তিধারী, হাসতে হাসতে বললেন— হে স্বামিন্। আপনি এত দুঃখিত কেন? শ্রীরূপ গোপকুমারের মধুর সম্ভাষণ শুনে প্রাণে বড়ই সন্তোষ লাভ করলেন; তারপর শ্রীরূপ ব্রজবাসীর নিকট মহাপ্রভুর আদেশের কথা বললেন। গোপকুমার বললেন স্বামিন্! আমার সঙ্গে চলুন। শ্রীরূপ বললেন- হে গোপকুমার কোথায় যাব। স্বামিন্! যে বিগ্রহ সেবা প্রকাশের জন্য আপনি এত চিন্তাযুক্ত সে বাসনা পূর্ণ হবে। হে গোপকুমার! আমার আশা পূর্ণ হবে? নিশ্চয় হবে। আসুন আমার সঙ্গে। গোপকুমার শ্রীরূপকে নিয়ে এলেন গোমাটিলায়। বললেন স্বামিন্! এ টিলাটিকে প্রতিদিন পূৰ্ব্বাহে এক গাভী এসে দুগ্ধ ধারায় স্নান করিয়ে যান। আপনি আগামী দিবস পূৰ্ব্বাহ্নে এখানে এলে সাক্ষাৎ দর্শন পাবেন। এ গোমাটিলাতেই বিগ্রহ আছেন। এখন যা উচিত তা করুন আমি চললাম। শ্রীরূপ গোমাটিলাটির দিকে দৃষ্টিপাত করছিলেন পিছে ফিরে দেখলেন গোপকুমার অদৃশ্য। ভাবতে লাগলেন—কে এই গোপকুমার? মনে হয় প্রাণের আরাধ্য শ্রীগোবিন্দ। প্রেমে পুলকিত হয়ে শ্রীরূপ সেই গোমাটিলা মহাযোগ পীঠস্থানটি উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। অনন্তর শ্রীরূপ নিজস্থানে ফিরে এলেন, পরদিবস থ্রাতে সেই গোমাটিলা দর্শনে এলেন, দেখলেন, এক অপূর্ব্ব সুরভী তথায় আগমন করে স্বরিত দুগ্ধধারায় টিলাটি স্নান করিয়ে চলে গেলেন শ্রীরূপের সম্পূর্ণ বিশ্বাস হল, ঠাকুর এখানে আছেন। অতঃপর তিনি গোপপল্লীতে গিয়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ গোপগণকে একত্রিত করে এ আখ্যান বললেন। গোপগণ বিস্ময়ান্বিত হয়ে কুদাল কুড়ুলাদি নিয়ে শীঘ্রই গোমাটিলায় এলেন; শ্রীরূপও এলেন। টিলার মাটি সামান্য মাত্র অপসারিত করতেই, কোটি মদন বিনিন্দিত শ্রীগোবিন্দ মূর্ত্তি দর্শন পেলেন। সকলের আর আনন্দের সীমা রইল না, মহানন্দে হরি হরি ধ্বনিতে দশদিক মুখরিত করে তুললেন। পুনঃ শ্রীগোবিন্দ প্রকট হ’লেন। শ্রীরূপ প্রেমাশ্রু স্মরণ নেত্রে শ্রীগোবিন্দ পাদমূলে দন্ডবৎ করে বহু স্তব স্তুতি করতে লাগলেন। শীঘ্র এ বার্তা ব্রজের সমস্ত গোস্বামিদিগের কাছে জানালেন, তচ্ছুবনে গোস্বামিগণ আনন্দ সিন্ধুতে ভাসতে ভাসতে শ্রীগোবিন্দ পাদপদ্মে উপস্থিত হলেন।
 
শ্রীগোবিন্দদেবের প্রকট ধ্বনি হৈতে।
উল্লাসে অসংখ্য লোক ধায় চারি ভিতে।।
মিশাইয়া মনুষ্যে ব্রহ্মাদি দেবগন |
পরম উল্লাসে করে গোবিন্দ দর্শন।।
তিলার্ধেক লোক ভিড় নিবৃত্ত না হয়।
কোথা হৈতে আইসে কেহ লখিতে না পায়।।
গোবিন্দ প্রকট মাত্র শ্রীরূপ গোসাঞি।
ক্ষেত্রে পত্রী পাঠাইলা মহাপ্রভু ঠাঞি।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু পার্ষদ সহিতে।
পত্রী পড়ি আনন্দে না পারে স্থির হৈতে।।
 
—- (ভঃ রঃ ২।৪৩৩-৪৩৭ )
 
নীলাচলে শ্রীগৌরসুন্দর এ শুভ সংবাদ শ্রবণ মাত্রই গোবিন্দের সেবকরূপে শ্রীকাশীশ্বর পন্ডিতকে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিলেন।
 
যে সময় শ্রীরূপ ও সনাতন ব্রজধামে বাস করছিলেন সে সময় ব্রজে ভারতের বিভিন্ন দেশ হতে প্রসিদ্ধ নামাচার্য্য, ভক্তগণ ও সন্ন্যাসিগণ ব্রজধামে বসবাস করছিলেন, গুজরাট দেশের প্রসিদ্ধ বৈষ্ণবাচার্য্য শ্রীমদ বল্লভাচাৰ্য্য সে সময় তিনিও ব্রজধামে বসবাস করছিলেন। দাক্ষিণাত্যের প্রসিদ্ধ ত্রিদন্ডী সন্ন্যাসী। শ্রীপ্রবোধানন্দ সরস্বতী ব্রজ ধামে বাস করছিলেন, বঙ্গদেশের প্রসিদ্ধনামা ভূতপূর্ব্ব গৌড়ীয়েশ্বর শ্রীসুবুদ্ধি রায় তিনিও ব্রজধামে বাস করছিলেন। সেকালে ভারতের প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ পন্ডিত ও সন্ন্যাসিগণ ব্রজধামে আগমন করতেন।
 
শ্রীরূপ সনাতন ব্রজবাসিগণকে সাক্ষাৎ কৃষ্ণ পরিকর জ্ঞান করতেন; তাদের সঙ্গে সেইরূপ ব্যবহার করতেন। ব্রজবাসিগণ শ্রীরূপের ব্যবহারে একেবারেই বিমুগ্ধ। ব্রজবাসিগণ সকলেই শ্রীরূপ সনাতনকে আপন বুদ্ধি করতেন। গৃহের সুখ-দুঃখজনক যাবতীয় ব্যবহারিক কথা তাদের কাছে বলত ও সদুপদেশ চাইতেন। ব্রজগোপীগণ তাঁদের পুত্র প্রায় বোধ করতেন।
 
শ্রীরূপ ও সনাতন ব্রজের বিভিন্নস্থানে থাকতেন। দুই ভাই একসঙ্গেও থাকতেন না। শ্রীসনাতন গোকুল মহাবনে; শ্রীরূপ মথুরায় বা বৃন্দাবনে নন্দঘাটাদিতে থাকতেন। এঁদের সঙ্গী ছিলেন শ্রীলোকনাথ গোস্বামী, শ্রীভট্ট গোস্বামী, শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী, শ্রীল গোপাল ভট্ট গোস্বামী ও শ্রীরঘুনাথ ভট্ট গোস্বামী প্রভৃতি।
 
যেমন শ্রীরূপের কাছে গোবিন্দ দেব প্রকট হলেন, তেমনি শ্রীসনাতনের কাছে মদন গোপাল প্রকট হলেন। শ্রীগোপাল ভট্টের কাছে শ্রীরাধা রমণ ও শ্রীমধু পন্ডিতের কাছে শ্রীগোপীনাথ প্রকটিত হলেন। যুগপৎ বহু ঠাকুর প্রকটিত হলেন। কৃষ্ণ পুনঃব্রজে নিত্য বিহার লীলা করতে লাগলেন।
 
মহাপ্রভুর নির্দেশমত শ্রীরূপ সনাতন গ্রন্থ লিখন কৰ্ম্মে নিযুক্ত আছেন। শ্রীরূপ বিদগ্ধ মাধব নাটক, ললিত মাধব নাটক আরও অন্যান্য গ্রন্থ লেখার পর শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থ আরম্ভ করলেন। এই সময় একদিন শ্রীবল্লভাচাৰ্য্য শ্রীরূপের সন্নিধানে আগমন করলেন, শ্রীরূপ তাঁকে দন্ডবৎ প্রভৃতি করে বসতে আসন দিলেন। দুইজনে কিছুক্ষণ ইষ্টগোষ্ঠী করলেন। অনন্তর শ্রীরূপ ভক্তিরসামৃতের প্রথম বন্দনা শ্লোকটি বল্লভাচার্য্যের হাতে পড়তে দিলেন, তিনি অনেক সময় দেখার পর বললেন— কোন কোন স্থানে কিছু অশুদ্ধি আছে। এ সময় শ্রীরূপের ছোট ভাই শ্রীঅনুপমের পুত্র শ্রীজীব গোস্বামী অল্পদিন হল বঙ্গদেশ থেকে এসেছেন। তিনি শ্রীরূপের অঙ্গে বাতাস করছিলেন। তিনি ন্যায় বেদাত্তাদি শাস্ত্রে পরম পন্ডিত ছিলেন। শ্রীবল্লভাচার্য্যের কথায় তিনি সুখী হলেন না। শ্রীবল্লভাচার্য্য যখন যমুনায় স্নান করতে এলেন তখন শ্রীজীব যমুনার জল আহরণ হলে সে ঘাটে এলেন এবং শ্লোকে কোথায় অশুদ্ধি আছে জিজ্ঞাসা করলেন। শ্রীজীবের পান্ডিত্য প্রতিভা দেখে বল্লভাচার্য্য আশ্চর্যান্বিত হলেন। কিছুক্ষণ জীব বল্লভাচার্য্যের সঙ্গে শ্লোক বিচারের পর জল নিয়ে কুটীরে ফিরে এলেন। অল্পক্ষণ পরে শ্রীবল্লভাচার্য্য এসে শ্রীরূপকে ঐ বালকটির কথা জিজ্ঞাসা করলেন এবং তাঁর বিদ্যা প্রতিভার প্রশংসা করলেন। শ্রীবল্লভাচার্য্য নিজ স্থানে চলে যাবার পর শ্রীজীবকে শ্রীরূপ গোস্বামী আহ্বান করলেন এবং বললেন— আমরা যাঁদের গুরু জ্ঞান করে দন্ডবৎ প্রণামাদি করি তাঁদের তুমি দোষ বিচার করতে চাও ইহা অশিষ্টাচার। আমার হিতের জন্য তিনি আমাকে এমন কথা বলেছিলেন—তুমি ইহা সহন করতে পারলে না। “এ অতি অল্প বাক্য সহিতে নারিলা” তাহে পূর্ব্ব দেশ শীঘ্র করহ গমন। মন স্থির হইলে আসিবা বৃন্দাবন। (ভঃর ৫।১৬৪৩) একথা বলে শ্রীরূপ জীবকে গৃহে যাবার আদেশ দিলেন। শ্রীরূপের আজ্ঞায় শ্রীজীব পূর্ব্বদিকে চলতে মনস্থ করলেন, শ্রীরূপের কুটীর থেকে বাহির হলেন এবং শ্রীনন্দ রাজের কোন এক জীর্ণ মন্দিরে নিরাহারে পড়ে রইলেন এবং দুঃখে ক্রন্দন করতে লাগলেন। গ্রামের লোকজন ঐ সুন্দর বালকের নিরাহারে খেদ করতে দেখে সকলেই চিন্তান্বিত হলেন, এমন সময় তথায় শ্রীসনাতন গোস্বামী এলেন, তার কাছে সকলে এ বালকের কথা বললেন। তিনি তথায় গিয়ে দেখলেন শ্রীজীব পড়ে আছে, নিরাহারে শরীর শুকিয়ে গেছে, তাকে এমত অবস্থায় দেখে অত্যন্ত করুণার্দ্র হৃদয়ে ভূমি থেকে উঠিয়ে স্নেহ করতে লাগলেন এবং সব কথা জিজ্ঞাসা করলেন, শ্রীজীব সব কথা বললেন। শ্রীসনাতন জীবকে অনেক প্রবোধ বাক্য বলে শ্রীরূপের কাছে গেলেন। শ্রীরূপ কথা প্রসঙ্গে জীবের কথা উঠালেন, তখন শ্রীসনাতন জীবের কথা বলেন। তচ্ছুবনে শ্রীরূপ শীঘ্রই জীবকে নিয়ে এলেন।
 
শ্রীজীবের দশা দেখি শ্রীরূপ গোঁসাই।
করিলেন শুশ্রূষা—কৃপার সীমা নাই।।
 
—- (ভঃ রঃ ৫।১৬৬৩)
 
শ্রীরূপ গোস্বামী শ্রীজীবকে অতিশয় আদর পূর্ব্বক শুশ্রূষাদি করতে লাগলেন, শ্রীজীব সুস্থ হলে এবার তাঁর লিখিত সমস্ত গ্রন্থের সংশোধন করবার ভার দিলেন। শ্রীরূপ যেমন শিশু শ্রীজীবকে কঠোর শাসন করেছেন, আবার তেমনি অতিশয় স্নেহ করেছেন। সদ্‌শিষ্যের ও সদ্গুরুর আদর্শ তারা জগতে প্রদর্শন করলেন।
 
শ্রীরূপ ললিত মাধব নাটক রচনার পর উহা শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীকে আস্বাদন করতে দিলেন। ললিত মাধব নাটকখানি বিপ্রলম্ভ রসাত্মক অর্থাৎ প্রবাস বর্ণন। গ্রন্থ পাঠ করে দাস গোস্বামী দিবারাত্র কৃষ্ণ বিরহে ক্রন্দন করতে লাগলেন।
 
গ্রন্থ পাঠে রঘুনাথ দিবানিশি কান্দে।
হইল উম্মাদ দুঃখে——ধৈৰ্য্য নাহি বান্ধে।।
(ভঃ রঃ ৫।৭৬৮)
সে সংবাদ শ্রবণে শ্রীরূপ গোস্বামী চিন্তান্বিত হলেন এবং দানকেলি কৌমুদী নামক এক খন্ড কাব্য রচনা করে শ্রীরঘুনাথ দাসকে দিলেন এবং ললিত মাধব নাটকখানি সংশোধন করবার নাম করে নিয়ে নিলেন। শ্রীদাস গোস্বামী দানকেলি পড়ে অতিশয় সুখ লাভ করলেন।
 
শ্রীরূপ গোস্বামী সনাতন গোস্বামীকে এক সময় পরমান্ন ভোজন করানোর ইচ্ছা করলেন। দুধ ও শর্করা কোথায় পাবেন কোন ঠিক নাই। শ্রীরূপের কুটীরে একদিন শ্রীসনাতন গোস্বামী এলেন, শ্রীরূপ চিন্তা করছেন আজ শ্রীগোস্বামী এলেন কি খেতে দিব? ঠিক এমন সময় এক গোপবালিকা ঘৃত, দুগ্ধ, তন্ডুল ও শর্করা নিয়ে শ্রীরূপকে ডাকতে লাগলেন—বাবা। বাবা! সিধা রাখুন। শ্রীরূপ শীঘ্র কুটীরের বাইরে এলেন, বালিকার হাত থেকে সিধাটি নিয়ে নিলেন। সিধা পাত্রটি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোপ বালিকা অন্তৰ্দ্ধান হলেন, তাঁকে আর না দেখে শ্রীরূপ বিস্ময়ান্বিত হলেন। তাতে পরমান্ন করে গিরিধারীর ভোগ দিয়ে সেই পরমান্ন শ্রীসনাতনকে খাওয়ালেন। তা খেয়ে শ্রীসনাতন গোস্বামী প্রেমাবিষ্ট হলেন এবং শ্রীরূপকে কোথায় এসব সামগ্রী পেলে জিজ্ঞাসা করলেন। শ্রীরূপ সব কথা বললেন তা শুনে শ্রীসনাতন বললেন “ঐছে ভক্ষ্য দ্রব্য চেষ্টা না করিহ আর” (ভঃ রঃ ৫। ১৩২২) শ্রীরূপও খেদ যুক্ত হলেন, হায় হায় আমি শ্রীরাধারাণীকে দুঃখ দিলাম বলে। স্বপ্নে শ্রীরাধারাণী রূপকে দেখা দিয়ে প্রবোধ দিলেন।
 
ভগবান্ ভক্তের জন্য সব কিছু করে থাকেন। তিনি ভক্ত বৎসল। শ্রীগৌরসুন্দর শ্রীরূপ সনাতনের দ্বারা পুনঃ ব্রজধাম ও ব্রজ লীলা যেন জগতে প্রচার করলেন। শ্রীরূপ ও সনাতন মহাপ্রভুর পুত্রোপম স্থানিয়া; নিজ হৃদয়ের কথা তাদের কাছে ব্যক্ত করে তাঁদের দ্বারা নিজাভীষ্ট পূর্ণ করলেন।
 
শ্রীরূপ গোস্বামীকে শ্রীনরোত্তম ঠাকুর মহাশয় বন্দনা করেছেন—
 
শ্রীচৈতন্যমনোভীষ্টং স্থাপিতং যেন ভূতলে।
সোয়ং রূপ কদা মহাং দদাতি স্বপদান্তিকম্।।
 
যিনি পৃথিবীতে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু মনোভীষ্ট পূর্ণ করেছেন, কবে সেই শ্রীরূপ গোস্বামী আমাকে নিজ পদান্তিকে স্থান প্রদান করবেন।
 
শ্রীরূপ গোস্বামী কৃত গ্রন্থাবলী শ্রীহংসদুত কাব্য, শ্রীউদ্ধব সন্দেশ, শ্রীকৃষ্ণজন্ম তিথির বিধি, শ্রীবৃহৎ গণোদ্দেশ দীপিকা, শ্রীলঘুগণোদ্দেশ দীপিকা, স্তবমালা, বিদগ্ধমাধব, ললিত মাধব, দানকেলি কৌমুদী, ভক্তিরসামৃত সিন্ধু, উজ্জ্বল নীলমণি, প্রযুক্তাখ্যাত চন্দ্রিকা, মথুরা মহিমা, পদ্যাবলী, নাটকচন্দিকা ও লঘুভাগবতামৃত প্রভৃতি।
 
শ্রীরূপ গোস্বামিপাদের অপ্রকট তিথি শ্রাবণী শুক্লাদ্বাদশী শকাব্দ ১৪৮৬, খৃষ্টাব্দ ১৫৬৪, গৃহবাস ২২ বছর, ব্রজেবাস ৫১ বছর, প্রকট স্থিতি ৭৩ বছর মতান্তরে ৭৫ বছর।
 
 
 
  • February 20-21, 2022 Puri, Odisha
  • 3rd of July in 2022 Balasore, Odisha
  • August 24-26, 2022 Kurukshetra, Haryana
  • October 7, 2022 Prayagraj, Uttar Pradesh
  • November 30 -1, 2022 Agartala, Tripura
  • December 3-4, 2022 Lalabazar, Assam
  • December 7, 2022 Guwahati, Assam
  • February 17-18, 2023 Baruipur, West Bengal
  • May 27-28, 2023 Patna, Bihar
  • June 26, 2023 Bhubaneswar, Odisha
  • November 26, 2023 Gaya, Bihar
  • February 8, 2024 Delhi
  • February 13-15, 2024 Balighai, Medinipur
  • March 19, 2024 Nabadwip, West Bengal
  • May 27 2024 Florida, USA
  • June 23-24, 2024 Baripada, Odisha
  • June 26-27, 2024 Paradeep, Odisha
  • June 29-30, 2024 Cuttack, Odisha
  • July 14, 2024 Chennai, Tamilnadu
  • August 31 2024 London
  • September 07 2024 London
  • September 08 2024 Berlin (Germany)
  • September 13 2024 Canada
  • September 14-15 2024 Rochester (USA)
  • September 21 2024 New Jersey (USA)
  • Upcoming Events