Disappearance Day of Srila Haridas Thakur

নামাচার্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুর
 
যিনি ছিলেন ব্রহ্মা, তিনিই এবার শ্রীহরিদাস ঠাকুর হয়ে অবতীর্ণ শ্রীহরিদাস ঠাকুরের জন্ম সম্বন্ধে ব্যাসাবতার শ্রীবৃন্দাবনদাস ঠাকুর হলেন।
 
লিখেছেন—
 
“বুঢ়ন গ্রামেতে অবতীর্ণ হরিদাস।
সে-ভাগ্যে সে-সব দেশে কীৰ্ত্তন-প্ৰকাশ।।
কতদিন থাকিয়া আইলা গঙ্গাতীরে।
আসিয়া রহিলা ফুলিয়ায় শান্তিপুৱে।।
পাইয়া তাহান সঙ্গ আচার্য্য গোসাঞি।
হুঙ্কার করেন, আনন্দের অন্ত নাই।।
হরিদাস ঠাকুর অদ্বৈত-দেব সঙ্গে।
ভাসেন গোবিন্দরস-সমুদ্র-তরঙ্গে।।”
 
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ আদি ১৬।১৮)
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুর নিত্যসিদ্ধ ভগবদ্-পার্ষদ। তিনি যশোর জেলায় বুঢ়ন গ্রামে যবন কুলে আবির্ভূত হন। ভগবান্ বা তাঁর পার্ষদগণ যে কুলেই অবতীর্ণ হন, তাঁরা নিত্য পূজ্য। যেমন গরুড় পক্ষীকুলে, হনুমান কপিকুলে তেমনি শ্রীহরিদাস যবন কুলে অবতীর্ণ হয়েছেন। শ্রীহরিদাসের জন্ম থেকে শ্রীকৃষ্ণ নামের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। তিনি কিছু দিন পরে গঙ্গাতীরবর্তী ফুলিয়ায় এসে ভজন করতে লাগলেন। তাঁর সঙ্গ পেয়ে শ্রীঅদ্বৈত আচাৰ্য্য অতিশয় সুখী হলেন। গোবিন্দ-প্রেমরসে দুই জন ভাসতে লাগলেন। ফুলিয়াবাসী ব্রাহ্মণগণ শ্রীহরিদাসের নাম ভজন দেখে বড়ই সুখী হলেন। তার দর্শনের জন্য প্রতি দিন তারা আসতে লাগলেন। ক্রমে ক্রমে শ্রীহরিদাসের মহিমা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এসব দেখে তথাকার শাসক কাজী হিংসানলে জ্বলে উঠল এবং শ্রীহরিদাসকে শায়েস্তা করবার জন্য মুলুকের পতি যবন রাজের কাছে গিয়ে সব কিছু জানাল।।
 
“যবন হৈয়া করে হিন্দুর আচার।।
ভালমতে তা’রে আনি’ করহ বিচার।।
পাপীর বচন শুনি’ সেহ পাপ মতি।
ধরি’ আনাইল তা’নে অতি শীঘ্রগতি।।”
 
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ আদি ১৬৩৭)
 
কাজী বললেন–হরিদাস যবন হয়ে হিন্দুর আচার করছে। অতএব তাকে কঠোর শান্তি দেওয়া দরকার। পাপীর বচনে পাপমতি যবনরাজ তৎক্ষণাৎ শ্রীহরিদাসকে ধরে তথায় আনালেন। যবনরাজ হরিদাসকে বললেন তুমি হরিনাম ত্যাগ করে কলমা উচ্চারণ কর। শ্রীহরিদাস ঠাকুর বললেন—“ঈশ্বর এক, নাম মাত্র ভেদ। হিন্দুর শাস্ত্র পুরাণ ও মুসলমানদের শাস্ত্র কোরাণ। সেই প্রভু যাঁরে যেমন মতি দেন, তিনি তেমনি কর্ম করেন।”
 
“এতেকে আমারে সে ঈশ্বর যেহেন।
লওয়াইছেন চিত্তে, করি আমি তেন।।”
 
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ আঃ ১৬৮২)
 
অতএব সেই পরমেশ্বর আমাকে যেমন করাচ্ছেন, আমি তেমনি করছি। কেহ হিন্দু হয়ে যবন হয়, কেহ আবার যবন হয়ে ঈশ্বর ভজন করে। হে মহারাজ! তুমি এখন বিচার কর। হরিদাস ঠাকুরের এই কথা শুনে কাজী বলতে লাগলেন একে উচিত শাস্তি দেওয়া দরকার। নতুবা সমস্ত যবন জাতি হিন্দু হয়ে যাবে। কাজীর কথা শুনে মুলুকপতি শ্রীহরিদাস ঠাকুরকে বলতে লাগলেন—–ভাই। তুমি নিজ ধর্মকথা বল। তা হলে তোমার চিন্তা নাই। অন্যথা তোমাকে শাস্তি প্রদান করা হবে। তদুত্তরে শ্রীহরিদাস বললেন—
 
“খন্ড খন্ড হই দেহ যায় যদি প্রাণ।
তবু আমি বদনে না ছাড়ি হরিনাম।।”
 
—(শ্রীচৈ: ভাঃ আদি ১৬।৯৪)
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুরের এই দৃঢ়বাক্য শুনে কাজী বলতে লাগলেন— একে বাইশ বাজারে পিটিয়ে পিটিয়ে মারতে হবে। বাইশবাজারে মারলেও যদি না মরে, তবে বুঝব জ্ঞানীরা সত্য কথা বলে। দুষ্ট কাজীর পরামর্শে পাপমতি মুলুকপতি হরিদাস ঠাকুরকে বাইশবাজারে মারতে আদেশ দিলেন। অমনি যবনগণ হরিদাস ঠাকুরকে ধরে নিয়ে বাজারে বাজারে মারতে লাগল।
 
‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ স্মরণ করেন হরিদাস।
নামানন্দে দেহ-দুঃখ না হয় প্রকাশ।।”
 
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ আদি ১৬।১০২)
 
শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজকে বধ করবার জন্য অসুরগণ অনেক চেষ্টা করেও যেমন অকৃতকার্য হয়েছিল ঠিক সেইরূপ যবনগণও হরিদাস ঠাকুরকে মারবার অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারল না। হরিদাস ঠাকুর নামানন্দে ডুবে আছেন। অতপরঃ যবনগণ বুঝতে পারল শ্রীহরিদাস সাধারণ ব্যক্তি নয়। তখন অনুনয় করে বলতে লাগল— হরিদাস! আমরা বুঝতে পেরেছি, তুমি যথার্থ সাধু পুরুষ। তোমাকে কেহ কিছু করতে পারবে না। কিন্তু মুলুকপতি একথা বুঝবে না। সে আমাদের প্রাণ নাশ করবে।
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুর যবনগণের কথা শুনে তখনই ধ্যানস্থ হলেন। তখন যবনগণ হরিদাসকে কাষে নিয়ে মুলুকপতির কাছে এল। মুলুকপতি মনে করলেন হরিদাস মরে গেছেন। তাই তিনি হরিদাসকে গঙ্গায় ফেলে দিতে বললেন। যবনগণ হরিদাসকে গঙ্গায় ফেলে দিল। হরিদাস ঠাকুর ভাসতে ভাসতে পুনঃ ফুলিয়া-ঘাটে এলেন এবং তটে উঠে উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম করতে লাগলেন। শ্রীহরিদাসের মহিমা দেখে মুলুকপতি যবনের মনে ভয় হল। যবনগণের সঙ্গে তিনি তথায় এলেন এবং তার অপরাধের জন্য হরিদাস ঠাকুরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন।
 
‘পীর’ জ্ঞান করি সবে কৈল নমস্কার।
সকল যবনগণ পাইল নিস্তার ।।
 
(শ্রী চৈঃ ভাঃ আ১৬।১৪৭)
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুর যবনগণকে কৃপা করে ফুলিয়া-নগরে এলেন। এবার ভক্তগণের আনন্দের সীমা রইল না।
 
ফুলিয়ায় যে কুটিরে বসে হরিদাস ঠাকুর হরিনাম করতেন, তাঁর ভিটার গর্ভে এক বিষধর সর্প বাস করত। তার বিষের জ্বালায় ভক্তগণ বেশীক্ষণ তথায় বসতে পারতেন না। একদিন ভক্তগণ হরিদাস ঠাকুরকে নাগের কথা বললেন। হরিদাস ঠাকুর ভক্তগণের দুঃখ দেখে নাগকে আহ্বান করে বললেন
 
“সত্য যদি ইহাতে থাকে মহাশয়।
তেঁহো যদি কালি না ছাড়েন এ আলয়।।
তবে আমি কালি ছাড়ি যাইমু সৰ্ব্বথা।”
 
–(শ্রী চৈঃ ভাঃ আঃ)
 
নাগরাজ হরিদাস ঠাকুরের এই আদেশ শুনে তৎক্ষণাৎ গর্ভ থেকে বের হয়ে তাঁকে নমস্কার করে অন্যত্র চলে গেলেন। তৎ দর্শনে ভক্তগণ অত্যন্ত বিস্ময়ান্বিত হলেন। হরিদাস ঠাকুরের এই সমস্ত মহিমা দেখে ভক্ত ব্রাহ্মণগণের তাঁর প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি জন্মিল।
 
যশোহর জেলায় হরিনদী নামে একটি গ্রামে শ্রীহরিদাস ঠাকুর শুভবিজয় করলেন। গ্রামটিতে ব্রাহ্মণের বসবাস বেশী। একদিন এক পান্ডিত্যাভিমানী পাষন্ডী ব্রাহ্মণ সভামধ্যে শ্রীহরিদাস ঠাকুরকে ডেকে বলতে লাগল – ওহে হরিদাস! তুমি হরিনাম উচ্চস্বরে কর কেন? শাস্ত্রে ত মনে মনে করতে বলা হয়েছে। শ্রীহরিদাস ঠাকুর তদুত্তরে বললেন—
 
“পশু-পক্ষী-কীট আদি বলিতে না পারে।
শুনিলেই হরিনাম তারা সব তরে।।
জপিলে শ্রীকৃষ্ণনাম আপনে সে তরে।
উচ্চ-সংকীর্তনে পর-উপকার করে।।
অতএব উচ্চ করি’ কীর্ত্তন করিলে।
শত গুণ ফল হয় সৰ্ব্ব শাস্ত্রে বলে।।”
 
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ আদি ১৬।২৮০)
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুরের এইরূপ বাস্তব সিদ্ধান্ত শ্রবণ করে সেই পাপমতি ব্রাহ্মণ অসহিষ্ণু হয়ে বলতে লাগল—কলিতে শূদ্রগণ বেদ পাঠ করবে, এখন ত’ তাই দেখছি। হরিদাস দর্শন-কর্তা হল। শ্রীহরিদাস ঠাকুর এই সমস্ত কথা শ্রবণ করে নীরবে সভা ত্যাগ করলেন। কয়েকদিন পরে সেই দুষ্ট ব্রাহ্মণটির গলিত কুষ্ঠ হল। বৈষ্ণর অপরাধের ফল হাতে হাতে পেল।
 
“কলিযুগে রাক্ষস-সকল বিপ্র-ঘরে।
জন্মিবেক সুজনের হিংসা করিবারে।।”
 
—(শ্ৰীচৈঃ ভাঃ আদি ১৬।৩০০)
 
 
শ্রীহরিদাস বৈষ্ণব দর্শন ইচ্ছা করে নবদ্বীপে এলেন। তাঁকে দেখে বৈষ্ণবগণ আনন্দে আপ্লুত হলেন। শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য হরিদাসকে প্রাণের সমান ভালবাসতেন। কোন সময় আচার্য্য পিতৃশ্রাদ্ধ-বাসরে সর্বাগ্নে বৈষ্ণৱ শ্রীহরিদাসকে ভোজন করান।
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুর যশোহর জেলার অন্তর্গত বেনাপোল গ্রামে অবস্থান করতেন। তিনি দিবারাত্র তিন লক্ষ হরিনাম গ্রহণ করতেন। সেই জায়গার অধ্যক্ষ ছিল রামচন্দ্র খাঁন। রামচন্দ্র খাঁন বড় পাষন্ড প্রকৃতির লোক ছিল। শ্রীহরিদাস ঠাকুরের প্রতিষ্ঠার কথা শুনে মাৎসর্যে তার চিত্ত জ্বলতে লাগল। কি করে হরিদাসের মহিমা হ্রাস করা যায় চিন্তা করতে লাগল। খানের অনেকগুলি বেশ্যা ছিল। খাঁন চিন্তা করল কোন বেশ্যাকে হরিদাসের কাছে পাঠিয়ে তাঁর পতন ঘটাতে হবে। পরমা সুন্দরী এক বেশ্যাকে নিযুক্ত কর হল। একরাত্রে বেশ্যাটি শ্রীহরিদাস ঠাকুরের কুটিরে এল এবং তুলসী ও হরিদাসকে নমস্কার করে সামনে বসে বলতে লাগল
 
“ঠাকুর, তুমি—পরমসুন্দর, প্রথম যৌবন।
তোমা দেখি’ কোন নারী ধরিতে পারে মন।।
তোমার সঙ্গম লাগি’ লুব্ধ মোর মন।
তোমা না পাইলে প্রাণ না যায় ধারণ।।”
 
—(শ্ৰীচৈঃ চঃ অন্ত্যঃ৩।১১২-১১৩)
 
ঠাকুর ! তোমার সুন্দর যৌবন দেখে কোন্ নারী ধৈর্য্য ধারণ করতে পারে? তোমার সঙ্গ কামনা করে আমি এসেছি। একবার সঙ্গ দাও; নতুবা আমি প্রাণ ধারণ করতে পারব না।
 
হরিদাস কহে, -“তোমা করিমু অঙ্গীকার।
সংখ্যা-নাম-সমাপ্তি যাবৎ না হয় আমার।।
তাবৎ তুমি বসি’ শুন নাম-সংকীৰ্ত্তন।
নাম সমাপ্তি হৈলে করিমু যে তোমার মন।।
 
—(শ্রীচৈঃ চঃ অন্ত্যঃ৩।১১৪-১১৫)
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুর সর্বজ্ঞ ছিলেন। সব কিছুই জানতে পারলেন। তিনি মহাভাগবত। ইহা যে কৃষ্ণের পরীক্ষা তা বুঝতে তাঁর বাকী রইল না। তিনি বেশ্যাকে সুমধুর বাক্যে বললেন—তোমার বাসনা আমি পূর্ণ করব। আমার সংখ্যা নাম পূর্ণ হতে দাও। ততক্ষণ তুমি বসে নাম সংকীর্ত্তন শ্রবণ কর। শ্রীহরিদাস ঠাকুর বেশ্যাকে পাপী জ্ঞানে অনাদর করলেন না। কৃষ্ণের প্রেরণায় সে এসেছে, এই জ্ঞানে তিনি তাকে সমাদর করলেন। ভক্তগণ কখনও কোন জীবকে অনাদর করেন না।
 
“কৃষ্ণ-অধিষ্ঠান সর্বজীবে জানি’ সদা।
করবি সম্মান সবে আদরে সর্ব্বদা।।”
 
(গীতাবলী)
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুরের কথা অনুযায়ী বেশ্যা বসে বসে নাম কীর্তন শুনতে লাগল। কীর্তনে রাত শেষ হল। ভোর হয়েছে দেখে বেশ্যা ঘরে চলে এল। রামচন্দ্র খানকে সব কথা বলল।
 
পরদিন রাত্রে বেশ্যা শ্রীহরিদাসের কুটিরে এসে তাঁকে নমস্কার করে বসল, তখন হরিদাস ঠাকুর বলতে লাগলেন—
 
“কালি দুঃখ পাইলা, অপরাধ না লইবা মোর।
অবশ্য করিমু আমি তোমায় অঙ্গীকার।।
তাবৎ ইহা বসি, শুন নাম-সংকীৰ্ত্তন।
নাম পূর্ণ হৈলে, পূর্ণ হবে তোমার মন।।”
 
(শ্রীচৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৩।১২০-১২১)
 
কাল তুমি দুঃখ পেয়েছ। তজ্জন্য আমার কোন অপরাধ নিও না। আমি তোমার সঙ্গ অবশ্যই করব। যে পর্যন্ত আমার নাম সংখ্যা পূর্ণ না হয়, সে পর্যন্ত বসে বসে নাম-সংকীৰ্ত্তন শুন। বেশ্যা নাম-কীৰ্ত্তন শুনতে শুনতে হৃদয়ে এক পরম আনন্দ অনুভব করতে লাগল। রাত্র শেষ হল। কিন্তু ঠাকুরের নাম শেষ হল না। ঠাকুর বললেন—আমি মাসে কোটি নাম গ্রহণ করবার ব্রত নিয়েছি। ব্রত শেষ হয়ে এল ভেবেছিলাম কিন্তু সমস্ত রাত্রি জপেও পূর্ণ করতে পারলাম না; মনে হয় কাল সমাপ্ত হবে। তখন তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। বেশ্যা গৃহে ফিরে এল। পুনঃসন্ধ্যাকালে সে হরিদাস ঠাকুরের কুটিরে এসে বসল এবং নামকীৰ্ত্তন শুনতে লাগল।
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুরের শ্রীমুখে হরিনাম শুনতে শুনতে বেশ্যার মন শুদ্ধ হল। সেও মাঝে মাঝে ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ বলতে লাগল। বেশ্যা মনে মনে চিন্তা করতে লাগল—আমি কি মহাপাপ করবার জন্য এখানে এসেছি। এই মহাভাগবত সাধুর চরণে আমি মহা অপরাধ করতে বসেছি। এই অপরাধ ফলে কত কাল যে আমাকে ঘোরতর নরকে বাস করতে হবে জানি না। রাত্রি প্রায় তৃতীয় প্রহর। বেশ্যা অতি নির্বেদযুক্ত হয়ে সজল নয়নে শ্রীহরিদাস ঠাকুরের চরণে দন্ডবৎ হয়ে পড়ল এবং বহু অনুনয় বিনয় করতে লাগল। শ্রীহরিদাস ঠাকুর বলতে লাগলেন—তুমি গাত্রোত্থান কর। শ্রীহরি তোমাকে কৃপা করবেন। বেশ্যা গাত্রোত্থান করে সজল নয়নে রামচন্দ্র খাঁনের কথা বলল।
 
“ঠাকুর কহে—খাঁনের কথা সব আমি জানি।
অজ্ঞ মূর্খ সেই, তা’রে দুঃখ নাহি মানি।”
 
—(শ্ৰীচৈঃ চঃ অ৩।১৩৩)
 
আমি রামচন্দ্র খানের কথা সব জানি; আমি সেই দিন চলে যেতাম। কেবল তোমার জন্য তিন দিন রইলাম। শ্রীহরিদাসের করুণাময় উক্তি শ্রবণে বেশ্যার দুনয়ন দিয়ে অশ্রুধারা বইতে লাগল। শ্রীহরিদাস ঠাকুর তারপর বললেন— ঘরের সমস্ত দ্রব্য ব্রাহ্মণকে দান করে এই কুটিরে এসে বাস কর। নিরন্তর হরিনাম কর ও তুলসী সেবা কর। তুমি অচিরাৎ শ্রীকৃষ্ণের চরণ পাবে।
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুরের কথামত বেশ্যা নিজগৃহে জিনিস পত্র সব ব্রাহ্মণকে দান করল। মাথা মুন্ডন করে এক বস্ত্রে সেই কুটিরে বসে হরিনাম এবং তুলসী সেবা করতে লাগল।
 
“তুলসী সেবন করে, চণি, উপবাস।
ইন্দ্রিয়-দমন হৈল, প্রেমের প্রকাশ।।”
 
(শ্ৰীচৈঃ চঃ অন্ত্যঃ৩।১৪১)
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুর বেশ্যাকে কৃপা করে অন্যত্র চলে গেলেন। বেশ্যার পরম শুদ্ধ চরিত্র দেখে সকলে চমৎকৃত হলেন এবং শ্রীহরিদাস ঠাকুরের মহিমা গান করতে লাগলেন।
 
“প্রসিদ্ধা বৈষ্ণবী হৈল পরম-মহান্তী।
বড় বড় বৈষ্ণব তাঁ’র দর্শনেতে যান্তি।।”
—(শ্ৰীচৈঃ চঃ অন্ত্যঃ ৩।১৪২)
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুর যেন পরশমণির ন্যায় মহাপাপী-তাপীকে সদ্যই উদ্ধার করে পরম বৈষ্ণব করেন।
 
শ্রীহরিদাস ঠাকুর এক সময় সপ্তগ্রাম চাঁদপুরে এসে হিরণ্য গোবর্দ্ধন মজুমদারদের পুরোহিত শ্রীবলরাম আচার্য্যের নিকট রইলেন। মজুমদারদের পুত্র শ্রীরঘুনাথ দাস এই সময় শ্রীবলরাম আচার্য্যের গৃহে রোজ অধ্যয়ন করবার জন্য আসতেন এবং শ্রীহরিদাস ঠাকুরের দর্শন পেতেন ও তাঁর মুখে হরিকথা শুনতেন। শ্রীহরিদাস ঠাকুর মাঝে মাঝে মজুমদারদের আমন্ত্রণে তাঁদের সভাগৃহে আসতেন এবং হরিকথা বলতেন। কোন সময় মজুমদারের জমিদারী সেরেস্তার পত্র ও রাজকর-বাহক পেয়াদা গোপাল চক্রবর্তী শ্রীহরিদাস ঠাকুরের সঙ্গে মুক্তি সম্বন্ধে তর্ক আরম্ভ করে। শ্রীহরিদাস ঠাকুর বললেন, নামাভাসেই মুক্তি হয়। পূর্ণ নামোদয়ে শ্রীকৃষ্ণ-প্রেমভক্তি লাভ হয়। এ কথা শুনে গোপাল চক্রবর্ত্তী ক্রুদ্ধ হয়ে বলল—কোটি জন্মে তপস্যা করেও যোগী যে মুক্তি পায় না, নামাভাসেই সেই মুক্তি হয়। এ সমস্ত ভাবুকের সিদ্ধান্ত। পাপমতি গোপাল শ্রীহরিদাস ঠাকুরকে উপহাস করতে লাগল। শ্রীহরিদাস ঠাকুর সভা ত্যাগ করে চলে গেলেন। মজুমদার মহাশয় গোপাল চক্রবর্তীকে ধিক্কার দিয়ে সভা থেকে বের করে দিলেন। তাকে তাঁদের গৃহে আসতে নিষেধ – করলেন মহৎ চরণে অপরাধের ফলে গোপাল চক্রবর্তীর সর্ব্বাঙ্গে গলিত কুণ্ঠ হল মহৎ চরণে অপরাধের ফল হাতে হাতে পেল।
 
শ্রীহরিদাস কখনও নবদ্বীপে কখনও শান্তিপুরে ভক্তগণের নিকট যাতায়াত করতেন। ভক্তগণ হরিদাসকে পেলে পরম আনন্দ লাভ করতেন। যেদিন শ্রীগৌরসুন্দর ফাল্গুন পূর্ণিমার চন্দ্র গ্রহণ সন্ধ্যাকালে মিশ্রগৃহে অবতীর্ণ হলেন, সেইদিন তিনি শ্রীঅদ্বৈত আচার্য্য প্রভুর সঙ্গে কৃষ্ণ কথারসে অবস্থান করছিলেন। অকস্মাৎ শ্রীহরিধ্বনিতে চতুর্দিক মুখরিত দেখে অনুমানে বুঝতে পারলেন, শ্রীভগবান অবতীর্ণ হয়েছেন।
 
“সেই কালে নিজালয়,
উঠিয়া অদ্বৈত রায়,
নৃত্য করে আনন্দিত-মনে।
হরিদাসে লঞা সঙ্গে,
হুঙ্কার-কীৰ্ত্তন-রঙ্গে,
কেনে নাচে কেহ নাহি জানে।।”
“জগৎ আনন্দময়,
দেখি’ মনে সবিস্ময়,
ঠারেঠোরে কহে হরিদাস।
তোমার ঐছন রঙ্গ,
মোর মন পরসন্ন,
দেখি—কিছু কাৰ্যে আছে ভাস।।”
 
 
—(শ্ৰীচৈঃ চঃ আদি ১৩।৯৯-১০১)
 
ভক্তের কাছে ভগবান্ কোন লীলা গোপন করতে পারেন না। অদ্বৈত আচার্য্য ও হরিদাস ঠাকুর সব কিছু বুঝতে পারলেন। শ্রীহরিদাস ঠাকুর মাঝে মাঝে নবদ্বীপ নগরে ভক্তগৃহে অবস্থান পূর্ব্বক শ্রীগৌরসুন্দরের বাল্যলীলা, পৌগন্ড-লীলা কৈশোরলীলাদি দর্শন করতেন। অতঃপর যখন মহাপ্রভু যৌবন-লীলায় হরি-সংকীর্ত্তন আরম্ভ করলেন, তখন হরিদাস ঠাকুর নিয়তই নবদ্বীপ মায়াপুরে অবস্থানপূর্ব্বক প্রেমরস আস্বাদন করতে লাগলেন। একদিন মহাপ্রভু শ্রীবাস অঙ্গনে মহাপ্রকাশ-লীলা করে শ্রীহরিদাস ঠাকুরকে আহ্বান করলেন এবং তার পূর্ব্ব চরিত সকল বলতে লাগলেন। হরিদাস ! যবনগণ যখন তোমাকে নগরে নগরে প্রহার করতে আরম্ভ করেছিল, তখনই আমি তাদের সুদর্শন অস্ত্রে ধ্বংস করতাম। কিন্তু তুমি তাদের মঙ্গল কামনা করেছিলে, তাই কিছুই করতে পারিনি।
 
“তুমি ভাল চিন্তিলে না করো মুঞি বল।
মোর চক্র তোমা লাগি’ হইল বিফল।”
 
—(শ্ৰীচৈঃ ভাঃ মধ্যঃ ১০(৪২)
 
ভগবান্ শ্রীগৌরসুন্দর এই সমস্ত কথা বলে’ বললেন—
 
তোহার মারণ নিজ অঙ্গে করি লঙ।
এই তার চিহ্ন আছে’ নাহি মিছা কঙ।।”
 
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ মঃ ১০৪৪ )
 
 
 
আমি মিথ্যা বলছিনা। এই দেখ, এখনও তার চিহ্ন আছে। এই বলে মহাপ্রভু নিজ পৃষ্ঠে মারণের চিহ্ন দেখালেন। হরিদাস ঠাকুর মহাপ্রভুর এই করুণ লীলা দেখে তখনই প্রেমে মুর্ভূিত হয়ে পড়লেন। তারপর স্তুতি করে বলতে লাগলেন।
 
“বাপ বিশ্বস্তর, প্রভু, জগতের নাথ।
পাতকীরে কর কুপা, পড়িল তোমাত।।
নির্গুণ অধম সর্বজাতি বহিষ্কৃত।
মুক্তি কি বলিব প্রভু তোমার চরিত।।”
 
—(শ্রীচৈঃ ভাঃ মঃ ১০।৫৮-৫৯)
 
মহাপ্রভুর যাবতীয় নদীয়া লীলাতে শ্রীহরিদাস প্রায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন।তারপর যখন মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ লীলা করে পুরীধামে যান, তখন শ্রীহরিদাস প্রভুর সঙ্গে তথায় যান এবং স্থায়ী ভাবে বাস করেন। মহাপ্রভু প্রতিদিন শ্রীগন্নাথ দেবের মঙ্গলরাত্রিক দর্শন করবার পর শ্রীহরিদাস সন্নিধানে আসতেন এবং তাকে জগন্নাথের শীতল ভোগ প্রসাদ প্রদান করতেন। শ্রীহরিদাস ঠাকুরকে মহাপ্রভু নামাচাৰ্য্য আখ্যা দেন। বৃন্দাবনধাম হতে শ্রীরূপ- সনাতন পুরীধামে এলে তাঁরা শ্রীহরিদাসের সঙ্গে থাকতেন। শ্রীহরিদাস দূর হতে শ্রীজগন্নাথ দেবের মন্দিরের চূড়া দর্শন করে প্রণাম করতেন। মর্য্যাদা রক্ষা করে শ্রীমন্দির সন্নিধানে যেতেন না। মহামায়া-দেবী শ্রীহরিদাসের কাছ থেকে হরিনাম মন্ত্র গ্রহণ করেছিলেন। শ্রীহরিদাস ঠাকুর অতি বৃদ্ধ হলেও তিন লক্ষ হরিনাম নিয়মিত প্রতিদিন করতেন।
 
অতঃপর শ্রীহরিদাস ঠাকুরের অন্তিম সময় এসেছে জানতে পেরে শ্রীগৌরসুন্দর সপার্ষদ তাঁর সন্নিধানে উপস্থিত হলেন এবং ভক্তগণ সঙ্গে মহাসংকীর্ত্তন নৃত্য করতে লাগলেন। শ্রীহরিদাস ঠাকুর ভক্তগণকে বন্দনা করে মহাপ্রভুকে সামনে বসালেন।
 
“হরিদাস নিজাগ্নেতে প্রভুরে বসাইলা।
নিজ-নেত্র—দুই ভৃঙ্গ-মুখপদ্মে দিলা।।
 
‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ শব্দ বলেন বার বার।
প্রভুমুখ-মাধুরী পিয়ে, নেত্রে জলধার।।
‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ শব্দ করিতে উচ্চারণ।
নামের সহিত প্রাণ কৈল উৎক্ৰমণ।।
—(শ্রীচৈঃ চঃ অন্ত্য একাদশ ৫৩, ৫৫-৫৬)
 
শ্রীহরিদাস মহাপ্রভুর নাম নিতে নিতে অন্তর্ধান হলেন। মহাযোগেশ্বর প্রতিম শ্রীহরিদাসের অপ্রকটলীলা দেখে ভক্তগণ ‘হরি কৃষ্ণ’ শব্দ উচ্চারণ করে প্রেমানন্দে মহানৃত্যগীত করতে লাগলেন। তারপর মহাপ্রভু শ্রীহরিদাস ঠাকুরের অপ্রাকৃত দেহ কোলে নিয়ে প্রেমে ক্রন্দন করতে লাগলেন এবং ভক্তগণের কাছে তাঁর মহিমা বর্ণন করতে লাগলেন। অতঃপর সমুদ্রতটে নিয়ে মহাপ্রভু স্বহস্তে তাঁর সমাধি দিলেন। অবশেষে শ্রীজগন্নাথদেবের মন্দিরে এসে প্রসাদ ভিক্ষা করে তাঁর নির্মাণ-মহোৎসব সম্পাদন করলেন। ভগবান্ স্বয়ং এইরূপে ভক্তের মর্যাদা জগতে স্থাপন করলেন।
 
হরিদাস আছিল পৃথিবীর ‘শিরোমণি’।
তাহা বিনা রত্ন-শূন্যা হইল মেদিনী।।
‘জয় জয় হরিদাস’ বলি’ কর হরিধ্বনি ।
এত বলি’ মহাপ্রভু নাচেন আপনি।।
সবে গায়, —“জয় জয় জয় হরিদাস।
নামের মহিমা যেঁহ করিলা প্রকাশ।।”
তবে মহাপ্রভু সব ভক্তে বিদায় দিলা।
হর্ষ-বিষাদে প্রভু বিশ্রাম করিলা।।
এই ত কহিলুঁ,হরিদাসের বিজয়।
যাহার শ্রবণে কৃষ্ণে দৃঢ়ভক্তি হয়।।
 
-(শ্রীচৈঃ চঃ অন্ত্যলীলা একাদশ পরিচ্ছেদ ৯৭-১০১)
 
 
 
 
 

Date

Sep 09 2022
Expired!

Time

All Day