শ্রীশুক উবাচ—
একে তমনুরুন্ধানা জ্ঞাতয়ঃ পর্যুপাসতে।
হতেষু ষটসু বালেষু দেবক্যা উগ্রমেনিনা ।।
সপ্তমো বৈষ্ণবং ধামযমনন্তং প্রচক্ষ্যতে।
গর্ভো বভূব দেবক্য হর্ষশোক বিবৰ্দ্ধনঃ।।
(ভাগবত ১0\2\8-৫)
অনুবাদ :— শ্রীবসুদেবের পত্নী সকল ও স্বজন বর্গগণ কংসাসুরের দ্বারা নিপীড়িত হয়ে কুরু পাঞ্চাল, কেকয়, শালবা ও বিদর্ভ দেশাদিতে গমন করলেন। কিছু স্বজন কংসাসুরের মন যোগায়ে কংসাসুরের কাছে নিবাস করতে লাগলেন। এ দিকে দেবকী দেবীর গর্ভজাত ছয়টি পুত্রকে কংসাসুর এককালীন হত্যা করল। এরপর দেবকী দেবীর সপ্তম গর্ভ প্রকট হল, এই সপ্তম গর্ভে বৈষ্ণব ধাম স্বয়ং অনন্তদেব আবির্ভূত হলেন।
দেবকী দেবীর যখন সপ্তম গর্ভ প্রকট হল তখনই বসুদেবের দ্বিতীয় পত্নী রোহিণী দেবীর গর্ভও প্রকট হল। বসুদেব রোহিণীদেবীর গর্ভ দশা দেখে শীঘ্রই তাঁকে শ্রীনন্দ গোকুলে প্রেরণ করলেন। ভাগবতের দশম স্কন্ধে দ্বিতীয় অধ্যায়ে সপ্তম শ্লোকে শ্রীভগবান যোগমায়াদেবীকে আহ্বান করে বলছেন – হে দেবী! হে ভদ্রে! শীঘ্র নন্দ গোকুলে গমন কর। সেখানে বসুদেবের দ্বিতীয় পত্নী রোহিণী দেবী আছে দেবক্যা জঠরে গর্ভং শেষাখ্যং ধাম মামকম্।” দেবকী দেবীর গর্ভে মদংশভূত বলদেব, যাঁর এক অংশ অনন্তদের, যিনি অনন্ত ব্রহ্মাগণকে শিরে ধারণ করেছেন এবং অনন্ত বদনে নিরন্তর কৃষ্ণগুণ গান করেছেন।
রোহিণী দেবীর নিত্য পুত্র শ্রীবলরাম হলেও ভগবদ্ ইচ্ছায় প্রথমে দেবকী গর্ভে প্রবেশ করলেন। কারণ বলরাম সর্বকাল শয্যা, আসন, ব্যজন, চামর, সখা, পাদুকা ও উপাধানাদি দশ দেহে শ্রীকৃষ্ণসেবা করেন। দেবকী দেবীর গর্ভে শ্রীকৃষ্ণ আসবেন তখনা কৃষ্ণ ইঙ্গিতে বলরাম ঐ গর্ভকে শোধন, নির্বাসযোগ্য আসন ও শয্যাদি রচনা পূর্বক পুনঃ যোগমাযা দ্বারা বাহিত হয়ে গোকুলে রোহিণী দেবীর গর্ভে প্রবেশ করলেন, গোকুল যাবার সময় রোহিণীর তিন মাসের গর্ভ ছিল। যোগমায়া সে গর্ভটি অপসারিত করে বলরামকে স্থাপন করলেন। রোহিণী দেবী এসব স্বপ্নের ন্যায় অনুভব করেছিলেন।(ভাঃ ১০।২।৮)
এখন প্রশ্ন শ্রীদেবকীর শুদ্ধ সত্ত্বময় গর্ভে কি করে প্রাকৃত জড়ীয় ছয়টি গর্ভ (ছয় পুত্র) কংসাসুর যাদের হত্যা করল তারা প্রবিষ্ট হয়েছিল?
উত্তর- যেমন ভগবদ্ গর্ভে মহাপ্রলয়ে প্রকৃতির সহিত সমষ্টি ও ব্যষ্টি জীবগণ প্রবিষ্ট হয়ে থাকে। বাস্তবতঃ তাদের ভগবদ অঙ্গ সঙ্গ হয় না। গীতায় ভগবান বলেছেন—আমাতে সৰ্ব্বভূতগণ আছে, কিন্তু আমি তাদের মধ্যে অবস্থিত নহি। অর্থাৎ আমি নিত্য বৈকুণ্ঠে অবস্থিত। আমি ঐ জীবগণের সঙ্গে কোন সম্বন্ধ রাখি না। সেইরূপ দেবকীর গর্ভে প্রাকৃত ছয়টি গর্ভ থাকলেও সাক্ষাৎ কোন স্পর্শ বা সম্বন্ধ হয় নি। ইহা ভগবানের যোগৈশ্বর্য্য বলে সব কিছু হয়েছে।
এস্থলে তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত–ভক্ত স্থানের ভক্তি পরিপাটি প্রদর্শনার্থ ভগবানের এসব লীলা বুঝতে হবে। যেমন ভক্তের শ্রবণ কীর্ত্তন আদি ভক্তি লক্ষণ হৃদয়ে থাকলেও আনুসঙ্গিকরূপে বড় বিষয় ভোগ অবস্থান করে। যখন ভক্তি সাধকের তা হতে ভয় হয় অর্থাৎ এ বিষয় সকল হায়! হায়! আমাকে সংসার অন্ধকূপে নিমজ্জিত করবে। এরূপ ভয় প্রকট হতে কালে ঐ বিষয় নিবৃত্তি হয়ে থাকে। তখন ভগবদ যশঃ শ্রবণ কীৰ্ত্তন পরিচর্য্যাদিময়ী ভক্তি রতি প্রবৃদ্ধ হ’তে থাকে। যতই রতি বাড়তে থাকে ততই ভাগবানের রূপ গুণ মহাসমুদ্র প্রাদুর্ভাব হতে থাকে। ভক্তের শুদ্ধ সত্ত্বে ভগবদ্ আবির্ভাব হন “ভক্তিঃ এব এনং-দর্শয়তীতিশ্ৰুতি:”।
দেবকী মাতার গর্ভে যে ছয়টি পুত্র হয়েছিল, এরা পূর্বে মরীচি মুনির পুত্র ছিল। অভিশাপ কারণে মর্ত্তে দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। কংসাসুর বধ করলে ইহারা দৈত্যরাজ বলির গৃহে গিয়ে অবস্থান করে। পরবর্তিকালে দেবকী মাতা যখন রামকৃষ্ণের কাছে, তোমাদের পূর্বজ ছয়টি ভ্রাতাকে আমাকে দর্শন করাও এরূপ প্রার্থনা করেন তখন রামকৃষ্ণ দুইভাই তৎক্ষণাৎ সুতলে বলিরাজপুরে যান এবং তথা হইতে ছয়টি ভাইকে নিয়ে মাতা দেবকী দেবীকে অর্পণ করেন। তারপর দেবকী মাতা স্নেহ ভরে সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণকে স্তন্য দুগ্ধ পান করান। অনন্তর ঐ ছয় ভ্রাতা কৃষ্ণভুক্ত স্তন্য ক্ষীর পান মাত্রই দেবলোক প্রাপ্ত হন।
ব্রহ্মার মন থেকে মরীচি মুনির জন্ম। মরীচি থেকে ছয় পুত্র। মানুষের মনেই ছয়টি রিপু নিবাস করে অথবা ষড়বিধ বিষয় মনের কাছে থাকে। ষড় বিষয় শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ মনেই ভোগ করে বলে এ পাঁচের সঙ্গে মন যোগ করলে ষড় বিষয় হয়।
দেবকীতে ভগবান আবির্ভাব হেতু দেবকী মাতা ভক্তাবতার। ““ভয়াৎ কংস” কংস নিরন্তর কৃষ্ণকে কালরূপে ভয় ভাবনা করত যখনই কৃষ্ণনাম শুনত তখনই ভায় হত। তজ্জন্য কংস ভয়াবতার।
অতঃ ভক্তি গর্ভগত যড় বিষয় ধীরে ধীরে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ সংসার আসক্তি আদি ধীরে ধীরে চলে যায়। তদ্রূপ দেবকীর ষড় গর্ভ কাল কংস এসে হত্যা করে যেন বড় বিষয় নিবৃত্ত করল, সাধকের শ্রবণ কীর্তনাদি করতে করতে অন্তর্গত ষড় বিষয় কালে চলে যায়। তখন শুদ্ধ ভক্তি গর্ভে ভগবদ্ যশঃ পরিচর্য্যাদিময়ী প্রেমভক্তির উদয় হয়। তথৈব দেবকীর ষড় গর্ভ নিবৃত্তিনন্তর সপ্তম গর্ভে ভগবদ্ যশ নিবাস শয্যা আসন আচ্ছাদনাদি রূপ, অনন্ত বৈষ্ণব ধাম সেবা মূৰ্ত্তি শ্রীবলদেব আবির্ভূত হলেন। সপ্তম গর্ভে ভগবদ যশ আদি, অষ্টম গর্ভে ভগবদ্ সাক্ষাৎকার, কৃষ্ণাবির্ভাব।
দেবকী দেবীর সপ্তম গর্ভ প্রকট হলে, রোহিণী দেবীকে বসুদের গুপ্তভাবে নন্দগোকুলে পাঠিয়ে দিলেন। শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যাকালে অশ্বারোহণে রোহিণীদেবী নন্দ ভবনে এলেন। রোহিণী দেবীর আগমনে শ্রীনন্দ মহারাজ ভ্রাতৃবর্গের সহিত বড়ই আনন্দিত তথা যশোদার সহিত সমস্ত গোপীগণ পরম তুষ্ট হলেন। দুইজনের যশোদা ও রোহিণীর পরস্পরের প্রতি এত প্রণয় ভালবাসা যেন গঙ্গা ও যমুনা। জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ তিন মাসের গর্ভাবস্থায় রোহিণী দেবী নন্দ গোকুলে আগমন করলেন। (গোঃ চম্পুঃ পূৰ্ব্ব চম্পুঃ ৬৭ শ্লোক)
অতঃপর মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষে প্রতিপদ তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ যোগমায়া সহ শ্রীযশোদার গর্ভসিন্ধুতে প্রকট হলেন। এ সময় যোগমায়া দেবী রোহিণী দেবীর সাতমাসের গর্ভটিকে নষ্ট করে দেবকী দেবীর সাতমাসের গর্ভটি আকর্ষণ পূর্ব্বক রোহিণীতে স্থাপন করলেন। রোহিণীর গর্ভটি নষ্ট হয়েছিল যে সময়, সেই সময় রোহিণীদেবী ঘোরনিদ্রায় নিদ্রিত কেবল স্বপ্নের মত বোধ হল। রোহিণীদেবীতে ভগবান অনন্ত ধাম অবস্থিত হবার পর তাঁর অনেক সুমঙ্গল দর্শন হতে লাগল। শ্রীনন্দ ভবন যেন সৰ্ব্বক্ষণ আনন্দ উৎসবে পূর্ণ হল।সমস্ত গোপগোপীগণের চিত্তে এক অব্যক্ত আনন্দ হিল্লোল প্রবাহিত হতে লাগলো।
“ততশ্চ লব্ধ-সৰ্ব্ব সময় সম্পদৃশো চতুর্দশো মাসে শ্রাবণতঃ প্রাক শ্রবণক্ষে সমস্ত সুখরোহিণী রোহিণী গুণ-গণয়া সুষমং সিতসুষমংসুতং সুসাব। ‘সান্দ্র শুভ্রতাবিভ্রাজমানতয়া পৌর্ণমাসী চন্দ্ৰমসমিব।”
তারপর সর্ব্বমঙ্গল সূচক চৌদ্দমাসে শ্রাবণের পূর্ব্বাদ্ধে শ্রবণ নক্ষত্রযুক্ত সকল মুখ প্রাদুর্ভাবকারিণী শ্রীরোহিণী দেবী হতে নিবিড় শুভ্রতা-গুণেতে বিরাজিত পৌর্ণমাসী তিথিতে গোকুল মহাবনে শ্রীনন্দ ভবনে শ্রীবলরাম আবির্ভূত হলেন।
শিশুর কান্তি শুভ্রচন্দ্রের ন্যায় ধবলিম, ভুজযুগল আজানুবিলম্বি ; নয়ন যুগল প্রস্ফুটিত কমল দলের তুল্য ও উন্নত নাসিকা। মহাপুরুষের যাবতীয় চিহ্ন সমূহ সুন্দর শোভা পাচ্ছিল। তৎক্ষণাৎ গগনমণ্ডলে দেব মুনিগণ মহা জয়জয়ধ্বনি ও দুন্দুভি ধ্বনি মুখরিত করছিল। আনন্দে দেববধূগণ পুষ্প বৃষ্টি করছিলেন। গোকুল আনন্দময় হল। সম্পদ সুখে গোপগোপীগণ পূর্ণ হলেন, তারপর জাত কর্মাদি যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হল। শ্রীবাসুদেব এ সমস্ত কর্ম ব্রাহ্মণাদি প্রেরণ করে সম্পাদন করলেন।
শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলরাম তত্ত্বাদি এরূপ বর্ণনা করছেন—
সৰ্ব্ব অবতারী কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান্ ।
তাহার দ্বিতীয় দেহ শ্রীবলরাম ।।
একই স্বরূপ দোঁহে, ভিন্ন মাত্র কায় ।
আদা কামব্যূহ কৃষ্ণ লীলার সহায়।।
সেই কৃষ্ণ- নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্য ।
সেই বলরাম- সঙ্গে নিত্যানন্দ ।।
শ্রীবলরাম গোসাঞি মূল সঙ্কর্ষণ।
পঞ্চরূপ যরি, করেন কৃষ্ণের সেবন।।
আপনে করেন কৃষ্ণলীলার সহায়।
সৃষ্টিলীলা কার্য্য করে ধরি চারি কায়।।
সৃষ্ট্যাদিক সেবা— তাঁর আজ্ঞার পালন।
‘শেষ’ রূপে করে কৃষ্ণের বিবিধ-সেবন।।
সর্ব্বরূপে আস্বাদয়ে কৃষ্ণ-সেবানন্দ।
সেই বলরাম-গৌর সঙ্গে নিত্যানন্দ।।
* * *
অংশের অংশ যেই ‘কলা’ তার নাম।
গোবিন্দের প্রতিমূর্তি শ্রীবলরাম।।
তাঁর এক স্বরূপ—শ্রীমহাসঙ্কর্ষণ।
তাঁর অংশ ‘পুরুষ’ হয় কলাতে গণন।।
যাঁহাকে তা কলা কহি তিঁহো মহাবিষ্ণু।
মহাপুরুষাবতারী তেঁহো সৰ্ব্ব জিষ্ণু।।
গর্ভোদ-ক্ষীরোদশায়ী দোঁহে ‘পুরুষ’ নাম।
সেই দুই যাঁর অংশ – বিষ্ণু বিশ্বধাম।।
যদ্যপি কহিয়ে তাঁরে কৃষ্ণের ‘কলা’ করি ।
মৎস্য কুর্মাদ্যবতারের তিঁহে অবতারী।।
(চৈতন্য চরিতামৃত আদি ৫ম পরিচ্ছেদ ৭৩-৭৮)
শ্রীবলরাম পঞ্চ রূপ ধারণ পূর্ব্বক সর্বক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের লীলার সহায় করছেন। শ্রীবলরাম স্বয়ং মূলসঙ্কর্ষণ রূপে সর্বক্ষণ মথুরায় ও দ্বারকায় কৃষ্ণের সেবা করছেন, শেষ বা অনন্তদেব রূপে আর এক মূর্ত্তিতে নিরন্তর অনন্ত প্রদনে কৃষ্ণগুণ গান করছেন এবং ব্রহ্মাণ্ড সকলকে শিরে ধারণ করে আছেন।
তিন মূর্ত্তিতে পুরুষত্রয় রূপে বিশ্বের সৃজন পালন ও সংহারাদি করছেন। প্রথম পুরুষাবতার কারণোদকশায়ী মহাবিষ্ণু প্রকৃতির অন্তর্যামী পুরুষ। দ্বিতীয় গর্ভোদকশায়ী পুরুষ ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্যামী, তৃতীয় ক্ষীরোদকশায়ী পুরুষ সমস্ত ভূতের অন্তর্যামী পরমাত্মা পুরুষ। এ পুরুষত্রয় প্রকৃতি সহ বিলাস করেন। ইহারা হলেন পরমাত্মা পুরুষ, যোগীগণের ধোয়, এ পরমাত্মা স্বরূপগণ ভগবানের ত্রিবিধ প্রকাশের মধ্য আংশিক প্রকাশ। যদি পুরুষত্রয়ের প্রকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধ “তথাপি প্ৰকৃতি সহ নাহি স্পর্শগন্ধ।” মহাসঙ্কর্ষণই সমস্ত জীব শক্তির আশ্রয় ৷
“জীব নাম তটস্থাখ্য এক শক্তি হয়।
মহাসঙ্কর্ষণ- সব জীবের আশ্রয়।।
(চৈঃ চঃ আদি ৫\৪৫ )
শ্রীজীব গোস্বামী সন্দর্ভ গ্রন্থে তটস্থাখ্য জীব শক্তিকে পরমাত্মার বৈভব বলেছেন।
বলরাম যেমন সৃষ্টি কার্যে মহাপুরুষ-এর অবতার সম্পাদন করছেন, তেমনি আদি চতুর্ব্যহ দ্বারকা ও মথুরায় মহা সঙ্কর্ষণ স্বরূপে দ্বিতীয় চতুর্ব্যহ। পরব্যোম বৈকুণ্ঠে ইনি সঙ্কর্ষণ রূপে শ্রীকৃষ্ণ লীলার সহায় করছেন। নিত্যগোকুল বৃন্দাবনে স্বয়ং বলরামরূপে গোপ বেশে শ্রীনন্দনন্দনের সেবা করছেন। তিনি যখন মথুরা ও দ্বারকায় তখন ক্ষত্রিয় বেশ।
অতঃপর বলরামের নাম করণের জন্য মথুরা হতে গর্গঋষি এলেন। শ্রীবসুদেব তাঁকে ব্রজে পাঠিয়েছেন। তিনি গুপ্তভাবে গোকুলে এসেছেন। শ্রীগর্গমুনি নামকরণ করতে লাগলেন এ বালকের এক নাম “রাম”, সুহৃদ্গণকে এ সুখী করবে। আর এক নাম সঙ্কর্ষণ, গর্ভ আকর্ষণপূর্ব্বক জন্ম বলে। অন্য আর একটি নাম বলভদ্র—সর্বাধিক বলবান হবে বলে। (ভাঃ১০।৮।১২) কৃষ্ণের বয়সের অধিক একবর্ষ বড় বলরাম। তিনি শিশুলীলা সহায় করতে লাগলেন। সৰ্ব্বক্ষণ কৃষ্ণ সন্নিধানে অবস্থান করেন এবং উভয়ে হামাগুড়ি দিয়ে গোকুল অঙ্গনে বিবিধ শৈশব লীলা করতে লাগলেন। উভয়ে সর্ব্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান বিশিষ্ট হলেও অসর্ব্বজ্ঞ অজ্ঞানী শিশুর ন্যায় অঙ্গন মধ্যে শায়িত গাভী ও বৃষের সিং ধারণ করতেন। তাঁদের করকমল স্পর্শে, গাভীগণ অসাড়ে দুগ্ধ ধারা বর্ষণ করতেন। গাভীর স্বরিত দুগ্ধ ও গোমুত্র সঙ্গে অঙ্গনের ধুলী মিলিত হয়ে কদম রূপ ধারণ করলে, রামকৃষ্ণ সেই ব্রজ কদম সানন্দে স্বহস্তে অঙ্গে ধারণ করতেন। শুভ্রবর্ণ সেই ব্রজ কদম যেন রাম কৃষ্ণের অঙ্গে অঙ্গরাগ সদৃশ শোভা পেত। মুগ্ধ শিশুর ন্যায় নিজের কটির কিঙ্কিনী শব্দে বিস্মিত হয়ে চতুৰ্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করতেন। গোপীগণকে স্ব মাতৃজ্ঞানে জড়িয়ে ধরতেন।
শ্রীরোহিণী দেবীর ও শ্রীযশোদা মাতার অসাধারণ মাতৃবৎসলতা হেতু নিরন্তর স্বরিত দুগ্ধধারে বক্ষের কাঁচলি সিক্ত হত। কৰ্দ্দম লিপ্ত অবস্থায় পুত্রদ্বয়কে, রোহিণী ও যশোদা কোলে নিয়ে অঞ্চলে মুখখানি মুছিয়ে স্তন্য পান করাতেন। বালকদ্বয়ের নবোদিত কুন্দ কুসুমের ন্যায় শুভ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দত্ত, দর্শনে আনন্দে বিভোর হতেন। জননীদ্বয় যখন কার্য্যান্তরে থাকতেন তখন বালকদ্বয় অঙ্গনে শায়িত বৎসের পুচ্ছ ধরতেন। বৎসগুলি ভয়ে দ্রুত পলায়ন করত তখন তারা ক্রন্দন করতেন।
রাম ও কৃষ্ণ হামাগুড়ি দিয়ে চলতে অঙ্গনে কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তরে নিজের প্রতিবিম্বে চকিত ও স্তম্ভিত হতেন। ক্রমে গৃহের ভিত্তি ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলে কখন কখন পদস্খলিত হয়ে ভূতলে পড়ে যেতেন, তখন বসে ক্রন্দন করতেন, আবার ভিত্তি ধরে চলতে ভিত্তিতে নিজ প্রতিবিম্ব দেখে সেই প্রতিবিম্বের মুখে মুখ দিয়ে চুম্বন করবার চেষ্টা করতেন। এরূপ মনোহর শৈশব লীলাতে সমস্ত স্বজনগণকে মুগ্ধ করেছিলেন।
বলরাম শ্রীকৃষ্ণের মাখন হরণলীলাতেও সহায় করেছেন ।কৃষ্ণ উচ্চ শিকেতে হাত দিতে না পারলে বলরাম উচ্চ করে ধরতেন, তখন কৃষ্ণ অনায়াসে মাখন হরণ করতেন। বলরাম খুব বুদ্ধিমান ছিলেন। কৃষ্ণ কে মাখন হরণ বুদ্ধি শিখাতেন। গোপ গোপীদিগের গৃহে গৃহে গোপশিশু সঙ্গে দুই ভাই মাখন হরণ লীলা করে ভ্রমণ করতেন।
যে দিবস মা যশোদা কৃষ্ণাকে বন্ধন করেছিলেন, সে দিবস বলরাম স্বীয় রোহিণী দেবীর সঙ্গে কোন গোপ গৃহে আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। অপরাহ্নে এসে যখন কৃষ্ণের বিষণ্ণ বদন দেখলেন, বলরাম বললেন ভাই কানু? তোর বদনখানি বিষণ্ণ দেখছি কেন? কৃষ্ণ বললেন দাদা। তুই ছিলিনা মা আজ আমাকে বেঁধেছিলেন। বলরাম বললেন আমি থাকলে তোকে কিছুতেই বন্ধন করতে দিতাম না।
পদকল্পতরুতে বৈষ্ণব দাস একটি সুন্দর পদকীর্তনে রাম-কৃষ্ণের শৈশবলীলার বর্ণনা করেছেন–
নাচরে নাচরে মোর রাম দামোদর।
যত নাচ তত দিব ক্ষীর ননী সর।।
আমি নাহি দেখি বাছা নাচ আর বার।
গলায় গাঁথিয়া দিব মণিময় হার।।
তা তা থৈয়া থৈয়া বলে নন্দরানী।
করে তালি দিয়া নাচে রাম যদুমণি।।
রাম কানু ওরে মোর তরে রাম কানু।
মণিময় ঝুরি মাঝে ঝলমল তনু।।