Appearance Day of Srila Sribas Pandit
শ্রীশ্রীগৌর অবতারের ব্যাসরূপী শ্রীমদ্ বৃন্দাবনদাস ঠাকুর শ্রীবাস পণ্ডিতের মহিমা এই রূপ বর্ণন করেছেন—
সেই নবদ্বীপে বৈসে পণ্ডিত শ্রীবাস।
যাঁহার মন্দিরে হৈল চৈতন্য বিলাস ৷৷
সর্ব্বকাল চারি ভাই গায় কৃষ্ণ নাম।
ত্রিকাল করয়ে কৃষ্ণপূজা, গঙ্গাস্নান ।।
—(শ্ৰীচৈঃ ভাঃ আদি ২।৯৬-৯৭)
শ্রীবাস, শ্রীরাম, শ্রীপতি ও শ্রীনিধি এঁরা চার ভাই। এঁরা পূর্ব্বে শ্রীহট্ট জেলায় বসবাস করতেন; পরবর্তী কালে গঙ্গাতটে শ্রীনবদ্বীপে এসে বাস করতে লাগলেন। ভ্রাতৃচতুষ্টয় শ্ৰীঅদ্বৈত সভায় এসে ভাগবত শ্রবণ ও নাম সংকীর্ত্তনাদি করতেন। শ্রীজগন্নাথ মিশ্রের সঙ্গে তাদের পরম সৌহার্দ্য-ভাব প্রকাশ পেতে লাগল। সকলেই এক সঙ্গে ভাগবত শ্রবণ ও নাম-সংকীৰ্ত্তনাদি করতেন। চার ভায়ের মধ্যে শ্রীবাস পণ্ডিত সৰ্ব্ব বিষয়ে অগ্রণী ছিলেন। তিনি কৃষ্ণভক্তি বলে বুঝতে পেরেছিলেন যে শ্রীজগন্নাথ মিশ্র গৃহে শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হবেন। শ্রীবাস পণ্ডিতের পত্নীর নাম ছিল শ্রীমালিনী দেবী। তিনি নিরন্তর শ্রীশচী দেবীর সঙ্গে সখ্য ভাবাপন্ন হয়ে তাঁর সন্তোযোৎপাদন করতেন।
কলিযুগে জীবের দুর্দশা দেখে ভক্ত বড়ই দুঃখিত হলেন এবং তাদের উদ্ধারের জন্য শ্রীভগবানের কাছে কাতর প্রার্থনা করতে লাগলেন। ভক্তের আহবান ভগবান্ শুনেন। ১৪০৭ শকে ফাল্গুন পূর্ণিমাতে শ্রীমায়াপুরে শ্রীজগনাথ মিশ্রের গৃহে শ্রীহরি অবতীর্ণ হলেন। তাঁর শুভ আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই জগতে। সর্ব্ববিধ মঙ্গলের উদয় হল। জগৎ হরিনামে পূর্ণ হল। শ্ৰীঅদ্বৈত আচার্য্য যেমন শাস্তিপুর থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে শ্রীহরি অবতীর্ণ হচ্ছেন, তেমনি শ্রীবাসাদি ভক্তগণও বুঝতে পেরেছিলেন। শ্রীবাস পণ্ডিতের পত্নী শ্রীমালিনী দেবী আগে থেকে শ্রীশচী মাতার পরিচর্য্যায় নিযুক্ত ছিলেন। শ্রীবাস পণ্ডিতও শ্রীজগন্নাথ মিশ্র গৃহে এসে তাঁকে এ সম্বন্ধে আভাস দিতে লাগলেন।
শ্রীভগবান্ যতক্ষণ নিজেকে না জানান ততক্ষণ তাঁকে কেহ জানতে পারেন না। শ্রীগৌরসুন্দর শৈশব কালে অনেক অলৌকিক লীলা ভক্তগণকে দেখালেও ভগবদ্ মায়ায় তা ভক্তগণ বুঝতে পারতেন না। বাৎসল্যভাবে তাঁদের হৃদয় ভরপুর হয়ে উঠত। শ্রীবাস পণ্ডিত ও মালিনী দেবী, শচী জগন্নাথকে পুত্রের পালন বিষয়ে অনেক উপদেশ দিতেন। শ্রীগৌরসুন্দর শ্রীবাস পণ্ডিত ও মালিনী দেবীকে জনক-জননীর ন্যায় জানতেন।
বিদ্যা বিলাসে উদ্ধত শ্রীগৌরসুন্দরকে একদিন শ্রীবাস পণ্ডিত উপদেশ দিতে লাগলেন—
পড়ে কেনে লোক?— কৃষ্ণ-ভক্তি জানিবারে।
সে যদি নহিল, তবে বিদ্যায় কি করে।।
এতেকে সর্ব্বদা ব্যর্থনা গোঙাও কাল ।
পড়িলা ত’ এবে কৃষ্ণ ভজহ সকাল ৷৷
–(শ্রীচৈঃ ভাঃ আদি ১২।২৫১-২৫২)
লোকে পড়ে কেন? শ্রীকৃষ্ণ-ভক্তি জানবার জন্য। যদি সেই কৃষ্ণ ভক্তি পড়ে শুনে লাভ না হয়, তবে বিদ্যায় কি করবে? তুমিত অনেক পড়াশুনা করলে, এখন কৃষ্ণভজন কর। মহাপ্রভু তা শুনে হাসতে হাসতে বললেন “ তোমার কৃপায় সেহ হইবে নিশ্চিত।” তোমাদের কৃপায় আমার নিশ্চয় কৃষ্ণ-ভক্তি হবে।
অনন্তর মহাপ্রভু গয়াধামে গিয়ে শ্রীঈশ্বর পুরীর নিকট মন্ত্রে দীক্ষাদি গ্রহণ অভিনয় করে ক্রমে জগতে প্রেম-ভক্তি প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। একদিন মহাপ্রভুরভাবে শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহে এসে বলতে লাগলেন–
“কাহারে পুঁজিস্, করিস্ কার ধ্যান।
যাহারে পূজিস্ তারে দেখ্ বিদ্যমান ৷৷
–(শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ২।২৫৮)
শ্রীবাস কার পূজা করছিস্? যাঁর পূজা করছিস্ তাকে সাক্ষাৎ দর্শন কর। এই কথা বলে মহাপ্রভু শ্রীবাসের বিষ্ণুগৃহে প্রবেশ করলেন এবং বিষ্ণুর আসনে বসে চতুর্ভুজ মূর্তি প্রকট করলেন। “দেখে বীরাসনে বসি আছে বিশ্বম্ভর। চতুর্ভুজ শঙ্খচক্রগদাপদ্ম ধর।।”শ্রীবাস পণ্ডিত শ্রীগৌরসুন্দরের সেই দিব্যরূপ দেখে স্তম্ভিত হলেন। তখন শ্রীগৌরসুন্দর শ্রীবাসকে বলতে লাগলেন—“ তোর উচ্চ সংকীর্তনে নাড়ার হুঙ্কারে। ছাড়িয়া বৈকুন্ঠ আইনু সর্ব্ব পরিকরে।।” তোমার উচ্চ সঙ্কীর্জনে এবং অদ্বৈত আচার্য্যের হুঙ্কারে আমি বৈকুন্ঠ ছেড়ে সপরিকরে মর্তলোকে অবতীর্ণ হয়েছি। আমি দুষ্টজনের বিনাশ এবং সাধুজনের ত্রাণ করব। তোমরা নির্ভয়ে আমার সংকীর্ত্তন কর। মহাপ্রভুর এই অভয়বাণী শুনে শ্রীবাস পণ্ডিত ভূতলে দন্ডবৎ হয়ে এই স্তুতি পাঠ করতে লাগলেন—
বিশ্বস্তর-চরণে আমার নমস্কার।
নব-ঘন বর্ণ, পীত বসন যাঁহার ৷৷
শচীর নন্দন পায়ে মোর নমস্কার।
নব গুঞ্জা শিখিপুচ্ছ ভূষণ যাঁহার।।
গঙ্গাদাস-শিষ্য পায়ে মোর নমস্কার।
বনমালা, করে দধি-ওদন যাঁহার।।
জগন্নাথ-পুত্ৰ-পায়ে মোর নমস্কার।
কোটি চন্দ্র জিনি রূপ বদন যাঁহার।।
শৃঙ্গ বেত্র বেণু চিহ্ন ভূষণ যাঁহার।
সেই তুমি তোমার চরণে নমস্কার।।
চারি বেদে যারে ঘোষে নন্দের কুমার।
সেই তুমি তোমার চরণে নমস্কার।।
(শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ২।২৭২-২৭৭ )
আজি মোর জন্ম কর্ম-সকল সফল।
আজি মোর উদয়—সকল সুমঙ্গল ৷৷
আজি মোর পিতৃকুল হইল উদ্ধার।
আজি সে বসতি ধন্য হইল আমার।।
আজি মোর নয়ন-ভাগ্যের নাহি সীমা।
তঁারে দেখি—যাঁর শ্রীচরণ সেবে রমা।।
শ্রীবাস এইরূপে শ্রীগৌরসুন্দরের বিবিধ স্তুতি পাঠাদি করলে শ্রীগৌরসুন্দর শ্রীবাসের প্রতি সদয় হয়ে তাঁর গৃহের যাবতীয় পরিজনকে দর্শন দিলেন। সম্মুখে শ্রীবাস পণ্ডিতের ভ্রাতৃসুতা নারায়ণীকে দেখে প্রভু বললেন— নারায়ণী ! কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে কাঁদ —
“চারি বৎসরের সেই উন্মত্ত চরিত।
‘হা কৃষ্ণ’ বলিয়া কান্দে নাহিক সম্বিত।।
অঙ্গ বহি পড়ে ধারা পৃথিবীর তলে।
পরিপূর্ণ হৈল স্থল নয়নের জলে।।
(শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ২য় অধ্যায়)
বালিকা নারায়ণী কৃষ্ণ বলে কেঁদে অস্থির হল। সেই প্রেম ক্রন্দন দেখে শ্রীবাসের পত্নী, দাস-দাসী সকলে প্রেমে কাঁদতে লাগলেন। শ্রীবাস অঙ্গন কৃষ্ণ প্রেমে এক অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করল।
শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহে দুঃখী নামে এক দাসী ছিল। সে প্রতিদিন মহাপ্রভুর স্নানের জল আনত। একদিন গৌরসুন্দর শ্রীবাসকে জিজ্ঞাসা করলেন—জল কে আনে? শ্রীবাস পণ্ডিত বললেন—দুঃখী আনে। শ্রীগৌরসুন্দর বললেন— আজ থেকে ওর নাম সুখী। যাঁরা ভগবানের ও ভক্তের সেবা করে, তাঁরা দুঃখী নহে, সুখী। শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহে শ্রীগৌরসুন্দর বিবিধ লীলা করতে লাগলেন। ক্রমে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু মহাপ্রভুর সঙ্গে মিলিত হ’লেন। মহাপ্রভু নিত্যানন্দ প্রভুর সঙ্গে সংকীর্ত্তন বিলাস আরম্ভ করলেন। এই সংকীৰ্ত্তন-স্থলী হল শ্রীবাস অঙ্গন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু শ্রীবাস অঙ্গনে অবস্থান করতে লাগলেন। শ্রীমালিনী দেবী তাঁকে পুত্রের ন্যায় সেবা করতে লাগলেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু সাক্ষাৎ শ্রীবলদেব। তিনি অবধৃতের লীলা করতেন। সর্ব্বদা কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর হয়ে থাকতেন। বেশ ভূযার দিকে তার কোন নজরই থাকত না।
একদিন শ্রীগৌরসুন্দর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে সন্ধ্যাকালে শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহে সংকীৰ্ত্তন নৃত্য প্রভৃতি করছেন। এমন সময় শ্রীবাসের একমাত্র পুত্রটী কোন ব্যাধিতে পরলোক গমন করলো। অন্তঃপুরে স্ত্রীলোকেরা শোকে হাহাকার করে উঠলেন ৷ শ্রীবাস পণ্ডিত সব বুঝতে পেরে সত্ত্বর অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন।
সত্বরে আইলা গৃহে পণ্ডিত শ্রীবাস।
দেখে পুত্র হইয়াছে পরলোক-বাস।।
পরম গম্ভীর ভক্ত মহা-তত্ত্ব-জ্ঞানী।
স্ত্রী-গণেরে প্রবোধিতে লাগিলা আপনি ৷৷
তোমরা তো সব জান, কৃষ্ণের মহিমা।
সম্বর রোদন সবে চিত্তে দেহ, ক্ষমা ।।
অন্তকালে সকৃৎ শুনিলে যাঁর নাম।
অতি মহা-পাতকীও যায় কৃষ্ণধাম।।
হেন প্রভু আপনে সাক্ষাতে করে নৃত্য।
গুণ গায় যত তার ব্রহ্মাদিক ভৃত্য।।
এহেন সময় যাহার হইল পরলোক।
ইহাতে কি যুয়ায় করিতে আর শোক।।
কোন কালে এ শিশুর ভাগ্য পাই যবে।
‘কৃতার্থ’ করিয়া আপনারে মানি তবে।।
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ২৫।৩০)
শ্রীবাস পণ্ডিত নারীগণকে এইভাবে অনেক তত্ত্বোপদেশ দিবার পর বললেন, তোমরা যদি সংসার ধর্ম সম্বরণ করতে না পার তবে এখন ক্রন্দন না করে পরে ক্রন্দন কর। সাক্ষাৎ গোকুলপতি শ্রীগৌরসুন্দর আমার গৃহে ভক্তসঙ্গে সংকীর্ত্তন করছেন। তোমাদের ক্রন্দনে যদি তার নৃত্য সুখ ভঙ্গ হয়, আমি তৎক্ষণাৎ গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করব।
“কৃষ্ণ ইচ্ছামতে সব ঘটয় ঘটনা।
তাতে সুখ দুঃখ জ্ঞান অবিদ্যা কল্পনা৷৷
যাহা ইচ্ছা করে কৃষ্ণ তাই জান ভাল ৷
ত্যজিয়া আপন ইচ্ছা ঘুচাও জঞ্জাল ।।
দেয় কৃষ্ণ নেয় কৃষ্ণ পালে কৃষ্ণ সবে।
রাখে কৃষ্ণ মারে কৃষ্ণ ইচ্ছা করে যবে।।
কৃষ্ণ ইচ্ছা বিপরীত যে করে ভাবনা।
তার ইচ্ছা নাহি ফলে সে পায় যাতনা৷৷
ত্যজিয়া সকল শোক শুন কৃষ্ণ নাম।
পরম আনন্দ পাবে পূর্ণ হবে কাম।।”
—(শ্রীভক্তি বিনোদ-গীতি)
এই সমস্ত উপদেশ দিয়ে শ্রীবাস পণ্ডিত বাইরে এলেন এবং মহাপ্রভুর সঙ্গে নৃত্য-গীত করতে লাগলেন। স্ত্রীলোকেরাও মৃত শিশু ফেলে রেখে মহাপ্রভুর কীর্ত্তন শ্রবণ করতে লাগলেন। এইরূপে মহাপ্রভু মধ্যরাত্র পর্য্যন্ত সংকীর্ত্তন করলেন। সংকীর্ত্তন ভঙ্গ হল। সকলে বিশ্রাম করতে লাগলেন। এমন সময় মহাপ্রভু বলতে লাগলেন—
প্রভু বলে, – “আজি মোর চিত্ত কেমন করে।
কোন দুঃখ হইয়াছে পণ্ডিতের ঘরে।।”
পণ্ডিত বলেন—“প্রভু মোর কোন্ দুঃখ।
যার ঘরে সুপ্রসন্ন তোমার শ্রীমুখ।।”
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ ২৫।৪৩)
শ্রীবাস ! আজ কীৰ্ত্তনে আনন্দ পাচ্ছি না কেন? তোমার ঘরে কি কোন অমঙ্গল হয়েছে? শ্রীবাস পণ্ডিত বলতে লাগলেন –হে প্রভো! তুমি সৰ্ব্বমঙ্গলময় ৷ যেখানে তুমি বিরাজমান সেখানে কখন কি দুঃখ আসতে পারে? অনন্তর ভক্তগণ শ্রীবাসের পুত্রের মৃত্যুর কথা নিবেদন করলেন।
“শুনি গোরা রায়
করে হায় হায়,
মরমে পাইনু ব্যথা।”
হায়! হায়! তোমরা এই বিপদ সংবাদ আমাকে দিলে না কেন? তখন শ্রীবাস পণ্ডিত বলতে লাগলেন—
“বলি শুন নাথ
তব রসভঙ্গ,
সহিতে না পারি আমি।।
একটি তনয়,
মরিয়াছেনাথ,
তাহে মোর কিবা দুঃখ।
যদি সব মরে,
তোমারে হেরিয়া,
তবু ত পাইব সুখ।।
তব নৃত্যভঙ্গ,
হইলে আমার,
মরণ হইত হরি।
তাই কু-সংবাদ,
না দিল তোমারে,
বিপদ আশঙ্কা করি।।
—(গীতিমালা)
শ্রীগৌরসুন্দর পণ্ডিতের এই প্রগাঢ় নিষ্ঠা দেখে বলতে লাগলেন—
প্রভু বলে—“হেন সঙ্গ ছাড়িব কেমতে।
এত বলি মহাপ্রভু লাগিলা কান্দিতে।।
পুত্রশোক না জানিল যে মোহার প্রেমে।
হেন সব সঙ্গ মুঞি ছাড়িব কেমনে।।
এত বলি’ মহাপ্রভু কান্দেন নির্ভর।
ত্যাগ-বাক্য শুনি’ সবে চিল্ডেন অস্তর।।”
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্য ২৫ অধ্যায়)
অতঃপর মহাপ্রভু মৃতশিশু স্থানে এলেন এবং তাকে স্পর্শ করে বলতে লাগলেন— হে বালক! তুমি শ্রীবাস পণ্ডিতকে ত্যাগ করে যাচ্ছ কেন? মৃত শিশু প্রভু স্পর্শে প্ৰাণ লাভ করল এবং প্রভুকে নমস্কার করে বলতে লাগল— হে প্রভো তুমি হস্তাকর্ডা বিধাতা তোমার নির্বন্ধের অন্যথা কেহ করতে পারে না। যতদিন এখানে থাকবার নির্বন্ধ ছিল, ততদিন রইলাম। নির্বন্ধ শেষ হল তাই চললাম। হে প্রভো। অনেক বার আমার জন্ম ও অনেক বার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এবার মৃত্যু কালে তোমার শ্রীবদন দর্শন করে সুখে চলে যাচ্ছি।
“এত বলি নীরব হইলা শিশু-কায়।
এ মত কৌতুক করে শ্রীগৌরাঙ্গ রায়।।”
মৃত-পুত্র মুখে শুনি, অপূৰ্ব্ব কথন।
আনন্দ-সাগরে ভাসে সর্ব্ব-ভক্ত-গণ।।
শ্রীবাস পণ্ডিত মহাপ্রভুর এরূপ অদ্ভুত লীলা দর্শন করে সপরিবারে তার শ্রীচরণতলে পড়ে প্রেমে ক্রন্দন করতে লাগলেন। তখন মহাপ্রভু বললেন—
“আমি নিত্যানন্দ–দুই নন্দন তোমার।
চিত্তে তুমি ব্যথা কিছু না ভাবিহ আর।।”
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ মধ্য ২৫ অধ্যায়)
আমি ও নিত্যানন্দ তোমার দুই পুত্র; অতএব তোমার দুঃখের কি আছে? মহাপ্রভুর এই করুণাপূর্ণ বাণী শ্রবণ করে ভক্তগণ চতুৰ্দ্দিকে জয় জয় ধ্বনি করতে লাগলেন। শ্রীবাস পণ্ডিতের প্রেমে ও সেবায় যেন শ্রীগৌর নিত্যানন্দ তাঁর কাছে ঋণী। ভক্তের কাছে ভগবান ঋণী—এই তার প্রমাণ ৷
মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করলে শ্রীবাস পণ্ডিত কুমারহট্ট এসে বসবাস করতেন। তিনি ভ্রাতাদের সঙ্গে প্রতি বৎসর নীলাচলে মহাপ্রভুর দর্শনে যেতেন। শ্রীশচীমাতাকে দেখবার জন্য তিনি প্রায় নবদ্বীপ মায়াপুরে আসতেন এবং গৃহে কিছু দিন বাস করতেন।
শ্রীশচীমাতাও গঙ্গা দর্শন করবার জন্য শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহে আসতেন এবং নীলাচল থেকে মহাপ্রভু গৌড়দেশে আগমন করলে কুমারহট্টে শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহেও আসতেন।
“কতদিন থাকি প্রভু অদ্বৈতের ঘরে।
আইলা কুমারহট্ট–শ্রীবাস-মন্দিরে।।”
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ অন্ত্যঃ ৫।৫)
মহাপ্রভু শ্রীবাস পণ্ডিতকে বর দিয়েছিলেন “তোমার গৃহে কদাপি দারিদ্র্য হবে না।” শ্রীবাস পণ্ডিত তিন ভাই সহ সুখে শ্রীগৌরসুন্দরের সেবা করতেন। শ্রীবাস পণ্ডিত শ্রীনারদের অবতার ছিলেন। তিনি মহাপ্রভুর যাবতীয় লীলার সঙ্গী।