Raghunathdas raghunandanthakur gaudiyamission gaudiya

Appearance Day of Srila Raghunath Das and Sri Raghunandan Thakur

শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী ও শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুরের আবির্ভাব তিথি
 
২৬ জানুয়ারী ২০২৩
 
 
 
[[শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী
কৃষ্ণ-পাদপদ্ম গন্ধ যেই জন পায়।
ব্রহ্মলোক আদি সুখ তাঁরে নাহি ভায়।।
 
—(শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত অন্ত্য ৬।১৩৬)
 
শ্রীমদ্ রঘুনাথ দাস ইন্দ্রের ন্যায় ঐশ্বর্য্য ও অপ্সরা-সম পত্নীকে ত্যাগ করে এলেন শ্রীপুরীধামে। শ্রীগৌরসুন্দরের কোটি চন্দ্র সুশীতল শ্রীচরণ-ছায়ায় তাঁর সংসারতপ্ত হৃদয় শীতল হল।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী হুগলী জেলার অন্তর্গত শ্রীকৃষ্ণপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম শ্রীগোবর্দ্ধন দাস। জ্যেঠার নাম— -শ্রীহরিণ্য দাস। তাঁরা কায়স্থ কুলোদ্ভূত সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য ভূম্যধিকারী ছিলেন। তাঁদের রাজপ্রদত্ত উপাধি ছিল ‘মজুমদার’। বিশ লক্ষ মুদ্রা তাঁদের বাৎসরিক আয় ছিল।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস শৈশবে পুরোহিত আচার্য্য শ্রীবলরাম দাসের গৃহে অধ্যয়ন করতেন। শ্রীবলরাম দাস শ্রীহরিদাস ঠাকুরের কৃপা পাত্র ছিলেন। শ্রীহরিদাস ঠাকুর মাঝে মাঝে তাঁর গৃহে শুভাগমন করতেন। এসময় তিনি শ্রীহরিদাস ঠাকুরের কৃপা প্রাপ্তির ও তত্ত্বোপদেশ প্রভৃতি শ্রবণের সৌভাগ্য লাভ করেন।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস হিরণ্য-গোবর্দ্ধনের একমাত্র পুত্র ছিলেন। তাঁর আদর যত্নের সীমা ছিল না। রাজপুত্রের ন্যায় প্রতিপালিত হতেন, সৎসঙ্গ প্রভাবে অল্প বয়সে সংসারের অনিত্যতা উপলব্ধি করতে পারলেন। এ সংসারের ধন, জন, পিতা-মাতা ও স্বজনাদির প্রতি অনাসক্তি ভাবের উদয় হল। ক্রমে ভক্ত পরম্পরায় শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের মহিমা শ্রবণ-পূর্ব্বক তাঁদের শ্রীচরণ দর্শন করবার জন্য উৎকণ্ঠাযুক্ত হয়ে পড়লেন। অতঃপর তিনি যখন শুনলেন শ্রীগৌরসুন্দর সন্ন্যাস গ্রহণ করে নদীয়া থেকে চির বিদায় নিয়ে চলেছেন দেশান্তরে তখন তিনি পাগল প্রায় হয়ে ছুটে এলেন শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈত গৃহে। সেখানে শ্রীগৌরসুন্দরের শ্রীচরণ দর্শন লাভ করলেন। লুটিয়ে পড়লেন শ্রীরঘুনাথ প্রভুর শ্রীচরণ যুগলে। প্রভু দেখে বুঝতে পেরেছেন এ তাঁর নিত্য প্রিয়জন। আনন্দে শ্রীরঘুনাথকে দৃঢ় আলিঙ্গন করলেন। শ্রী রঘুনাথ কাঁদতে কাঁদতে বললেন আপনার সঙ্গে আমিও যাব। তখন প্রভু বললেন—
 
“স্থির হৈয়া ঘরে যাও না হও বাতুল।
ক্রমে ক্রমে পায় লোক ভবসিন্ধু-কূল।।
মর্কট বৈরাগ্য না কর লোক দেখাঞা।
যথাযোগ্য বিষয় ভুঞ্জ অনাসক্ত হঞা।।
অন্তরে নিষ্ঠা কর, বাহ্যে লোক ব্যবহার।
অচিরাৎ কৃষ্ণ তোমায় করিবে উদ্ধার।।
বৃন্দাবন দেখি’ যবে আসিব নীলাচলে।
তবে তুমি আমা-পাশ আসিহ কোন ছলে।।
সে ছল সেকালে কৃষ্ণ স্ফুরাবে তোমারে।
কৃষ্ণকৃপা যাঁরে, তাঁরে কে রাখিতে পারে।।
এত কহি’ মহাপ্রভু তাঁরে বিদায় দিল।
ঘরে আসি’ মহাপ্রভুর শিক্ষা আচরিল।।
 
—(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ১৬।২৩৭-২৪২)
 
প্রভুর—এ আদেশ শুনে শ্রীরঘুনাথ ঘরে ফিরে গেলেন এবং বিষয়ী প্রায় অবস্থান করে সংসারে কার্য করতে লাগলেন। ইহাতে পিতা-মাতা অতিশয় সুখী হলেন। শ্রীরঘুনাথের মন প্রভুর শ্রীচরণে পড়ে আছে। একরাতে পালিয়ে তিনি পুরীর দিকে যাত্রা করলেন। তাঁর পিতা দশ জন লোক পাঠিয়ে তাঁকে ধরে আনলেন। এরূপে যতবার রঘুনাথ পালায় ততবার তাঁকে ধরে আনা হয়। বংশের একমাত্র সন্তান রঘুনাথ। তাঁকে কড়া পাহারা দিয়ে রাখা হল। পিতা-মাতা চিন্তা করলেন রঘুনাথের যদি বিবাহ দেওয়া যায় তবে আর পালাতে পারবে না। রঘুনাথকে অল্প বয়সে বিবাহ দিলেন এক বড় জমিদারের কন্যার সঙ্গে। পত্নী দেখতে অপ্সরার ন্যায়। শ্রীরঘুনাথের মন তাতে কি মোহিত হয়? তাঁর মন কোটি কন্দর্পের দর্পহারী শ্রীহরির পাদপদ্মে।
 
অর্থ হলে শত্রুও হয়। হিরণ্য-গোবর্দ্ধনের জমিদারীর মোট আয় বিশ লক্ষ। নবাবকে দিতে হত বার লক্ষ। এ ঐশ্বর্য্য দেখে মুসলমান চৌধুরীর সহ্য হল না। চৌধুরী নবাবের সেরেস্তায় গিয়ে মিথ্যা নালিশ করল। হুজুর ঘরের খবর রাখেন না? হিরণ্য-গোবর্দ্ধনের জমিদারীতে বর্তমান আয় বিশ লক্ষ কিন্তু আপনাকে দিচ্ছে বার লক্ষ মাত্র। আদায় যদি বেশী হয় আপনাদের করও তাকে বেশী দিতে হবে। নবাব বললেন, তুমি ঠিক বলছ, তলব কর। রাজাকে কম দিয়ে নিজে বেশী নিচ্ছে এ কেমনতর কথা? হিরণ্য-গোবর্দ্ধনকে বন্দী কর। হিরণ্য-গোবর্দ্ধন একথা শুনে পালালেন। নবাবের সৈন্য বাড়ী ঘিরল। তাঁদের না পেয়ে শ্রীরঘুনাথ দাসকে বেঁধে নিয়ে গেল। তাঁকে কারাগারে রাখল। উজির ধমক দিয়ে বলে—তোমার বাপ জ্যেঠা কোথায়?
 
আমি জানি না।
 
তুমি জান, কিন্তু মিথ্যা বলছ।
 
আমি কি করে জানব তাঁরা কোথায় গেছেন? উজির তখন খুব তর্জ্জন গর্জ্জন করতে করতে মারবার ভয় দেখাতে লাগলেন। শ্রীরঘুনাথ দাস কিন্তু নির্ভীক। উজির রঘুনাথের সৌম্যমূর্ত্তি ও প্রসন্ন বদন দেখে ভুলে গেলেন।
 
“মারিতে আসিয়া যদি দেখে রঘুনাথ। মন ফিরে যায় তবে না পারে মারিতে।।” –(চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৬।২২) মুসলমান উজির মনে মনে ভয় পেলেন। কায়স্থ জাতি। তাদের বুদ্ধি-বিদ্যার কাছে সকলে নত হয়। শ্রীরঘুনাথের মিষ্ট বাক্যে ক্রমে উজিরের মন নরম হল, বলতে লাগলেন— তোমার বাপ-জ্যেঠা এত টাকা পাচ্ছে, আমাদের বেশী দিচ্ছে না। শ্রীরঘুনাথ বললেন আমার বাপ জ্যেঠা ত আপনার ভায়ের মত। ভায়ে ভায়ে ঝগড়া হয় আবার সহজে মিলনও হয়। আমি যেমন পিতার পুত্র, তেমনি আপনারও পুত্র। আমি আপনার পাল্য, আপনি আমার পালক। পালক হয়ে পাল্যকে তাড়ন করা উচিত নয়। আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, জিন্দাপীরের ন্যায় ব্যক্তি। অধিক আর কি বলব? এ কথা শুনে ম্লেচ্ছ অধিকারীর মন আর্দ্র হল। দাড়ি বেয়ে অশ্রু পড়তে লাগল। বললেন—আজ থেকে তুমি আমার পুত্র। অধিকারী এ কথা বলে শ্রীরঘুনাথকে মুক্ত করে দিলেন। শ্রীরঘুনাথ ঘরে ফিরে এলেন এবং বাপ-জ্যেঠাকে বলে নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করালেন। মীমাংসা সহজেই হয়ে গেল। শ্রীরঘুনাথকে সকলে প্রশংসা করতে লাগলেন। শ্রীরঘুনাথ দাসের এক বছর এভাবে কেটে গেল। শ্রীরঘুনাথ দাস আবার সংসার ছেড়ে পালাবার জন্য উদ্যত হলেন। পিতা জানতে পেরে কড়া পাহারা দিয়ে রাখতে লাগলেন। শ্রীরঘুনাথ নিরুপায় হলেন। ভাবতে লাগলেন কেন শ্রীগৌরসুন্দর নিজ পাদপদ্মে আমাকে স্থান দিচ্ছেন না? তাঁর জননী বলতে লাগলেন—পুত্র পাগল হয়েছে, বেঁধে রাখ। পিতা বললেন— বেঁধে রাখলেই বা কি হবে?
 
ইন্দ্রসম ঐশ্বর্য্য, স্ত্রী অপ্সরা-সম।
এ সব বান্ধিতে নারিলেক যার মন।।
দড়ির বন্ধনে তাঁরে রাখিবা কেমতে?
জন্মদাতা পিতা নারে ‘প্রারব্ধ’ খণ্ডাইতে।।
চৈতন্যচন্দ্রের কৃপা হঞাছে ইহারে।
চৈতন্য প্রভুর ‘বাতুল’ কে রাখিতে পারে?
 
― (চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৬৩৯-৪১ )
 
গোবর্দ্ধন দাস একথা বলে পত্নীকে প্রবোধ দিলেন। একদিন শ্রীরঘুনাথ চিন্তা করলেন, করুণাময় শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর কৃপা ছাড়া বোধ হয় শ্রীগৌরসুন্দরের কৃপা পাওয়া যাবে না। আগে তাঁর শ্রীচরণ একবার দর্শন করি। শ্রীরঘুনাথ একদিন বাপ-মাকে বললেন—আমি পানিহাটিতে শ্রীরাঘব পণ্ডিতের ঘরে কীর্ত্তন মহোৎসব দর্শন করতে যাব। এবার বাপ-মা বাধা দিলেন না, যাবার অনুমতি দিলেন। তাঁর নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে কয়েকজন ভৃত্য দিলেন ও অর্থ-কড়ি দিলেন।
 
পানিহাটি শ্রীনিত্যানন্দ প্রভাবে আনন্দময়। গৃহে-গৃহে শ্রীহরি সংকীর্ত্তন মহোৎসব। শ্রীরঘুনাথ দাস পানিহাটিতে এসে পরম সুখী হলেন। ক্রমে তিনি গঙ্গাতটে যেখানে ভক্ত সঙ্গে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসে আছেন সে স্থানে উপস্থিত হলেন। দূর থেকে শ্রীরঘুনাথ দেখলেন, গঙ্গাতট আলোকিত করে একটা বৃক্ষমূলে ভক্তগণ সঙ্গে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসে আছেন। শ্রীরঘুনাথ দেখেই দূর থেকে সাষ্টাঙ্গে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন।
 
শ্রীহিরণ্য-গোবর্দ্ধন প্রসিদ্ধ জমিদার। সর্ব্বত্র তাঁদের খ্যাতি। তাঁরা ব্রাহ্মণ- বৈষ্ণবের সেবা-পরায়ণ। শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য ও শ্রীজগন্নাথ মিশ্র প্রভৃতি নবদ্বীপ শান্তিপুরাদি নিবাসী পণ্ডিতগণেকে বহু অর্থ-কড়ি দানাদি করে সাহায্য করেন। তাঁদের পুত্র শ্রীরঘুনাথ দাস এসেছেন সর্ব্বত্র সাড়া পড়ে গেল। শ্রীরঘুনাথ দাসের কথা ভক্তগণ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীচরণে নিবেদন করলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু রঘুনাথ দাসের নাম শুনেই বললেন – রে রে চোরা ! আয়, তোকে আজ দণ্ড দিব। ভক্তগণ শ্রীরঘুনাথ দাসকে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীচরণে নিয়ে এলেন। শ্রীচরণ মূলে রঘুনাথ দাস লুটিয়ে পড়লেন। করুণাময় নিত্যানন্দ অভয় চরণ তাঁর শিরে ধারণ করলেন, শ্রীরঘুনাথের সেই শ্রীচরণ-স্পর্শ মাত্র যেন সব বন্ধন কেটে গেল। সহাস্য বদনে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বলতে লাগলেন তুমি আমার ভক্তগণকে চিড়া-দধি ভোজন করাও। এ তোমার দণ্ড। এ কথা শুনে শ্রীরঘুনাথের আনন্দের সীমা রইল না। তখনই দই-চিড়া মহোৎসবের আয়োজন আরম্ভ হল। চারিদিকে লোক প্রেরণ করে দই-চিড়া আনতে লাগলেন। উৎসবের নাম শুনে পসারিগণ দই চিড়া পাকা কলাদি নিয়ে পসার বসাল। শ্রীরঘুনাথ দাস মুল্য দিয়ে সমস্ত দ্রব্য খরিদপূর্ব্বক নিতে লাগলেন। এদিকে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে ভক্তগণ সজ্জন ব্রাহ্মণগণ আসতে লাগলেন। বড় বড় মৃৎকুত্তিকার মধ্যে পাঁচ-সাত জন ব্রাহ্মণ চিড়া ভিজাতে লাগলেন। একজন ভক্ত শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্য চিড়া ভিজাতে লাগলেন। অৰ্দ্ধেক চিড়া দই কলা দিয়ে, আর অৰ্দ্ধেক ঘন দুধ, চিনি চাঁপা কলা দিয়ে মাখতে লাগলেন। অনন্তর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বৃক্ষমূলে পিণ্ডার উপর উপবেশন করলেন। তখন তাঁর সামনে চিড়া-দইপূর্ণ সাতটী মৃৎকুণ্ডিকা রাখা হল। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর চারি পার্শ্বে রামদাস, সুন্দরানন্দ দাস, গদাধর, শ্রীমুরারি, কমলাকর, শ্রীপুরন্দর, ধনঞ্জয়, শ্রীজগদীশ, শ্রীপরমেশ্বর দাস, মহেশ পণ্ডিত, শ্রীগৌরীদাস, হোড়কৃষ্ণ দাস, ও উদ্ধারণ দত্ত ঠাকুর প্রভৃতি ভক্তগণ উপবেশন করলেন। নীচে বসলেন অভ্যাগত পণ্ডিত ভট্টাচাৰ্য্যগণ। গঙ্গাতটে স্থান না পেয়ে কেহ কেহ গঙ্গায় নেমে চিড়া-দই নিচ্ছেন। সে দিন শ্রীরাঘব পণ্ডিতের ঘরে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর আমন্ত্রণ ছিল। বিলম্ব দেখে শ্রীরাঘব পণ্ডিত স্বয়ং এলেন। দেখলেন—বিরাট মহোৎসবের ঘটা, ঠিক যেন সখাগণ সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বন্য-ভোজন লীলা। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বললেন—রাঘব ! তোমার ঘরের প্রসাদ রাত্রে গ্রহণ করব। এখন রঘুনাথ দাসের উৎসব হউক। তুমিও বস। এ বলে তাঁকে নিকটে বসালেন এবং দই চিড়া ও দুধ-চিড়াপূর্ণ দুটা মৃৎকুণ্ডিকা এনে দিলেন। সকলের চিড়া দেওয়া শেষ হলে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু মহাপ্রভুর ধ্যানে বসলেন। অন্তর্যামী শ্রীগৌরসুন্দর তাঁর ধ্যানে জানতে পেরে তথায় এলেন।
 
“মহাপ্রভু আইল দেখি নিতাই উঠিলা। তাঁরে লঞা সবার চিড়া দেখিতে লাগিলা।।” (চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ)
 
শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু হাস্য করতে করতে সবাকার হোলনা থেকে এক এক গ্রাস নিয়ে মহাপ্রভুর মুখে দিতে লাগলেন। এ রূপ লীলাপূৰ্ব্বক শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কিছুক্ষণ ভ্রমণ করতে লাগলেন। তারপর নিজ আসনে তিনি বসলেন ও ভক্তগণকে ভোজন করতে আদেশ দিলেন। মহা ‘হরি’ ‘হরি’ ধ্বনিতে ভক্তগণ দশদিক মুখরিত করতে লাগলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু ভোজন করছেন না দেখে কেহই ভোজন করছেন না। ভক্তগণ অগ্রে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে ভোজন করবার প্রার্থনা জানালেন, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু ভোজন আরম্ভ করলেন। সমস্ত ভক্তগণ আনন্দভরে ভোজন করতে লাগলেন। সকলের পুলিন ভোজনের কথা মনে হতে লাগল। ভোজন শেষ হলে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু শ্রীরঘুনাথ দাসকে ডেকে অবশেষ প্রদান করলেন। এবার শ্রীরঘুনাথ দাস শ্রীনিত্যানন্দ কৃপা-প্রসাদে শ্রীগৌরসুন্দরের কৃপা পাবেন এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন। তারপর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তাঁর শিরে হাত দিয়ে আশীর্ব্বাদ করলেন— “অচিরাৎ প্রভু তোমাকে কৃপা করবেন।”
 
অতঃপর শ্রীরঘুনাথ দাস প্রভু ভক্তগণের সেবার্থে কিছু কিছু মুদ্ৰাদি দিয়ে গৃহে যাবার জন্য বিদায় চাইলেন। ভক্তগণ সকলেই কৃপা আশীর্ব্বাদ করলেন। শ্রীরঘুনাথ এ রূপে গৃহে ফিরে এলেন। শ্রীরঘুনাথকে দেখে পিতা মাতা সুখী হলেন। শ্রীরঘুনাথ বাহ্য ব্যবহার ঠিক মত করতে লাগলেন। এবার বাহিরে দুর্গামণ্ডপে শয়ন করতে লাগলেন। পাহারাদারগণ তাঁকে ঠিক ঠিক পাহারা দিতে লাগল।
 
একদিন প্রায় চার দণ্ড রাত থাকতে তাঁদের গুরু শ্রীযদুনন্দন আচাৰ্য্য রঘুনাথের গৃহে এলেন। তিনি এসে দাঁড়াতেই শ্রীরঘুনাথ শয্যা থেকে উঠে দণ্ডবৎ করলেন ও এত রাত্রে আসবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন—বিগ্রহ সেবকটি সেবা ত্যাগ করে গৃহে চলে গেছে, তুমি তাকে বুঝিয়ে পুনর্ব্বার সেবায় নিযুক্ত করার ব্যবস্থা কর। শ্রীরঘুনাথ দাস বললেন— চলুন, আমি তাকে বুঝিয়ে বিগ্রহের সেবায় পুনঃ নিযুক্ত করে দিব। এ বলে শ্রীরঘুনাথ দাস শ্রীযদুনন্দন আচার্য্যের সঙ্গে চললেন। পাহারাদারগণ ঘুমন্ত অবস্থায় মনে করল রঘুনাথ গুরুদেবের সঙ্গে তার গৃহে যাচ্ছে। শ্রীরঘুনাথ কিছু দূর শ্রীগুরুদেবের সঙ্গে গিয়ে বললেন—গুরুদেব ! আপনি গৃহে ফিরে যান আমি সেবকটিকে বুঝিয়ে শীঘ্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। শ্রীযদুনন্দন আচার্য্য বললেন—আচ্ছা তুমি যাও। শ্রীরঘুনাথ দাস ভাবলেন প্রভু ভাল সময় উপস্থিত করেছেন। কৌশলে তিনি শ্রীগুরুদেবের আদেশ নিয়ে শ্রীপুরী ধামের দিকে যাত্রা করলেন। গ্রামের প্রসিদ্ধ পথ ছেড়ে বন পথে চলতে লাগলেন। এক দিনে পনর ক্রোশ রাস্তা হেঁটে সন্ধ্যার সময় এক গোপ পল্লীতে উপস্থিত হলেন এবং গোয়ালাদের থেকে কিছু দুধ মেগে পান করে রাত কাটালেন। সকাল বেলা আবার চলতে লাগলেন।
 
এদিকে সকাল বেলা শ্রীরঘুনাথের খোঁজ আরম্ভ হল। গোবর্দ্ধন দাস তাড়াতাড়ি গুরু শ্রীযদুনন্দন আচার্য্যের গৃহে এলেন। রঘুনাথ কোথায়? যদুনন্দন দাস সব ঘটনা বললেন। এবার গোবর্দ্ধন দাস বুঝতে পারলেন, রঘুনাথ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে। গৃহে ক্রন্দনের রোল উঠল। তৎক্ষণাৎ চারিদিকে অনুসন্ধানের জন্য লোকজন ছুটল। বহু অনুসন্ধান করেও রঘুনাথকে পাওয়া গেল না। গোবর্দ্ধন দাস গৌড়ীয় ভক্তদের সঙ্গে নীলাচলের দিকে রঘুনাথ যাচ্ছে কিনা সন্ধান নেওয়ার জন্য কয়েকজন লোককে পত্র লিখে শ্রীশিবানন্দ সেনের নিকট প্রেরণ করলেন। হিরণ্য-গোবর্দ্ধনের লোক শ্রীশিবানন্দ সেনকে নীলাচলের পথে গিয়ে ধরল এবং সব কথা বলল ও পত্র দিল। শ্রীশিবানন্দ সেন সব কথা বুঝলে পারলেন। তিনি জানালেন তাঁদের সঙ্গে রঘুনাথ আসে। নাই হয় ত অন্য পথে নীলাচলে গিয়েছে লোক এসে হিরণ্য-গোবর্দ্ধন দাসকে এ সংবাদ জানাল।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস ছত্রভোগের পথে পুরীর দিকে চললেন।
 
ভক্ষণ অপেক্ষা নাহি, সমস্ত দিবস গমন।
ক্ষুধা নাহি বাধে, চৈতন্য-চরণ প্রাপ্ত্যে মন।।
কভু চর্ব্বন, কভু রন্ধন, দুগ্ধপান।
যবে যেই মিলে, তাহে রাখে নিজ প্রাণ।।
—(চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৬।১৮৬-১৮৭)
 
এ ভাবে এক মাসের পথ বার দিনে অতিক্রম করে পুরীতে পৌঁছলেন। এর মধ্যে তিন দিন মাত্র ভোজন করেছিলেন। পুরীতে পৌঁছে লোক-পরম্পরা জেনে মহাপ্রভুর নিকট এলেন। দূর থেকে শ্রীরঘুনাথ দাস প্রভুকে বন্দনা করতেই মুকুন্দ দেখলেন ও বুঝতে পারলেন। প্রভুকে বললেন—রঘুনাথ দাস দণ্ডবৎ করছে। ইহা শুনে প্রভু বললেন, রঘুনাথ ! রঘুনাথ ! এস, এস। রঘুনাথ নম্রভাবে নিকটে আসলেই প্রভু উঠে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। প্রভুর স্নেহ-আলিঙ্গনে রঘুনাথের সমস্ত দুঃখ দূর হল। আনন্দে তাঁর দু-নয়ন দিয়ে প্রেম অশ্রু পড়তে লাগল। প্রভু বললেন— রঘুনাথ! কৃষ্ণ বড় করুণাময়। তোমাকে বিষয় বিষ্ঠাগর্ভ থেকে উদ্ধার করেছেন।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস বললেন—প্রভো ! আমি কৃষ্ণ কৃপা জানি না। তোমার কৃপায় উদ্ধার হয়েছি এ মাত্র জানি। তখন প্রভু হাস্য করতে করতে বললেন- তোমার বাপ জ্যেঠা বিষয়টাকে সুখ বলে মনে করে। ব্রাহ্মণের সেবা করে ও পুণ্য করে। অভিমান করে আমি বড় দানী। তারা শুদ্ধ বৈষ্ণব নন, বৈষ্ণবপ্রায়। বিষয় বাড়ান তাদের যাবতীয় সৎকার্য্যের মূলে। বিষয়বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া যায় কিরূপে তার সন্ধান রাখে না। বিষয়ের এমন স্বভাব মনুষ্যের মন্দ প্রবৃত্তি এনে দেবেই। রঘুনাথ ! এমন বিষয় থেকে তুমি মুক্তি লাভ করেছ। তোমার বাপ-জ্যেঠাকে আমার মাতামহ শ্রীনীলাম্বর চক্রবর্ত্তী ভায়ের মত দেখেন। সে সম্বন্ধে তোমার বাপ জ্যেঠা আমার আজা হন। তাই পরিহাস করে তোমাকে এ সব কথা বললাম।
 
অতঃপর মহাপ্রভু শ্রীস্বরূপ-দামোদরকে সম্বোধন করে বললেন রঘুনাথকে তোমায় দিলাম। পুত্র বা ভৃত্য জ্ঞানে একে অঙ্গীকার কর। ‘স্বরূপের রঘু’ বলে এর খ্যাতি হবে। তারপর প্রভু তাঁকে শীঘ্র সমুদ্র-স্নান ও জগন্নাথ দর্শন করে এসে প্রসাদ গ্রহণ করতে বললেন।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস সমুদ্র স্নান ও জগন্নাথ দর্শন করে এলে শ্রীগোবিন্দ প্রভুর ভোজন অবশেষ পাত্রটি তাঁকে দিলেন। শ্রীরঘুনাথ মহানন্দে প্রভুর পেয়ে সমস্ত ক্লেশ থেকে মুক্ত হলেন। নিজেকে ধন্যাতিধন্য মনে করলেন। পাঁচ দিন শ্রীরঘুনাথ প্রভুর নিকট ভোজন করলেন। অনন্তর সারা দিন ভজন করতেন। রাত্রে সিংহদ্বারে দাঁড়িয়ে মেগে খেতেন। অন্তর্যামী প্রভু তা জানতে পেরে একদিন সেবক গোবিন্দকে ভঙ্গী করে জিজ্ঞাসা করলেন রঘুনাথ প্রসাদ নিচ্ছে কি? গোবিন্দ বললেন—এখানে প্রসাদ নেওয়া বন্ধ করে রাত্রে সিংহদ্বারে মেগে খায়। প্রভু তা শুনে বললেন—
 
বৈরাগী করিবে সদা নাম-সংকীৰ্ত্তন।
মাগিয়া খাঞা করে জীবন রক্ষণ।।
বৈরাগী হঞা যেবা করে পরাপেক্ষা।
কার্যসিদ্ধি নহে, কৃষ্ণ করেন উপেক্ষা।।
বৈরাগী হঞা করে জিহ্বার লালস।
পরমার্থ যায়, আর হয় রসের বশ।।
বৈরাগীর কৃত্য-সদা নাম-সংকীৰ্ত্তন।
শাক পত্র ফল মূলে উদর ভরণ।।
জিহ্বার লালসে যেই ইতি উতি ধায়।
শিশ্নোদরপরায়ণ কৃষ্ণ নাহি পায়।।
 
-~(চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৬।২২৩-২২৭ )
 
প্রভু জগৎকে শিক্ষা দিবার জন্য শ্রীরঘুনাথ দাসকে লক্ষ্য করে এ সমস্ত কথা বললেন। শ্রীরঘুনাথ দাস বাস্তবতঃ সৰ্ব্বত্যাগী নিষ্কিঞ্চন বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস সামনা সামনি প্রভুর কাছে কোন কথা জিজ্ঞাসা করতেন না। শ্রীস্বরূপ গোস্বামী দ্বারা বা অন্য কারও দ্বারা জিজ্ঞাসা করতেন। একদিন শ্রীস্বরূপ গোস্বামীর দ্বারা কর্তব্যাকর্তব্য সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন। প্রভু তার উত্তরে বলতে লাগলেন–
 
গ্রাম্যকথা না শুনিবে, গ্রাম্যকথা না কহিবে।
ভাল না খাইবে আর ভাল না পরিবে।।
অমানী মানদ হঞা কৃষ্ণনাম সদা ল’বে।
ব্রজে রাধাকৃষ্ণ-সেবা মানসে করিবে।।
 
–(চৈঃ চঃঅন্তাঃ ৬।২৩৬-২৩৭)
 
প্রভুর শ্রীমুখ থেকে শ্রীরঘুনাথ দাস এই অমৃতময় উপদেশ শুনে প্রভুকে সাষ্টাঙ্গ বন্দনা করলেন। প্রভু শ্রীরঘুনাথ দাসকে স্নেহে আলিঙ্গন করলেন।
 
একদিন শিবানন্দ সেন শ্রীরঘুনাথ দাসের কাছে তাঁর পিতার যাবতীয় চেষ্টার কথা বললেন। রথযাত্রা উৎসব শেষ হলে গৌড়দেশের ভক্তগণ মহাপ্রভুর অনুজ্ঞা নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। শ্রীগোবর্দ্ধন দাস মজুমদার প্রেরিত লোক শ্রীশিবানন্দ সেনের গৃহে এসে তাঁর নিকট শ্রীরঘুনাথের সম্বন্ধে যাবতীয় কথা শ্রবণ করলেন। অতঃপর শ্রীগোবর্দ্ধনদাস শ্রীরঘুনাথের নিকট একজন ব্রাহ্মণ ও এক ভৃত্য এবং চারশত মুদ্রা প্রেরণ করলেন। শ্রীরঘুনাথ সে-অর্থ স্বয়ং গ্রহণ না করে প্রভুর সেবার জন্য কিছু কিছু গ্রহণ করতে লাগলেন। মাসে দুদিন মহাপ্রভুকে আমন্ত্রণ করে ভোজন করাতে লাগলেন। দু বছর এভাবে কেটে গেল। তারপর প্রভুর নিমন্ত্রণ বন্ধ করে দিলেন। একদিন শ্রীস্বরূপ দামোদর গোস্বামী শ্রীরঘুনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন প্রভুর ভোজন আমন্ত্রণ বন্ধ করলে কেন? শ্রীরঘুনাথ দাস বললেন—বিষয়ীর অন্নে প্রভুর মন প্রসন্ন হয় না। আমার অনুরোধে তিনি নিমন্ত্রণ স্বীকার করেন মাত্র। এ নিমন্ত্রণে মাত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কিছু নাই। প্রভুএ কথা শুনে সুখী হয়ে বললেন—
 
বিষয়ীর অন্ন খাইলে মলিন হয় মন।
মলিন মন হৈলে নহে কৃষ্ণের স্মরণ।।
 
—(চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৬।২৭৮)
 
আমি রঘুনাথের আগ্রহে কেবল আমন্ত্রণ স্বীকার করতাম।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস কিছুদিন সিংহদ্বারে মেগে খাওয়ার পর ছত্রে গিয়ে মেগে খেতে লাগলেন। অন্তৰ্য্যামী প্রভু তা বুঝতে পেরে ছলপূৰ্ব্বক সেবককে জিজ্ঞাসা করলেন এখন রঘুনাথ কি সিংহদ্বারে মেগে খায়?
সেবক বললেন— রঘুনাথ মেগে খাওয়া বন্ধ করে ছত্রে গিয়ে মেগে খায়। তা শুনে প্রভু বললেন—
 
“প্রভু কৈল, ছাড়িল সিংহদ্বার।
সিংহদ্বারে ভিক্ষা বৃত্তি – বেশ্যার আচার।।”
 
– (চৈঃ চঃ ৬।২৮৪)
 
শ্রীরঘুনাথের আচরণে প্রভু পরম সুখী হলেন। অন্য একদিবস শ্রীরঘুনাথকে ডেকে প্রভু গোবর্দ্ধন শিলা ও গুঞ্জামালা দিয়ে বললেন–
 
“প্রভু কহে ,—–“এই শিলা কৃষ্ণের বিগ্রহ।
ইহার সেবা কর তুমি করিয়া আগ্রহ।।”
 
-(চৈঃ চঃ ৬।২৯৪ )
 
এই গোবৰ্দ্ধন শিলাটী প্রভু সাক্ষাৎ কৃষ্ণ জ্ঞানে কখন হৃদয়ে ধারণ, কখন অঙ্গ আঘ্রাণ করতেন, কখন বা নেত্র জলে স্নান করাতেন। তিন বছর প্রভু এ শিলা সেবার পর প্রিয় শ্রীরঘুনাথ দাসকে অর্পন করলেন। পূৰ্ব্বে শ্রীশঙ্করানন্দ সরস্বতী নামক একজন সন্ন্যাসী বৃন্দাবন ধাম থেকে এ শিলা ও গুপ্তামালা নিয়ে প্রভুকে বহু আগ্রহ করে ভেট দিয়েছিলেন। প্রভু স্মরণের সময় গুঞ্জামালাটি কণ্ঠে ধারণ করতেন।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস জল তুলসী দিয়ে সেই গোবর্দ্ধন শিলার সাত্ত্বিক সেবা করতে লাগলেন। শ্রীস্বরূপ-দামোদর প্রভু জলের জন্য একটী কুঁজা দিলেন। শ্রীরঘুনাথ কিছুদিন এরূপ সাত্ত্বিক সেবা করতে থাকলে, একদিন স্বরূপ দামোদর প্রভু বললেন- রঘুনাথ গিরিধারীকে কমপক্ষে আটটি কড়ির খাজা সন্দেশ প্রদান কর। সেদিন থেকে শ্রীরঘুনাথ আট কড়ির খাজা সন্দেশ গিরিধারীকে ভোগ দিতে লাগলেন। তিনি খুব নিয়মের সহিত ভজন করতেন। সাড়ে সাত প্রহর ভজন-কীৰ্ত্তনে অতিবাহিত করতেন। চার দণ্ড মাত্র আহারের জন্য দিতেন। জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করতেন। গাত্র-আবরণ ছিল এক ছেঁড়া কাথা।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী কিছুদিন ছত্রে মেগে খাওয়ার পর তা বন্ধ করে বাজারে পরিত্যক্ত পচা অন্ন-প্রসাদ এনে জলে ধুয়ে লবণ দিয়ে সে প্রসাদ গ্রহণ করতে লাগলেন। একদিন শ্রীস্বরূপ দামোদর প্রভু শ্রীরঘুনাথের ভজন কুটীরে এসে সেই প্রসাদ এক মুষ্টি মেগে খেলেন। খুব তৃপ্তি পেলেন। তিনি মহাপ্রভুর কাছে এলেন এবং প্রভুর কাছে সে প্রসাদের স্বাদের কথা বললেন। তা শুনে রঘুনাথের সে প্রসাদের প্রতি প্রভুর মনে বড় লোভ হল। একদিন গোপনে প্রভু শ্রীরঘুনাথের ভজন-কুটীরে এসে সে-অন্ন প্রসাদ গ্রহণ করতে লাগলেন। শ্রীরঘুনাথ দেখে হায় হায় করে ছুটে এলেন এবং প্রভুর হাত থেকে সে প্রসাদ কেড়ে নিয়ে বললেন- হে প্রভো ! এ সব আপনার খাবার যোগ্য নয়। প্রভু বললেন—“খাসা বস্তু খাও সরে মোরে না দেহ কেনে?” (চৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৬।৩২২) প্রভুর শ্রীচরণে পড়ে শ্রীরঘুনাথ কাঁদতে লাগলেন। প্রভু বার বার শ্রীরঘুনাথকে আলিঙ্গন করতে লাগলেন। শ্রীরঘুনাথের বৈরাগ্য দেখে প্রভু অন্তরে বড়ই সুখ লাভ করলেন।
 
 
শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী প্রভুর করুণা-ধারায় নিত্য স্নান করতে করতে যেন পরম সুখে প্রভুর শ্রীচরণে কালাতিপাত করতে লাগলেন। অনন্তর অকস্মাৎ পৃথিবী অন্ধকার করে শ্রীগৌরসুন্দর অন্তর্ধান হলেন। প্রভুর বিচ্ছেদে ভক্তগণের হৃদয়ে দারুণ বিরহ-অনল জ্বলে উঠল। শ্রীরঘুনাথ দাস সে বিরহ-অনলে দগ্ধ হতে হতে প্রভুর নির্দেশ মাথায় করে এলেন শ্রীব্রজধামে। পূর্বেই শ্রীসনাতন, শ্রীরূপ, শ্রীগোপাল ভট্ট, শ্রীরঘুনাথ ভট্ট, শ্রীলোকনাথ, শ্রীকাশীশ্বর ও শ্রীভূগর্ভ গোস্বামী প্রভৃতি শ্রীবৃন্দাবন ধামে প্রভুর নির্দেশমত অবস্থান করছিলেন। প্রভুর অন্তর্ধানে সকলে বিরহ-দাবানলে দগ্ধীভূত হতে লাগলেন। তথাপি বহু কষ্টে ধৈর্য ধারণ পূর্ব্বক সকলে সমবেতভাবে শ্রীমন্মহাপ্রভুর শিক্ষা সিদ্ধান্ত বাণী প্রচারে ব্রতী হয়ে গ্রন্থাদি লিখতে লাগলেন। এঁরা সকলে মহান পণ্ডিত ছিলেন। এঁদের গুণ-মহিমাতে আকৃষ্ট হয়ে তদানীন্তন ভারতের বড় বড় সাহিত্যিক কবি ও রাজন্যবর্গ ব্রজধামে আগমন করতে লাগলেন। ব্রজধামে এক মহান সুবর্ণ-যুগের উদয় হল। ঠিক এ সময় পশ্চিম ভারতের একজন মহান আচার্য্য শ্রীবল্লভাচার্য্য বৃন্দাবনে আগমন করলেন।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী শ্রীরাধাকুণ্ডে বাস করতেন। তখন শ্রীরাধাকুণ্ড অসংস্কার অবস্থায় ছিল। শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী কুগুটি সুন্দরভাবে সংস্কারের কথা মাঝে মাঝে চিন্তা করতেন। এক সময় এক বড় শেঠ বহু কষ্টে পদব্রজে শ্রীবদরিকাশ্রমে গিয়েছিলেন। তিনি শ্রীবদরিনারায়ণ দেবকে বহু ভক্তিপুরঃসর পূজাদি করেন এবং বহু অর্থ অর্পণ করেন। সেদিন শ্রীবদরিকা আশ্রমে রাত্র বাস করলেন। স্বপ্নে শ্রীবদরিনারায়ণ শেঠকে দর্শন দিয়ে বললেন—তুই এ সব অর্থ নিয়ে ব্রজে আরিট গ্রামে যা এবং তথায় রঘুনাথ দাস নামে একজন আমার পরম ভক্ত আছে তাঁকে দে। যদি সে না নিতে চায় আমার কথা বলিস এবং কুণ্ডদ্বয়ের সংস্কারের কথা মনে করিয়ে দিস্। স্বপ্ন দেখে শেঠ বড় সুখী হলেন। সুখে গৃহে ফিরে এলেন ও শ্রীনারায়ণের আজ্ঞা পালনে তৎপর হয়ে
 
 
ব্রজধামে আরিট গ্রামে শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীর সন্নিকট এলেন। অতঃপর শেঠ শ্রীদাস গোস্বামীকে দণ্ডবতাদি করবার পর সমস্ত কথা নিবেদন করলেন। কথা শুনে শ্রীদাস গোস্বামী একটু চমৎকৃত হলেন। তিনি শ্রীরাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড সংস্কারের অনুমতি প্রদান করলেন। শেঠ পরম আনন্দিত মনে সংস্কার কার্য্য আরম্ভ করলেন।
 
“শুনি মহাজন মহা আনন্দ হইল।
সেই ক্ষণে বহুলোক নিযুক্ত করিল।।
শীঘ্রই কুণ্ডদ্বয় খোদাইল যত্নমতে।।”
 
— (শ্রীভক্তি রত্নাকর ৫ম তরঙ্গ)
 
শ্রীরাধাকুণ্ড তীরে পঞ্চপাণ্ডব পঞ্চবৃক্ষরূপ অবস্থান করছেন। তাদের কাটবার কথা হল, সে রাত্রে পাণ্ডবগণ শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীকে দর্শন দিয়ে বৃক্ষ কাটতে নিষেধ করলেন। অদ্যাপি বৃক্ষগুলি কুণ্ডতীরে শোভা পাচ্ছে। শ্রীরাধাকুণ্ড ও শ্রীশ্যামকুণ্ডের সংস্কার হলে ভক্তগণের আনন্দের সীমা রইল না। কুণ্ডের আশে পাশে অষ্ট সখীর কুণ্ডাদি ও অষ্ট সখীর কুঞ্জাদি নির্মাণ করা হল। এসব দেখে শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী আনন্দে আত্মহারা হলেন।
 
শ্রীদাস গোস্বামী শ্রীরাধাকুণ্ড তটে অনিকেত বাস করতেন। মাঝে মাঝে মানস গঙ্গাতটেও এরূপে বাস করতেন। তখন সেখানে ভয়ানক জঙ্গল ছিল। তাতে হিংস্র ব্যাঘ্রাদি বাস করত। একদিন শ্রীসনাতন গোস্বামী মানস-গঙ্গাতটে শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামীর ভজন কুটিরে এলেন। সেখানে তিনি মধ্যাহ্ন ভোজন করবেন। মানস-গঙ্গার পাবন ঘাটে স্নান করতে গেলেন। কিছু দূরে দেখলেন একটি ব্যাঘ্র জল পান করে চলে গেল। তার কিছু দূরে শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী ভজন আবেশে বৃক্ষতলে অবস্থান করছেন। শ্রীসনাতন গোস্বামী দেখে বিস্মিত হলেন। অনন্তর তিনি শ্রীদাস গোস্বামীকে কুটীরের মধ্যে ভজন করবার অনুরোধ জানালেন। সে দিন থেকে তিনি কুটীরে ভজন করতেন।
 
ব্রজধামে পরকীয়াভাবে শ্রীরাধা ও চন্দ্রাবলী শ্রীগোবিন্দের সেবা করতেন। এ দুজনার অনন্ত সখী ছিল। শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী নিজেকে শ্রীরাধার সখীগণের দাসী বলে অভিমান করতেন। তিনি কখনও চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে যেতেন না এবং চন্দ্রাবলীর সখীদের সঙ্গে বার্তালাপ করতেন না। এরূপে মানস-ভজনে দিনাতিপাত করতেন। শ্রীদাস ব্রজবাসী নামক এক ভক্ত রোজ শ্রীদাস গোস্বামীকে এক দোনা মাঠা দিতেন। তিনি সেটুকু পান করে সারাদিন ভজন করতেন। একদিন শ্রীদাস ব্রজবাসী চন্দ্রাবলীর স্থান সখীস্থলীতে গোচারণ করতে গিয়ে ছিলেন। সেখানে বড় বড় পলাশ পাতা দেখতে পেলেন। তিনি কয়েকটি পলাশ পাতা ভেঙ্গে নিলেন। ঘরে এসে সে পাতার দোনা তৈরী করে মাঠা নিয়ে শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীর কাছে এলেন এবং মাঠার দোনাটি দিলেন। শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী দোনা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন শ্রীদাসজী ! এ সুন্দর পলাশ পাতা কোথায় পেলেন? শ্রীদাস বললেন গোচারণ করতে সখীস্থলীতে গিয়ে এ সুন্দর পলাশ পাতা এনেছি।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী সখীস্থলীর নাম শুনেই রোষভরে মাঠাসহ দোনাটি ফেলে দিলেন। বললেন— শ্রীরাধার অনুগত যারা তারা সখী স্থলীর জিনিষ গ্রহণ করেন না। শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীর শ্রীরাধা-নিষ্ঠা দেখে শ্রীদাস ব্রজবাসী বিস্মিত হলেন।
 
শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী সর্ব্বদা শ্রীরাধা গোবিন্দের মানস সেবা করতেন। একদিন মানসে পরমান্ন রন্ধন করে শ্রীরাধা-কৃষ্ণের ভোগ লাগালেন। তাঁরা সুখে ভোজন করলেন, অন্যান্য সখীগণও ভোজন করলেন। অতঃপর সেই অবশেষ প্রসাদ স্বয়ং ভোজন করলেন। প্রেমভরে ভোজন করতে করতে একটু বেশী পরিমাণে ভোজন হল। শ্রীদাস গোস্বামী সকাল হতে প্রায় অপরাহ্ন কাল পর্যন্ত দরজা খুললেন না। ভক্তগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। অনেক ডাকাডাকি করার পর দরজা খুললেন। ভক্তগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কুটীর বন্ধ করে শুয়ে আছেন কেন? শ্রীদাস গোস্বামী বললেন—শরীর অসুস্থ। ভক্তগণ শুনে দুঃখিত হলেন। তখনই মথুরায় শ্রীসনাতন গোস্বামীর নিকট সংবাদ পাঠালেন। সে সময় শ্রীসনাতন গোস্বামী শ্রীবল্লভাচার্য্যের গৃহে অবস্থান করছিলেন। খবর পেয়ে শ্রীবল্লভাচার্য্যের পুত্র শ্রীবিঠল নাথজী দু’জন বৈদ্য রাধাকুণ্ডে শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীর নিকট প্রেরণ করলেন।
 
নাড়ী দেখি চিকিৎসক কহে বার বার।
দুগ্ধ অন্ন খাইলা ইহো ইথে দেহ ভার।।
 
– (ভক্তিরত্নাকর ৫ম তরঙ্গ)
 
বৈদ্যের কথা শুনে সকলে অবাক হলেন। অতঃপর ভক্তগণ রহস্য বুঝতে পারলেন। শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীর ভজন কথা অদ্ভূত তাঁর সম্বন্ধে শ্রীকবিকর্ণপুর গোস্বামী লিখেছেন—
 
দাস শ্রীরঘুনাথস্য পূর্ব্বাখ্য রস মঞ্জরী।
অমুং কেটিৎ প্রভাষতে শ্রীমতীং রতিমঞ্জরীম্।।
ভানুমত্যাখ্যয়া কেচিদাহস্তং নাম ভেদতঃ।।
 
-(শ্রীগৌরগণোদ্দেশ দীপিকা) –
 
শ্রীদাস গোস্বামী পূৰ্ব্বে কৃষ্ণ-লীলায় রস মঞ্জুরী ছিলেন; কেহ বলেন রতি মঞ্জুরী ছিলেন। আবার কেহ ভানুমতী ছিলেন বলেন। তাঁহার রচিত স্তবাবলী, দানচরিত, মুক্তাচরিত প্রভৃতি গ্রন্থাবলী ও অনেক গীত আছে।
 
তাঁহার জন্ম–১৪২৮ শকাব্দে, অপ্রকট–১৫০৪ শকাব্দ, আশ্বিন শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে;স্থিতি—৭৫ বছর।]]
 
 
 
[শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর-
শ্রীমুকুন্দ দাস, শ্রীমাধব দাস ও শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর তিন ভাই এঁরা শ্রীখণ্ডে বাস করতেন। শ্রীমুকুন্দ দাস ঠাকুরের পুত্র শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর। শ্রীমুকুন্দ দাস ঠাকুর রাজবৈদ্য ছিলেন। তিনি নিরন্তর কৃষ্ণাবেশে কাজ করতেন।
 
বাহ্যে রাজবৈদ্য ইহো করে রাজ-সেবা। অ
ন্তরে কৃষ্ণ-প্রেম ইঁহার জানিবেক কেবা।।
 
–(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ১৫।১২০)
 
একদিন শ্রীমুকুন্দ দাস বাদশাকে চিকিৎসা করবার জন্য রাজভবনে গমন করলেন। বাদশা উচ্চ আসনে বসে আছেন। শ্রীমুকুন্দ দাস পাশে বসে চিকিৎসার কথা জিজ্ঞাসা করছেন। সে সময় এক ভৃত্য ময়ুরের পুচ্ছের বৃহৎ পাখা নিয়ে বাদশাকে হাওয়া করতে লাগল। ময়ুরের পুচ্ছ দেখে শ্রীমুকুন্দ দাসের কৃষ্ণ-স্মৃতির উদ্দীপনা হল। অমনি বিবশ হয়ে ভূমিতে পড়লেন। বাদশা শ্রীমুকুন্দ দাসকে অচৈতন্য দেখে মনে করলেন—তিনি প্রাণত্যাগ করলেন না কি? তাড়াতাড়ি নীচে নেমে তাঁকে ধরে উঠালেন। জিজ্ঞাসা করলেন— কোন ব্যথা পেয়েছেন কি না? শ্রীমুকুন্দ দাস বললেন—কোন ব্যথা পাই নি। বাদশা পড়বার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। মৃগী ব্যাধি আছে বলে বাদশার কাছে গোপন করলেন। মহাসিদ্ধ পুরুষ বলে বাদশা অনুমানে বুঝতে পারলেন। বহু সম্মান সহ তাঁকে গৃহে পাঠিয়ে দিলেন।
 
শ্রীমুকুন্দ দাস, শ্রীমাধব দাস ও শ্রীনরহরি সরকার—এঁরা প্রতি বছর নীলাচলে এসে মহাপ্রভুর দর্শন ও রথযাত্রায় নৃত্যকীর্ত্তনাদি করতেন। শ্রীমুকুন্দ দাসকে প্রভু এক দিবস স্নেহভরে জিজ্ঞাসা করলেন, মুকুন্দ ! তুমি ও রঘুনন্দ দুজনের মধ্যে কে পিতা? কে পুত্র বল? শ্রীমুকুন্দ বললেন—রঘুনন্দনই আমার পিতা। যাঁর থেকে কৃষ্ণ-ভক্তি পাওয়া যায় তিনিই প্রকৃত পক্ষে পিতা। প্রভু বললেন— তোমার বিচারই ঠিক।
 
“যাঁহা হৈতে কৃষ্ণ ভক্তি সেই শুরু হয়।।”
 
–(চৈঃ চঃ মধ্যঃ ১৫।১১৭)
 
প্রভু শ্রীরঘুনন্দনকে বিগ্রহ সেবা করতে আদেশ দিলেন।
 
“রঘুনন্দনের কার্য—কৃষ্ণের সেবন।
কৃষ্ণ-সেবা বিনা ইঁহার অন্যে নাহি মন।।”
 
– (চৈঃ চঃ মধ্য ১৫।১৩১ )
 
শিশুকালে শ্রীরঘুনন্দন শ্রীমূৰ্ত্তিকে লাড়ু খাইয়ে ছিলেন। পদকৰ্ত্তা শ্রীউদ্ধব দাস অতি সুন্দরভাবে এ বিষয় বর্ণন করেছেন।
 
(তথাহি গীত)
 
প্রকট শ্রীখণ্ডবাস,
নাম শ্রীমুকুন্দ দাস,
ঘরে সেবা গোপীনাথ জানি।
গেলা কোন কার্য্যান্তরে,
সেবা করিবার তরে,
শ্রীরঘুনন্দনে ডাকি আনি।।
ঘরে আছে কৃষ্ণ-সেবা,
যত্ন করে খাওয়াইবা,
এত বলি মুকুন্দ চলিলা।
পিতার আদেশ পাঞা,
সেবার সামগ্রী লৈয়া,
গোপীনাথের সম্মুখে আইলা।।
শ্রীরঘুনন্দন অতি,
বয়ঃক্রম শিশুমতি,
খাও বলে কান্দিতে কান্দিতে।
কৃষ্ণ সে প্রেমের বশে,
না রাখিয়া অবশেষে,
সকল খাইলা অলক্ষিতে।।
আসিয়া মুকুন্দ দাস,
কহে বালকের পাশ,
প্রসাদ নৈবেদ্য আন দেখি।
শিশু কহে বাপ শুন,
সকলি খাইল পুনঃ,
অবশেষ কিছুই না রাখি।।
শুনি অপরূপ হেন,
বিস্মিত হৃদয়ে পুনঃ
আর দিনে বালকে কহিয়া।
সেবা অনুমতি দিয়া,
বাড়ীর বাহির হৈয়া,
পুনঃ আসি রহে লুকাইয়া।।
শ্রীরঘুনন্দন অতি,
হইয়া হরিষ মতি,
গোপীনাথে লাড়ু দিয়া করে।
খাও খাও বলে ঘন,
অৰ্দ্ধেক খাইতে হেন,
সময়ে মুকুন্দ দেখি দ্বারে।।
যে খাইল রহে হেন,
আর না খাইলা পুনঃ,
দেখিয়া মুকুন্দ প্রেমে ভোর।
নন্দন করিয়া কোলে,
গদ্‌গদ্ স্বরে বলে
নয়নে বরিষে ঘন লোর।
অদ্যাপি শ্রীখণ্ডপুরে,
অর্দ্ধ লাড়ু আছে করে,
দেখে যত ভাগ্যবন্ত জনে।
অভিন্ন মদন যেই,
শ্রীরঘুনন্দন সেই,
এ উদ্ধব দাস রস ভনে।।
 
 
শ্রীনরোত্তম ও শ্রীনিবাস খেতরি গ্রামে যে মহোৎসব করেছিলেন সে উৎসবে শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর এসেছিলেন এবং কীৰ্ত্তন করেছিলেন।
 
শ্রীঅভিরাম গোপাল ঠাকুর ও শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর বড় ডাঙ্গিতে কোন ভক্তগৃহে নৃত্য করেছিলেন। শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুরের পায়ের নুপুর নৃত্যকালে খুলে আকাই হাটে এক পুষ্করিণীতে গিয়ে পড়ে। ইহার থেকে পুষ্করিণীর নাম নূপুর কুণ্ড হয়। বর্তমানে আকাই হাটের দক্ষিণে বড়ুই গ্রামের মহান্তবাড়ীতে সে নূপুর আছে।
 
শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর ব্রজলীলায় কন্দর্প মঞ্জরী ছিলেন। দ্বারকা লীলাতে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পুত্র কন্দর্প।
 
শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুরের পুত্র কানাই ঠাকুর। শ্রীখণ্ডে অদ্যাপি তাঁর বংশধরগণ আছেন। শ্রীখণ্ডবাসী পঞ্চানন কবিরাজ এঁর বংশে জন্মেছিলেন।
 
শ্রীরঘুনন্দনের জন্ম শকাব্দ ১৪৩২।]
 
 
 
 
 
 
 
  • February 20-21, 2022 Puri, Odisha
  • 3rd of July in 2022 Balasore, Odisha
  • August 24-26, 2022 Kurukshetra, Haryana
  • October 7, 2022 Prayagraj, Uttar Pradesh
  • November 30 -1, 2022 Agartala, Tripura
  • December 3-4, 2022 Lalabazar, Assam
  • December 7, 2022 Guwahati, Assam
  • February 17-18, 2023 Baruipur, West Bengal
  • May 27-28, 2023 Patna, Bihar
  • June 26, 2023 Bhubaneswar, Odisha
  • November 26, 2023 Gaya, Bihar
  • February 8, 2024 Delhi
  • February 13-15, 2024 Balighai, Medinipur
  • March 19, 2024 Nabadwip, West Bengal
  • May 27 2024 Florida, USA
  • June 23-24, 2024 Baripada, Odisha
  • June 26-27, 2024 Paradeep, Odisha
  • June 29-30, 2024 Cuttack, Odisha
  • July 14, 2024 Chennai, Tamilnadu
  • August 31 2024 London
  • September 07 2024 London
  • September 08 2024 Berlin (Germany)
  • September 13 2024 Canada
  • September 14-15 2024 Rochester (USA)
  • September 21 2024 New Jersey (USA)
  • Upcoming Events