Disappearance Day of Srila jagabandhu Bhaktiranjan
শ্রীল জগবন্ধু বরিশাল জেলার সুপ্রসিদ্ধ বানরিপাড়া গ্রামে বাঙ্গালা ১২৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্বগ্রামস্থ বিদ্যালয়ে চতুর্দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যা লাভ করিয়া একদিন বানরিপাড়া হইতে আট ক্রোশ দূরে ‘রামসিদ্ধি’ নামক গ্রামে মাসীমাতার গৃহে যাইবার কালে কৰ্ণে ঝাপটা বাতাস লাগায় সেই দিন হইতে জগবন্ধু সাংসারিক গোলমাল শুনিবার উপযোগী কর্ণে কিছু কম শুনিতে থাকেন। সেই সময় হইতে তাঁহার হরিভক্তির অন্তরায়জনক পড়াশুনাও বন্ধ হয়। ১৬ বৎসর বয়সে স্বগ্রামে অতি ক্ষুদ্র একটী মনোহারী দোকান খুলিয়া বসেন; কিন্তু অর্থাভাব-নিবন্ধন একাকী ক্রেতা-বিক্রেতাগণের সহিত সমস্ত ব্যবহার করিতে হওয়ায় এবং শ্রবণশক্তির অপটুতা নিবন্ধন পদে পদে অসুবিধা ভোগ করায় জগবন্ধুর হৃদয়ে বড়ই দুঃখ হয়। সেই দুঃখে তিনি দুইবার অহিফেন সেবন করিয়া দুইবার প্রাণত্যাগের সঙ্কল্প করেন। বৈদ্যগণ অনেক চেষ্টায় জগবন্ধুকে দুইবার রক্ষা করেন। দেশে আত্মীয়-স্বজনের নিকট থাকিলে তাঁহার মরা হইবে না বিবেচনা করিয়া জগবন্ধু মরিবার সঙ্কল্প করির৷ ১৪ চৌদ্দ টাকা মাত্র পাথেয় লইয়া কলিকাতায় পলাইয়া আসেন। কলিকাতায় আসিয় তাঁহার চিত্তের পরিবর্তন হয়। কিন্তু রাজধানী কলিকাতার মৃত স্থানে তাঁহার মত সম্বলহীনের স্থান ও রাত্রিকালের বিশ্রামের শয্যা রাজপথের ফুটপাত, পানীয় ও আচার্য্য গঙ্গার জল ও দুই এক পয়সার ছোলা ভাজা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তথাপি ধৈর্য, তিতিক্ষা ও সর্ব্বোপরি তাঁহার সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি তাঁহাকে সর্ব্বপ্রকার শারীরিক ও মানসিক ক্লেশ হইতে রক্ষা করিয়া কোন এক অদুর, অজানা, মহতো মহীয়ান্ উদ্দেশ্বের জন্য প্রস্তুত করিয়া তুলিতেছিল।
সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে জগবন্ধুর ভাগ্যলক্ষ্মী কলিকাতায় হাসিবার পর হইতে ক্রমশঃই সহাস্তবদন প্রকাশ করিতে থাকিলেন। তিনি এই সময় কাঠের কৌটাতে ‘জে, বি, ডি’ মার্কা কালির প্রচলন করেন। নিজে একরূপ নিরক্ষর হইলেও তাঁহার এই কালি সমগ্র বাঙ্গালাদেশের ছাত্র, শিক্ষক ও পণ্ডিত-সম্প্রদায়ের নিকট তাঁহাকে পরিচিত করাইয়া দেয়। তিনি গঙ্গাতীরে বাস ও নিত্যগঙ্গাস্নান মানসে ১৩২২ সালে বাগবাজার গঙ্গাতট- প্রদেশে একটী ভূমি ক্রয় করিয়া অট্টালিকা নির্মাণ ও অন্যত্র বাগানবাড়ী প্রস্তুত করান। ১৩২৬ সালে জগবন্ধু ভ্রাতৃশ্রাদ্ধোপলক্ষে স্বদেশে গমন করেন এবং তথায় তাঁহার পদদেশ ভগ্ন হওয়ায় ক্ষতস্থান বিষাক্ত হইয়া পড়ে। ডাক্তারগণ একবাক্যে তাঁহার পা কাটিয়া ফেলিতে ব্যবস্থা দেন এবং বলেন যে, পা কাটিয়া না ফেলিলে তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ দুষ্ট বিষে আক্রান্ত হইম। অচিরেই জীবন নষ্ট করিবে। জগবন্ধু জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়া তখন ভগবানকে ডাকিতে থাকেন। সেই সময় একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে শ্রীগৌড়ীরমঠের দুইজন বৈষ্ণবের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়।
শ্রীল জগবন্ধু যে-কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা বৈষ্ণবকুল নহে, কিন্তু তিনি নিজে বৈষ্ণচূড়ামণি হইয়া ছিলেন এবং দৈহিক আত্মীয়-স্বজনকে একমাত্র জগদ্গুরুর পাদপদ্মাশ্রয় করাইবার জন্য চেষ্টিত ছিলেন। তাঁহার কৃপায় শ্রীগৌড়ীয়মঠের উৎসবকালে তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃদ্বয় এবং পরিবারস্থ কয়েক ব্যক্তি শ্রীশ্রীল প্রভুপাদের শ্রীমুখ হইতে শ্রীনাম-দীক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছেন।শ্রীল জগবন্ধু আত্মীয়-স্বজনবৰ্গকে স্বদেশ হইতে কলিকাতায় আনাইয়া শ্রীগৌড়ীয়মঠের উৎসব-দর্শন ও ভগবৎকথা-শ্রবণের সুযোগ দিয়াছিলেন। আত্মীয়-স্বজনের প্রকৃত হিতকামনা এবং আত্মীয়-স্বজনকে প্রকৃতপ্রস্তাবে লাভবান ,জগবন্ধুর মত আর কয়জন করিতে পারেন, জানি না। জগবন্ধু আত্মীয়-স্বজনকে – আত্মীয়-স্বজনকে কেন, জগতের সকল লোককে আত্মীয়জ্ঞানে এমন সম্পত্তি দান করিয়া গিয়াছেন —এমন শ্রেষ্ঠ জিনিষের উত্তরাধিকারী করিয়া গিয়াছেন, যাহার তুলনা কোথায় ও মিলে না।
শ্রীল জগবন্ধু জগতের জন্য যে অমন্দোদয়-দয়দাতব্য চিকিৎসার মহামন্দির নির্মাণ করিয়া গিয়াছেন, কীর্ত্তন দুর্ভিক্ষ-প্রপীড়িত জগদ্বাসীর জন্য যে শ্রচৈতন্যবাণীর অন্নসত্র খুলিয়া গিয়াছেন, ভবরোগে জর্জরিত জগতের লোকের হইতে শ্রীনাম-দীক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছেন। শ্রীল জগবন্ধুর জন্য যে মহৌষধ ও মহাপথ্যের সেবা-সদনের সন্ধান দিয়া গিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার আত্মীয়-স্বজনবর্গ, জগতের যাবতীয় জীব বর্তমানকালে ও অনন্ত ভবিষ্যৎ জীবনে সকল দুঃখ-দৈন হইতে মুক্ত হইয়া পরা শান্তির রাজ্যে বিচরণ করিতে পারিবেন। জগবন্ধুর মত এতবড় দান আত্মীয়-স্বজনকে, পরিবারবর্গকে, সহধম্মিণীকে, সহকর্মীকে বিশ্ববাসীকে বর্তমানযুগে কোন গৃহস্থ ব্যক্তি আর বিতরণ করেন নাই।