শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা মহোৎসব

#GaudiyaMission #Gaudiya #prabhupad150 #srilaprabhupad #rathyatra #RathaJatra #rathayatra2024 #harekrishna #rathyatra #JagannathDham

(শ্রীল স্বরূপ দামোদর গোস্বামী প্রভুর তিরোভাব তিথি)

৭ জুলাই ২০২৪, রবিবার

শ্রীরথযাত্রা উৎসব শ্রীপুরুষোত্তম-ধামের সর্বপ্রধান উৎসব; ইহার অপর নাম—‘নবযাত্রা’, ‘গুণ্ডিচাযাত্রা’, ‘নন্দিঘোষ-যাত্রা’, ‘পতিতপাবন-যাত্রা’, বা ‘মহাবেদী-উৎসব’”। শ্রীজগন্নাথদেব মহারাজ শ্রীইন্দ্রদ্যুম্নকে বলিয়াছিলেন “আষাঢ়-মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে সুভদ্রার সহিত আমাকে ও শ্রীবলরামকে রথে আরোহণ করাইয়া নবযাত্রা উৎসব সম্পন্ন করিবে। যেস্থানে আমি আবির্ভূত হইয়াছিলাম এবং যেস্থানে তোমার সহস্র অশ্বমেধযজ্ঞের মহাবেদী বর্তমান, সেই শ্রীগুণ্ডিচা মন্দিরে আমাকে লইয়া যাইবে।”

শ্রীজগন্নাথদেবের রথের নাম ‘নন্দিঘোষ’। উহার চূড়ায় চক্র ও শ্রীগরুড় অধিষ্ঠিত, এজন্য এই রথকে ‘চক্রধ্বজ’ বা গরুড়ধ্বজ রথও বলে। ইহা ২৩ হাত উচ্চ এবং ইহাতে ৫ হাত পরিধিবিশিষ্ট অষ্টাদশ-সিদ্ধির প্রতীক স্বরূপ ১৮টি চাকা থাকে (মতান্তরে ১৬টি) শ্রীবলদেবের রথের শীর্ষভাগে তালচিহ্ন আছে; এই জন্য ইহার নাম ‘তালধ্বজ’, ইহাকে ‘হলধ্বজ’ও বলে। ইহা ২২ হাত উচ্চ এবং উহাতে সাড়ে চার হাত পরিধি-বিশিষ্ট ষোড়শ কলার প্রতীকস্বরূপ ১৬টি চরকা (মতান্তরে ১৪টি) থাকে। শ্রীসুভদ্রাদেবীর রথের নাম ‘পদ্মধ্বজ’ বা ‘দেবদলন’; ইহা ২১ হাত উচ্চ। ইহাতে ৪ হাত পরিধিবিশিষ্ট (চৌদ্দ ভুবনের প্রতীকস্বরূপ) ১৪ টি (মতান্তরে ১২টি) চাকা থাকে। শ্রীজগন্নাথের রথ পীতবর্ণে, শ্রীবলভদ্রের রথ নীলবর্ণে ও শ্রীসুভদ্রাদেবীর রথ কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত হয়।

শ্রীজগন্নাথেদেবের রথের রক্ষক—– শ্রীনৃসিংহ; সারথির নাম—মাতলি; অশ্বচতুষ্টয়ের নাম— রেচিকা, মোচিকা, সূক্ষ্মা ও অমৃতা এবং ইহাদের বর্ণ শুক্ল। শ্রীবলদেবের রথের রক্ষক– শেষাবতার; সারথি— সুদ্যুম্ন; অশ্বচতুষ্টয়ের নাম—স্থিরা, ধৃতি, স্থিতি ও সিদ্ধা এবং ইহাদের বর্ণ কৃষ্ণ। শ্রীসুভদ্রাদেবীর রথের রক্ষক—বনদুর্গা; সারথি—অর্জুন; অশ্বদের নাম–অধর্ম, অজ্ঞান, অপরাজিতা ও জ্যোতিনী।

শ্রীজগন্নাথদেবের রথের পার্শ্বদেবতা –দক্ষিণে বরাহ, গোবর্ধনকৃষ্ণ ও গোপী-কৃষ্ণ; পশ্চাতে নৃসিংহ, রাম ও নারায়ণ; বামে ত্রিবিক্রম, হনুমান্ ও রুদ্র। শ্রীবলভদ্রের রথের পার্শ্বদেবতা—দক্ষিণে গণেশ, কার্তিকেয় ও সর্বমঙ্গলা; পশ্চাতে প্রলম্বঘ্ন, হলায়ুধ ও মৃতুঞ্জয়; বামে নাটাম্বর, মহেশ্বর ও শেষদেব। শ্রীসুভদ্রার রথের দক্ষিণে চণ্ডী, চামুণ্ডা ও উগ্রতারা; পশ্চাতে বনদুর্গা, শূলী দুর্গা ও বারাহী; বামে শ্যামাকালী, মঙ্গলা ও বিমলা। ইহা ব্যতীত শ্রীজগন্নাথের রথের দ্বারদেশে ইদ্র ও ব্রহ্মা এবং ঋষিপাটায় মরীচিপ্রমুখ সপ্তর্ষি থাকেন। শ্রীবলদেবের রথের দ্বারদেশে রুদ্র ও সাত্যকি এবং ঋষিপাটায় অষ্টবসু। শ্রীসুভদ্রার রথের দ্বারদেশে শ্রীদেবী ও ভূদেবী এবং ঋষিপাটায় অষ্ট ভৈরব অবস্থিত। রথের চূড়া হইতে চাকার উপরিভাগ পর্যন্ত সমগ্র স্থানটিতে বিচিত্র-বর্ণের বস্ত্রাদি দ্বারা সুশোভিত করা হয়। রথের শিরোভাগে বহু বিচিত্র বর্ণের পতাকা উড্ডীন হয়; রথের উপর উপর অপূর্ব আকারের ঘোটক ও তৎপশ্চাতে সারথী (ডাক) দৃষ্ট হয়। ডাহুকের নির্দেশে ‘কালবেড়িয়াগণ’ রথ টানিয়া থাকে।

শ্রীহরিভক্তিবিলাসে উত্থান-একাদশীতে শ্রীহরির উত্থানাস্তে রথযাত্রার বিধান আছে। কিন্তু আষাঢ় মাসে পুষ্যানক্ষত্রযুক্তা শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতেই শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রার বিধি পুরীর রথযাত্রা এক বিরাট্ ব্যাপার। অতি প্রাচীনকাল হইতে সমগ্র ভারতের এমন কি, সমগ্র পৃথিবীর, ধর্মপ্রাণ লক্ষ লক্ষ নরনারী এই রথযাত্রা উৎসব-দর্শনের জন্য পুরীতে সমবেত হইতেন এবং এখনও হইয়া থাকেন। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব তাঁহার অগণিত গৌড়ীয় ভক্তগণের সহিত প্রতিবৎসর এই রথযাত্রা মহোৎসব দর্শন এবং রথের সম্মুখে সাতটি সংকীর্তন সম্প্রদায় রচনা করিয়া উদ্দণ্ড-নৃত্য-কীর্তন করিতেন।

শ্রীচৈতন্যদেব যখন ভক্তগণের সহিত রথাগ্রে নৃত্য করিতেন, তখন স্বয়ং মহারাজ প্রতাপরুদ্র স্বর্ণসম্মার্জনীদ্বারা রথের পথ পরিষ্কার করিতেন—ইহা শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে দেখিতে পাওয়া যায়।

শ্রীল-রূপগোস্বামিপ্রভু শ্রীরথাগ্রে নর্তনকারী শ্রীচৈতন্যদেবের নিত্য দর্শন আকাঙ্খা করিয়াছেন—

রথারূঢ়স্যারাদধিপদবি-নীলাচলপতে

রদভ্র-প্রেমোমিস্ফুরিতনটনোল্লাসবিবশঃ।

সহর্ষং গায়দ্ভিঃ পরিবৃততনুবৈষ্ণবজনৈঃ

স চৈতন্যঃ কিং মে পুনরপি দৃশোৰ্যাস্যতি পদন্ ॥

শ্রীজগন্নাথের রথ টানিবার সময় রথের চাকার নীচে পড়িয়া প্রাণ বিসর্জন* ধর্মোন্মত্ত নর-নারীর মধ্যে একসময় খুবই দেখা যাইত। হৃদয়ের সহজ অনুরাগটি অনুকরণমূলক কৃত্রিমতায় পরিণত হইলে তাহাই ‘ধর্মোন্মত্ততা’ নাম ধারণ করে। শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ শ্রীল সনাতন গোস্বামী ‘কৃষ্ণসেবা-লাভ হইল না, সুতরাং এই প্রাণপতঙ্গ ধারণ করা বৃথা এই সহজ আর্তি ও দৈন্যে বিভাবিত হইয়া কৃষ্ণবিরহে রথচকে প্রাণ বিসর্জন করিতে চাহিয়াছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেবের নিত্যসিদ্ধ অন্তরঙ্গ পার্যদের এই বিপ্রলম্ভময়ী চিত্তবৃত্তি ফলভোগকামিগণের ভোগময় বিচার হইতে সম্পূর্ণ পৃথগ্-ভূমিতে অবস্থিত। নশ্বর ও সকাম পুণ্যের আশায় কতকগুলি মূর্খ লোক রথের চাকার নীচে প্রাণ বিসর্জনের যত্ন করিত। ইহা যে কেবল ভারতে প্রচলিত ছিল তাহা নহে, তথাকথিত সুসভ্য য়ুরোপের সিসিলীদ্বীপেও রথযাত্রার সময় ঐরূপ বীভৎস ও নির্মম কাণ্ড হইত।

শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা সম্বন্ধে শাস্ত্রীয় বিধান এই যে, আষাঢ় মাসের পুষ্যানক্ষত্রযুক্তা শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুষ্ঠান করা কর্তব্য। শ্রীসুভদ্রা ও শ্রীবলরামের সহিত শ্রীজগন্নাথদেবকে রথে আরোহণ করাইয়া এই উৎসব করিতে হয়। যদি এই তিথিতে পুষ্যা নক্ষত্রের যোগ না হয়, তাহা হইলেও উক্ত তিথিতেই ইহার অনুষ্ঠান করা কর্তব্য। এই স্থলে কেবল তিথিরই প্রাধান্য, অধিকন্তু নক্ষত্রযোগ হইলে বিশিষ্ট গুণ হইবে মাত্র। এই দিন নানাবিধ উৎসব ও ব্রাহ্মণভোজন করাইতে হয়। শ্রীসুভদ্রা ও শ্রীবলরামের সহিত শ্রীজগন্নাথদেবকে রথে আরোহণ করাইয়া যাত্রা বিধেয়। পরে সাত দিন এই রথ নদীতীরে রাখিয়া, অষ্টম দিনে নানাপ্রকার ভূষণাদি দ্বারা সজ্জিত করিয়া নবম দিনে পুনর্যাত্রা করিতে হয়। শ্রীবিষ্ণুর দক্ষিণাভিমুখে যাত্রা অতি দুর্লভ ও মুক্তি-প্রদায়িনী।

আষাঢ়স্য দ্বিতীয়ায়াং রথং কুর্যাবিশেষতঃ।

আষাঢ়শুক্লৈকাদশ্যাং জপ-হোম-মহোৎসবম্ ॥

রথস্থিতং ব্রজস্তং তং মহাবেদীমহোৎসবে।

যে পশ্যন্তি মুদা ভক্ত্যা বাসস্তেষাং হরেঃ পদে ॥

সত্যং সত্যং পুনঃ সত্যং প্রতিজ্ঞাতং দ্বিজোত্তমাঃ ।

নাতঃ শ্রেয়ঃ প্রদো বিষ্ণোরুৎসবঃ শাস্ত্রসম্মতঃ ॥

অর্থাৎ আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়াতে রথযাত্রা করিয়া বিশেষতঃ শুক্লা একাদশীর দিন পুনর্যাত্রা করিতে হইবে। এই দিন জপ ও হোমাদি-মহোৎসব বিধেয়। এই মহোৎসবে যাঁহারা শ্রদ্ধা ও আনন্দ সহকারে বিষ্ণুকে রথে বা গমন সময়ে দর্শন করেন, তাঁহাদের বিষ্ণুলোকে বাস হইয়া থাকে। অতএব হে দ্বিজোত্তমগণ! আমি পুনঃ পুনঃ সত্য করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, এই শ্রীবিষ্ণুর উৎসব শাস্ত্রসম্মত এবং ইহা অপেক্ষা পরম মঙ্গলপ্রদ আর কিছুই নাই।

Related Article

Dol yatra gaudiyamission Gour jayanti Sri Chaitanya harekrishna
BLOG

শ্রীগৌরপূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমা

কলিযুগ পাবনাবতারী শ্রীমদ্ গৌরসুন্দরের শুভ আবির্ভাব তিথি ও শ্রীশ্রীগৌরজয়ন্তীর ব্রতোপবাস ১৪ মার্চ ২০২৫, শুক্রবার ……..শ্রীমদ্ গৌরসুন্দরের শুভ জন্মোৎসব……..শ্রীগৌরপূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমা……..শ্রীশ্রীকৃষ্ণের বসন্তোৎসব……..পূর্ণিমান্তে ৫৩৯ গৌরাব্দ আরম্ভ……..পরের দিন

Read More »
Amlaki_ Ekadashi ekadashi ekadashi special gaudiyamission Gaudiya Harekrishna
BLOG

আমলকী একাদশীর ব্রতোপবাস

১০ মার্চ ২০২৫, সোমবার পরের দিন দি ৮।১৩ মিঃ মধ্যে একাদশী ব্রতের পারণ [একাদশীতে কী কী করা এবং খাওয়া উচিত নয় ১। ধান জাতীয় সকল

Read More »
GaudiyaMission Gaudiya prabhupad prabhupad150 bhagwat_goswami disappearance bhagwat bhagwat_maharaj harekrishna
BLOG

শ্রীশ্রীমদ্ভক্তি শ্রীরূপ ভাগবত গোস্বামী মহারাজের (শ্রীল আচার্যপাদ) ৩২ তম তিরোভাব তিথি

শ্রীগুরুদেব শ্রীকৃষ্ণের কৃপামূর্তি, করুণাশক্তি। নামরূপে শ্রীহরি যেমন কৃপা করছেন, তেমনি সাধু শাস্ত্র গুরুরূপে কৃপা করছেন। ভগবান নিত্যকাল সাধু গুরু ও শাস্ত্ররূপে কৃপা করছেন। শ্রীহরি বলেছেন—–

Read More »
GaudiyaMission Gaudiya prabhupad prabhupada srilaprabhupad srilaprabhupada prabhupada150 prabhupad150 srilaprabhupad150 ekadashi ekadashi2025 ekadashivrat ekadashispecial harekrishna
BLOG

জয়া বা ভৌমী একাদশী

[এখন দেখে নেওয়া যাক একাদশীতে কোন পাঁচ প্রকার রবিশস্য গ্রহণ নিষিদ্ধ: ১। ধান জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন চাল, মুড়ি, চিড়া, সুজি, পায়েস, খিচুড়ি, চালের

Read More »