নমোভক্তিবিনোদায় সচ্চিদানন্দ নামিনে।
গৌরশক্তি স্বরূপায় রূপানুগবরায়তে।।
শ্রীশ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনেদ ঠাকুর মহাশয় শ্রীগৌর সুন্দরের নিজ জন ছিলেন। তিনি রূপানুগ ধারায় শ্রীগৌর সুন্দরের লুপ্ত প্রায় বাণী মর্ত্যলোকে পুনঃ প্রচার করেছিলেন। তাঁর গুণ ছিল অমিত ও অপার। তার জীবনী আলোচনা করার মত পারঙ্গতা আমার নাই। তথাপি আত্ম পবিত্রতা করবার জন্য কিছুটা চেষ্টা করছি মাত্র।
কান্যকুব্জ কায়স্থপ্রবর শ্রীপুরুষোত্তম দত্ত, তাঁর সপ্তদশ পর্যায়ে শ্রীগোবিন্দ শরণ দত্ত। তিনি দিল্লীশ্বরের কৃপায় গঙ্গাতটে ভূ-সম্পত্তি প্রাপ্ত হন। তিনি তথায় গোবিন্দপুর নামে গ্রাম পত্তন করেন। পরবর্তীকালে গোবিন্দপুরে ইংরেজরা দূর্গ নির্মাণ করলে তাঁর পুত্র পৌত্রগণ হাটখোলায় এসে বসবাস করতেন। তখন থেকে তাঁরা হাট খোলার দত্ত নামে পরিচিত। পুরুষোত্তম দত্তের একবিংশ পর্যায়ে মহানুভব শ্রীমদন মোহন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাট খোলার দত্তদের মধ্যে অগ্রগণ্য এবং পরম ভক্ত বলে পরিচিত ছিলেন। প্রেতশিলাদি তীর্থে যে সব কীৰ্ত্তি বর্ত্তমান, তা বঙ্গবাসী মাত্রই অবগত আছেন। শ্রীমদন মোহন দত্তের পৌত্র ছিলেন শ্রীরাজবল্লভ দত্ত। তিনি সাধক ও দৈবজ্ঞ পুরুষ ছিলেন। তিনি স্বজনগণের উৎপীড়নে উড়িষ্যা প্রদেশে কটক জেলার অন্তর্গত বিরূপা নদীতটে ছুটি–গোবিন্দপুর গ্রামে বসবাস করতেন।। শ্রীরাজবল্পতদত্তের পুত্র শ্রীআনন্দচন্দ্র দত্ত। তিনিও পরম ধার্মিক প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি বিবাহ করেন নদীয়া জেলায় বীরনগর গ্রামের প্রসিদ্ধ জমিদার শ্রীঈশ্বরচন্দ্র মস্তৌফী মহোদয়ের কন্যা শ্রীমতী জগন্মোহিনীকে। তার গর্ভে শ্রীশ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর মহাশয় বাংলা ১২৪৫ সাল ১৮ই ভাদ্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম লগ্ন দেখে জ্যোতিষী পণ্ডিতগণ বলেছিলেন শিশু ভবিষ্যতে বিদ্যাবুদ্ধিতে উন্নত হবে এবং একজন মহাপুরুষ হবে। পিতৃ প্রদত্ত নাম ছিল শ্রীকেদার নাথ দত্ত।
ঠাকুর মহাশয় এগার বৎসর বয়সে পিতৃহারা হয়ে মাতামহের আলয়ে প্রতিপালিত হন। তার মাতামহের ন্যায় ধনাঢ্য জমিদার নদীয়া জেলায় তখন ছিল না। বীরনগরে তাঁর প্রসিদ্ধ অট্টালিকা দেখবার জন্য অনেক জায়গা থেকে লোক আসত। শ্রীঠাকুর মহাশয়ের বড় দুই ভাই কালক্রমে পরলোক গমন করেন। তখনকার কথা তিনি আত্ম-চরিতে লিখেছেন–“তিনি বড় কষ্টে প্রতিপালিত হন ও বিদ্যাভাসাদি করেন। পাঁচ বৎসর বয়সে মাতামহের আলয়ে থেকে পাঠশালায় বিদ্যাভ্যাস আরম্ভ করেন। তার অসাধারণ মেধা ছিল। নয় বৎসর বয়সে জ্যোতিষ শাস্ত্র অধ্যয়ন করো। অল্পকাল মধ্যে রামায়ণ মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থ বিশদভাবে পাঠ করেন। ঠাকুর মহাশয়ের বার বছর বয়সে বিবাহ হয়েছিল। পত্নীর বয়স মাত্র পাঁচ বছর ছিল।
শৈশবকালে তাকে সকলে ভূতের ভয় দেখাত। তিনি ভূতের ভয়ে বাগিচায় গিয়ে আম জাম খেতে পারতেন না। ভয় কি করে যায় তা একদিন মাতামহের ভাণ্ডার রক্ষয়িত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন। সে বলল ‘রাম’ ‘রাম’ বললে ভুত পালায়। তার কাছ থেকে ভূত তাড়ানো মন্ত্র পেলেন।। সৰ্ব্ব ‘রাম’, ‘রাম’ জপ করতে লাগলেন, আর ভূতের ভয় করেন না। স্বচ্ছন্দে আম জাম খেতে পারেন। অন্যান্য ছেলেদেরও ‘রাম’ ‘রাম’ বলতে বললেন। পাড়ায় যাদের ঘরে রামায়ণ মহাভারত পাঠ হত তথায় যেতেন। রামের কথা তার খুব ভাল লাগত। তিনি পুরোহিত ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করলেন ঠাকুর কথা বলে না কেন? পুরোহিত বললেন কলিকালের ঠাকুর কথা বলে না। কারও কারও কাছে বলেন। তিনি মন্দিরে ঢুকে শিবের মাথায় হাত দিয়ে পালাতেন। কোন কোন দিন কথা বলতেন, মন্দিরে ভিতরে প্রতিধ্বনি শুনে মনে করতেন ঠাকুর কথা বলছে। বৃদ্ধাদের কাছে রাম ও কৃষ্ণ সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাস করতেন। শৈশব হতেই ভগবানের প্রতি তাঁর দৃঢ় অনুরাগ প্রকাশ পায়। জগৎ কি? আমরাই বা কে? এইসব বিষয়ে দশ বছর হতে ঠাকুরের মনে অনুসন্ধিৎসা জাগে। কলিকাতায় মেসোমশায় কবি কাশীপ্রসাদ ঘোষের বাড়ীতে থেকে তিনি কলেজে পড়াশুনা করতে লাগলেন। এই সময় বিশেষ সাহিত্য চর্চা করতেন ও সাময়িক পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের পরম স্নেহাস্পদ ছাত্র ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহোদয়ের বোধোদয় পুস্তকে “ঈশ্বর নিরাকার স্বরূপ” এই উক্তি পাঠ করে ঠাকুর মহাশয় একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করলেন ঈশ্বরকে দেখে তিনি তার স্বরূপ নির্ণয় করেছেন কিনা? বিদ্যাসাগর মহাশয় সরলভাবে ছাত্রের নিকট ঈশ্বর সম্বন্ধে স্বীয় অনভিজ্ঞতার কথা স্বীকার করলেন।
সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরে ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে ঠাকুর মহাশয় পিতামহ রাজবল্লভ দত্তকে দেখবার জন্য উড়িষ্যাভিমুখে যাত্রা করেন। বাষ্পীয় যান তখনও হয় নাই। যেখানে হউক পদব্রজেই যেতে হত। পদব্রজেই তিনি মাতা ও পত্নীকে নিয়ে অতি কষ্টে উড়িষ্যা ছুটী গোবিন্দপুরে পিতামহের কাছে এলেন। তাঁদের দেখে পিতামহ কাঁদতে লাগলেন। পিতামহ খুব বৃদ্ধ হয়েছিলেন। তথাপি রাত্র ১২টার পর স্বহস্তে খিচুড়ী তৈরী করে খেতেন, দিনের বেলায় জপাদি করতেন। তিনি সন্ন্যাসীদের ন্যায় অরুণ বস্ত্র পরতেন।
একদিন তাঁর পিতামহ মহোদয় দ্বিপ্রহর সময়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে নাম জপ করতে লাগলেন। (স্বলিখিত জীবনী পৃঃ ৯৩) এমন সময় ঠাকুর মহাশয় ভোজন করে এলেন। দাদা মহাশয় তখন বলতে লাগলেন— “আমার মৃত্যুর পর তোমরা আর এদেশে থেকো না। ২৭ বছর বয়সে তোমার বড় চাকরী হবে। আমি আশীর্ব্বাদ করছি তুমি এক বড় বৈষ্ণব হবে।” এই কথা বলা মাত্রই তার ব্রহ্মতালু ভেদ করে জীবন নির্গত হল। ঠাকুর মহাশয় যথাশাস্ত্র বিধানে পিতামহের তর্পণ কৃত্যাদি সমাপ্ত করলেন।
ঠাকুর মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের চেষ্টায় ভদ্রকের উচ্চ বিদ্যালয়ের হেড মাষ্টারী পেলেন। বেতন মাত্র ৪৫ টাকা। ভদ্রকে থাকাকালে “মঠস্ অফ উড়িষ্যা” নামে ইংরাজী পুস্তক লিখেন। ইতঃপুর্ব্বে তিনি পুরী, সাক্ষী-গোপাল ও ভুবনেশ্বরাদি বিশেষভাবে দর্শন করে আসেন। ভদ্রকে ১২৬৭ সালের ভাদ্র মাসে তার প্রথম পুত্রের জন্ম হয়। সেই পুত্রের নাম অন্নদাপ্রসাদ। এ বছর তিনি মেদিনীপুরে একটী উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কার্য্য পান ৷ পূর্ব্ব হতেই ঠাকুর মহাশয়ের বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। একদিন ঐ স্কুলের পণ্ডিতের নিকট প্রসঙ্গক্রমে জানতে পারলেন যে—–শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আপামরে কৃষ্ণপ্রেম ভক্তি দান করেছিলেন। সেদিন থেকে তিনি শ্রীচৈতন্যদেবের সম্বন্ধে বিস্তারিত জানবার জন্য বড়ই উদ্গ্রীব হন। তখন যেখানে সেখানে বৈষ্ণব গ্রন্থ পাওয়া যেত না।
মেদিনীপুরে ঠাকুর মহাশয়ের পত্নী কঠিন রোগে মারা গেলেন। তখন নবজাত শিশুর বয়স মাত্র দশ মাস। বৃদ্ধা জননীও সঙ্গে রয়েছেন। সুতরাং দ্বিতীয় বার বিবাহ করা ছাড়া উপায় নাই। যকপুরের গণমান্য রায় মহাশয়ের দৌহিত্রী—শ্রীমতী ভগবতীকে বিবাহ করলেন। পত্নী খুব সুশীলা শান্ত ও যাবতীয় কার্য্যে নিপুণ ছিলেন। ঠাকুর মহাশয় ‘বিজন গ্রাম কাব্য’ সন্ন্যাসী প্রদত্ত our wants নামে কয়েকখানি ছোট গ্রন্থ রচনা করলেন। এ সময় তিনি আইন পরীক্ষা পাশ করলেন। ছাপরী জেলায় ডেপুটী রেজিষ্টার এর পদ পেলেন। কিছুদিন তথায় কাজ করবার পর কয়েকটা পরীক্ষা দিয়ে দিনাজপুরে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট এর পদ পেলেন। ছাপরায় থাকাকালে তিনি গৌতম মুনির আশ্রমটি দর্শন করেন। তিনি যখন যেখানে যেতেন ধর্ম সম্বন্ধীয় সমস্ত ব্যাপার বিশেষ ভাবে অনুসন্ধান করতেন। মাঝে মাঝে কলিকাতা আসতেন এবং “বড়দাদা” দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ীতে থাকতেন। একবার ঠাকুর মহাশয় কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। সে খবর পেয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয় পত্রে এক ঔষধের কথা লিখে পাঠান। সেই ঔষধ তৈরী করে ঠাকুর মহাশয় শীঘ্র সুস্থ হন।
দিনাজপুরে ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট এর কাজ করবার সময় কোন বন্ধুর সৌজন্যে শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত ও শ্রীমদ্ভাগবত তার হস্তগত হয়। এ তার প্রথম শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত পাঠ ও অনুশীলন।
পুর্ব্বে ঠাকুর মহাশয় রাধা কৃষ্ণের লীলাকে হেয় মনে করতেন। কিন্তু যখন দেখলেন শ্রীচৈতন্যদেব সেই লীলা একমাত্র অবলম্বন করেছেন, তখন তিনি শ্রীচৈতন্য চরণে শরণ নিলেন। শ্রীচৈতন্যদেব কৃপা পূর্ব্বক তার হৃদয়ে যথার্থ তত্ত্ব স্ফূর্ত্তি করালেন। সে সময় হতে তাঁর শ্রীরাধাকৃষ্ণে ও শ্রীচৈতন্য বিশেষ ভক্তি উৎপন্ন হল।
শ্রীঠাকুর মহাশয় “চৈতন্য গীতা” নামক এক পুস্তক সচ্চিদানন্দ প্রেমালঙ্কার নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। তিনি আগে ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত করতেন। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত পড়বার পর ব্রাহ্মসমাজকে একেবারেই বাদ দিলেন।
ঠাকুর দিনাজপুরে থাকা কালে শ্রীকান্ত জীউ ও আত্রেয় নদী দর্শন করেন। ১৮৬৮ সালে তিনি পুরী ধামে বদলি হয়ে আসেন, বড় দাঁড়ে মণ্ডলের কোটা ভাড়া নিয়ে থাকলেন। এ সময় প্রত্যহ শ্রীজগন্নাথদেব দর্শন করতেন এবং মহাপ্রভুর লীলাস্থলী দর্শনাদি করতেন। তখন উড়িষ্যার কমিশনার ছিলেন রেভেন্সা সাহেব। তিনি ঠাকুর মহাশয়কে খুব স্নেহ করতেন।
একসময় এক ঘটনা ঘটল। অতিবাড়ী দলের বিষকিষণ নামে একজন লোক ছিল । সে কিছু যোগ বিভূতি জানত। শরদাইপুরের ক্রোশ খানেক দূরে এক জঙ্গলে সে আপন দলবল নিয়ে এক মঠ স্থাপন করে এবং নিজেকে মহাবিষ্ণুর অবতার বলে জাহির করে। সে নিজের লোক দ্বারা কতকগুলি কল্পিত কথা প্রচার করে যে— “মহাবিষ্ণু বিষকিষণ গুপ্তভাবে আছে। ১৪ই চৈত্র রণ হবে। তখন চতুর্ভুজ মূর্ত্তি ধরে সব যবন বধ করবে।” এ সব কথা শুনে অনেক স্ত্রী পুরুষ তাকে দেখতে যেত। ভৃঙ্গারপুরের চৌধুরী রমনীদের সম্বন্ধে কোন কেলেঙ্কারী হওয়ায় চৌধুরীরা ব্যাপারটা কমিশনার রেভেন্সা সাহেবকে জানান। তিনি ঠাকুর মহাশয়কে তদারক করতে পাঠান। ঠাকুর মহাশয় পুলিশের হেড্কে নিয়ে রাত্রিকালে সেই জঙ্গলে গিয়ে বিষকিষণের সঙ্গে আলাপ করেন। বিশকিষণ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে যে ইংরাজ রাজ ধ্বংস করবেই। পেছন থেকে Dist. supdt. সাহেব সব কথা শুনলেন। পরদিন বিষকিষণকে গ্রেপ্তার করে পুরীর জেলে পাঠান হয়, তারপর বিচারে দেড় বছর তার কারাদণ্ড হয়। বিষকিষণের জটা কেটে ফেলা হল। এ সময় তার দলের প্রায় হাজার খানেক লোক পুরীতে উৎপাত করেছিল। এজন্য অনেকে বলেছিলেন তাকে মুক্ত করে দিলে ভাল হয়। কিন্তু ধর্ম পরায়ণ সত্যপ্রিয় ঠাকুর মহাশয় কারও কথায় কান দিলেন না। এ সময় যোগী বিষকিষণ কিছু যোগ বিভূতি প্রকট করেছিলেন। তাতে ঠাকুর মহাশয় ও তার পুত্র কন্যাদির কিছু ক্লেশ হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপ করেন নাই। জেলেই বিষকিষণ মারা যায়। এর পরে দিনাজপুরে একজন নিজেকে ব্রহ্মা বলে পরিচয় দিয়ে উৎপাত করতে থাকলে, ঠাকুর মহাশয় তাকেও অনুরূপ শাস্তি প্রদান করেন।
পুরীতে ঠাকুর মহাশয় শ্রীগোপীনাথ পণ্ডিত, শ্রীহরিদাস মহাপাত্র ও মার্কণ্ডেয় মহাপাত্র প্রভৃতি সজ্জন সঙ্গে শ্রীভাগবত পাঠ এবং শ্রীধর টীকা আলোচনা করবার খুব সুযোগ লাভ করেন। এই সময় তিনি ষট্সন্দর্ভ ও গোবিন্দ ভাষ্য নকল করে তা অধ্যয়ন করেন। ভক্তিরসামৃত সিন্ধু পাঠ করেন। হরিভক্তি কল্পলতিকা নকল করেন এবং দত্তকৌস্তভ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। শ্রীকৃষ্ণ সংহিতার অনেক শ্লোক সেই সময় রচনা করেন। তিনি শ্রীজগন্নাথ বল্লভ উদ্যানে ‘ভাগবত’ সংসদ স্থাপন করেন। সে সভায় অনেক সজ্জন পণ্ডিত আসতেন। সিদ্ধ রঘুনাথ দাস বাবাজী মহাশয় ঠাকুর মহাশয়ের সঙ্গে মিশতেন না। অন্য কাকেও তার সঙ্গে মিশতে নিষেধ করতেন। কিছুদিন বাদ তার মাহাত্ম্য বুঝতে পারলেন। একদিন ঠাকুরের কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন— আপনার তিলক মালা না দেখে আমি আপনাকে অবজ্ঞা করেছি। ক্ষমা করুন।
ঠাকুর বললেন বাবাজী মহাশয়, আমার কি দোষ? তিলক মালা দীক্ষাগুরু দিয়ে থাকেন। মহাপ্রভু এখনও দীক্ষাগুরু জুটিয়ে দেন নাই। কেবল মালা সাহায্যে হরিনাম জপ করি। এ অবস্থায় নিজের মনোমত তিলক মালা নেওয়া কি ভাল? শ্রীরঘুনাথ দাস বাবাজী সব বুঝতে পেরে ঠাকুর মহাশয়কে খুব প্রশংসা করতে লাগলেন।
মহাত্মা শ্রীস্বরূপ দাস বাবাজী একজন বড় বৈষ্ণব ছিলেন, ঠাকুর মহাশয় প্রায় সময় তার দর্শনে যেতেন। তিনি তাকে অনেক উপদেশ দিতেন। ঠাকুর মহাশয় শ্রীজগন্নাথের অড়হর ডাল খুব পছন্দ করতেন। তিনি মন্দিরে প্রবেশ করতেই কে যেন তাকে ডাল এনে দিতেন। স্নানযাত্রা, রথযাত্রা ও দোল যাত্রাদি সময়ে ঠাকুর মহাশয়ের উপর পর্যবেক্ষণের ভার পড়ত। তিনি খুব পরিশ্রম করে যাত্রিদের শ্রীজগন্নাথ দর্শনের সুন্দর ব্যবস্থা করে দিতেন। তিনি পূর্ণ পাঁচ বছর কাল শ্রীজগন্নাথ দেবের এই সেবায় নিযুক্ত ছিলেন।
১৮৭৪ খৃঃ ৬ই ফেব্রুয়ারী মাঘী কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতে শ্রীবিমলা প্রসাদ (শ্রীশ্রীমদ্ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ) ঠাকুরের ৬ষ্ঠ সন্তানরূপে পুরীতে আবির্ভূত হলেন। শ্রীজগন্নাথদেব ঠাকুরের সেবায় সন্তুষ্ট হ’য়ে যেন এই পুত্রটীকে দান করেন। পুত্রটী যেন স্বর্ণ প্রতিমা বলে মনে হচ্ছিল। লগ্ন দেখে জ্যোতিষী পণ্ডিতগণ বলেছিলেন–পুত্র ভবিষ্যতে একজন বড় আচার্য্য হবে, ধর্ম প্রচার করবে। কয়েক মাস পরে ঠাকুর মহাশয় শিশু ও তার মা এবং অন্যান্য ছেলে মেয়েদের পাল্কী যোগে রানাঘাটে পাঠিয়ে দেন। কিছু দিন পরে তিনিও বদলী হয়ে নড়ালে আসেন।
১২৮৬ সাল নড়ালে থাকার সময় ঠাকুর মহাশয় কৃষ্ণ সংহিতা, কল্যান-কল্পতরু গ্রন্থ নতুন ভাবে প্রকাশ করেন। নড়ালে মফস্বলে অনেক বৈষ্ণবের সঙ্গে ঠাকুরের পরিচয় হয়। রাইচরণ গায়ক নামে বৈদ্যবংশ জাত একজনকে ঠাকুর শুদ্ধ বৈষ্ণব বলে মনে করতেন।
ঠাকুর মহাশয় কিছু দিনের জন্য তীর্থ ভ্রমনে বের হয়ে বৃন্দাবন ধামে এলেন এবং বিভিন্ন স্থান দর্শন করলেন। সেই সময় শ্রীরূপ দাস বাবাজীর কুঞ্জে শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজী মহারাজের দর্শন পেলেন। বাবাজী মহারাজ তাকে অনেক উপদেশ দান করলেন। বৃন্দাবন হতে ঠাকুর মহাশয় কাৰ্য্যস্থানে পুনঃ ফিরে এলেন। মিত্র উকিল সারদা চরণ মৈত্র মহাশয় তাঁকে বিশ্বনাথের টীকাসহ শ্রীমদ্ভাগবত খরিদ করে দেন। মাতৃদেবীর পরলোক গমনে ঠাকুর মহাশয় শ্রাদ্ধ করবার জন্য গয়া ধামে যান ও তর্পণ ক্রিয়াদি করেন। প্রেতশিলা পৰ্ব্বতে উঠতে ৩৯৫টা ধাপ তার বৃদ্ধ প্রপিতামহ শ্রীযুত মদন মোহন দত্ত নির্মাণ করেছিলেন। তা দর্শন করলেন এবং পর্ব্বত গাত্রে পিতামহের নাম দেখলেন৷ ১২৮৮ সালে নড়ালে ‘সজ্জনতোষণী’ পত্রিকা প্রকাশ আরম্ভ করেন। ১৮৮৫ সালে রামবাগানের বাটীতে বৈষ্ণব ডিপোজিটারী হয়। এই সালে ঠাকুর মহাশয় শ্রীবিমলা প্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে কুলিন গ্রাম ও সপ্তগ্রাম প্রভৃতি দর্শন করেন। ১৮৮৬ সালে শ্রীরামপুরে থাকার সময় চৈতন্য শিক্ষামৃত রচনা ও প্রকাশ করেন। শ্রীবিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তীর টীকার সহিত স্বয়ং ‘রসিকরঞ্জন’ নামে অনুবাদ লিখে একখানি গীতা প্রকাশ করেন। তাতে শিক্ষাষ্টকের সংস্কৃত টীকাও প্রকাশ করেন। শ্রীকৃষ্ণবিজয় গ্রন্থ খানি এই সময় প্রথমবার ছাপা হয়। বৈষ্ণব গ্রন্থ প্রকাশের জন্য তিনি চৈতন্য যন্ত্র নামে প্রেস স্থাপন করেন।
শ্রীঠাকুর মহাশয় ঠিক করেছিলেন চাকরীর থেকে অবসর নিয়ে বৃন্দাবনে বাস করবেন। এই সময় কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে তারকেশ্বরে যান। সেখানে স্বপ্নে শ্রীতারকেশ্বর বললেন—তোমার গৃহের নিকটবর্ত্তী শ্রীনবদ্বীপ ধামে যে কার্য্য আছে তার কি করলে? স্বপ্ন দেখে তিনি বৃন্দাবনে যাবার ব্যবস্থা স্থগিত করলেন।
ঠাকুর মহাশয় গুরু করণের জন্য অনেক দিন ধরে চিন্তা করছিলেন। স্বপ্নে মহাপ্রভু তাকে জানান- তোমার গুরু বিপিন বিহারী শীঘ্র আগমন করতেন। এমন সময় বিপিন বিহারী গোস্বামীর পত্র পেলেন, তিনি শীঘ্র এসে মন্ত্র দিবেন। শ্রীবিপিন বিহারী গোস্বামী বংশী বদনানন্দ ঠাকুরের বংশধর ছিলেন। গোস্বামী শীঘ্র এলেন এবং মন্ত্র দীক্ষা প্রদান করলেন। ঠাকুর চিত্তে বড়ই প্রফুল্লতা লাভ করলেন।
Srila Bhaktivinoda Thakura’s Appearance




