Srila Narattam Das Thakur Appearance Day
আকুমার ব্রহ্মচারী সব্বতীর্থদর্শী।
পরম ভাগবতোত্তম শ্রীল নরোত্তম দাসঃ।।
পদ্মাবতী নদীতটে গোপালপুর নগরে রাজা শ্রীকৃষ্ণানন্দ দত্ত বাস করতেন। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা শ্রীপুরুষোত্তম দত্ত। দুই ভাইয়ের ঐশ্বর্য ও যশাদির তুলনা হয় না।
রাজা শ্রীকৃষ্ণানন্দের পুত্র শ্রীনরোত্তম এবং শ্রীপুরুষোত্তম দত্তের পুত্র শ্রীসন্তোষ দত্ত। মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমীতে শ্রীনরোত্তম ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন।শুভলগ্নে পুত্রের জন্মে রাজা কৃষ্ণানন্দ আনন্দে বহু দান-দক্ষিণা ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করেন। ব্রাহ্মণগণ লগ্ন দেখে বললেন পুত্র প্রসিদ্ধ মহান্ত হবে, এর প্রভাবে বহু লোক উদ্ধার হবে।
রাজপুরে দিন দিন শশীকলার ন্যায় শিশু বাড়তে লাগল। তপ্ত কাঞ্চনের ন্যায় অঙ্গকান্তি, দীঘল নয়ন, আজানুলম্বিত ভুজযুগল ও গভীর নাভি,- মহাপুরুষের লক্ষণসমূহ বর্তমান। পুত্র দর্শনের জন্য রাজপুরে সর্ব্বদা লোকজনের সমাবেশ হত। ক্রমে অন্নপ্রাশন চূড়াকরণাদি হল। পুত্রের কল্যাণের জন্য শ্রীকৃষ্ণানন্দ বহু দান-ধ্যান করলেন।
রাজা কৃষ্ণানন্দের পত্নীর নাম শ্রীনারায়ণী দেবী। তিনি অপূৰ্ব্ব পুত্র পেয়ে আনন্দ সাগরে ভাসতে লাগলেন। তিনি শ্রীনারায়ণের কাছে সর্ব্বদা পুত্রের মঙ্গল কামনা করতে লাগলেন। শিশু অতিশয় শান্ত, জননী যেস্থানে রাখতেন সেখানে থাকতেন। অন্তঃপুরে রমণীগণ শিশুকে লালনপূর্ব্বক কত আনন্দ প্রাপ্ত হতেন। ক্রমে বয়োবৃদ্ধি হলে তার হাতে খড়ি দিলেন। বালক যে বর্ণ একবার গুরু স্থানে শুনতেন তখনই তাহা কণ্ঠস্থ করতেন। অল্পকালের মধ্যেই তিনি ব্যাকরণ, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে বিশেষ পারঙ্গত হলেন। পণ্ডিত স্থানে দর্শন শাস্ত্রাদি কিছু কাল অধ্যয়ন করলেন। কিন্তু ভাগবদ্ ভজন বিনা বিদ্যার কোন সার্থকতা হয় না ইহা বিশেষ অনুভব করলেন। পূর্ব্বে বহু বিদ্বান ব্যক্তি সংসার ত্যাগ করে অরণ্যে গিয়ে শ্রীহরির উপাসনা করেছেন। শ্রীনরোত্তম দাসের মন দিনের পর দিন সংসারের প্রতি উদাসীন হতে লাগল। তিনি ভোগবিলাসে উদাসীন হলেন। এ সময় শ্রীগৌরসুন্দরের ও নিত্যানন্দের মহিমা ভক্তগণের মুখে শুনে হৃদয়ে পরম আনন্দ অনুভব করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যে শ্রীনরোত্তম শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের গুণে আকৃষ্ট হয়ে দিন রাত ঐ নাম জপ করতে লাগলেন। দয়াময় শ্রীগৌরসুন্দর সপার্ষদ একদিন স্বপ্নযোগে নরোত্তমকে দর্শন দিলেন।
অতঃপর কেমনে সংসার ত্যাগ করে শ্রীবৃন্দাবনে যাবেন শ্রীনরোত্তম দিন রাত ভাবতে লাগলেন।
হরি ! হরি ! কবে হব বৃন্দাবনবাসী।
নয়নে নিরখিব যুগল রূপরাশি।।
এই বলে শ্রীনরোত্তম সৰ্ব্বদা গাইতে লাগলেন। বিষয়ের প্রতি, ভোগ বিলাসের প্রতি শ্রীনরোত্তমের বৈরাগ্য দেখে রাজা কৃষ্ণানন্দ ও নারায়ণী দেবী নানা চিন্তা করতে লাগলেন। পুত্র যাতে সংসার ত্যাগ করে যেতে না পারে তজ্জন্য কিছু লোক পাহারা নিযুক্ত করলেন। শ্রীনরোত্তম দেখলেন দুর্গম বিষম পর্ব্বত অতিক্রম করে, তিনি বোধ হয় শ্রীগৌরসুন্দরের শ্রীচরণ ভজন ও শ্রীবৃন্দাবন ধামে যেতে পারবেন না। নিরুপায়ভাবে কেবল শ্রীগৌর নিত্যানন্দের কাছে কৃপা প্রার্থনা করতে লাগলেন। ইতি মধ্যে গৌড়েশ্বরের লোক এসে রাজা কৃষ্ণানন্দকে গৌড়েশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করতে বললেন। রাজা কৃষ্ণানন্দ ও পুরুষোত্তম দত্ত দুই ভাই গৌড়-রাজ-দরবার অভিমুখে যাত্রা করলেন। শ্রীনরোত্তম সংসার ত্যাগের ভাল সুযোগ পেল। তখন জননীর কাছ থেকে কোন প্রকারে বিদায় নিয়ে রক্ষক-লোকের অলক্ষ্যে বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করলেন। কার্ত্তিক পূর্ণিমায় শ্রীনরোত্তম সংসার ত্যাগ করেন। তিনি অতি দ্রুত বঙ্গভূমি অতিক্রম করে শ্রীমথুরা ধামের পথ ধরলেন। যাত্রীগণ শ্রীনরোত্তমের প্রতি অতি স্নেহ রতে লাগলেন, তাঁকে দেখে বুঝলেন কোন রাজকুমার হবে। তিনি কখনও দুধ পান করে, কখনও বা ফলমুলাদি ভোজন করে চলতে লাগলেন। শ্রীবৃন্দাবন ভূমি দর্শনের আশায় তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণা চলে গেছে। স্থানে স্থানে লোক মুখে শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের মহিমা শুনে তাঁদের শ্রীচরণ চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়েন। চলতে চলতে পতিত পাবন নিত্যানন্দ প্রভুর শ্রীচরণে প্রার্থনা করতে লাগলেন।
আর কবে নিতাই চাঁদ করুণা করিবে।
সংসার বাসনা মোর কবে তুচ্ছ হবে।।
বিষয় ছাড়িয়া কবে শুদ্ধ হবে মন।
কবে হাম হেরব মধুর বৃন্দাবন।।
এইরূপে চলতে চলতে শ্রীনরোত্তম মথুরা ধামে এলেন এবং যমুনাদেবীকে দর্শন বন্দনাদি করলেন। শ্রীরূপ, সনাতন প্রভৃতি গোস্বামিগণের নাম স্মরণ করে ক্রন্দন করতে লাগলেন। অনন্তর শ্রীবৃন্দাবন ধামে এলেন। শ্রীমদ্ জীব গোস্বামী তাঁকে শ্রীলোকনাথ গোস্বামীর শ্রীচরণ সেবা করতে বললেন। অতি বৃদ্ধ লোকনাথ গোস্বামী শ্রীগৌর-বিরহে অতি কষ্টে প্রাণ ধারণ করছেন। শ্রীনরোত্তম তাঁর চরণ বন্দনা করলে, শ্রীলোকনাথ গোস্বামী বললেন তুমি কে? শ্রীনরোত্তম বললেন আমি আপনার দীন-হীন দাস, শ্রীচরণ সেবাকাঙ্খী। শ্রীলোকনাথ গোস্বামী বললেন—আমি শ্রীগৌর গোবিন্দের সেবা করতে পারলাম না অন্যের সেবা কি করে নিব। শ্রীনরোত্তন গুপ্তভাবে নিশাকালে গোস্বামীর মুত্র-পুরীষের স্থানাদি সংস্কার করে রেখে দিতেন। কয়েক বছর এই ভাবে সেবা করতে থাকলে, শ্রীলোকনাথ গোস্বামীর কৃপা হল, শ্রাবণ পৌর্ণমাসীতে দীক্ষা প্রদান করলেন।
তিনি মাধুকরী করে খেতেন এবং শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট গোস্বামী গ্রন্থ অধ্যয়ন করতেন। শ্রীনিবাস আচার্য্যের সঙ্গে তার চির মিত্রভাব, উভয়ে শ্রীজীবের নিকট অধ্যয়ন করেন। এ সময় গৌড় দেশ থেকে শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু এলেন; তিনি শ্রীজীব গোস্বামীর নিকট গোস্বামী গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করলেন। তিনজন একাশয় ও এক হৃদয় ছিলেন। তিনজন একান্তভাবে ব্রজে ভজন করবেন বলে সময় করলেন কিন্তু সে আশা পূর্ণ হল না। একদিন শ্রীজীব গোস্বামী তিনজনকে ডেকে বললেন ভবিষ্যতে তোমাদিগকে শ্রীমন্মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করতে হবে। এ গোস্বামী-গ্রন্থরত্ন নিয়ে তোমরা শীঘ্র গৌড় দেশে গমন কর এবং তা প্রচার কর।
তিনজন বৃন্দাবন বাসের সংকল্প ত্যাগ করে শ্রীগুরু-বাণী শিরে ধারণ করলেন। গ্রন্থ রত্ন নিয়ে গৌড় দেশ অভিমুখে যাত্রা করলেন। চলতে চলতে বনবিষ্ণুপুরে প্রবেশ করলেন। বনবিষ্ণুপুরের রাজা দস্যু দলপতি শ্রীবীর হাম্বীর রাত্রে সেই গ্রন্থ রত্নসমূহ হরণ করলেন। প্রাতে গ্রন্থ-রত্ন না দেখে শিরে যেন বজ্রপাত হল। দুঃখিত অন্তঃকরণে চতুর্দিকে অনুসন্ধান করতে করতে খবর পেলেন রাজা বীর হাম্বীর গ্রন্থ হরণপূর্ব্বক উহা রাজগৃহে সংরক্ষণ করছেন। শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু উৎকল অভিমুখে এবং শ্রীনরোত্তম খেতরির দিকে যাত্রা করলেন ও শ্রীনিবাস আচার্য্য গোস্বামী-গ্রন্থ রাজগৃহ থেকে উদ্ধার করবার মানসে তথায় অবস্থান করতে লাগলেন।
শ্রীনরোত্তম মহাপ্রভুর জন্ম স্থান দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে শীঘ্র নবদ্বীপে এলেন। হা গৌর হরি, হা গৌর হরি বলে গঙ্গা তটে তিনি শত শত বার বন্দনা করতে লাগলেন। একটি বৃক্ষতলে উপবেশন করলেন এবং কোথায় প্রভুর জন্মস্থান? কি করে দর্শন পাবেন ভাবতে লাগলেন, এমন সময় অতিবৃদ্ধ এক জন ব্রাহ্মণ তথায় আগমন করলেন। শ্রীনরোত্তম উঠে ব্রাহ্মণকে প্রণাম করলেন। ব্রাহ্মণ বললেন—বাবা কোথা থেকে এসেছ? কি নাম? শ্রীনরোত্তম নিজ পরিচয় দিয়ে শ্রীগৌরসুন্দরের জন্ম স্থান দর্শনের ইচ্ছা নিয়ে এসেছেন বললেন।
ব্রাহ্মণ বললেন,—আহা, আজ প্রাণ শীতল হল। গৌরের প্রিয় ভক্তের দর্শন পেলাম।
শ্রীনরোত্তম—বাবা! আপনি শ্রীগৌরসুন্দরের দর্শন পেয়েছিলেন?
ব্রাহ্মণ—কি বলব বাবা ! শ্রীনিমাই প্রতিদিন এই ঘাটে বসে শিষ্যগণসহ শাস্ত্র চর্চ্চা করতেন। দুর থেকে আমরা তখন তাঁর কি অপূর্ব্ব রূপ দেখতাম, আজও সেই রূপ স্মরণ করে এই বৃক্ষতলে প্রতিদিন একবার করে আসি। ব্রাহ্মণ বলতে বলতে অশ্রু জলে ভাসতে লাগলেন।
শ্রীনরোত্তম—বাবা ! আজ আপনার চরণ দর্শন করে জীবন ধন্য হল।
এ বলে অশ্রুপূর্ণ নয়নে শ্রীনরোত্তম ব্রাহ্মণের চরণ তলে লুটিয়ে পড়লেন।
ব্রাহ্মণ—বাবা ! আমি আশীর্ব্বাদ করছি, তুমি গোবিন্দ চরণে ভক্তি লাভ কর। গৌর-গোবিন্দের কথা সর্ব্বত্র প্রচার কর।
অতঃপর ব্রাহ্মণ নরোত্তম দাসকে শ্রীজগন্নাথ মিশ্রের গৃহে যাবার পথ দেখিয়ে দিলেন। শ্রীনরোত্তম সে পথ দিয়ে শ্রীজগন্নাথ মিশ্র ভবনে আগমন করলেন। অশ্রুপূর্ণ নয়নে তিনি মিশ্র গৃহের দ্বার দেশে সাষ্টাঙ্গ বন্দনাপূৰ্ব্বক ক্রন্দন করতে লাগলেন। অনন্তর ভবনে প্রবেশ করে শ্রীশুক্লাম্বর ব্রহ্মচারীর চরণ দর্শন পেলেন। নরোত্তম তাঁর শ্রীচরণ বন্দনা করলেন। অনুমানে শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী বুঝতে পারলেন ইনি গৌরসুন্দরের কোন কৃপা পাত্র।
শ্রীশুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কে?
শ্রীনরোত্তম ঠাকুর নিজ পরিচয় দিয়ে বললেন বর্তমানে তীব্রজ ধাম, শ্রীজীব গোস্বামী ও শ্রীলোকনাথ গোস্বামী প্রভৃতির সন্নিকট থেকে এসেছি।
শ্রীশুক্লাম্বর—বাবা, তুমি ব্রজে শ্রীলোকনাথ ও শ্রীজীবের থেকে এসেছ? এ বলে উঠে নরোত্তম দাসকে দৃঢ় আলিঙ্গন করলেন। অনন্তর তিনি যাবতীয় গোস্বামিগণের কুশল বার্তা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। শ্রীনরোত্তম ব্রহ্মচারীর নিকট ব্রজের যাবতীয় সংবাদ যথাযথ বর্ণনা করলেন। অনন্তর শ্রীনরোত্তম শচীমাতার সেবক—অতিবৃদ্ধ শ্রীঈশান ঠাকুরের চরণ বন্দনা করলেন এবং স্বীয় পরিচয় প্রদান করলেন। শ্রীঈশান ঠাকুর তাঁর শির স্পর্শ করে আশীৰ্ব্বাদ করতে করতে স্নেহে আলিঙ্গন করলেন। তথায় শ্রীদামোদর পণ্ডিতকেও নরোত্তম বন্দনা করলেন।
অনন্তর শ্রীনরোত্তম শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহে এসে শ্রীপতি ও শ্রীনিধি পণ্ডিতকে বন্দনা করলেন। তাঁরা স্নেহ ভরে শ্রীনরোত্তমকে আলিঙ্গন করলেন। কয়েকদিন নবদ্বীপ মায়াপুরে থাকার পর শ্রীনরোত্তম শান্তিপুরে অদ্বৈত ভবনে এলেন ও শ্রীঅচ্যুতানন্দের চরণ বন্দনা করলেন। পরিচয় পেয়ে শ্রীঅচ্যুতানন্দ সাদরে তাঁকে আলিঙ্গন এবং ব্রজে গোস্বামিদিগের কুশল বার্তা জিজ্ঞাসা করলেন। শান্তিপুরে নরোত্তম দাস দুই দিবস অবস্থানের পর অম্বিকা কালনায় শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিতের ভবনে এলেন। তখন শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভু তথায় অবস্থান করছেন। তিনি গৌরীদাস পণ্ডিতের শিষ্য। শ্রীনরোত্তম শ্রীহৃদয় চৈতন্য প্রভুকে বন্দনা করলেন। সাদরে হৃদয় চৈতন্য প্রভু নরোত্তম দাসকে ধরে আলিঙ্গন পূর্ব্বক উপবেশন করলেন এবং ব্রজের গোস্বামিগণের সন্দেশ নিতে লাগলেন।একদিন অম্বিকা কালনাতে শ্রীনরোত্তম ঠাকুর থাকবার পর গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর মিলনস্থলী সপ্তগ্রামে এলেন। এ স্থানে শ্রীউদ্ধারণ দত্ত ঠাকুর থাকতেন। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর কৃপায় সপ্তগ্রাম বাসীরা পরম ভক্ত হন। শ্রীউদ্ধারণ দত্ত ঠাকুরের অপ্রকটের পর সপ্তগ্রাম অন্ধকারময় হয়। শ্রীনরোত্তম উদ্ধারণ দত্ত ঠাকুরের গৃহে গমন করলেন। তথায় যে কয়েকজন ভক্ত আছেন প্রভু বিরহে অতি দুঃখে তাঁরা দিন যাপন করছেন। শ্রীনরোত্তম দাস বৈষ্ণবগণকে বন্দনা করে তথা হতে খড়দহ গ্রামে এলেন।
খড়দহ গ্রামে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু অবস্থান করতেন। তাঁর শক্তিদ্বয় শ্রীবসুধা ও জাহ্নবা দেবী তথায় অবস্থান করছেন। শ্রীনরোত্তম নিত্যানন্দ ভবনে এসে অঙ্গনে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর নাম স্মরণ পূর্ব্বক গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। শ্রীপরমেশ্বরী দাস ঠাকুর শ্রীনরোত্তম দাসকে অন্তঃপুরে শ্রীবসুধা জাহ্নবা মাতার শ্রীচরণে নিলেন। তাঁরা নরোত্তম দাসের পরিচয় এবং শ্রীজীব ও শ্রীলোকনাথের পরম কৃপা পাত্র শুনে খুব অনুগ্রহ করলেন।
সর্বতত্ত্বজ্ঞাতা বসু-জাহাবী ঈশ্বরী।
অনুগ্রহ কৈল যত কহিতে না পারি।।
—(ভঃরঃ ৮।২১৩)
চার দিবস শ্রীনরোত্তম দাস খড়দহ গ্রামে কৃষ্ণ-কথা আনন্দে অবস্থান করবার পর শ্রীবসুধা জাহ্নবা মাতা থেকে বিদায় নিয়ে খানাকুল কৃষ্ণনগর শ্রীঅভিরাম গোপাল ঠাকুরের আলয়ে এলেন। শ্রীনরোত্তম দাস তাঁর শ্রীচরণ বন্দনা করলেন। তিনি শ্রীগৌর নিত্যানন্দ বিরহে অতি কষ্টে দিন যাপন করছেন। বাহ্য দশা প্রায় সময় থাকে না। শ্রীনরোত্তম তাঁর এরূপ দশা দেখে বহু ক্রন্দন করলেন। অভিরাম ঠাকুরের গোপীনাথ বিগ্রহ অপূর্ব্ব দর্শন। নরোত্তম দাস বিগ্রহ দর্শন করে বহু স্তব-স্তুতি করলেন। এক দিবস অভিরাম গোপাল ভবনে অবস্থান পর তাঁর অনুমতি নিয়ে নরোত্তম দাস শ্রীনীলাচল অভিমুখে যাত্রা করলেন।
শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুর প্রভু-পরিকরগণের স্মরণ করতে করতে শীঘ্র নীলাচলে এলেন। শ্রীগোপীনাথ আচার্য্য প্রভৃতি ভক্তগণ শ্রীনরোত্তমের পথ নিরীক্ষণ করছিলেন। এমন সময় শ্রীনরোত্তম উপস্থিত হলেন। নরোত্তম শ্রীগোপীনাথ আচার্য্যের চরণে দণ্ডবৎ করতেই আচার্য্য তাঁকে আলিঙ্গন করে বললেন—অদ্য তুমি আসবে আমাদের মনে হচ্ছিল। শ্রীনরোত্তম ব্রজবাসী ও গৌড় দেশবাসী ভক্তগণের যাবতীয় সংবাদ প্রদান করলেন।
ভক্তগণ নরোত্তম দাসকে পেয়ে পরম সুখী হলেন, তাঁকে নিয়ে শ্রীজগন্নাথদেব দর্শনে গেলেন। শ্রীজগন্নাথ, শ্রীবলরাম ও শ্রীসুভদ্রা দেবীকে দর্শন করে নরোত্তম বহু স্তব-স্তুতি-দণ্ডবৎ করতে লাগলেন। তারপর শ্রীহরিদাস ঠাকুরের সমাধি পীঠে এলেন। নরোত্তম প্রেমে মূৰ্চ্ছিত হয়ে পড়লেন। তথা হতে শ্রীগদাধর পণ্ডিতের গৃহে আগমন করলেন। নরোত্তম হা গৌর প্রাণ গদাধর বলে উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে লাগলেন। তথায় শ্রীগোপীনাথ বিগ্রহ দর্শন পূৰ্ব্বক শ্রীমামু গোস্বামী ঠাকুরকে বন্দনা করলেন। তিনি তৎকালে গোপীনাথের সেবা করছিলেন।
অনন্তর শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুরের কাছে গোপীনাথের অঙ্গে শ্রীমন্মহাপ্রভু কিরূপে অন্তর্ধান হন তা’ ভক্তগণ বর্ণনা করেন।
ন্যাসি শিরোমণি চেষ্টা বুঝে সাধ্য কা’র।
অকস্মাৎ পৃথিবী করিলা অন্ধকার।।
প্রবেশিলা এই গোপীনাথের মন্দিরে।
হৈলা অদর্শন,— পুনঃ না আইলা বাহিরে।।
—(ভঃ রঃ ৮।৩৫৬-৩৫৭)
শ্রীনরোত্তম শ্রবণ মাত্রই হা শচীনন্দন গৌরহরি বলে ভূতলে অচৈতন্য হলেন। ভক্তগণ নরোত্তমের বিরহ আকুলতা দেখে প্রেমে ক্রন্দন করতে লাগলেন।
অতঃপর শ্রীনরোত্তম কাশী মিশ্র ভবনে শ্রীগোপাল গুরু প্রভুর চরণ দর্শন ও শ্রীরাধাকান্ত বিগ্রহ দর্শনাদি করলেন। শ্রীগুণ্ডিচা মন্দির দর্শনের পথে মহাপ্রভুর লীলাস্থলী জগন্নাথবলভ উদ্যান, নরেন্দ্র সরোবর প্রভৃতি দর্শন করলেন। তিনি কিছুদিন নীলাচলে ভক্তগণ সঙ্গে আনন্দে মহাপ্রভুর বিলাসস্থলী সকল দর্শন করলেন। অতঃপর ভক্তগণ থেকে বিদায় নিয়ে শ্রীনৃসিংহপুরে এলেন। এ স্থানে শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু অবস্থান করছিলেন। বহুদিন পরে শ্রীনরোত্তম ঠাকুরকে দর্শন করে শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু আনন্দ সাগরে ভাসতে লাগলেন। দুইজন প্রেম ভরে পরস্পরকে কত আলিঙ্গন করলেন।
শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু বহু আদর পূর্ব্বক শ্রীনরোত্তম ঠাকুরকে কয়েক দিন নৃসিংহপুরে রাখলেন। শ্রীনরোত্তমের শুভাগমনে শ্রীনৃসিংহপুরে সংকীর্তন বন্যা প্রবাহিত হল। শ্রীশ্যামানন্দ ও শ্রীনরোত্তম উভয়ে শ্রীকৃষ্ণ কথানন্দে দিন রাত জ্ঞান রহিত হলেন। অনন্তর শ্রীনরোত্তম ঠাকুর শ্রীশ্যামানন্দ প্রভু থেকে বিদায় নিয়ে গৌড় দেশাভিমুখে যাত্রা করলেন।
শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর শীঘ্র শ্রীখণ্ডে এলেন। শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর ও শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুরের শ্রীপাদপদ্ম বন্দনা করলেন। শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর শ্রীনরোত্তম দাসের পিতা শ্রীকৃষ্ণানন্দ দত্তকে ভালভাবে জানতেন। শ্রীনরোত্তম বন্দনা করতেই শ্রীনরহরি সরকার ঠাকুর তাঁর শিরে হাত দিয়ে প্রচুর আশীর্ব্বাদ করলেন। শ্রীরঘুনন্দন ঠাকুর ধরে আলিঙ্গন করলেন। নরোত্তম ঠাকুরকে বসিয়ে পুরী ধামের ভক্তগণের কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। নরোত্তম ঠাকুরের আগমনে শ্রীখণ্ড আনন্দময় হয়ে উঠল। নরোত্তম ঠাকুর কয়েকদিন শ্রীখণ্ডে ভক্ত সঙ্গে সংকীৰ্ত্তন নৃত্যাদি রঙ্গে সুখে যাপন করলেন।
শ্রীনরোত্তম শ্রীখণ্ডবাসী গৌর-পার্যদগণের থেকে বিদায় নিয়ে কণ্টক নগরে শ্রীগদাধর দাস ঠাকুরের ভবনে এলেন। গৃহাঙ্গনে দণ্ডবৎ করতেই শ্রীগদাধর দাস ঠাকুর তাকে কোলে তুলে নিলেন।
নরোত্তমে দেখিয়া শ্রীদাস গদাধর।
কোলে করি’ সিঞ্চে নেত্রজলে কলেবর।।
-(ভঃ রঃ ৮।৪৪৮ )
শ্রীগদাধর দাস প্রভু শ্রীগৌর-নিত্যানন্দ বিরহে দুঃখে দিন যাপন করছেন। নরোত্তম ঠাকুর দুই দিন তথায় অবস্থান করবার পর রাঢ় দেশে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর জন্মস্থান দর্শন করতে চললেন। নরোত্তম ঠাকুর একচক্রা গ্রামে এলেন এবং শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর জন্মস্থান দর্শন করলেন। তথায় কেজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ নরোত্তমকে স্নেহ করে শ্রীনিত্যানন্দের বিবিধ লীলাস্থলী দর্শন করালেন। হাড়াই পণ্ডিত ও শ্রীপদ্মাবতী দেবীর নাম স্মরণ করে নরোত্তম ভূমিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। শ্রীনরোত্তম ঠাকুর নিত্যানন্দ প্রভুর জন্মস্থান দর্শন করার পর খেতরির দিকে যাত্রা করলেন।
খেতরি গ্রামের পথ জিজ্ঞাসি লোকেরে।
অতিশীঘ্র আইলেন পদ্মাবতী তীরে।।
পদ্মাবতীর পার হৈয়া খেতরী যাইতে।
আইলাগ্রামবাসীলোক আগুসরি নিতে।।
― (ভঃ রঃ ৪।৪৬৮)
বহুদিন পরে শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর খেতরি গ্রামে শুভবিজয় করছেন শুনে আনন্দে খেতরিবাসিগণ তাঁকে অভ্যর্থনা করতে এলেন। রাজা শ্রীকৃষ্ণানন্দ দত্ত ও শ্রীপুরুষোত্তম দত্ত পরলোকে গমন করবার পর পুরুষোত্তম দত্তের পুত্র শ্রীসন্তোষ দত্ত বিষয় সম্পত্তি দেখাশুনা করতেন। তিনি সনজ্ঞাগ্রণী ব্যক্তি ছিলেন। বহুদিন পরে শ্রীনরোত্তম শুভাগমন করছেন শুনে আনন্দে তাঁকে বহু সম্মান পুরুঃসর অভিনন্দন করে আনবার জন্য লোকজন সঙ্গে খেতরি গ্রামের বহির্দেশে অপেক্ষা করছিলেন। অতঃপর দূর থেকে শ্রীনরোত্তম ঠাকুর মহাশয়কে দর্শন করে দণ্ডবৎ হয়ে পড়লেন এবং অগ্রসর হয়ে আনন্দাশ্রু ফেলতে ফেলতে চরণ-ধূলি গ্রহণ করলেন। শ্রীনরোত্তম সন্তোষ দত্তকে স্নেহ ভরে কুশল প্রশ্নাদি জিজ্ঞাসা করলেন।
অতঃপর কয়েক দিবস পর শ্রীসন্তোষ দত্ত শ্রীনরোত্তম ঠাকুর থেকে শ্রীরাধাকৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হলেন। রাজা সন্তোষ দত্ত মন্দির নির্মাণ পূর্ব্বক শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য শ্রীনরোত্তম ঠাকুরের শ্রীচরণে প্রার্থনা জানালেন। শ্রীনরোত্তম ঠাকুর মহাশয় সানন্দে অনুমতি প্রদান করলেন।
রাজা সন্তোষ দত্ত কয়েক মাসের মধ্যে বিশাল মন্দির, ভোগশালা, কীর্তন মন্ডপ ভক্তগণের নিবাস-গৃহ ‘সরোবর’ পুষ্পোদ্যান ও অতিথিশালা প্রভৃতি নির্মাণ করলেন। ফাল্গুন পৌর্ণমাসী শ্রীগৌরসুন্দরের জন্মোৎসব বাসরে মন্দিরে শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা মহা মহোৎসবের, রাজসূয় যজ্ঞের ন্যায়, বিপুল আয়োজন আরম্ভ করলেন। দেশ-বিদেশে রাজা, জমিদার, কবি, পণ্ডিত, বৈষ্ণব ও সাহিত্যিক প্রভৃতিকে আমন্ত্রণ করবার জন্য আমন্ত্রণপত্র সহ লোক প্রেরণ করলেন। কয়েকজন সজ্জন ব্যক্তিকে পুরী, শ্রীখণ্ড, যাজিগ্রাম, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, খড়দহ, কালনা প্রভৃতি স্থানের গৌরপার্ষদগণকে আমন্ত্রণ করতে শ্রীনরোত্তম • ঠাকুর মহাশয়ের পত্র সহ প্রেরণ করলেন। দেশ বিদেশে উত্তম উত্তম গায়ক ও বাদকগণকে আমন্ত্রণের জন্য কিছু লোক প্রেরণ করলেন। এককালে ছয়টী শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হবার উদ্যোগ চলতে লাগল।
শ্রীঠাকুরের যশ মহিমা-
কোন সময় একস্মার্ত্ত ব্রাহ্মণ-অধ্যাপক নিজ ছাত্রদের কাছে শ্রীঠাকুর মহাশয়কে শূদ্র বুদ্ধি করে তাঁকে নিন্দা করেন। সেই অপরাধে ব্রাহ্মণের সর্ব্বাঙ্গে গলিত কুষ্ঠ হয়। রোগের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ব্রাহ্মণ গঙ্গায় ডুবে মরবেন সঙ্কল্প করলেন। সে রাত্রে ভগবতী দেবী ব্রাহ্মণকে স্বপ্নে বললেন— “তুই পরম ভাগবত শ্রীনরোত্তমকে শূদ্র বুদ্ধি করেছিস্, তোর কোটি জন্মেও নিস্তার নাই, তুই যদি তাঁর চরণে ক্ষমা প্রার্থনা করিস্ তো তোর ভাল হবে।”
পরদিন প্রাতঃকালে ব্রাহ্মণ গলবস্ত্র হয়ে দীন ভাবে ক্রন্দন করতে করতে শ্রীঠাকুরের শ্রীচরণে পতিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কুষ্ঠ রোগ সেরে গেল। শ্রীঠাকুর মহাশয় তাঁকে কৃষ্ণ-ভজন করতে উপদেশ দিলেন; তিনি
ঠাকুর মহাশয়ের ভক্ত হলেন।
একদিন শ্রীনরোত্তম ঠাকুর ও শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ পদ্মাবতী নদীতে স্নান করতে যাচ্ছেন। এমন সময় দেখলেন—দুই ব্রাহ্মণ কুমার অনেক ভাগ মেষ নিয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর মহাশয় বললেন এ দুই ব্রাহ্মাণ কুমার যদি হরি ভজন করত তাদের রূপ যৌবনাদি সার্থক হত। ব্রাহ্মণ কুমারদ্বয় এ কথা শুনতে পেল। তারা শ্রীঠাকুর মহাশয়ের ও শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের দিব্য মূর্তি ও মধুর বাক্য শুনে তাঁদের পাশে এল এবং বিনীত ভাবে বন্দনা করল। ঠাকুর মহাশয় তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলল আমরা গোয়াস গ্রামের জমিদার শ্রীশিবানন্দ আচার্য্যের পুত্র। আমাদের নাম হরিরাম ও রামকৃষ্ণ। গৃহে দুর্গাপূজা হচ্ছে, পিতার আদেশে বলি দেওয়ার জন্য এসব ছাগ মেষ নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা আমাদের কিছু উপদেশ প্রদান করুন। আপনাদের দেখে বড় শান্তি পাচ্ছি।
ব্রাহ্মণ পুত্রদ্বয়ের দৈন্যভাব দেখে শ্রীঠাকুর মহাশয় মধুর হাস্যপূরুকি ভগবদ্ তত্ত্ব কথা বলতে লাগলেন। বেদোক্ত যে কর্মকাণ্ড তাহা রাজস ও তামস ভাবযুক্ত, পরিণামে নরকপ্রদ। বেদোক্ত কর্মকারী কমিগণ পূণ্য ক্ষয়ে স্বর্গ হতে চ্যুত হয় এবং নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। বিষয় দ্বারা আচ্ছন্নমতি বিষয়ী বেদের আপাততঃ মধুর বাক্য বহুমানন পূর্ব্বক জীব-হত্যাদি করে ও অস্তেনরক যন্ত্রণা পেয়ে থাকে। সমস্ত জীব ভগবদ শক্তি। পরমাত্মদর্শী, হিংসা শূন্য, নিরহঙ্কার ভগবদ্ ভজনকারীগণ বাস্তবতঃ সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবদ পাদপদ্ম লাভ করতে পারে।
শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ের মুখে এই সমস্ত কথা শুনে ব্রাহ্মণ কুমারদ্বয় উঠে ঠাকুর মহাশয়ের শ্রীচরণে দণ্ডবৎ হয়ে বললেন, অধম ব্রাহ্মণ কুমারদ্বয়কে চরণরজঃ দিয়ে কৃপা করুন। ঠাকুর মহাশয় তাদের শিরে হাত দিয়ে আশীর্ব্বাদ করলেন।—“তোমাদের কৃষ্ণ-ভক্তি হউক।”
ব্রাহ্মণ কুমারদ্বয় ছাগ ও মেষগুলিকে ছেড়ে দিয়ে শ্রীঠাকুর মহাশয় ও শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের সঙ্গে পদ্মাবতী নদীতে স্নান করে শ্রীমন্মহাপ্রভুর মন্দিরে এলেন। সে দিবস প্রসাদ পাওয়ার পর পুনঃ তারা ঠাকুর মহাশয়ের ও শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজের নিকট থেকে বিবিধ তত্ত্ব-কথা শ্রবণাদি করলেন। দ্বিতীয় দিবসে মস্তক মুণ্ডন পূর্বক শ্রীহরিরাম শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ থেকে এবং রামকৃষ্ণ শ্রীঠাকুর মহাশয়ের থেকে রাধাকৃষ্ণ মন্ত্র গ্রহণ করলেন।
এদিকে তাদের পিতা শিবানন্দ আচার্য্য খোঁজ করতে করতে দেখলেন পুত্রদ্বয় খেতরিতে শ্রীনরোত্তম ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তথায় বাস করছে। শিবানন্দ আচার্য্যের ক্রোধের সীমা রইল না।
কিছুদিন পরে দুই ভাই গৃহে ফিরে এলেন। তাঁদের ললাটে উদ্ধপুণ্ড্র, কণ্ঠে তুলসী মালা, দ্বাদশ অঙ্গে তিলক ও শিরে শিখা দেখে শিবানন্দ আচাৰ্য্য অগ্নির ন্যায় জ্বলে উঠলেন এবং বলতে লাগলেন
ওরে মূর্খ কহ দেখি কোন্ শাস্ত্রে কয়। ব্রাহ্মণ হৈতে কি বৈষ্ণব বড় হয়? ভগবতী নিগ্রহ করিলা এতদিনে! বৃথাই জীবন তোর ভগবতী বিনে।। বিথ্রে শিষ্য কৈল সে বা কেমন বৈষ্ণব। পণ্ডিতের সমাজে করাব পরাভব।। —–(শ্রীনরোত্তম বিলাস ১০।৪৩-৪৪ )
পিতার এই সমস্ত কথা শুনে কুমারদ্বয় বলতে লাগলেন—
ধর্মে কিংবা কর্মে অন্যের হিংসা হয়–দুঃখ হয় তা ধর্ম কিংবা কর্ম বলে অভিহিত হতে পারে না। তার নাম অকর্ম কিংবা অধর্ম। ওহে পিতঃ! শ্রীশালগ্রাম নারায়ণ ছাড়া কোন দেব-দেবীর প্রাণ-প্রতিষ্ঠ। হতে পারে কি? সেই শ্রীনারায়ণ ভজন বাদ দিয়ে কেবল দেব-দেবীর পূজা নিরর্থক মনে করি।
শিবানন্দ আচার্য্য ও স্মার্ত্ত পণ্ডিতগণ পুত্রদ্বয়ের কাছে সিদ্ধান্তে পরাভূত হলেন। মনে মনে শিবানন্দ আচার্য্য বিচার করলেন, একটী বড় স্মার্ত্ত পণ্ডিত এনে এদের পরাভূত করব এবং বৈষ্ণব ধর্ম ছোট বলে প্রতিপাদন করব। মিথিলা থেকে স্মার্ত্ত মহাপণ্ডিত মুরারিকে শিবানন্দ আচার্য্য নিয়ে এলেন এবং এক তর্ক সভার আয়োজন করে পুত্রদ্বয়কে তথায় ডাকলেন এবং বললেন তোমরা কি সিদ্ধান্তে ব্রাহ্মণ অপেক্ষা বৈষ্ণব বড় বলছ তা এ সভার মধ্যে বল।
শ্রীহরিরাম ও শ্রীরামকৃষ্ণ দুইজন শ্রীগুরুপাদপদ্মের স্মরণ পূর্ব্বক ভাগবত সিদ্ধান্ত দ্বারা স্মার্ত্ত মত খণ্ড বিখণ্ড করতে লাগলেন। স্মার্ত্ত মহাপণ্ডিত মুরারি তাঁদের সামনে কোন যুক্তি উত্থাপন করতে পারলেন না। পরিশেষে তিনি অধোবদনে সভা ত্যাগ করলেন ও লজ্জায় ভিক্ষুধর্ম গ্রহণ করলেন।
শিবানন্দ আচার্য্য পরাভূত হয়ে রাত্রে দেবীর চিন্তা করতে লাগলেন। নিদ্রিত হ’লৈ দেবী স্বপ্নে বলতে লাগলেন—ওহে শিবানন্দ! সকলের পতি, গতি ও প্রভু হলেন শ্রীহরি। তাঁকে অবজ্ঞা করে যারা আমাকে ভজন করে আমি তাদের বিনাশ করে থাকি। যারা শ্রীহরিকে মানে না তারা দৈত্য। যারা শ্রীহরির প্রিয় ভক্ত, তাঁরাই বাস্তব আমার প্রিয়। তুই যদি রক্ষা পেতে চাস্ তবে নরোত্তমের চরণে ক্ষমা প্রার্থনা কর, নতুবা বৈষ্ণব অপরাধী তোকে আমি বিনাশ করব। দেবী শিবানন্দ আচার্য্যকে এইরূপ বাক্যে শাসন করে অন্তর্হিতা হলেন।
গাম্ভীলা গ্রামে শ্রীগঙ্গানারায়ণ চক্রবর্ত্তী নামে একজন বিদ্বান ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তিনি শ্রীনরোত্তম ঠাকুরের শ্রীমুখে গোস্বামী সিদ্ধান্ত শুনে একান্তভাবে তাঁর শ্রীচরণ আশ্রয় করলেন এবং ঠাকুর মহাশয়ের নিকট গোস্বামী গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে লাগলেন।
শ্রীজগন্নাথ আচার্য্য নামক এক ব্রাহ্মণ একান্ত দেবীর উপাসনা করতেন। তিনি একদিন স্বপ্নে দেখছেন দেবী তাঁকে বলছেন—ওহে সরল বিপ্র ! তুমি শ্রীনরোত্তমের নিকট যাও ও তাঁর আশ্রয় করে কৃষ্ণ ভজন কর। তোমার পরম কল্যাণ হবে। কৃষ্ণই আমাদের প্রভু, পতি ও গুরু। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া আমরা কেহ স্বতন্ত্র হয়ে চলতে পারি না।
জগন্নাথ আচার্য্য প্রাতঃকালে স্নানাদি সেরে খেতরি গ্রামে এলেন এবং শ্রীনরোত্তম ঠাকুরকে দণ্ডবৎ করে সমস্ত কথা বললেন। শুনে ঠাকুর মহাশয় হাস্য করে বললেন আপনার প্রতি শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহ আছে। শুভদিনে ঠাকুর মহাশয় তাঁকে রাধাকৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত করলেন। শ্রীজগন্নাথ আচার্য্য ঠাকুর মহাশয়ের স্নিগ্ধ শিষ্য হলেন।
শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ের মহিমা দেখে স্মার্ত্ত ব্রাহ্মণ সমাজ ঈর্যায় দগ্ধ হতে লাগল। সকলে রাজা নরসিংহের কাছে গিয়ে নালিশ করল মহারাজ ! আপনি যদি ব্রাহ্মণ সমাজকে না বাঁচান, তবে তারা ধ্বংস হবে। রাজা কৃষ্ণানন্দ দত্তের পুত্র নরোত্তম শূদ্র হয়ে ব্রাহ্মণগণকে শিষ্য করছে এবং যাদু করে সকলকে মুগ্ধ করছে।
রাজা নরসিংহ বললেন—আমি আপনাদের রক্ষা করব। আমায় কি করতে হবে বলুন। ব্রাহ্মণগণ বললেন মহাদিগ্বিজয়ী পণ্ডিত শ্রীরূপনারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা খেতরি যাব এবং নরোত্তমকে পরাভূত করব। সে আমাদের সামনে কিছু বলতে পারবে না। এতে আপনি আমাদের সাহায্য করুন।
রাজা নরসিংহ বললেন আমি স্বয়ং আপনাদের সঙ্গে যাব। স্মার্ত্ত ব্রাহ্মণগণ দিগ্বিজয়ী রূপনারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে খেতরি গ্রামের অভিমুখে যাত্রা করলেন। একজন লোক এসে খেতরিতে শ্রীল নরোত্তম ও শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ আদির নিকট জানালেন।
শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ ও শ্রীগঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী এসব শুনে বড় দুঃখিত হলেন। তখন দুইজন অনুসন্ধান করে জানলেন স্মার্ত্ত পণ্ডিতগণ কুমারপুরের বাজারে একদিন বিশ্রাম করে খেতরিতে আসবেন। তাঁরা শীঘ্রই কুমারপুরের বাজারে এলেন এবং দুইজন দুইখানি দোকান খুললেন। শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ কুম্ভকারের দোকান ও গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্ত্তী পান সুপারির দোকান।
এদিকে রাজা নরসিংহ সঙ্গে স্মার্ত্ত পণ্ডিতগণ কুমারপুর বাজারে এলেন এবং বাজারের বৃহৎ দোকান গৃহাদিতে অবস্থান করতে লাগলেন। স্মার্ত্ত পণ্ডিতগণের ছাত্রগণ কুম্ভকারের দোকানে এলে হাঁড়ি কিনতে কুম্ভকার (রামচন্দ্র কবিরাজ) সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতে লাগলেন। ছাত্রগণও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতে লাগল, ক্রমে তর্ক-বিতর্ক আরম্ভ হল। এদিকে পান সুপারির দোকানদারের (গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্ত্তী) সঙ্গে ছাত্রদেরও তর্ক-বিতর্ক আরম্ভ হল। ক্রমে অধ্যাপকগণ তর্ক-বিতর্ক ক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। তখন তাঁদের সঙ্গে কথা আরম্ভ হল। অধ্যাপকগণও তাদের কথার জবাব দিতে পারছেন না। পরিশেষে রাজা নরসিংহ ও রূপনারায়ণ পণ্ডিত সেখানে এলেন। কিন্তু ভক্তি সিদ্ধান্ত বিচারে পণ্ডিত রূপনারায়ণ তথায় পরাস্ত হলেন। চতুৰ্দ্দিকে মহাকোলাহল হতে লাগল। বাজারের কুম্ভকার তাম্বুলিকের সহিত স্মাৰ্ত্ত পণ্ডিতগণ পরাভূত হলেন। তখন রাজা নরসিংহ অনুসন্ধান নিলেন এই কুম্ভকার ও তাম্বুলিক শ্রীল নরোত্তম দাসের শিষ্য। তিনি পণ্ডিতগণকে বললেন আপনারা যখন তাঁর এই সামান্য শিষ্যগণের সঙ্গে সিদ্ধান্ত বিচারে পারেন না, তখন তাঁর সঙ্গে কিরূপে বিচার করবেন? স্মার্ত্ত পণ্ডিতগণ নীরবে তথা হতে স্বস্থানে প্রস্থান করলেন।
রাত্রিকালে রাজা নরসিংহ ও শ্রীরূপনারায়ণ স্বপ্নে দেখলেন স্বয়ং দূর্গাদেবী বলছেন—“যদি শ্রীনরোত্তমের চরণে শরণ না নিস্ এ খড়গ দ্বারা সকলকে বিনাশ করব।” প্রাতঃকালে রাজা নরসিংহ ও রূপনারায়ণ শ্রীনরোত্তম ঠাকুরের সন্নিধানে এলেন। ঠাকুর মহাশয় তাঁদের বহু আদর সৎকার পূর্ব্বক বসালেন এবং দৈন্য করে বললেন আপনাদের ন্যায় সজ্জন পণ্ডিতের দর্শনে আমি ধন্য হলাম। রাজা নরসিংহ ও রূপনারায়ণ শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুরের বৈষ্ণবীয় নম্র ব্যবহারে একেবারেই মুগ্ধ হলেন এবং তাঁর চরণে সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ করে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন। পরিশেষে দেবীর কথা জ্ঞাপন করলেন। শ্রীনরোত্তম ঠাকুর শুনে মৃদুহাস্য করলেন। অনন্তর কিছুদিন বাদ তাঁদের রাধাকৃষ্ণ মন্ত্র প্রদান করলেন।
শ্রীল ঠাকুর মহাশয়ের অন্তর্দ্ধান-
শ্রীল ঠাকুর মহাশয় নিরন্তর গৌর নিত্যানন্দের গুণ গানে বিভোর থাকতেন। দিনের পর দিন কত পাষণ্ড তাঁর শ্রীচরণ স্পর্শ করে পবিত্র হতে লাগলেন। শ্রীরামচন্দ্র কবিরাজ ঠাকুর মহাশয়ের অনুমতি নিয়ে শ্রীবৃন্দাবন ধামে গেলেন। কয়েকমাস বাদ তথায় তিনি শ্রীরাধাগোবিন্দের নিত্যলীলায় প্রবেশ করলেন। বোধ হয় এই নিদারুণ সংবাদ শ্রীনিবাস আচার্য্য প্রাপ্ত হলে, ভক্ত বিরহ সইতে অক্ষম হয়ে তিনিও কয়েক দিন বাদে নিত্যলীলায় প্রবেশ করলেন। এ সব নিদারুণ সংবাদ পেয়ে শ্রীল ঠাকুর মহাশয় বিরহ সিন্ধুতে যেন নিমজ্জিত হলেন। কাতর কণ্ঠে গাইতে লাগলেন—“যে আনিল প্রেমধন করুণা প্রচুর। হেন প্রভু কোথা গেলা আচার্য্য ঠাকুর।।” এ নিদারুণ বিরহ সিন্ধুতে ভাসতে ভাসতে শ্রীল ঠাকুর মহাশয় ভক্তগণ সঙ্গে গঙ্গাতটে গাম্ভীলায় শ্রীমন্মহাপ্রভুর মন্দিরে এলেন। ভক্তগণকে ঠাকুর মহাশয় নাম সংকীর্তন করতে আদেশ করলেন। ভক্তগণ নাম-সংকীর্ত্তন আরম্ভ করলেন। অতঃপর সংকীৰ্ত্তন সহ ঠাকুর মহাশয় গঙ্গাতীরে এলেন এবং সজল নয়নে গঙ্গা দর্শন করতে করতে দণ্ডবৎ করলেন; অনন্তর স্নান করলেন। গঙ্গা তীরে স্বল্পজলে উপবেশন করলেন, চতুর্দিকে ভক্তগণ উচ্চৈঃস্বরে শ্রীনাম সংকীর্ত্তন করতে লাগলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ আচার্য্য ও শ্রীগঙ্গানারায়ণ চক্রবর্ত্তী দুই দিকে কীর্ত্তন করছেন। ইতিমধ্যে শ্রীল ঠাকুর মহাশয় দুই জনকে বললেন শ্রীগঙ্গাজলে আমার অঙ্গ মার্জ্জন কর। এই বলে তিনি নামসংকীৰ্ত্তনে মগ্ন হলেন। কীর্ত্তন করতে করতে তাঁরা গঙ্গাজল নিয়ে যখন অঙ্গ মার্জ্জন করতে উদ্যত হলেন তৎক্ষণাৎ শ্রীল নরোত্তম ঠাকুর মহাশয় শ্রীনাম সঙ্কীর্ত্তন করতে করতে শ্রীগঙ্গার সহিত মিলিত হয়ে গেলেন।
কার্ত্তিক কৃষ্ণ পঞ্চমীতে তিনি অপ্রকট লীলা করলেন।