Disappearance Day of Srila Gaur Kishor Das Babaji Maharaj
ভবসাগর পার হবার অভিলাষী নিষ্কিঞ্চন ভগবদ্ভজন অভিলাষী ব্যক্তির পক্ষে বিষয়ীদর্শন ও যোষিতদর্শন বিষভক্ষণ অপেক্ষাও অসাধু (খারাপ) এই শাস্ত্র-বাণী জীবনে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ। তিনি কোন দিন বিষয়ীর জিনিস গ্রহণ করতেন না। গঙ্গাতটে মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত বস্তু গঙ্গাজলে ধৌত করে তা কৌপীন করে পরতেন। সজ্জন গৃহস্থের গৃহ থেকে চাল ভিক্ষা করে তা গঙ্গাজলে ভিজিয়ে রাখতেন। লবন লঙ্কা দিয়ে খেতেন। কাকেও অনুনয় বিনয় করতেন না। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নিষ্কিঞ্চন পুরুষ ছিলেন তিনি।
শ্রীচৈতন্য মঠ ও শ্রীগৌড়ীয় মঠ সমূহের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রীমক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদ এই সিদ্ধ মহাত্মার থেকে ভাগবত দীক্ষা গ্রহণ করেন। এই নিষ্কিঞ্চন মহাপুরুষের পূর্ব্বাশ্রমের পরিচয় সম্বন্ধে আমরা এই মাত্র অবগত হয়েছি যে তিনি পদ্মার তীরবর্তী টেপাখোলার নিকটস্থ বাগযান নামক কোনও পল্লীতে বৈশ্যকুলে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
বাবাজী মহারাজ গৃহস্থাশ্রমে অবস্থান কালে বংশী দাস নামে পরিচিত ছিলেন। তৎকালে তিনি শস্য ব্যবসার দ্বারা সৎ-বৃত্তিতে জীবিকা নিৰ্ব্বাহ পূৰ্ব্বক সস্ত্রীক পরমার্থানুশীলন করতেন। পত্নী বিয়োগান্তে তিনি সংসার ত্যাগ করে শ্রীধাম বৃন্দাবনে গমন করেন এবং বৈষ্ণব সর্ব্বভৌম শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজী মহারাজের অন্যতম শিষ্য শ্রীল ভাগবত দাস বাবাজী মহারাজের থেকে বৈরাগী বেশ গ্রহণ পূর্ব্বক ছয় ক্রোশ শ্রীব্রজ মণ্ডলের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করতেন। এই সময় সামান্য মাধুকরী করে প্রাণ ধারণ এবং বৃক্ষতলে শয়ন করতেন। ব্রজবাসিগণকে সাক্ষাৎ কৃষ্ণ পরিকর জ্ঞানে দর্শন ও সমস্ত বৃক্ষ লতা কীট পতঙ্গাদিকে দণ্ডবন্নতি করতেন। তিনি বহুদিন বর্ষাণায় বসতি করে শ্রীরাধা গোবিন্দকে নিত্য পুষ্প মাল্যাদি সেবা দ্বার সুখী করেছিলেন। শ্রীল বাবাজী মহারাজ প্রায় ত্রিশ বর্ষকাল শ্রীব্রজ মণ্ডলে অবস্থান করে শ্রীব্রজ ধামের ঈশ্বর ঈশ্বরীকে বিবিধ সেবা দ্বারা তুষ্ট করেছিলেন। তারপর সেই শ্রীযুগল কিশোরের কৃপা নির্দেশে যেন তিনি গৌড় মণ্ডল শ্রীনবদ্বীপ ধামে এলেন। তিনি নবদ্বীপ ধামকে বৃন্দাবনাভেদে দর্শন করে শ্রীগৌর সুন্দরের মধুর লীলাস্থল সকল ভ্রমণ করতে লাগলেন।
এই সময় কত দিব্যভাব সমূহে শ্রীল বাবাজী মহারাজ সর্ব্বদা বিভোর থাকতেন। কখন বা দিব্যভাবে গঙ্গাতটে “গৌর গৌর” বলে নৃত্য করতেন, কখনও মূৰ্চ্ছিত হতেন। গঙ্গাতটের উপবন সমূহে রাধা গোবিন্দের দিব্য লীলা স্মরণ করে সানন্দে ভ্রমণ করতেন। এই সময় তাঁর পরিধানে কৌপীন থাকত। সময় সময় দিগম্বরও থাকতেন। মালার সাহায্যে নামজপ করতেন। কোন কোন সময় বস্ত্র গ্রন্থি দিয়েও নাম করতেন। তিনি কখনও কখনও গোমধামে স্বানন্দ সুখদ-কুঞ্জ-মণ্ডপে এসে বাস করতেন এবং শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের শ্রীমুখে ভাগবত শ্রবণ করতেন। নিষ্কিঞ্চন শ্রীল বাবাজী মহারাজের সেবা করবার জন্য সজ্জন মাত্রেই পরম উৎসুক হতেন। কিন্তু তাঁর সেবার সুযোগ পাওয়া বড় দুষ্কর ছিল। এক সময় কাশিম বাজারের মহারাজ মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী বাহাদুর শ্রীল বাবাজী মহারাজকে তাঁর রাজপ্রাসাদে নেবার জন্য এক বিশিষ্ট লোক পাঠান। তখন শ্রীল বাবাজী মহারাজ বলেছিলেন, আমি মহারাজের প্রাসাদে গেলে আমার অর্থলোভ হতে পারে। তাতে মহারাজের সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হবার সম্ভাবনা আছে। আমার যাবার পরিবর্ত্তে তিনিই সমস্ত বিষয় বৈভব আত্মীয় স্বজনকে দিয়ে আমার নিকট আসুন। আমি তাঁর অবস্থানের জন্য আমার ন্যায় একটা ছৈ প্রস্তুত করে দিব এবং উভয়ে আনন্দে হরি ভজন করব।
শ্রীল বাবাজী মহারাজ বলতেন যেখানে সেখানে ভোজন করলে ভজন পন্ড হয়। এক বার ভক্ত হরেনবাবু নবদ্বীপের ভজন কুটীরের উৎসবের প্রসাদ গ্রহণ করেছিলেন। তজ্জন্য শ্রীল বাবাজী মহারাজ তিন দিন তাঁর সঙ্গে কথা বলেন নাই। চতুর্থ দিন বললেন—ভজন কুটীরে যে উৎসবের প্রসাদ দেওয়া হয়েছিল তা এক কুলটা রমণীর প্রদত্ত বস্তু। সঙ্গ বিচার না করে যেখানে সেখানে খেলে ভজন নষ্ট হয়।
একবার শ্রীল সনাতন গোস্বামিপাদের তিরোভাব তিথির পূর্ব্ব দিনে শ্রীল বাবাজী মহারাজ বললেন—“আগামীকল্য শ্রীগোস্বামী প্রভুর অপ্রকট তিথি। সুতরাং আমরা মহোৎসব করব। নিকটস্থ সেবকটি জিজ্ঞাসা করলেন— মহোৎসবের জিনিষ পত্র কোথায় পাওয়া যাবে? শ্রীল বাবাজী মহারাজ বললেন কারও নিকট কিছু বল না, একবেলা খাওয়া বন্ধ করে সর্ব্বক্ষণ কেবল হরিনাম করব। তাই আমাদের ন্যায় কাঙ্গালের মহোৎসব।
এক সময় আগরতলা নিবাসী শ্রীনরেন্দ্র কুমার সেন শ্রীল বাবাজী মহারাজের নিকট আসলেন এবং শ্রীগুরু প্রণালী (সিদ্ধ প্রণালী) জানতে চাইলেন। তদুত্তরে শ্রীল বাবাজী মহারাজ বললেন—শ্রীভগবানকে কল্পনার দ্বারা জানা যায় না। শ্রীহরিনাম করতে করতে শ্রীনামের অক্ষর সমূহের ভিতর দিয়ে তাঁর স্বরূপ প্রকাশ পায়। সাধকও তৎকালে আত্মস্বরূপ জানতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে সাধকের প্রিয় সেবাদিও জেগে উঠে।
একবার জনৈক ডাক্তার শ্রীল বাবাজী মহারাজকে বলেছিলেন তিনি শ্রীনবদ্বীপ ধামে বাস করে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতে চান। তাকে শ্রীল বাবাজী মহারাজ বললেন আপনি যদি সত্যই নবদ্বীপে বাস করতে চান তবে বিনামূল্যে চিকিৎসা করে বিষয়ী লোকের বিষয় চেষ্টার সহায়তা করবার ইচ্ছা ত্যাগ করুন। যাঁরা বাস্তবিক হরিভজন করেন তাঁদের হরিভজনের সহায়তা ব্যতীত অন্য কোন প্রকারের সেবা বা ধর্ম সমস্তই ঘোর বন্ধনের কারণ হয়ে থাকে।
কোন সময় একজন নবীন কৌপীন ধারী শ্রীল বাবাজী মহারাজের নিকট কয়েকদিন যাতায়াত করবার পর নবদ্বীপে কোন ভূম্যধিকারিণী রাণীর এস্টেটের কর্মচারীর কর্মচারীর থেকে পাঁচকাঠা জমি সংগ্রহ করেন। শ্রীল বাবাজী মহারাজ সেই কথা শুনে অতি ক্রোধভরে বলেন—শ্রীনবদ্বীপ ধাম অপ্রাকৃত। এখানে প্রকৃত ভূম্যধিকারিগণ কিরূপে ভূমি প্রাপ্ত হলেন যে তা হাতে তাঁরা উক্ত কৌপীনধারীকে পাঁচ কাঠা জমি দিতে সমর্থ হলেন। বিনিময়ে এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত রত্নরাজি প্রদান করলেও অপ্রাকৃত নবদ্বীপের একটি বালুকার মূল্যের তুলা হয় না। উক্ত কৌপীন ধারীরই বা কত ভজন বল আছে যে সে তার ভজন মুদ্রার বিনিময়ে নবদ্বীপে এত জমি সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছে?
একদিন একজন ভক্ত কিছু মিষ্টি মহাপ্রভুকে ভোগ দিয়ে শ্রীল বাবাজী মহারাজের নিকট নিয়ে গেলেন এবং তা গ্রহণ করবার জন্য প্রার্থনা জানালেন। বাবাজী মহারাজ বললেন— যারা মাছ খায়, ব্যভিচার করে কিংবা অন্য কোন অভিলায় নিয়ে মহাপ্রভুকে ভোগ দেয়, তাদের হাতে মহাপ্রভু খান না। তা প্রসাদ হয় না।
শ্রীল বাবাজী মহারাজ স্বয়ং চাল ভিক্ষা করে তা রান্না করে ভোগ দিয়ে নিজে গ্রহণ করতেন। কখনও অন্যের দেওয়া কোন জিনিষ গ্রহণ করতেন না। কোন সময় তিনি বর্ষাকালে ফুলিয়া নবদ্বীপের ধর্মশালায় কিছু দিন বাস করেন। কিছু প্রসাদ একটি ভাণ্ড করে রেখে দিয়েছেন। একটি সর্প তার পাশ দিয়ে চলে যায়, কোন মহিলা তা দেখতে পায়। যখন শ্রীল বাবাজী মহারাজ সেই প্রসাদ পেতে বসলেন, স্ত্রীলোকটি তথায় উপস্থিত হয়ে সর্পের কথা বলতে লাগল। বাবাজী মহারাজ বললেন মা এখান থেকে আপনি না গেলে আমি প্রসাদ গ্রহণ করব না। বাধ্য হয়ে স্ত্রীলোকটি চলে গেল। তখন বাবাজী মহারাজ বললেন—মায়ার কার্য্য দেখ। মায়া সহানুভূতির ছল নিয়ে কিরূপে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে চায়। মায়া বহুরূপিণী। জীবকে হরিভজন করতে বাধা দেয়।
এক সময় শ্রীযুত গিরীশবাবু শ্রীল বাবাজী মহারাজকে নবদ্বীপে তাঁর কুটীরে থাকবার জন্য সপত্নীক বহু অনুনয় বিনয় করেন। শ্রীল বাবাজী মহারাজ তাঁদের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন—আপনাদের পায়খানাটি দিলে তথায় বসে আমি ভজন করতে পারি। শ্রীগিরীশবাবু সপত্নীক বহু অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন কিন্তু শ্রীল বাবাজী মহারাজ দৃঢ়ভাবে পায়খানাটি চাইলেন। অগত্যা গিরীশবাবু পায়খানাটি ভালমতো পরিষ্কার করে দিলেন। বাবাজী মহারাজ তার মধ্যে বসে হরিনাম করতে লাগলেন। মহাভাগবতগণ যেখানে সেখানে বসে হরিভজন করতে পারেন। তাঁরা যে জায়গায় থাকেন তা হয় “বৈকুণ্ঠ ধাম। বাহ্য চক্ষে অবশ্য আমরা অন্যরূপ দেখি।
শ্রীল বাবাজী মহারাজ মহাভাগবত পুরুষ ছিলেন। তিনি কখনও ছল ধর্ম, কাপটা ধর্ম বা অশাস্ত্রীয় কোন কথা বা সিদ্ধান্ত প্রশ্রয় দিতেন না। কোন প্রসিদ্ধ ভাগবত পাঠক সর্ব্বদা “গৌর “গৌর” বলতেন—একদিন শ্রীবাবাজী মহারাজের নিকট কোন ভক্ত তাঁর কথা উল্লেখ করলে বাবাজী মহারাজ বললেন–ও “গৌর” “গৌর” বলছে না। টাকা টাকা বলছে। যারা পয়সা নিয়ে ভাগবত পাঠ করে, তাদের মুখে ভগবানের নাম হয় না।
শ্রীল বাবাজী মহারাজ বাহ্যতঃ কাকেও কোন উপদেশ প্রদান করতেন না। কিন্তু তাঁর শুদ্ধ চরিত্রে সকলে মুগ্ধ হত। তিনি শুদ্ধ আচরণ করে জগতে প্রকৃত ভাগবত ধর্ম স্থাপন করে গেছেন। তাঁর দর্শনে মহা বহির্মুখ ব্যক্তিও হরিভজনে উন্মুখ হতেন। “দর্শনে পবিত্র কর এই তোমার গুণ।“বৈষ্ণব হৃদয়ে সদা গোবিন্দ বিশ্রাম। গোবিন্দ কহেন মম বৈষ্ণব পরাণ।।” (শ্রীনরোত্তম ঠাকুর) ভগবান শ্রীভক্তের হৃদয় মন্দিরে বাস করেন।
শ্রীল বাবাজী মহারাজ শ্রীহরি উত্থান একাদশী তিথিতে ১৩২২ বঙ্গাব্দের ৩০শে কার্ত্তিক শেষ রাত্রে নিত্যলীলায় প্রবিষ্ট হন। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ স্বয়ং শ্রীগুরুদেবের সমাধি প্রদান করেন।
নমো গৌরকিশোরায় সাক্ষাদ্বৈরাগ্যমূর্তয়ে ।
বিপ্রলম্ভরসম্ভোধে পাদাম্বুজায় তে নমঃ।।