শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা মহোৎসব
(শ্রীল মুকুন্দদত্ত ঠাকুর ও শ্রীধর পন্ডিত ঠাকুরের তিরোভাব)
২২ জুন ২০২৪, শনিবার
জ্যৈষ্ঠী পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীশ্রীপুরুষোত্তম-জগদীশের স্নানযাত্রা মহামহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে শ্রীজগদীশ, শ্রীবলভদ্র ও শ্রীসুভদ্রাদেবী স্নানবেদীতে ‘পহণ্ডি’-বিজয় করেন এবং তথায় সুদর্শনের সহিত শ্রীবিগ্রহত্রয়ের অষ্টোত্তরশত সুবর্ণকুম্ভপূর্ণ সুশীতল-সলিলে মহাস্নান হইয়া থাকে ৷ স্নানানন্তর শ্রীভগবান্ গণেশরূপ ধারণ করেন। সমুদয় ব্রহ্মর্ষি ও সমুদয় দেবতা জগদীশকে মহাস্নান করাইবার জন্য পারিজাত-সুবাসিত সুরতরঙ্গিণীর পূত-সলিল শিরে বহন করিয়া ব্রহ্মার সহিত শ্রীপুরুষোত্তমে আগমন করেন এবং ব্রহ্মার আনুগত্যে মঞ্চস্থ শ্রীভগবান্কে স্নান করান এবং ‘জয়’ শব্দপূর্ণ বিচিত্র স্তুতিবাদ দ্বারা প্রভুকে বন্দনা করেন।
দেবতাগণ যাহাতে স্বচ্ছন্দে বিরাজমান হইয়া ভগবানের স্নানযাত্রা দর্শন করিতে পারেন, এই উদ্দেশ্যে মহাভাগবত মহারাজ শ্রীইন্দ্রদ্যুম্ন স্নানযাত্রাকালে স্নানবেদীর পারিপার্শ্বিক স্থানসমূহ চন্দ্রাতপশোভিত ও মহা মরকতমণি খচিত সুবিস্তৃত আবরণবস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত করিতেন। ঐ স্নানবেদী কালক্রমে জীর্ণ হইলে মহারাজ শ্রীঅনঙ্গভীমদেব বর্তমান স্নানবেদী নির্মাণ করাইয়াছেন।
স্নানযাত্রা দিবস শ্রীজগদীশের স্নানমঞ্চ নানাবিধ মণি, মুক্তা, মালা, চামর, পতাকা ও তোরণাদি দ্বারা বিমণ্ডিত, চন্দন সংমিশ্র সুগন্ধ ও সুশীতল পবিত্র জল দ্বারা সংসিক্ত এবং সুগন্ধি ধূপ গন্ধ-দ্বারা সুরভিত করা হয়। তৎপরে শ্রীজগদীশের সেবকগণ দক্ষিণ দিগ্ববর্তী কূপ হইতে স্নানীয় জল উত্তোলন-পূর্বক সেই জল সুগন্ধিদ্রব্যে সুবাসিত করিয়া ‘পাবমানী’ মন্ত্র উচ্চারণ করিতে করিতে সুবর্ণকলসসমূহ পরিপূর্ণ করেন এবং শাস্ত্রোক্ত বিধানানুসারে মন্দিরাভ্যন্তরে ভগবানের অধিবাস করিয়া থাকেন। অনন্তর হোলিদান পূর্বক শ্রীজগদীশকে শ্রীবলরাম, শ্রীসুভদ্রা ও শ্রীসুদর্শনের সহিত স্নানমঞ্চে লইয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত হন।
রাজার নিকট সম্মান ও সমাদরপ্রাপ্ত সেবকগণ চামর ও তালবৃত্তের দ্বারা ভগবানের ‘পহণ্ডি’ কালে বীজন করিতে থাকেন। শ্রীজগদীশকে স্নানমঞ্চে লইয়া যাইবার কালে অনবধানতা প্রযুক্ত পাছে কোন দোষ ঘটে— এই আশঙ্কায় সেবকগণ সুন্দর পট্টবস্ত্রাদি দ্বারা শ্রীপতির সর্বাঙ্গ আচ্ছাদন পূর্বক তাঁহাকে দূরবর্তী স্নানমঞ্চে লইয়া যান। তৎকালে অখিল জগৎ পূজনীয় শ্রীজগদীশকে দুরগমন নিমিত্ত উত্তানাস্য করিয়া লইয়া যাইতে হয় বলিয়া স্বর্গস্থ দেবগণ মনে মনে এইরূপ বিচার করিয়া থাকেন,—“শ্রীজগদীশ বোধ হয় স্বর্গধামে আরোহণ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন।” ইহা বিবেচনা করিয়া দেবতাগণ শ্রীপতির দিকে দৃষ্টি স্থাপনপূর্বক “হে রাম। হে কৃষ্ণ। আপনাদিগের জয় হউক, জয় হউক, জয় হউক” বলিতে থাকেন। এইরূপ লীলাসহকারে ভগবানের জন্ম-জ্যৈষ্ঠীতে স্নানবেদীতে বিজয়াভিষেক হইয়া থাকে।
ভগবান্ জগদীশ বলিয়াছেন যে, স্বায়ম্ভুব মনুর সত্যাদি চতুর্যুগান্বিত দ্বিতীয়াংশে এবং সত্যযুগের ভগবদ্দর্শনপ্রদ এই প্রথমাংশে স্বায়ম্ভুব মনুর যজ্ঞপ্রভাবেই তাঁহার আবির্ভাব। তিনি জ্যৈষ্ঠী পূর্ণিমাতে অবতীর্ণ হইয়াছেন। এইজন্য ঐ দিবসই শ্রীজগদীশের পুণ্য জন্মদিবস। তাহারই আজ্ঞামতে ঐ দিবস শ্রীজগদীশকে অধিবাস-পুরঃসর মহাস্নানবিধানানুসারে মহাসমারোহে স্নানবেদীর উপর তাঁহার স্নানসেবা অনুষ্ঠিত হয়।
মহাভাগবত শ্রীইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজ এই বিধানে শ্রীজগদীশ জন্ম তিথি জ্যৈষ্ঠী পূর্ণিমায় স্নানযাত্রা মহোৎসব করিতেন। শ্রীজগদীশ মহারাজ শ্রীইন্দ্রদ্যুম্নকে বলিয়াছেন—“সিন্ধুকূলে যে অক্ষয়বট আছে, তাহার উত্তরে সর্বতীর্থময় এক কূপ বিরাজিত আছে; কিন্তু উহা এক্ষণে বালুকারাশি দ্বারা আবৃত হইয়া গিয়াছে। স্নানার্থ পূর্বে উহা নির্মাণ করাইয়া পরে আমি অবতীর্ণ হইয়াছি। অতএব সেই কূপ আবিষ্কার করা প্রয়োজন। রক্ষক ক্ষেত্রপাল ও দিক্পালগণের উদ্দেশ্যে যথাবিধানে বলিপ্রদান-পূর্বক শঙ্খ কাহাল, মুরজাদি বাদ্যযন্ত্র বাদিত করিয়া চতুর্দশীতে ঐ কূপের সংস্কার করিতে হইবে। দ্বিজগণ স্বর্ণকুম্ভদ্বারা সেই সর্বতীর্থময় কূপ হইতে পূতজল উত্তোলন করিবেন এবং সেই জল-দ্বারা জ্যৈষ্ঠী পূর্ণিমায় প্রাতঃকালে ব্রহ্মার সহিত শ্রীজগদীশ, শ্রীবলভদ্র ও সুভদ্রার স্নানসেবা করিতে হইবে।” মহাভাগবত শ্রীইন্দ্রদ্যুম্নের প্রতি সাক্ষাৎ ভগবানের এই আদেশানুসারে আজও পুরুষোত্তমে এই ভাবে শ্রীস্নানযাত্রা অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। স্নানের পর শ্রীজগন্নাথ ও শ্রীবলরামের গণেশ বেশ বা হস্তিবেশ হইয়া থাকে।
মহাভাগবত মহারাজ শ্রীইন্দ্রদ্যুম্নের প্রতি শ্রীজগদীশের আদেশ ছিল— এই মহাস্নান করাইয়া পঞ্চদশ দিবস শ্রীভগবাকে অঙ্গরাগবিহীন বিরূপাবস্থায় কেহ কদাচ দর্শন করিবে না—
ততঃ পঞ্চদশাহানি স্নাপরিত্বা তু মাং নৃপ।
অচিত্রং বা বিরূপং বা ন পশ্যেত কদাচন ॥
শ্রীজগদীশের আজ্ঞানুসারে এই পঞ্চদশ দিবসকাল শ্রীমন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকে। এই সময় শ্রীভগবানের দর্শন হয় না বলিয়া ইহাকে ‘অনবসরকাল’ বলা হয়। অনবসরকালে বিপ্রলম্ভাশ্রিত গৌড়ীয় ভক্তগণ শ্রীশ্রীগুরুগৌরাঙ্গের লীলানুসরণে ‘শ্রীআলালনাথ’ দর্শনার্থ গমন করেন।
শ্রীজগমোহনের পার্শ্বস্থ ‘খটশেষগৃহে’ বা ‘নিরোধন-গৃহে তিনি একপক্ষকাল অবস্থান করেন।
স্নানযাত্রার সময় স্নান করিয়া শ্রীজগন্নাথদেব নরলীলা-মাধুর্য বিস্তার করিবার জন্য জুরলীলা প্রকাশ করেন। দয়িতাপতিগণ শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের জ্বর হইয়াছে বলিয়া পাচন (মিষ্টরসের পানাবিশেষ) ভোগ প্রদান করেন এবং অনবসরকালে প্রত্যহ মিষ্টান্ন ভোগ দেন। শ্রীজগন্নাথদেবের স্নানমঞ্চ ও বহিঃপ্রাঙ্গণমধ্যে এত উচ্চে স্থাপিত যে, বড়দাণ্ড (পুরীর প্রশস্ত রাজপথ) হইতেও যাত্রিগণ শ্রীজগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা দর্শন করিয়া কৃতার্থ হইতে পারেন।